আরশি পর্ব ৩০+৩১

#আরশি
#Part_30
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— বাবাই!!

অহনার উৎফুল্ল কন্ঠস্বর শুনে সাদের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে। সে অহনাকে নিজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। অহনার তুলতুলে গাল দুই-তিনটে চুমু খেয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলে,

— আমার এঞ্জেলটা ভালো আছে তো?

অহনা সাদের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

— এতক্ষণ ছিলাম না কিন্তু এখন একদম ফাস্ট ক্লাস আছি৷

— উমম! তাই নাকি?

অহনা জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে বলে,

— হ্যাঁ!

সাদ অহনাকে কোলে নিয়েই বাসার ভিতরে ঢুকে। আর আমি দরজা দিয়ে ওদের পিছন পিছন আসি। সাদ ড্রয়িংরুমে এসে অহনাকে নামিয়ে সোফায় বসে। তারপর অহনাকে নিজের কোলে বসিয়ে আদুরে সুরে বলে,

— ফাংশন কখন তোমার?

— ১১ টায়!

সাদ বা হাত দিয়ে নিজের চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে,

— তাহলে তো সময় আছে।

সাদের কথ শুনে অহনা গাল ফুলিয়ে বলে,

— না নেই৷ তুমি বলেছিলে ৯ টায় আসবে। আর এখন সাড়ে নয়টা বাজে।

সাদ অপরাধী সুরে বলে,

— সরি! আসলে হয়েছিল কি…

অহনা সাদকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

— থাক বলতে হবে না। তুমি এসেছ এইটাই অনেক।

সাদ অহনার গালে চুমু খেয়ে বলে,

— দ্যাট’স মাই গার্ল!

কথাটা বলেই সাদ নিজের বুক পকেট থেকে একটা ক্যাডবেরি ডেরিমিল্ক চকলেট বের করে অহনার দিকে এগিয়ে দেয়। চকলেট দেখে অহনার খুশি দেখেই বা কে? সে ফট চকলেটটা নিয়ে সাদের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

— থ্যাংক ইউ!!

সাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি তাদের কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে বলি,

— অহনা দেখেছ কয়টা বাজে? যাও তারাতাড়ি রেডি হতে যাও৷ আমাদের আবার বের হতে হবে তো। তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও আমি আসছি৷

— আচ্ছা আম্মি!

এই বলে অহনা দৌড়ে রুমে চলে গেল। আমি সাদের দিকে তাকিয়ে বলি,

— মিটিং কেমন হলো?

সাদ হালকা হেসে বলে,

— হ্যাঁ ভালো।

— যাও ফ্রেশ হতে আসো৷ এতটা পথ জার্নি করে এসেছ। তাই চেঞ্জও করে নাও।

সাদ ভ্রু কুঁচকে বলে,

— কিন্তু…

আমি সাদকে কথা বলতে না দিয়ে বলি,

— মামার বিছানায় কাপড় রাখা আছে।

সাদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,

— আচ্ছা। কিন্তু মামা কোথায়?

— সে তাগাদার জন্য ঢাকার বাইরে গিয়েছে। এক সপ্তাহ পর ফিরবে।

— অহহ আচ্ছা। বাই দ্যা ওয়ে তোমার বেকারির কাজ কেমন চলছে? আজ কাজ আছে নাকি?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আর আজ একটা কেকের অর্ডার আছে। অবশ্য কাজ প্রায় শেষ। জাস্ট লাস্ট ফিনিসিং দিয়ে সোহেলকে দিয়ে বেকারিতে পাঠিয়ে দিব।

— ভাই আমরাও তোমার গৃহবন্দী গ্রাহক। আমাদের কথাও একটু ভাব। মাঝে মধ্যে ফ্রি ফ্রি একটু কেক বানিয়ে খাওয়াতেও তো পারো নাকি?

আমি আড়চোখে সাদের দিকে তাকিয়ে বলি,

— ভেবেছিলাম আজ সন্ধ্যায় রেড ভেলভেট কেক বানাবো। বাট প্ল্যান ক্যান্সাল।

সাদ বিদঘুটে এক চেহেরা বানিয়ে বলে,

— এএএএএএএ!!

সাদের এমন রিয়েকশন দেখে আমি ফিক করে হেসে দেই। অতঃপর বলি,

— যাও তো আগে ফ্রেশ হয়ে এসো। নাস্তা দিচ্ছি টেবিলে আমি। খেয়ে নিও। আমাকে আবার অহনাকে সাজাতে হবে।

সাদ মুখ ফুলিয়ে বলে,

— তোমার নাম মিস দর্পণ না রেখে বরং মিস কিপ্টুস রাখার দরকার ছিল৷ হুহ!

বলেই সাদ মামার রুমের দিকে এগিয়ে গেল। আর আমি হালকা হেসে নিজের কাজে মনোযোগ দেই।

______________________

অডিটোরিয়াম ভর্তি শত শত মানুষ। চারদিক কোলাহলে পরিপূর্ণ। কিছু ভলেন্টিয়াররা এইদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে, তো কিছু ভলেন্টিয়াররা সকলকে বসার জায়গায় দেখিয়ে দিচ্ছে ও বসিয়ে দিচ্ছে। নিচের প্রথম সারিটি জার্জদের জন্য ও এর পরের সারিটি ভি আই পি পার্সনদের জন্য। এরপর থেকে যত সারি আছে সবই দর্শকদের জন্য। অডিটোরিয়ামের বিশাল বড় স্টেজটি খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। মাঝখানে টানানো ব্যানারটির মধ্যে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা “ইন্টার ফেস্ট ডান্স কম্পিটিশন”। তার চারপাশে আবার আর্টিফিশিয়াল ফুল লাগানো। স্টেজের পিছে সকল প্রতিযোগিতারা সিরিয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একজন যুবতী মেয়ে সকলের উপস্থিতি নিচ্ছে। সাথে এইটাও দেখছে কেউ বাদ পড়েছে কিনা। আমি অহনার উপস্থিতি নিশ্চিত করে ওকে ভালো মত সব বুঝিয়ে দেই আর নার্ভাস হতে মানা করি৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই গার্ডিয়ানদের স্টেজের পিছন থেকে সরে আসতে বললে আমি অহনাকে “বেস্ট অফ লাক” জানিয়ে ওর কপালে এক চুমু এঁকে দিয়ে চলে আসি।

বাইরে এসে দেখি সাদ সপ্তম সারিতে বসে আছে। তার পাশের সিট ফাঁকা। হয়তো আমার জন্যই জায়গায় রেখে গিয়েছে। আমি চুপচাপ গিয়ে ওর পাশে বসি। মনটা বেশ খচখচ করছে। কেমন এক ভয় কাজ করছে। নার্ভাস লাগছে খুব। এমন নয় যে অহনা এই প্রথম বারের মত এত মানুষের সামনে স্টেজে ডান্স করছে, এর আগেও সে অনেকবার স্টেজে পারফর্ম করেছে। কিন্তু তাও মায়ের মন তো। সাদ আমার মনে ভাব বুঝতে পেরে হালকা হেসে বলে,

— অহনাও এতটা ডেস্পারেট হয় না যতটা না তুমি হও।

আমি সাদের কথা শুনে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলি,

— ও তুমি বুঝবে না। মায়ের মন এমনই হয়।

— তাহলে বলতে এইদিক দিয়ে আমার ভাগ্য ভালো যে, বাবার মন মায়ের মত হয় না।

কথাটা বলে সাদ হাসে। সেই সাথে তার চামড়ার ভাঁজে ফুটে উঠে এক গভীর গর্ত। আমি চাপা স্বরে বলি,

— সাদ!

সাদ সোজা হয়ে বসে বলে,

— টেনশন করো না। সব ঠিকই হবে।

— তাই যেন হয়। অহনার এই ডান্স নিয়ে অনেক স্বপ্ন। ওর ডান্সের প্রতি এত উৎসাহ দেখেই ওকে এতোটা পথ উৎসাহ দিয়ে এসেছি। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ওকে নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু এখন এই পর্যায়ে যদি এসে ও পিছিয়ে পরে তাহলে ও অনেক কষ্ট পাবে। আর আমি ওর সেই কষ্টটাই সহ্য করতে পারবো না।

— অহনা এতটাও দূর্বল না যে অল্প কিছুতে কষ্ট পাবে। ও অনেক বুঝদার। আর এইভাবেও অহনা তার মায়ের মতই হয়েছে। ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। সো ডোন্ট ওয়ারি।

— হুম!

মুখে ‘হুম’ বললেও আমি বেশ ভয় পাচ্ছিলাম।তাই মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকি। এরই মিনিট দশকের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। একেক করে সকল ধরনের ফরমালিটিস শেষ করে প্রতিযোগিতাটি শুরু হয়। অতঃপর একেকজনের নাম ধরে ডাকতেই সে স্টেজে এসে তার নৃত্য প্রদর্শন করে যায়। সকলের নাচই ছিল মনোমুগ্ধকর। আমি তাদের নাচ বেশ মনোযোগ দিয়েই দেখছিলাম। অবশেষে অহনার নাম উচ্চারিত হতেই আমার বুক ধক করে উঠে। আমার ভিতরে থাকা অস্থির ভাবটা তীব্র হয়ে আসে। আমি উৎসুক চোখে সামনে তাকিয়ে থাকি। ধীরে ধীরে অহনা স্টেজে আসে। আমার দৃষ্টি স্থির হয় ওইদিকে। হঠাৎ চারদিকে “ফাগুন হাওয়ায়” গানটা বাজতে শুরু করে আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে অহনার নাচ শুরু হয়। দেখতেই দেখতে অহনার পারফর্মেন্স শেষ হয় আর চারদিকে করতালি বেজে উঠে। আমিও একটু স্বস্তিবোধ করি। কেন না অহনা বেশ ভালোই নেচেছে।
অহনা নাচ শেষ করেই স্টেজের পিছনে যেতেই আমি সেদিকে চলে যাই। অহনা আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে। আমিও ওকে আগলে নেই আর ওর নাচের প্রশংসা করি। সাথে এইটাও বুঝাই প্রাইজ পাওয়া বড় কথা না,অংশগ্রহণ করা বড় কথা। অহনাও আমার কথা মেনে নেয়। কিন্তু তাও মনের মাঝে একটা আশা যে থেকেই যায়। আমি আর কিছু না বলে অহনাকে সব বুঝিয়ে- সুঝিয়ে আমি আবার আমার সিটে ফিরে আসি। আর রেজাল্টের প্রতিক্ষা করতে থাকি। অবশেষে ঘন্টা দুই-এক পরে রেজাল্ট এনাউন্সড হয়। সেখানে জানা যায় অহনা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এ নিয়ে সে যে কি পরিমানে খুশি। সাথে আমিও। প্রাইজ পাওয়ার ছবি তুলা শেষে সে আমার কাছে দৌড়ে আসে আর আমায় জড়িয়ে ধরে। আমি ওর মাথায় চুমু একে দিয়ে ওকে উৎসাহ দেয়। এরপর ও আমাকে ছেড়ে সাদকেও জড়িয়ে ধরে। আমাদের সকলের ঠোঁটের কোনেই এক প্রশান্তির হাসি।

___________________

আমি রেড ভেলভেট কেকটা ফ্রিজ থেকে বের করে ডেকরেশন করতে থাকি। ডেকরেশন শেষে আমি তা ড্রয়িং রুমে নিয়ে যাই। ড্রয়িং রুমে সাদ আর অহনা দুষ্টুমি করছে। আমার হাতে কেক দেখেই দুইজনেই উৎফুল্ল সুরে চেঁচিয়ে উঠে। আমি তা দেখে মুচকি হাসি। কেক সেন্টার টেবিলের উপর রাখতেই ওরা আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমি অহনার হাতে একটা প্লাস্টিকের ছুরি ধরিয়ে দিয়ে বলি কেকটা কাটতে। অহনা নিজের হাতে ছুরিটা নিয়ে আমাদেরও টেনে নিয়ে আসে। সে নাকি একা একা কেক কাটবে না। আমাদের সাথে মিলে কেক কাটবে। তাই বাধ্য হয়ে আমি আর সাদও ওর দুইপাশে হাটু গেড়ে বসি আর তিনজনে মিলে কেকটা কাটি। কেক খাওয়া শেষে অহনা সাদকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— বাবাই আমার কিন্তু তোমার থেকে কিছু চাই।

সাদ হাসি মুখেই বলে,

— কি চাই আমার এঞ্জেলটার?

— আগে বলো আমি যা চাই তা দিবে।

সাদ অহনাকে কোলে নিয়ে বলে,

— এমন কখনো হয়েছে কি যে, আমার এঞ্জেলটা আমার কাছ থেকে কিছু চেয়েছে আর আমি তাকে তা দেয়নি?

অহনা দুইপাশে মাথা দুলিয়ে না সূচক উত্তর দেয়। সাদ মিষ্টি হেসে বলে,

— বলো তোমার কি চাই।

— আমি চাই তুমি আমাকে ফুটবল খেলা শিখাও।

— ফুটবল?

— হুম।

— তা হঠাৎ ফুটবল খেলার ইচ্ছা জাগলো কেন?

— আমার স্কুলে না ইরফান নামে এক ছেলে আছে। সে বলেছে মেয়েরা নাকি ফুটবল খেলতে পারে না। তো আমিও তাকে বলেছি আমি তার সাথে ফুটবল খেলব আর ওকে হারিয়ে দেখাব।

অহনার কথা শুনে সাদ ফিক করে হেসে দেয়। অতঃপর গম্ভীর হয়ে বলার চেষ্টা করে বলে,

— এইটা তো দেখছি গুরুতর ব্যাপার। এখন তো তোমাকে ফুটবল খেলা শিখাতেই হবে আর ইরফানকে হারাতেই হবে।

— হু!

— আচ্ছা সামনের শুক্রবার তোমায় পার্কে নিয়ে যাব নে। সেখানে গিয়ে আমরা প্রেক্টিস করবো নে।

অহনা কথাটা শুনে সাদের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

— আই লাভ ইউ বাবাই।

সাদও অহনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

— আই অলসো লাভ মাই লিটেল এঞ্জেল।

আমি দুইজনের এমন ভালবাসা দেখে মুচকি হাসি। অতঃপর অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলি,

— অনেক কথা হয়েছে মামণি এইবার যাও তোমার পড়া শেষ করে নাও। ম্যাম না তোমায় বাড়ির কাজ দিয়ে গিয়েছে।

— হুম যাচ্ছি।

কথাটা বলেই অহনা সাদকে ছেড়ে দিয়ে রুমে চলে যায়। আমি সাদের পাশে বসে বলি,

— শোভা আন্টির মৃত্যু বার্ষিকী না পরের সপ্তাহে।

— হ্যাঁ সোমবারে।

বলে সাদ চুপ হয়ে যায়। তা দেখে আমি সাদকে বলি,

— এইবারও কি অনাথ বাচ্চাদের খাওয়াবে?

সাদ আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— হুম।

বলে সাদ আর আমি চুপ করে বসে রই। হঠাৎ সাদ বলে উঠে,

— সময় কত দ্রুত গতিতে অতিবাহিত হয় তাই না? দেখতেই দেখতে কিভাবে যে মাকে ছাড়া দুইটা বছর কাটিয়ে দিলাম বুঝাই গেল না।

আমি সাদের এই কথার বিপরীতে কোন কথা বলতে পারলাম না। আসলে কি বলবো তাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সাদ মাথা নত করে বলে,

— সবাই কেন আমাকে ছেড়ে চলে যায়? একা করে দিয়ে যায়? আল্লাহই বা কেন সবসময় আমার আপনজনকে আমার থেকে কেড়ে নেয়?

আমি সাদের কথায় ওর কাঁধে আলতো করে হাত রাখি। তারপর বলি,

— সবই তো ওই উপরওয়ালার মর্জিতে হয়। তাই না? সেখানে আমরা এই প্রশ্ন করারই বা কে? নিশ্চয়ই তিনি যা করেন আমাদের ভালোর জন্য করেন। হয়তো আমরা ভালো দিকটা বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু এইটা আমাদের মানতে হবে আল্লাহ তা’য়ালা কখনো তার বান্দার খারাপ চান না।

— মৃত্যু জিনিসটা এত খারাপ কেন? সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। এক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু শুধু একজনের জান নেয় না বরং তার সাথে জড়িত আপন মানুষদের জীবনও নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। সান্ত্বনা দেওয়ার মত আমার ভাষা নেই। আর আমি সান্ত্বনা দিতেও চাই না। কেন না এইটা সবসময় অপর পাশের ব্যক্তিকে দূর্বল করে, শক্ত করে না। কিছুক্ষণ চুপটি মেরে বসে থেকে আমি উঠে গিয়ে অহনার কাছে চলে গেলাম। ওর কাছে গিয়ে বললাম সাদের সাথে গিয়ে খেলতে। বাড়ির পড়া আমি পরে শেষ করিয়ে দিব নে। অহনা আমার কথা শুনে দৌড়ে সাদের কাছে চলে যায় আর আমি অহনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রই। অহনাকে সাদের কাছে পাঠানোর কারণ হচ্ছে, একমাত্র এখন অহনাই পারবে সাদের মন ভুলাতে। ওকে হাসিখুশি রাখতে। আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে যাই রান্নাঘরের দিকে।

_________________

ফাহাদ অস্থির হয়ে পড়েছে। সাথে ভয় পাচ্ছে সে। ফারদিনের জ্বর কোনভাবেই কমছেই না। ঔষধ-পানি দিয়েও এখন তেমন কাজ হচ্ছে না। ডাক্তার দেখালে সে তাকে বলেছে ফারদিনকে ঢাকায় নিয়ে যেতে। কেন না তারাও বুঝতে পারছে না আসলে ফারদিনের হয়েছেটা কি। ফারদিনের রোগ বুঝার জন্য তাদের কিছু টেস্ট করার দরকার কিন্তু সেই টেস্ট করার জন্য তাদের কাছে উপযুক্ত মেশিন নাই। তাই আপাতত তাকে ঢাকাই নিয়ে যেতে হবে আর টেস্ট গুলো করাতে হবে। সেখানেই তার বাকি চিকিৎসা করালে ভালো হবে। তাই ফাহাদও আর দেরি না করে আজকের মধ্যেই খুলনা টু ঢাকার বাসে টিকিট কেটে নেয়। সেই সাথে অফিস থেকেও এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে নেয়। ফাহাদ সবকিছু গোছগাছ করে রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাসে উঠতেই তার বুক ধক করে উঠে। ঢাকা শহরের কথা চিন্তা করতেই তার মস্তিষ্কের মাঝে দুইটি নাম হানা দিয়ে বসে। সাথে সাথে সে বিচলিত হয়ে পড়ে। মনের মাঝে ক্ষুদ্র এক আশা জাগ্রত হয়। কিন্তু সে জানে না এই আশা আদৌ পূরণ হবে কি না। পরবর্তীতে কি হবে সে তাও জানে না৷ শুধু এতটুকু জানে, সামনে তার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু অপেক্ষা করছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কি তার জন্য ভালো নাকি মন্দ? কথাটা ভেবেই ফাহাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। স্থির চোখে বাইরের দিকে তাকায়।#আরশি
#Part_31
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

সাপ্তাহিক ছুটির দিন আজ। শুভ্র নীল আকাশের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘ। গোলাকৃতি আকারের সূর্যটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। চারদিক নিস্তব্ধ। দূর আকাশ থেকে ভেসে আসছে কাকের কর্কশ কন্ঠ। আমি ডেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিকাবটা ঠিক করছি এর মধ্যে অহনা তাড়া দিয়ে উঠে,

— আম্মি!! তারাতারি করো। দেরি হচ্ছে আমাদের।

আমি অহনার দিকে গোলগোল চোখে তাকিয়ে বলি,

— তোমার বাবাই এসেছে?

অহনা মাথা ঝাঁকিয়ে না সূচক উত্তর দেয়। আমি এইবার রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— তাহলে এত তাড়া কিসের? বাবাই আসুক আগে।

অহনা বিরবির করে বলে,

— তো আগে ভাগে রেডি হলে সমস্যা কোথায় বুঝি না?

অহনার কথাগুলো আমি ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে বলি,

— কি বলছ বিরবির করে?

অহনা আমার কথা শুনে ভড়কে যায়। আমতা আমতা করে বলে,

— কই কিছু না তো। তুমি রেডি হও।

এই বলে অহনা দৌড়ে বিছানার উপর গিয়ে বসে। আমি আর কিছু না বলে হিজাবটা আবার ঠিক করে নিকাবটা পড়তে থাকি। নিকাব পড়া শেষে আমি বিছানার কাছে আসতেই অহনা বলে উঠে,

— বাবাই আসে না কেন? উফফ! সবাই এত লেটলতিফ কেন?

আমি অহনার দিকে ছোট ছোট চোখ করে বলি,

— সবাই লেটলতিফ না, সবাই সবার জায়গায় ঠিকই আছে। তুমিই বরং আগে রেডি হয়ে গিয়েছ।

অহনা ভাব নিয়ে বলে,

— তাহলে সবাইকে উচিৎ আমার মত হওয়ার।

আমি অহনার নাক টেনে বলি,

— বড্ড কথা বলা শেখেছ।

অহনা কথা ঘুরিয়ে বলে,

— বাবাইকে ফোন দাও তো। কখন আসবে দেখ তো।

— সময় হোক সে এসে পড়বে। আর তারও তো কাজ থাকতে পারে তাই না মামণি। তুমি না সব বুঝো তাহলে এখন কেন বাচ্চামো করছো?

অহনা মুখটা ছোট করে বলে,

— হুম!

আমিও আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নেই। মিনিট পাঁচেক বাদেই সাদের ফোন আসে। সাদ এসে পড়েছে নিচে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কথাটা শুনে অহনার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে দ্রুত নিচে নেমে যায় আর আমিও ওর পিছে পিছে চলে যাই।

_________________________

রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে ফাহাদ। তার আর ভালো লাগছে না কিছু। একদিকে ফারদিনের অসুস্থতা আরেকদিকে নিজ মনের অশান্তি। সেই সাথে নিজের অসুস্থতা তো আছেই। ফারদিনের নিউমোনিয়া হয়েছে৷ খুলনায় ডাক্তাররা রোগটা ধরতে পারছিল না বল সঠিক চিকিৎসা দিতে পারেনি। যার ফলে এখন ওর অবস্থা গুরুতর। আপাতত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে তাকে। কিছুদিন সেখানেই রাখতে হবে তাকে। ফাহাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে এক পার্কের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তার পা আর চলছে না৷ সে আপাতত একটু বিশ্রাম নিতে চায়। খোলা আকাশের নিচে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চায়। সকল দুশ্চিন্তা ও অশান্তি থেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্তি চায় সে। কিছুদিন যাবৎ ধরে নিজেকে নিজের কাছেই বোঝা লাগে। সবকিছু ভেঙ্গে চুড়ে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সে পারে না। সে জানে তার আয়ু হয়তো বেশি নেই। হাতে গোণা ক’টি বছরই হয়তো আছে। আর তার আয়ু শেষ হওয়ার আগেই সে বেশ কিছু কাজ শেষ করে যেতে চায়। সেই সাথে এই ক’টি বছর সে ভালো ভাবে বাঁচতে চায়। শান্তিতে থাকতে চায়। কিন্তু এইটা আদৌ সম্ভব কিনা তার জানা নেই।

ফাহাদ একটি বেঞ্চিতে বসে গা এলিয়ে দে। মাথা ভনভন করছে। সে কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পেরুতেই এক অতিপরিচিত কন্ঠ কানে এসে বারি খায়। এই কন্ঠটা চিনতে সে ভুল করতে পারে না। সে চটজলদি চোখ খুলে তাকায়। চঞ্চল চোখে চারদিকটা বুলিয়ে দেখতে থাকে। ডান দিকে তাকাতেই সে দেখতে পায় একজন বোরকা পরিহিত মেয়ে তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। তাকে দেখার সাথে সাথে ফাহাদের মনে মাঝে একটি নাম টনক নাড়ে। সে চকিতে চায় আরেকবার সেইদিকে। অতঃপর কিছুক্ষণ চুপটি মেরে বসে থাকে সে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সে আর দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সেই দিকে।

____________________

নিরিবিলি পরিবেশ। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। ছোট বাচ্চাদের হালকা হৈ-চৈ এর শব্দ বাতাসে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কে এসেছি প্রায় ঘন্টাখানিক হলো। সাদ আর অহনা আমার থেকে নয়-দশ হাত দূরেই ফুটবল খেলছে। আমি তাদেরকেই খুব সুক্ষ্মভাবে পরোক্ষ করে চলেছি। এমন সময় আমার মুঠোফোনটি বেজে উঠে। আমি তাদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ব্যাগ হাতড়ে মুঠোফোনটা খুঁজার চেষ্টা করি। মুঠোফোনটা হাতের নাগালে পেতেই আমি তাতে চোখ বুলাই। বেকারি থেকে ‘সোহেল’ ফোন দিয়েছে। আমি চটজলদি কলটা রিসিভ করি। বেশ কয়েকবার হ্যালো বললাম কিন্তু কোন রেসপন্স পেলাম না। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক আপ-ডাউন করছে। বাংলালিংক সিমে এই এক সমস্যা। যখন তখন নেটওয়ার্ক আপ-ডাউন করে। আমি নেটওয়ার্ক পেতে উঠে দাঁড়ালাম। অতঃপর হাটতে হাটতে বা-দিকটা চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে ফুল নেটওয়ার্ক পেতেই আমি সোহেলকে ফোন করলাম। এতক্ষণে ওর কল কেটে গিয়েছে। দু’বার রিং হতেই কলটা রিসিভ হয়। কথা শেষ করে আমি পিছে ঘুরে দাঁড়াতেই থমকে যাই। পা দুটো জমে যায়। আমি স্থির দৃষ্টিতে সামনে দিকে তাকিয়ে রই। চোখের সামনে ভেসে উঠে এক অনাকাঙ্ক্ষিত চেহেরা। এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত তার সাথে আমার দেখা। প্রথমবার দেখা হয়েছিল সেই ছয় বছর আগে। আর আজ আবার ছয় বছর পরে। আমার সামনে সেই মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে যার সাথে নাকি একদা আমি আমার জীবনের দশটা বছর কাটিয়েছিলাম। আমার সন্তানের আসল পিতা সে। ফাহাদ! অবশ্য সে এখন আমাদের স্মৃতির মাঝেই বিরাজমান করে না। ‘ফাহাদ’ নামের কোন ব্যক্তি যে ছিল আমাদের জীবনে তা আমাদের মনেই নেই। আমি আর অহনা অতীতকে পিছে ফেলে যে যার মত এগিয়ে চলে গিয়েছি। এখন যে আর আমাদের অতীত টানে না। আমি দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফাহাদকে না দেখার ভাণ করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে ফাহাদ করুণ সুরে বলে উঠে,

— কেমন আছো?

সাথে সাথে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। চকিতে চাই তার দিকে। তার এমন করুণ কন্ঠ শুনে শরীরটা মৃদু কম্পন দিয়ে উঠে। নিজেকে একটু ভিতরে ভিতরে গুছিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলি,

— জ্বী আমাকে বলছেন?

ফাহাদ ম্লান হেসে বলে,

— হ্যাঁ। কেন আমাকে চিনতে পারো নি বুঝি? খুব কি অপরিচিত হয়ে গিয়েছি?

ফাহাদের কথাগুলো শুনে আমি ভড়কে যাই। কিন্তু তা প্রকাশ না করে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলি,

— অপরিচিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। তার উপর বিকৃতি মনের মানুষ ও তাদের সাথে জড়িত অতীতের স্মৃতি অচেনা করে দেওয়া উত্তম।

ফাহাদ কিছু না বলে চুপ করে যায়। অতঃপর পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

— কেমন আছো?

আমি এইবার ভালো মত ফাহাদের দিকে তাকালাম। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ একদম মলিন হয়ে আছে। গাল ভর্তি দারি। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। পড়নে অতি ঢোলা শার্ট আর প্যান্ট। দেখে বুঝাই যাচ্ছে সে ভালো নেই। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— জ্বী আলহামদুলিল্লাহ আপনি?

ফাহাদ আবারও ম্লান হেসে বলে,

— এইতো!

হঠাৎ মস্তিষ্কের মাঝে একটা প্রশ্ন টনক নাড়তেই আমি চট জলদি প্রশ্ন করে বসি,

— আমাকে চিনলেন কিভাবে?

— কিছু জিনিস না হয় অজানা এই থাক। তা অহনা কেমন আছে?

অহনা নাম তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হতেই আমার বুক কেঁপে উঠে৷ মনের মাঝে এক অজানা ভয় এসে ভীড় জমায়। সেই সাথে ভীড় জমায় একঝাঁক প্রশ্নের ঝুলি।
“সে কেন এত বছর পর অহনার খোঁজ করছে? যেই খোঁজ তার ছয় বছর আগে নেওয়ার দরকার ছিল তা এখন কেন নিচ্ছে? সে কি এতবছর পর তার থেকে তার অংশকে কেড়ে নিতে এসেছে?”
এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে মাথার ভিতর। মস্তিষ্ক কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ঠিক এমন সময় ফাহাদ আমায় আবার জিজ্ঞেস করে উঠে,

— বললে না যে অহনা কেমন আছে?

আমি কোনমতে নিজেকে সামলে বলি,

— আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো।

এরপর বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা। ফাহাদ হঠাৎ করুণ সুরে বলে,

— আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? জানি আমি তোমার আর অহনার সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। এতকিছুর পর ক্ষমা চাওয়াটা মোটেও যুক্তিগত নয় কিন্তু তাও চাইচ্ছি। নিজের করা ভুলের চরম শাস্তি তো পাচ্ছিই সেইসাথে অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছি।

ফাহাদের কথা শুনে আমি স্থির হয়ে যাই। তাচ্ছিল্যের সুরে বলি,

— আপনাকে ক্ষমা করতে পারবো কিনা জানি না। কেন না আপনি যে শুধু আমার সাথেই নয় আমার সন্তানের সাথেও চরম অন্যায় করেছেন। আমার কথা হলেও আমি হয়তো বা ক্ষমা করে দিতাম কিন্তু অন্যায়টা তো আর আপনি একা আমার সাথে করেন নি। আচ্ছা বলতে পারেন কি? সেই ছোট পাঁচ বছর বয়সী নিষ্পাপ মেয়েটার কি দোষ করেছিল যার জন্য ওকে এতকিছু সহ্য করতে হলো? পিতার ভালবাসার জায়গায় অনিহা আর তাচ্ছিল্য মিললো?

ফাহাদ কিছু না বলে মাথা নত করে নেয়। অতঃপর ধরা কন্ঠে বলে,

— আমি যে কি বড় ভুল করেছি তা আমি এখন হারে হারে টেড় পাচ্ছি। আর এর জন্য আমি সত্যি অনুতপ্ত। প্রতিনিয়ত ধুঁকে ধুঁকে মরছি আমি। আমি এখন এর থেকে মুক্তি চাই। আর এই মুক্তি আমায় শুধু তুমি দিতে পারো। তোমার ক্ষমা দিয়ে। আর এর বদকে তুমি যে শাস্তি আমায় দিবে তাই আমি মেনে নিব।

— শাস্তি দেওয়ার আমি কে? সেটা প্রকৃতি নিজেই নেয়। আমার সাথে অবিচার ঠিকই করেছেন কিন্তু এর বিচার আমি না বরং আল্লাহ নিজে করবে। আর রইলো ক্ষমার কথা? সেটা আমি চেষ্টা করবো।

ফাহাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই অহনা দৌড়ে এসে আমায় কোমড় জড়িয়ে ধরে। আর অভিমানী সুরে বলে,

— তুমি এইখানে কি করছো আম্মি? জানো আমি আর বাবাই মিলে তোমায় কতক্ষণ ধরে খুঁজছি?

আমি অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি,

— তোমার সোহেল মামার ফোন এসেছিল তার সাথেই কথা বলতে বলতে কখন যে এইদিকটায় এসে পড়েছি খেয়াল ছিল না। আম্মি এতগুলো সরি।

এরই মাঝে সাদ এসে বলে,

— এই তোমার কি মিসেস. ইন্ডিয়া হওয়ার ইচ্ছে জাগসে? হঠাৎ কোথায় হাওয়া হয়ে যাও তুমি।

আমি কিছু না বলে সাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাই। সাদ তা দেখে আড়চোখে আমাকে দেখে ফাহাদের দিকে তাকায়। ফাহাদের দিকে তাকাত্বি সাথে সাথে তার মুখে রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়। চোখ দুটো কেমন যেন জ্বলে উঠে। অহনা আমাকে ছেড়ে দিয়ে পিছে ঘুরে তাকাতেই ফাহাদকে দেখতে পায়। সে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ফাহাদের দিকে। অতঃপর আমার হাত টেনে জিজ্ঞেস করে,

— এই আঙ্কেলটা কে আম্মি?

অহনার কথা শুনে আমি চকিতে তাকাই ওর দিকে। অতঃপর চোখ তুলে একবার ফাহাদের দিকে তো আরেকবার সাদের দিকে তাকাই। অহনা যে ফাহাদকে চিনতে পারছে না তা আমার বুঝতে দেরি নেই। আর না চিনাটাও অস্বাভাবিক কিছু না। আজ প্রায় ছয় বছর পর অহনা ফাহাদকে দেখছে। এতদিনে ওর মন মস্তিষ্ক থেকে ফাহাদ নামের মানুষটি প্রতিচ্ছবি পুরোপুরি ভাবে মুছে গিয়েছে। তাই তো আজ ফাহাদ ওর কাছে অজানা।

হঠাৎ আমার মনের মাঝে প্রশ্ন জেগে উঠে, “আচ্ছা, নিজের সন্তান যখন তার বাবাকে চিনতে পারে না, আর এই প্রশ্নটি করে তখন একজন পিতার ঠিক কতটা আহত হয়? এর চেয়ে তিক্ত অনুভূতি কি আর দুটো আছে এই পৃথিবীতে? ফাহাদেরও কি এখন সেই তিক্ত অনুভূতি হচ্ছে? হয়তো না আবার হয়তো হ্যাঁ।” আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— তুমি চিনবে না মামণি।

— অহহ আচ্ছা।

ফাহাদ এতক্ষণ চুপ ছিল। দুই নয়ন ভরে অহনাকে দেখছিল। হঠাৎ সে বলে উঠে,

— ও কি সেই ছোট অহনা?

আমি কিছু না বলে শুধু মাথা দুলাই। যার অর্থ হ্যাঁ। ফাহাদ এইবার হাটু গেড়ে বসে। অহনাকে কাছে ডাকে। কিন্তু অহনা ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এক দৌড়ে চলে যায় সাদের কাছে। সাদ অহনাকে আগলে নিয়ে বলে,

— কি হয়েছে?

— আমার এনাকে ভয় করছে।

সাদ অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

— ভয় পাওয়ার কিছু নেই মাই এঞ্জেল। সে কিছু করবে না।

অহনা কিছু না বলে চুপটি করে থাকে। ফাহাদের দৃষ্টি হঠাৎ ছলছল করে উঠে। সে উঠে দাঁড়ায়। কৌতহূল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। অতঃপর জিজ্ঞেস করে,

— এই ভদ্রলোকটি কে?

আমি কিছু বলার আগেই সাদ উত্তর দেয়,

— আমি অহনার বাবা।

ফাহাদ বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তুমি আবার বিয়ে করেছ?

সাদ চোয়াল শক্ত করে বলে,

— নান অফ ইউর বিজনেস।

ফাহাদ এইবার আহত চোখে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার সাদের দিকে। সাদ তা দেখে বলে,

— এইখানে কেন এসেছেন আপনি মি. ফাহাদ হোসেন?

ফাহাদ নিজের নাম শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— আপনি আমায় চিনেন?

সাদ চোয়াল শক্ত করে বলে,

— আমার চেয়ে ভালো আপনাকে কে চিনবে?

— মানে?

— আপনি হয়তো আমায় চিনেন নি তাই না? ভুলে গিয়েছেন হয়তো আমায়। দ্যান লেট মি ইন্ট্রডিউস টু ইউ মাইসেফ। আমি মাহবুব হোসেন সাদমান। আপনার চাচা আজাদ হোসেনের ছেলে।

ফাহাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— তুমি কি সেই সাদমান? মানে আজাদ চাচা আর শোভা চাচীর ছেলে?

সাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— আনফরচিনেটলি ইয়েস!

আমি সাদ আর ফাহাদের কথা শুনার সাথে সাথে আমার মাথা ঘুরে উঠে। পায়ের নিচের মাটিটা কেমন নড়বড় করে উঠে। আমি বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি দুইজনের দিকে। এর মানে সাদ আর ফাহাদ চাচাতো ভাই? কিন্তু কিভাবে? কাহিনী কি? মাথা ভনভন করছে আমার। কোন মতে আমি নিজেকে সামলে নেই। পরবর্তীতে সাদ থেকে এই বিষয়ে আমি বিস্তারিত জানা যাবে আপাতত হাইপার হয়ে লাভ নেই। আমি লম্বা দুই-তিনটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলি।

চারদিকে নিরবতা। কাউরো মুখে কোন কথা নেই। আমি নিরবতা পেরিয়ে সাদকে বলি,

— তুমি অহনাকে নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াও। আমি দুই মিনিটে আসছি।

সাদ একবার আমার দিকে তাকিয়ে অহনাকে কোলে তুলে নেয়। অতঃপর ফাহাদকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— আশা করি কোন প্রকার বারাবাড়ি আপনি করবেন না।

বলেই সাদ উল্টো পথে হাটা দেয়। তা দেখে ফাহাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আমার দিকে ঘুরে বলে,

— তুমি হয়তো ঠিক। আল্লাহ হয়তো আমার বিচার করেছে। কঠোর বিচার করেছেন। আর তুমি আমায় শাস্তি না দিলেও প্রকৃতি কিন্তু আমায় ঠিকই শাস্তি দিয়েছে। ভয়ংকর শাস্তি। যা না পারবে কেউ সইতে, না পারবে মরতে।

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি,

— “রিভেঞ্জ অফ নেচার” বলে কিছু আছে তা জানতাম। কিন্তু আজ তা দেখেও নিলাম। আসলেই মানুষ সব ভুলে গেলেও প্রকৃতি কিন্তু কিছু ভুলে না। সে ঠিকই সময়মত তার প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। হোক সেটা পরোক্ষভাবে অথবা প্রত্যক্ষভাবে। কাউকে ছাড় দেয় না সে।

— আর এইটাই হয়তো প্রকৃতির প্রতি আমার নিষ্ঠুর প্রতিশোধ। আজ আমি বেঁচেও বেঁচে নেই, আমার আপন সন্তান আমায় চিনে না, বাবা বলে অন্য কাউকে চিনে, শেষ বারের জন্য তার আদরমাখা হাতের ছোয়াও পেলাম না, আমার প্রাক্তন স্ত্রী এখন আমারই চাচাতো ভাইয়ের অর্ধাঙ্গিনী, আমার আপন বলে এই পৃথিবীতে কেউ নেই। আসলেই প্রকৃতির প্রতিশোধ বড় নিষ্ঠুর। সে যাই হোক, আমার কাউরো প্রতি কোন অভিযোগ নেই। আমি আমার পাপের কর্মই পাচ্ছি। তা এখন তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ পারলে সবকিছুর জন্য আমায় ক্ষমা করে দিও। ভালো থেক।

এই বলে ফাহাদ দ্রুত সেই জায়গায় থেকে প্রস্থান করে। আর আমার বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস৷ আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটা দেই আমার গন্তব্যের দিকে।

#চলবে

গল্প কেমন হচ্ছে প্লিজ জানাবেন। ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিবেন।

#চলবে
গত পর্বে আমি একটা তথ্য ভুল দিয়েছিলাম। আর তা হলো সরকারি ব্যাংকে চাকরি করার জন্য বিসিএস পরীক্ষা দিতে হয় না। ব্যাংকে চাকরি করার জন্য আলাদা নিয়োগ পরীক্ষা দিতে হয়। ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here