#আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প
#নুজহাত_আদিবা
#পর্ব ৩
দুপুরের দিকে স্কুল থেকে ফিরে দেখি অমালিকা আপা এসেছেন। দুলাভাই আপাকে এই বাসায় পৌঁছে দিয়েই চলে গেছেন। অমালিকা আপা ৩-৪ দিনের মতো থাকবে। দুলাভাইয়ের অফিস থেকে না কি এত দিনের ছুটি দেবে না। তাই দুলাভাই আসতে পারেননি।
আমি আর অমালিকা আপা একসাথে খাবার খেতে বসলাম। আপা আর আমি আমাদের মতো চুপচাপ খেয়েই যাচ্ছি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। আমি আর অমালিকা আপা একটা সময় খেতে বসলেই গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসতাম। কিন্তু এখন একসঙ্গে খেতে বসা হলেও আগের মতো গল্প আর করা হয় না।
কলিংবেল বেজে উঠলো হঠাৎ করে। আমি আর আপা টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম। তাই আম্মা গিয়েই গেটটা খুলে দিলেন। আম্মা গেট খোলা মাত্রই দেখলাম আব্বা এসেছেন। আপা আব্বাকে দেখে খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে আব্বাকে গিয়ে সালাম দিলো।
আমিও খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে আমার রুমে চলে এলাম। আজ বুকের মাঝখান-টায় খুব ব্যাথা করছে। আহারে কী সুন্দরই না ছিল আগে খেতে বসার সময়ে গল্প করার দিন গুলো। আব্বা আম্মা ও কত রকমের গল্প করতেন। আজকাল কেউই তেমন গল্প করে না বাড়িতে। মনে হয় এই বাসায় আমি ব্যতীত আর কোনো মানুষ-ই থাকে না। হয়ত কিছু প্রিয় মানুষের মৃত্যু আমাদের মুখের হাসি এভাবেই কেড়ে নেয়।
আম্মা একটু আগে আমাকে বলেছেন, কালকে না কি নানু বাসায় যাবে। অমালিকা আপার না কি খুব নানু বাসার কথা মনে পরছে। অনেক দিন ধরে না কি অনেক দিন নানু বাসায় যায় না। তাই এবার যেহেতু অমালিকা আপা আছেন। তাই আম্মা এবার আপা আর আমাকে নিয়ে নানু বাসায় যাবেন। আম্মাকে আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম আম্মা নানু বাসায় কয়দিন থাকবে? আম্মা বললেন পাঁচ দিন থাকবে।
আমি এবার আমার রুমে গিয়ে পাঁচ দিনের জন্য জামাকাপড় প্যাক করলাম।
সকালে নাস্তা করেই অমালিকা আপা, আম্মা আর আমি নানুবাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হলাম। নানু বাসায় পৌঁছানো মাত্রই নানু আমাদেরকে দেখে দৌড়ে এলেন। ছোট মামীও বের হয়ে আম্মা আর আপার সাথে কোলাকুলি করলেন।
ছোট মামা দুপুর বেলা বাড়িতে আমাদেরকে দেখে খুব খুশি হলেন। বিকাল বেলা ছোট মামা বাজারে গিয়ে বড় বড় মাছ, মুরগি কিনলেন। সন্ধ্যা বেলা আমি, অমালিকা আপা, ছোট মামী আমরা সবাই মিলে গল্প করছিলাম। ছোট মামার দুই বছরের একটা ছেলে আছে। ওর নাম আহান।
পরেরদিন ঢাকা থেকে বড় মামা আসলেন আমাদের সাথে দেখা করতে। বড় মামী, বড় মামার মেয়ে ফাইজা আপা ও দেখা করতে আসলেন। ওইদিন সারাদিন গল্প, আড্ডা, হাসি ঠাট্টাতে আমরা মেতে ছিলাম।
সকাল বেলা নাস্তা খেয়েই সবাই পুকুরে গোসল করতে চলে যেতাম৷ পুকুরের সামনে বসে বসে পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেলতাম। খুব ভালো লাগতো পুকুরে পা ভিজিয়ে পানি ছিটিয়ে খেলতে।
নানু মাটির চুলায় রান্না করতো আর আমি বসে বসে দেখতাম। মাঝে মধ্যে চোখ জ্বলতো আগুনের ধোঁয়ায়। কিন্তু তবুও মাটির চুলায় এভাবে রান্না করতে দেখতে ভালোই লাগতো।
ছোট মামী অনেক ভালো আচার বানাতে পারেন। কাঁচা আম,জলপাই, চালতা থেকে শুরু করে কত রকমের আচার যে মামী বানাতে পারে তাঁর হিসেব নেই। যখনই নানু বাসায় বেড়াতে আসি যাওয়ার সময় ছোট; মামী ওনার বানানো আচার,মোরব্বা, আমসত্ত্ব দিয়ে দেন।
নানু বাসায় দিনের বেলা মোটামুটি নেটওয়ার্ক পাওয়া; গেলেও সন্ধ্যার পর একেবারেই পাওয়া যায় না। ফোনে কথা বলা গেলেও ঠিকমত শোনা যায় না। আটকে আটকে আসে কথা গুলো। নানুবাসা যেহেতু গ্রাম সাইডে সেহেতু; সন্ধ্যার পর সব একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়। বের হয়ে কোথাও যাওয়া ও যায় না। তাই ঘরে বসে টিভি দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আমি, অমালিকা আপা, ফাইজা আপা আর ছোট মামী আমরা সবাই মিলে টিভি দেখছিলাম। নানু রান্না ঘরে আমাদের জন্য পাকোঁড়া ভাজছেন। সবজি দিয়ে পাকোঁড়া। পাকোঁড়া ভাজা শেষ করে নানু আমাদের জন্য চা বানালেন। তারপর আমরা সবাই একসঙ্গে বসে চা আর পাকোঁড়া খেলাম।
চা পাকোড়া খাওয়া শেষ করে আমি, আর অমালিকা নানু বাসার গেটের সামনে জায়গাটাতে গিয়ে বসলাম। সব কেমন অন্ধকার নিরব নিস্তব্ধ। চারিদিকে শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক। কিছু কিছু জোনাকি পোকা ও দেখা যাচ্ছে মাঝে-সাঝে।
নানুবাসায় কিছুদিন থেকে আমরা আবার রওনা দিলাম আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। নানু অবশ্য বলেছিলেন আরও কিছুদিন থেকে যেতে। তবে আম্মা বলেছে এখন আর সম্ভব না। পরীক্ষা-টরীক্ষা শেষ হলে আবার এসে বেশ কিছুদিন থেকে যাবে।
আমরা যেদিন বাসায় চলে গেলাম ওইদিন অমালিকা আপা আমাদের সাথে; আমাদের বাসায় থেকে গেলেও পরেরদিন চলে গেলেন। আব্বা আম্মা দুজনেই বলেছেন আরও কিছুদিন থেকে যেতে। কিন্তু আপা বলেছে দুলাভাই না কি পরে রাগারাগি করবে। আবার আসবে কিছুদিন পরে।
আজকে দুপুর বেলা পাশের বাসার আরাফাত আংকেলের মেয়ের বিয়ে। মানে বর্ণের বোনের বিয়ে।
আমরা দুপুর বেলা বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। আমি আকাশি কালার একটা থ্রি পিস পড়েছি৷ সাথে গোলাপি কালার নেটের ওরনা। আম্মার কাছ থেকে আম্মার একটা কানের দুল নিয়ে আমিও কানের দুল পড়লাম। কানের দুলটা আসলে ঝুমকা। আর আমার ঝুমকা খুব পছন্দ। কিন্তু আম্মা আমাকে ঝুমকা বেশি পড়তে দেন না। ওনার মতে আমি এখন ও খুব ছোট৷ আমার এখন ও এসব পরার বয়স হয়নি।
বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে আমরা খেয়েদেয়ে চলে আসলাম। আব্বা আর আম্মা অনেকের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষন গল্প করেছিলেন। তবে এখানে সবাই আমার অপরিচিত বিধায় আমি কারো সাথেই কথা বলিনি।
বর্ণের বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার তিন চারদিন পর ;আমি রাতে ঘরের জানালা খুলতে গিয়ে বর্ণকে দেখতে পেলাম। আমি ভেবেছিলাম উনি হয়ত এখান থেকে চলে গেছেন। কিন্তু বুঝতে পারিনি উনি এখন ও এখানেই আছেন।
আমাকে জানালা খুলতে দেখেই বর্ন নিজের ঘরের জানালার সামনে এগিয়ে এসে বললেন,
— আমি কালকে আবার চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন। দোয়া করবেন আমার জন্য।
— জি।
আমি এতটুকু কথা বলেই চলে যাচ্ছিলাম জানালার সামনে থেকে। পরে আবার জানালার সামনে গিয়ে বর্ণকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
— আপনি তো এখানে থাকেন না।তাহলে আপনার রুমের বুক শেলফের এত বই কে পড়ে?
বর্ণ ও জানালা থেকে কিছুটা দূরেই সরে গিয়েছিলেন প্রায়। কিন্তু আবার কথা শুনে আবার জানালার সামনে এগিয়ে এলেন। জানালার সামনে এগিয়ে এসে এবার আমাকে বললেন,
— কী বললেন বুঝলাম না ঠিক।
— আপনি তো এখানে থাকেন না।তাহলে আপনার রুমের বুক শেলফের এত বই কে পড়ে?
— এগুলো আসলে সব গল্পের বই।
— বাহ! আপনি দেখি বেশ গল্পের বই পড়েন।
— গল্পের বই কিনে কালেকশন করাটা আসলে আমার শখ। তবে আমি অনেক গল্পের বই পড়ি এই ধারণাটা ভুল। আমি নিজের পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকি বেশিরভাগ। তাই গল্পের বই পড়ার সময় পাই না। তবে গল্পের বা উপন্যাসের বই কিনতে আমার খুব ভালো লাগে।
— ওহ,
— আপনি পড়েন না গল্পের বই?
— জি মাঝে মধ্যে পড়া হয় তবে আম্মা বেশি গল্পের বই পড়তে দেন না।
— কেন?
— আমার আম্মার ধারণা গল্পের বই শুধু বড়দের পড়ার জন্য। আর আমি না কি এখন ও খুব ছোট। তাই আমাকে গল্পের বই পড়তে দেন না বেশি। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ক্লাসমেটদের থেকে বই এনে পড়ি। এতটুকুই শুধু।
— আমার সময় নেই গল্পের বই পড়ার আর আপনার সময় থাকলেও পড়তে পারেন না। যাই হোক বড় হয়ে যান জলদি তাহলে নিজের ইচ্ছেমত গল্পের বই পড়তে পারবেন।
— হুম, দোয়া করবেন।
— জি অবশ্যই।
— আচ্ছা এটা কী বই?
— কোনটা?
— এই যে এই বইটা।
বর্ণ আমাকে এবার বুক শেলফ থেকে বইটা নামিয়ে দেখালেন। দূরে থাকায় বইয়ের নামটা বুঝতে পারলাম না। তবে আমি শুধু বইটার প্রছন্দটা দেখতে পেলাম। সাদা একটা প্রছন্দ। বইয়ের নামটা একেবারে নিচে।
আমি এবার বইয়ের নামটা জানার জন্য বর্ণকে বললাম বইয়ের নামটা একটু বলতে। উনি বললেন,
— বইটার নাম অপেক্ষা।
— লেখক কে বইটার?
— হুমায়ূন আহমেদ।
— ওহ,
— বইটা এখন ও একেবারে নতুন। আমি পড়িওনি একবার ও। আপনি চাইলে নিয়ে যেতে পারেন বইটা।
— হুম, কিন্তু আমি নিবো কীভাবে?
— হ্যাঁ, এটাই তো সমস্যা।
চলবে…