আসক্তি ২ পর্ব ১৫+১৬+১৭

#আসক্তি২
পর্বঃ১৫
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

পাখি চলে যাবার ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গেছে।ঝড়বৃষ্টিও শুরু হয়েছে পরপরই।পুরো বাড়িতে শান একা।কেমন যেন অজানা কারণে চারিদিকে শূন্যতা অনূভব হচ্ছে আজ শানের।কি সে কারণ তা শত চেষ্টার পরেও বুঝতে পারছে না।বিবেকটা বার বার নাড়া দিয়ে উঠছে।
“মেয়েটা কোথায় গেলো?”
পরোক্ষণে ভাবে,”এ শহরের কাউকেই সে চেনে না ঘুরেফিরে এখানেই আসতে হবে”
চট করে মাথায় ভাবনা আসে,”আরে আমি কেন ওকে নিয়ে ভাবছি!ও কোথায় যাক যাক তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না।এভাবে কোন নারীর প্রতি দূর্বল হওয়া আমার সাথে শোভা দেয় না”,ভাবতেই দাম্ভিকতার গাম্ভীর্য শানের চোখেমুখে স্পষ্ট হয়।তবুও বুকের কোন একটা জায়গায় কি যেন নেই নেই মনে হচ্ছে তার।
ঠোঁটে কটাক্ষের হাসি টেনে শান বিড়বিড় করে, “পরিবার বলতে আমি একা।আমার আমিত্বে আমি বরাবরই একাই রয়ে গেলাম”

ধীরপায়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।সম্মুখে ইনায়াহ্’র ঘর চোখে পড়ে।এ ঘরে পাখিও থাকত।আনমনে ঘরের ভিতরে একবার নজর ফেলে শান।বেশ পরিপাটি ঘরটা কেমন জনশূন্য হয়ে পরে আছে।একাকিত্বে ইনায়াহ্’র অভাবটা বেশ ঝেঁকে ধরেছে শানকে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে আসে।এরপর নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরে।দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে।একে একে গায়ের সব ড্রেস খুলে কাবার্ড থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে নেয়।গায়ের কাপড় গুলো খুলে রাখে ওয়াশরুমের বালতিতে।এরপর চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢোকে।পুরো বাড়িতে শান ব্যতিত কোন মানুষ নেই।কেমন যেন ভুতুরে বাড়ি মনে হয়।

তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বিছানার সাইড টেবিলের উপর চোখ পড়ে শানের। ফুলদানির নিচে একটা সাদা কাগজ বাতাসের বেগে ফরফর করছে।ভ্রকুচকে সেদিকে এগিয়ে যায় শান।নিচ থেকে বের করে খুলে দেখে সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,”রাতের ঔষধ রাখা আছে ওয়ারড্রোবের উপরের ঝুড়িটায়।মনে করে খেয়ে নিয়েন।আমি আসতে পারব না এ ঘরে ঔষধ খাওয়াতে”
ওয়ারড্রোবের উপরে চোখ ফেলে শানের কুঞ্চিত ভ্রুজোড়া সোজা হয়ে যায়।সত্যি সত্যি সেখানে তিনটা ঔষধ খুঁজে পায় শান।কেমন যেন পাখিকে এই সময় খুব মনে পড়ছে তার;সাথে গতরাতে তার দেয়া সেবাযত্ন গুলো।এরপর আনমনে রিমাইন্ড করতে থাকে গত কিছুদিন ধরে পাখির ব্যবহার গুলো।

সবটা বুঝতে শানের বেশিক্ষন সময় লাগে না।
“পাখির লজ্জা লজ্জা ভাব,আমারর প্রতি কেয়ারিং, চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলা এসবই প্রমান করে সে আমার প্রতি দূর্বল।”,চোখেমুখে ভাবনার পরশ এঁকে ভাবে শান।পরোক্ষণে নিজেকে প্রশ্ন করে,”আর আমি!আমিও কি দূর্বল ওর প্রতি?নাহলে কেন ওকে নিয়ে এতো ভাবছি?আর কেন ওকে বের করে দিয়ে এতো গিল্টি ফিল হচ্ছে?”
“না না, এসব কিছু না।ইনায়াহ্ কষ্ট পাবে।সে জন্যে খারাপ লাগছে আমার।অন্য কিছু নয়।”,পরপরই মনকে বৃথা বুঝ বুঝায় শান।

“ওয়েট ওয়েট,শুধু কি ইনায়াহ্’র জন্যে?নাকি সত্যিই আমি পাখিকে ভালো…..
ইম্পসিবল।জাস্ট ইম্পসিবল।”,শানের মন মগজে দুধরনের চিন্তা ঘোড়পাক খাচ্ছে এই মূহূর্তে।সবটাকে ছিটকে ঝেড়ে ফেলে শান কাগজটা ভাঁজ করে ড্রয়ারে ফেলে রাখে।এরপর না খেয়েই ঘুমে বিভোর শ্রান্ত চোখদুটোকে প্রশান্তি দেয়।

🌸🌸

পাখি সকাল সকাল ফ্রেশ হয় স্কুলে যাবার উদ্দেশ্যে।মন মস্তিস্ক ভালো নেই আজ।উদ্দেশ্য ইনায়াহ্’র সাথে শেষবার দেখা করে আজকেই সিলেট পৌঁছানো।রাখিদের সাথে তাদের গাড়ি করেই স্কুলে পৌঁছে যায় পাখি।স্কুলে ঢুকতেই গেইটের আড়াল থেকে ইনায়াহ্ দৌড়ে এসে বরাবরের ন্যায় কোমড় জড়িয়ে ধরে।পাখি পর পর কতোগুলো চুমু এঁকে কোলে তুলে নেয় ইনায়াহ্’কে। এরপর ক্লাসের দিকে চলে যায়।

“ম্যাম কিছু কথা ছিলো?”,প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকে বলে পাখি।
হাস্যোজ্বল মুখে প্রিন্সিপাল ম্যাম সম্ভাষণ জানিয়ে ভিতরে ঢুকতে বলে। এরপর প্রয়োজনীয় কথা বলতে আশ্বস্ত করে পাখিকে।
“ম্যাম কিভাবে বলব,বুঝতেছি না।আসলে,ম্যাম….”
“আমি জানি তুমি কি বলতে চাও?”,ঠোঁটের হাসি এলিয়ে বলেন প্রিন্সিপাল রেহানা হক।অবাক চোখে পাখি তাকিয়ে থাকে।
রেহানা হক পাখির দিকে চেয়ে বলে,”গতরাতে তোমার ঘুমানোর পর রাখি আমায় সবটা বলে দেয়।ডোন্ট ওয়ারি বাচ্চা তোমার যতোদিন ইচ্ছে তুমি আমার বাড়িতে থাকো।আমার স্কুলে জব কন্টিনিও করো।তবু তোমায় আমি সিলেট যেতে দিবো না”,
“কিন্তু ম্যাম…. ”
“উহু কোন কিন্তু নয়।তোমার মনের অবস্থা ভালো নয়।চাইলে তুমি কিছুদিন বাড়িতে নিজের সাথে একাকিত্বে কিছুটা সময় কাটাও তারপর স্কুলে আসো।তবুও আমি তোমায় ছাড়ছি না”,পাখির কথাকে থামিয়ে দিয়ে বলে রেহানা হক।

প্রিন্সিপালের একরোখা কথায় পাখি বেশ বুঝতে পারে তিনি কখনোই তাকে ছাড়বে না।আর এদিকে এখানে থাকা মানে শানের ঘৃন্য স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা।খানিকটা দোটানায় পরে যায় পাখি।ভাবনায় পরে যায় সে।পাখির দিকে নজর বুলিয়ে রেহানা হক বলেন,”তুমি আজ বাসায় যাও।ক্লাস নিতে হবে না।ড্রাইভারকে বলছি তোমায় বাসায় দিয়ে আসবে।তুমি একা কিছুটা সময় কাটাও দেখবে ভালো লাগবে”
পাখি তার দিকে চেয়ে একটা স্মিত হাসি উপহার দেয়।
এরপর পাখি পূনরায় ফিরে আসে রাখিদের ফ্ল্যাটে।

🌸🌸
এদিকে শান ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র কিছুক্ষন আগে।হসপিটালের সময় চলে যাচ্ছে। রাতে কিছু খায় নি; ক্ষিদাও লেগেছে ভীষণ।তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হয়ে নিচে নেমে আসে।গত দিন গুলোর মতো আজও অজান্তেই ডায়নিং এর চেয়ার টেনে বসে পরে শান।ভালো করে খেয়াল করে দেখে টেবিলের উপর জাস্ট প্লেট গুলোই উপর করে রাখা।পরোক্ষনে মনে পড়ে রাহেলা চাচি তো কাজে আসে না গত তিনদিন ধরে।তারপর পাখিও নেই।পাখির কথা মনে হতেই কেমন মূর্ছা যায় শান।পূনরায় শূন্য শূন্য লাগে নিজেকে।
ছটফট করে ওঠে বুকের ভেতর।

মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করে টেবিলে আঘাত করে শান।এরপর কোমড়ে এক হাত রাখে,আরেকটা হাতের দু আঙ্গুলে কপাল স্লাইড করে বিড়বিড় করে, “এরকম তো ছিলাম না আমি।হঠাৎ সবটা কেন এতো এলোমেলো লাগছে।কি নেই আমার কাছে?ইনায়াহ্!আজ একবার স্কুলে যাবো।ইনায়াহ্’কে নিয়ে আসতে হবে”
এরপর তাড়াহুড়ো করে দরজায় তালা মেরে বেরিয়ে আসে শান।রাফি গাড়ির কাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাফিকে দেখে শানের মনে পড়ে গাড়ির চাবি, ফোন কিছুই তার হাতে নেই।
পরোক্ষনে মনে হয়,”সবটাই তো আমার ঘরে।”
এরপর দৌঁড়ে সদর দরজার দিকে যেতেই বুঝতে পারে দরজায় তালা মেরেছে কিছুক্ষণ আগে।দুহাতের দিকে খেয়াল করে দেখে হাতে চাবি নেই।পকেট হাতরিয়েও চাবি খুঁজে পায় না।তালার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে মনে করে চাবিটা সে ডায়নিং এর উপরেই রেখে দরজায় তালা মেরেছে।মেজাজ যেন চরমে উঠে যায় মূহূর্তে।রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে দরজা বরাবর ডান পা দিয়ে পরপর কয়েকটা লাত্থি মারে শান।দরজার শব্দে দৌঁড়ে ছুটে আসে রাফি।
“ভাইয়া কি হয়েছে”,হন্তদন্ত হয়ে বলে সে।
“গাড়ির চাবি, ফোন সব বেডরুমে।দরজায় তালা মেরেছি চাবি ডায়নিং এ রেখে”,হাফিয়ে গিয়ে বলে শান।
কথার ফাঁকে ফাঁকে বাউন্ডারির চারিদিকে বার বার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে শান।কোত্থাও পাখি আছে কিনা এই ভেবে।
” কোথাও নেই।তারমানে বাড়িতে ফেরে নি!”
ব্যর্থ চিত্তে ভাবে,”হোয়াটএভার। কোথায় গেছে গেছে”

রাফি অবাক হয়ে যায়।কারণ ইতোপূর্বে শানের এরকম ভুল কোনদিনও হয় নি।পরোক্ষনে ঠোঁটের কোণে বিজ্ঞের ন্যায় মুচকি হেসে আনমনে বলে,”কিছু তো একটা আছে । যা স্বীকার করতে চাইছে না আর না মানতে চাইছে”
“তুই গাধার মতো হাসতেছিস কিসের জন্যে?আমি কি কমেডি করতেছি এখানে”,রাফির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে শান।
রাফি হাসি কন্ট্রোল করে বলে,”ভাইয়া এর আগে তো কখনো এমন হয় নি!”
“তো?”
“না মানে, এতো ভুল!তাও একই সময়ে!”
“বেশি কথা না বলে ভারী কিছু নিয়ে আয় তালা ভাঙ্গতে হবে।সময় কম”,ঘড়ি দেখে তড়িঘড়ি করে বলে শান।

রাফি অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাগানের একপাশে লোহার ভারী কিছু একটা দেখতে পায়।দৌঁড়ে গিয়ে সেটা নিয়ে এসে শানের হাতে দেয়।ঘড়ির দিকে চেয়ে শান সেটাকে তড়িৎগতিতে নিয়ে তালা বরাবর কয়েকটা বারি দেয়।চট করে খুলে যায় তালাটা।শেষ বারিটা দেয়ার সময় লোহার রডটার হাতে রাখা শেষ মাথাটা হাত ফসকে পরে যায় পায়ের উপর।দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করে শান।কুচকে যায় চোখমুখ।মুখে একটা স্লাং ইউজ করে বলে,”সব কি একই দিনে হতে হবে!”
এরপর দ্রুত হাঁটতে গিয়ে ব্যথায় টান পরে।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সোফায় বসে। মোজা খুলে পা টা দেখার চেষ্টা করে।ফর্সা পায়ে গোলাকৃতির জায়গা। লাল রক্তের ছোপছোপ দাগ হয়ে আছে।মনে হচ্ছে চামড়া ফেটে বের হলে শান্তি লাগত।সেদিকে পাত্তা না দিয়ে শান সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।প্রয়োজনীয় জিনিস সমেত নিচে নামে।এরপর বাড়ির চাবি সহ বাদ বকি সবকিছু পূনরায় চেইক করে দরজা লাগিয়ে বাহিরে চলে আসে।

“অলরেডি পনের মিনিট লেইট।ফাস্ট গাড়ি চালাবি।”,রাফিকে আদেশ করে শান ব্যথা পাওয়া জায়গাটা ডান হাতে আস্তে আস্তে বুলাতে থাকে।মোজা জুতা পায়ে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।তাই দ্রুত সেগুলো খুলে পা টা কে রিলিফ দেয়।গাড়ি এসে থামে হসপিটালের গেইটের সামনে।রাফি শানকে নামিয়ে গাড়ি পার্কিং জোনে নিয়ে যায়।গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই কারো কল আসে ফোনে।রিসিভারে ক্লিক করে কানে নিয়ে ধীর পায়ে চলে যায় হসপিটালের ভিতরে।দারোয়ান শুরু করে সবাই প্রথম আজ গুড মর্নিং এর পরিবর্তে মজার হাসি উপহার দিচ্ছে শানকে।যেটা গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে তার।একরাশ বিরক্ত আর রাগ নিয়ে নিজের কেবিনে ঢুকে চেয়ারে বসে পরে।পা টা ভালো করে দেখে নেয়।
“আমার লাইফে এরকম একই দিনে এতো দূর্ঘটনার স্বীকার এর আগে কখনোই হয় নি।আজ কি হচ্ছে এসব”,পায়ে মেডিসিন লাগাতে লাগাতে বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে শান।

🌸🌸

স্কুল থেকে ফ্ল্যাটে ফিরেছে পাখি।রাখির বিছানায় বসে দুহাতে হাঁটু জড়িয়ে নিঃশব্দ কেঁদে চলছে।
“আমার জীবন টা তো এমন ছিলো না।এর থেকে তো ভালো ছিলো রায়ানের সাথে বিয়ে হওয়াটা!আমি কি করে নতুন ভাবে এতোটা জড়িয়ে গেলাম ডাক্তারের সাথে?কখন হলো এসব?নিজের অজান্তেই কবে জায়গা দিলাম তাকে?”,এক ধ্যানে মেঝের টাইলসের দিকে তাকিয়ে ভাবছে পাখি।দুহাতে চোখের পানি মুছে বলে,”ভাগ্যিস সেটা এখন অপ্রকাশ্য।প্রকাশ করলে লজ্জায় মরে যেতাম আমি। আর তার অপমানেরও শেষ থাকত না।”

পায়ের ব্যথাটা টনটন করে উঠছে শানের।কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না শান।বাধ্য হয়ে দুপুরের আগেই ছুটি নিয়ে চলে আসে।রাফি গাড়ি ড্রাইভ করছে স্মুদলি।শান ব্যাকসিটে বসে ব্যথায় আহত পা টা সামনের সিটের ব্যাকসাইডে ঠেস দিয়ে বসে আছে।আর চোখেমুখে ব্যথার স্পষ্ট বলিরেখা বার বার ফুটিয়ে তুলছে।গাড়ি বাড়ির রাস্তা মুখো হতে না হতেই শান তড়িঘড়ি করে বলে,”গাড়ি ডানে নে।ইনায়াহ্’র স্কুলে”
রাফি কথামতো গাড়ি ডানে ঘুড়িয়ে স্কুলের দিকে নিয়ে যায়।
গাড়ি থেকে নেমে শান হাঁটার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।
“কষ্ট করে হলেও আজ ইনায়াহ্’কে একবার দেখে তবেই যাবো।নয়ত শান্তুি হচ্ছে না”,ভাবতে ভাবতে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলে অফিস কক্ষের দিকে।
রাখি সেদিকে একবার দেখে মুখ বাঁকিয়ে অন্য ক্লাসে চলে যায়।এমনি সময়ে শানের উপস্থিতিতে টিচার্সরা অনেক বেশি আগ্রহ দেখায়।আর আজ রাখির ব্যবহার শানকে বড্ডো ভাবাচ্ছে।গা ঝেড়ে এগিয়ে যায় ক্লাসের দিকে।উপস্থিত থাকা টিচারকে বলে বাহিরে আনে ইনায়াহ্’কে। এরপর বাহিরে রাখা বেঞ্চটার উপর ইনায়াহ্’কে কোলে নিয়ে বসে।আড়চোখে বার বার পাখিকে খোঁজে।কিন্তু কোথাও পায় না।এবার না চাইতেও বেশ দূঃচিন্তার রেশ চোখে মুখে দেখা যায় শানের।
“বাড়ির কোথাও নেই।স্কুলেও নেই।তাহলে গেলো কোথায় ও?”
ইনায়াহ্’র চোখে মুখে আদরের স্পর্শ এঁকে বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেসা করে, “মাম্মাম তোমার মুন সাইন স্কুলে আসে নি”
সহাস্যে ইনায়াহ্ জবাব দেয়,”হ্যা তো এসেছিলো তো।আমায় অনেক অনেক আদোর করেছিলো তো।”
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে ইনায়াহ্ বলে,”কোথায় যেন গেলো আবার।ও হ্যা একটু আগে ব্যাগ নিয়ে বাহিরে গেছে।আমি ক্লাসে ছিলাম তাই ডাকি নি ”

শান ইনায়াহ্কে কোল থেকে নামিয়ে ভাবে,”রাতে ছিলো কোথায় তবে?রাখিদের ওখানে!”,
“তোমার পায়ে কি হয়েছে সান সাইন”,ব্যথা পাওয়া পা টার দিকে চেয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে ইনায়াহ্।
“ও কিছু না মাম।একটু ব্যথা পেয়েছি।এবার বলো তুমি কবে আসবে?আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারছি না মা।কেন বুঝো না বলো তো”,ছোট বাচ্চাদের মতো ন্যাকাস্বরে টেনে টেনে বলে শান।ইনায়াহ্ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বলে,”দিদা যখন বলবে তখন”
শান হতাশ হয়ে ইনায়াহ্’র পেট জড়িয়ে ধরে বলে,”আই মিস ইউ গো মা”
“আই মিস টু “,শানের মাথাটা নিজের পেটের সাথে জড়িয়ে বলে ইনায়াহ্।
“ইনায়াহ্ ক্লাসে চলে আসো,ডায়েরি লিখার সময় হয়েছে”,ক্লাসের ভেতর থেকে ভেসে আসা টিচারের কথায় শান ইনায়াহ্’কে ছেড়ে বলে,”ক্লাসে যাও।আর তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসো, কেমন”
“আচ্ছা”,শানের কাপালে চুমু এঁকে বলে ইনায়াহ্।এরপর দৌঁড়ে ছুটে যায় ক্লাসের দিকে।

শান হাঁটতে হাঁটতে ভাবে,”একবার কি রাখিকে জিজ্ঞেসা করব পাখির কথা?ব্যপার টা উচিত হবে তো!”,
“কোন দরকার নাই।যখন স্কুলে আসতে পেরেছে তারমানে নিশ্চই কোন সেইফ জোনেই আছে।আমার কি!আই ডোন্ট কেয়ার ফর এনি উইমেন”,পরোক্ষনে নিজেকে ধাতস্ত করে গাড়ির কাছে চলে আসে।

শান আর ইনায়াহ্’র পিছনে আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের সম্পূর্ণ কথা শুনে ফেলে রাখি।এরপর নিজের ধারনা সত্যি হওয়ার পূর্বাভাসে রাজ্যজয়ের হাসি ফুটিয়ে তোলে ঠোঁটে।

🌸🌸
পায়ের ব্যথার প্রয়োজনীয় কিছু মেডিসিন সমেত শান বাড়িতে ঢোকে।ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবে,”ইনায়াহ্’কে দেখলাম আজ,আদোর করলাম।আর কোন সমস্যা নেই।এখন রিল্যাক্সে সময় কাটাতে পারব”
“আহহহ”,সোফায় বসতে পায়ে আবার টান পরে।রাগ যেন আর ধরেই না শানের।জোড়ে স্লাং একটা শব্দ ইউজ করে বাম পা দিয়ে সোফার কোনায় বারি মারে।নিজেই কিঞ্চিত ব্যথা পেয়ে দুহাত সিটকে আসে।চোখ মুখ কুচকে বলে,”পুরো দিনটাই না ব্যথায় ব্যথায় কাটাতে হয়!”

নিজের রান্না নিজে করা, বার বার সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে ওঠা নামা করা শানের কাছে আজ পাহারসম মনে হচ্ছে।কোন একজন হেল্পিং হ্যান্ডের অভাব বোধ করছে শান।মূহূর্তেই পাখির কথা মনে চলে আসে।পরশু রাতে কিভাবেই না মেয়েটা রাত জেগে সেবা করল তার!অথচ বিকেল হতে হতেই বাড়ি থেকে বের করে দিলো।তাও আবার অতো ঝড়বৃষ্টির রাত।ভাবতেই কেমন নিজের মাঝে অপরাধবোধ জেগে ওঠে শানের।চারিদিকে কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হয় তার।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। আজ যেন সময় গুলো কাটতেই চাইছে না শানের।ছন্নছাড়া লাগে নিজেকে।মনে হচ্ছে শরীরের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা নেই।
“ইনায়াহ’কে তো দেখে এলাম আজ।তাহলে আবার কেন এতো খারাপ লাগছে আমার।”,মাথার চুল দুহাতে চেপে ধরে বলে শান।
না চাইতেও বার বার পাখির কথা মনে পড়ছে। পাখির চোখ, মুখ,ঠোঁট,ঐ তিল সবটাই আজ নতুন করে আবিষ্কার করছে শান।কেন জানে না পাখির ভাবনাতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে ভালো লাগছে তার।

🌸🌸

বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও কিছুতেই ঘুম চোখে আসছে না শানের।নিজের মনকে প্রশ্ন করে,”তাহলে আমি সত্যিই পাখিকে ভালোবেসে ফেললাম?এটা কি করে সম্ভব।আমি চাইলেও কোন নারীকে আনতে পারব না জীবনে।আর সেখানে পাখির মতো অসহায় কাউকে কী করে আনলাম?আমি কাউকে আগলে রাখতে পারি না আমার জীবনে।আমি কী করে পাখিকে আগলে রাখব?মাকে হারিয়েছি শেষমেশ নিজের ভালোবাসা!আমি কাউকে রাখতে পারি না।সবাই একটা সময় পর চলে যায় আমায় একা করে।”,
ভাবতেই চোখের কোনা বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পরে শানের চোখ দিয়ে।

“উুহু,আমি পাখিকে জড়াতে চাই না আমার জীবনে।কিন্তু ওকে ছাড়া থাকতেও যে পারছি না।কী করব আমি?”,বিছানা ছেড়ে উঠে বসে দুহাতে মুখ চেপে বলে শান।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে পাখির মতো সড়কের দিকে চেয়ে দেখে শান।এরপর আকাশের দিকে মুখ করে অস্ফুট স্বরে বলে,”পাখি”

🌸🌸
ঘুমন্ত মানুষ ধড়ফড়িয়ে ওঠে পাখি।ঘন ঘন শ্বাস নেয়।ওর অবস্থা দেখে রাখি ফোনে কথা বলা রেখে বেলকোনি থেকে দৌঁড়ে ঘরে ঢোকে।
“পাখি, কি হয়েছে?এই পাখি?”,গা ঝাঁকিয়ে ডাকে রাখি।
“পানি,পানি দাও একটু”,শুকনো ঢোক গিলে পানি চায় পাখি।
রাখি পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই পাখি চট করে সেটা কেড়ে নিয়ে দ্রুত পানিটা শেষ করে।মুখ মুছে ঠাঁয় বসে থাকে।
“এবার বলো তো কি হয়েছিলো?স্বপ্ন দেখেছিলে?”
পাখি অসহায় মুখ করে রাখির দিকে তাকায়।রাখি আশ্বস্ত করে বলে,”হুমম বলো?”
“ডাক্তার সাহেব মনে হয় ভালো নেই।একা….”,শেষের শব্দটা বেশ রিনরিনে কন্ঠে বলে পাখি।

রাখি বুঝতে পারে পাখির মনের অবস্থা।মাথা বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”ভালোবেসে ফেলেছিস।”
পাখি চমকে মাথা তুলে তাকায়।রাখি দুইবার মাথা উপর নিচ করে জবাব দেয়,”হুমম।ইট’স কল্ড লাভ।এবং তুমি ভালোবাসো ডাক্তারকে।আর এটাই মূল ফ্যাক্ট”
রাখির কথাকে নাকোচ করার কোন সুযোগ পায় না পাখি।কেঁদে ফেলে নিঃশব্দে।
#আসক্তি২
পর্বঃ১৬
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ফজরের আজান কানে পড়তেই বিছানা ছাড়ে শান।দুচোখের পাতা তখনো ঘুমহীনতায় ভুগছে।সারারাত আকাশ-পাতাল ভেবেছে সে।কখনো মনের কথা শুনেছে তো কখনো মগজের। ফাইনাল কোন সিদ্ধান্তে কিছুতেই উপনীত হতে পারে নি শান।গা ঝাড়া দিয়ে উঠতেই পায়ের ব্যথাটা টনটনিয়ে ওঠে।খুঁড়িয়ে বাহিরে বের হয়।
“মাথাটা বড্ডো ধরেছে।এক কাপ কফির প্রয়োজন”,ভাবতেই পা বাড়ায় সিঁড়িতে কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না।ব্যথায় টান পরে ভীষণ।কেউ একজন থাকলে ভালো হতো।জীবনের এই প্রথম কাউকে এতো বেশি প্রয়োজন পরছে শানের।খুবই সাবধানে পা টা রাখে প্রথম সিঁড়িতে।ব্যথায় কুচকে যায় চোখমুখ। ব্যথা সহ্য করে সবকয়টা সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে নিচে নামে ।এরপর রান্নাঘরের দিকে যায়।নিজের জন্যে এককাপ কফি বানিয়ে পূনরায় আস্তেধীরে সোফায় এসে বসে।

কফির কাপে প্রথম চুমুক দিতেই গরমে জিহ্বটা পুড়ে যায় যেন।আর কি বিশ্রী সে কফি।জিহ্ব উল্টিয়ে জিহ্বা পরোখ করার চেষ্টা করে শান।কফির স্বাদে রুচি নষ্ট হয়ে যায়।কফি সমেত কাপটা ছুড়ে মারে মেঝেতে।বিড়বিড় করে বলে,”নরক নরক মনে হচ্ছে সবকিছু”
চোখ বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে দিতেই সেদিন রাতে পাখির অসহায় মুখখানা শানের মানষপটে ভেসে ওঠে।
বড্ডো অমানুষ মনে হয় নিজেকে।

🌸🌸

সময় ঘনিয়ে আসলে পাখি স্কুলের জন্যে তৈরী হয়ে নেয়।রাখি এসে মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,”তুই কোথায় যাচ্ছিস ম্যাম?তোরে না মা কয়দিন রেস্ট নিতে বললো!”
পাখি শুকনো মুখে জবাব দেয়,”বাড়িতে একা একা বোর হয়ে যাই।আর ইনায়াহ্’কে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না। ”
“ক্লাস করাতে হবে না।মন মগজে এতো চাপ নেয়ার দরকার নাই। ইনায়াহ্’কে দেখে বাড়ি চলে আসিস।আর আমিও আজ তাড়াতাড়ি চলে আসব।এরপর জমিয়ে আড্ডা দিবো।”,খুব আগ্রহ নিয়ে বলে রাখি।ঠোঁটে সামান্য মুচকি হাসি উপহার দেয় পাখি।

এরপর স্কুলে চলে যায় দুজনেই।পাখি ইনায়াহ্’র সাথে দেখা করে চলে যায় ক্লাসে।কিন্তু রাখি কিছুতেই ক্লাস করাতে দেবে না তাকে।তাইতো ঠেলে ঠেলে গেইট অবধি এনে সিএনজি ঠিক করে দেয়। কোন উপায় না পেয়ে অগত্যা পাখি চলে আসে বাসায়।

কাল থেকে ভুলের শেষ নেই শানের।তাই তো সকালের ঐ ঘটনার পর থেকে সব কাজ খুব সাবধনতার সহিত করার চেষ্টা করছে আর মনে মনে রাহেলাকে হাজারটা বকুনি দিচ্ছে।রান্না করতে ইচ্ছে করছে না।তাই কয়েকটা ব্রেড,জেলি সাথে ডিম পোচ নিয়ে বসে পরে ডায়নিং এ।নষ্ট রুচি নিয়ে সামান্য একটু কিছু মুখে দিয়ে হাসপাতালের জন্যে তৈরী হয়।
“আজ কিছুতেই ছুটি নেয়া যাবে না বা লেইট হওয়া পসিবল না”,ভাবতে ভাবতে নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফিট করে নেয় শান।ঠিকমতো দেখেশুনে গাড়ির চাবি,ফোন আরো অন্যান্য কাগজপাতি আজ হাত নেয় সে।এরপর সদর দরজায় তালা মেরে চাবি আব্দুল্লাহ্’র হাতে দিতে দিতে বলে,”তোমাদের দুজনের মতিগতি কিছুই বুঝতেছি না।এ কয়দিন চাচি নেই কাল আবার তুমি ছিলে না।কি যে শুরু করেছো তোমরাই জানো”,
আব্দুল্লাহ্ সহাস্যে জবাব দেয়,”তোমার চাচি দেশের বাড়ি থেকে এসেই কাল অসুস্থ্য হয়ে পরে।তাই আমি আসতে পারি নি বাবা”
শান বিরক্ত হয়ে বলে,”কতো করে বলি একটা ফোন কিনে দেই,ফোন কিনে দেই।তা তো নিবা না।ফোন থাকলে তো জানাতে পারতা নাকি?”,
আব্দুল্লাহ্ বরাবরের ন্যায় উত্তরহীন হয়ে সামনের দাঁত ক’পাটি বের করে হেহে করে হেসে দেয়। ফোনের কথা উঠতেই চট করে মনে পড়ে,”পাখিকে তো একটা ফোন কিনে দিলাম সেদিন।ফোনটা কি সাথে নিয়েছে?”
ভাবতেই নিজের ফোন বের করে পাখির নম্বরে ডায়াল করে।পরপর কতোগুলো রিং হয় কিন্তু ফোনটা রিসিভ হয় না।রাগে ফোনের পাওয়ার অফ করে আবার পকেটে ভরে রাখে শান।এরপর রাফিকে বলে গাড়ি স্টার্ট করতে।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে।এদিকে শান ভাবছে অন্যকথা।
“এতোবার কল দিলাম ধরলো না।এতো এটিটিউড কোথা দিয়ে আসে এই মেয়ের।আরে বাবা কোথায় আছে সেটার ব্যপারে অন্তত নিশ্চিত হতে পারতাম”,বিড়বিড় করতে থাকে শান।
রাফি মিররে তাকিয়ে শানকে দেখে বলে,”ভাইয়া কিছু হয়েছে কি?শরীর খারাপ করছে?”,
শান বিরক্তিমাখা চোখে সেদিকে চেয়ে বলে,”না”
রাফি আবারও বলে,”তাহলে!”
“সেটাও কি এখন তোকে বলব”,চাপাস্বরে ধমকে ওঠে শান।রাফি ভয়ে ভয়ে চুপ হয়ে যায়।শান ভ্রুকুচকে রাফিকে দেখে বলে,”পরশুদিন তুই কখন বাড়ি গেছিস?”
রাফি মিররে দেখে শুকনো ঢোক গিলে বলে,”আপনাকে নামিয়ে, গাড়ি রেখে আমি চলে গেছি ভাইয়া।”
রাফি স্বগতক্তি করে বলে,”কেন ভাইয়া?কোন…..?
বলতে বলতে শানের দিকে তাকাতেই কথা থেমে যায় রাফির।চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকে।

খানিক পর শান আবার বলে,”সেদিন কি পাখি ম্যাডামকে কোথাও দেখেছিস?”
শানের প্রশ্নে রাফি অবাক হয়ে যায়।ভেতরে ভেতরে খুশির বন্যা বয়ে যায়।নিজের আবেগানুভূতিকে চেপে রেখে রাফি বলে,”হ্যা দেখেছিলাম তো। কি বলব ভাইয়া বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে অবস্থা হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ায়া ছিলো।আমি কতো করে বললাম ‘ম্যাডাম বাড়িত যান’কিন্তু আমার কোন কথাই শুনলো না”
“তা শুনবে কেন?নিজের জেদ বজায় রাখতে হবে না”,ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে শান
“কিছু বললেন ভাইয়া”,রাফি স্টেয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বলে।
শান রাফির প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে ফিরতি প্রশ্ন করে,”তারপর কোথায় গেলো দেখেছিস?”
“তারপর,তারপর, তারপর তো জানি না ভাইয়া”
রাফির থেকে আশানুরূপ জবাব না পেয়ে শান হঠাৎই বলে ওঠে,”গাড়ি স্কুলে নে। ”
রাফি অবাক হয়ে বলে, “ভাইয়া স্কুল তো অন্য রাস্তায়!এখন ফিরে সেখানে গেলে তো সময় লাগবে অনেক”
শান কানে ব্লুটুথটা সেট করতে করতে বলে,”লাগুক।যা বলেছি, তাই কর।”
রাফি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়
এরপর ইনায়াহ্’র স্কুলে এসে থামে।

শান বাহিরের দোকান থেকে কতোকগুলো চকোলেট সমেত কিছু হেলথি স্ন্যাক্স নেয় ইনায়াহর জন্যে।এরপর স্কুলে ঢুকে সেগুলো ইনায়াহ্’র হাতে দিয়ে গতদিনের মতো জানতে চায়,”তোমার মুন সাইন আসে নি?”
“হ্যাঁহহ।আমায় আদোর করে কোথায় যেন চলে গেছে”
ইনায়াহ্’র কথাটা শানকে বেশ ভাবায়।
“স্কুলে আসে!আবার চলে যায়!যায় তো যায় কোথায় যায় ও”
ভাবতেই ফোনে কারোর সাথে হেসে হেসে কথা বলারত রাখিকে দেখতে পায় শান।
“রাখিকে জিজ্ঞেসা করব একবার, ব্যপার টা কেমন দেখাবে?”
মন বলছে এক মগজ বলছে আরেক।শেষমেশ রাখির দিকে এগিয়ে যায় শান।
“এক্সকিউজ মি!”
“এক মিনিট হোল্ড করো প্লিজ”,ফোনে কাউকে বলে রাখি শানের দিকে ফিরে বলে,”জ্বি ড.শান!কিছু বলবেন?”
শান সরুচোখে চেয়ে কি যেন ভেবে রাখিকে বলে,”ইনায়াহ্’র পড়াশুনা কেমন চলছে?”
রাখি সহাস্যমুখে বলে,”বেশ ভালো”
“ওকে থ্যাংকস”,বলেই দ্রুত প্রস্থান করে শান।

শানের যাওয়ার দিকে চেয়ে রাখি মুচকি হেসে বলে,”এতো সহজে আপনার ক্ষমা হচ্ছে না মিস্টার শান।সেদিন রাতে পাখিকে বের করে দিয়ে খুব অন্যায় করেছিলেন।এখন দেখবার পালা কি করো আপনার ইগো ভেঙ্গে যায়”

শান ধীর পায়ে গেইটের কাছে চলে আসতে আসতে চারিদিকে পাখিকে খোঁজে।ক্লান্ত শ্রান্ত চোখদুটো যেন তাকে দেখার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।চোখের প্রশান্তির জন্যে হলেও পাখিকে একটিবার দেখা প্রয়োজন।

গাড়ির কাছে এসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাফিকে বলে,”তাড়াতাড়ি চল।”
গাড়ি স্টার্ট করে মিররে বার বার শানকে দেখে নেয় রাফি।কেমন যেন বড্ডো মায়া হয় রাফির।এর আগে এতো বিমর্ষ কোন দিনও সে দেখেনি শানকে।চোখ বন্ধ করে শান গাড়িতে গা এলিয়ে বলে,”রাফি আমি কি খুব খারাপ?”
শানের প্রশ্নে হকচকিয়ে ওঠে রাফি।অপ্রস্তুত স্বরে বলে,”এসব কি কথা ভাইয়া।আমার দেখা পৃথিবীর সবথেকে ভালো মানুষ আপনি।সেদিন যদি মায়ের চিকিৎসার টাকা আপনি না দিতেন আর আমায় যদি জবে না নিতেন, এতোদিনে পথে বসতে হতো ভাইয়া”
শান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,”আমি খুবই খারাপ বুঝলি তো।নয়ত কেন কাউকে আগলে রাখতে পারি না”
শেষের কথাটা বিড়বিড় করে বললো শান।যেটা রাফির কর্ণগোচর হতে পারল না।

🌸🌸

পাখি নিজেকে অনেকটা স্বাভাবিক করে নিয়েছে।শানের ঘৃন্য স্মৃতিগুলো থেকে মোটামোটি বের হতে পেরেছে।শানের কথা মনে উঠলে চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে পাখির।সারাদিন বসে বসে গল্পের বই পড়া, দুপুরের পরে রাখি চলে আসলে জমিয়ে আড্ডা দেয়া।বেশ ভালোই চলছে জীবন।

“রাফি গাড়ি স্কুলের রাস্তায় নে”,আজও সকালে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হলেও রাফিকে স্কুলের দিকে গাড়ি ঘোরাতে বলে শান।রাফিও বাধ্য ছেলের মতো তাই করে।গত দিনগুলোর মতো আজ শান পাখিকে খোঁজে।কিন্তু পায় না।এবার ব্যপার টা সত্যিই দূঃচিন্তার মনে হয় শানের কাছে।নিজের কৌতূহলের কাছে ইগোকে অনেক ছোট মনে হয় তার।

ইনায়াহ্’র সাথে দেখা করে ব্যর্থ হয়ে আবার গাড়িতে ফিরে আসে শান।রাফি শানের অবস্থা দেখে আর ঠিক থাকতে পারে না।আনমনে ভাবে,”তাহলে আমার সন্দেহই ঠিক?ভাইয়া তবে পাখি ম্যাডামের প্রতি দূর্বল!”
ভাবনা চিন্তা একপাশ করে রাফি বলে,”ভাইয়া আমি জানি পাখি ম্যাডাম কোথায়?”
হরবরিয়ে শান বলে,”হোয়াট?তুই, তুই জানিস? আর আজকে মাত্র বললি”
“সরি ভাইয়া, ম্যাডাম বলতে মানা করেছিলো”,রিনরিনে স্বরে বলে রাফি।
“আচ্ছা বল এবার কোথায় ও।তাড়াতাড়ি বল ডাম ইট!”,হন্তদন্ত হয়ে বলে শান।
রাফি যেন গত সাত বছরে নতুন এক শানকে আবিষ্কার করলো।মনে মনে এক আকাশ খুশি সমেত গাড়ি নিয়ে দাঁড় করালো রাখিদের ফ্ল্যাটের সামনে।

“এটাতো ইনায়াহ্’র প্রিন্সিপালের ফ্ল্যাট!তারমানে আমার ধারনাই ঠিক ছিলো,শিট!”,বলেই শান রাগি চোখে তাকায় রাফির দিকে।রাফি অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকে।শান উঠে যায় রাখিদের ফ্ল্যাটের সামনে। দুইবার কলিং বেল চেপে বিপরীত মুখী হয়ে শান আশপাশে তাকায়।দরজা খোলার শব্দে শান একটু নড়ে চড়ে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ায়।কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছে শানের।

পাখি দরজা খুলে দুহাতে দরজার সাইড চেপে বলে,”জ্বি, কি চাই?”
চেনা কন্ঠস্বর কানে আসতেই শানের কান যেন অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরে যায়।নজর এদিক সেদিক করে শান পিছু ফিরতেই পাখির সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়।এক মূহূর্তের জন্যে যেন পৃথিবী থমকে যায় শানের।চোখের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।একদৃষ্টে চেয়ে থাকে পাখির দিকে।

চোখের সামনে এভাবে শানকে দেখতে পাবে পাখির ভাবনার মাঝেও ছিলো না।অবাক বিষ্ময়ে চেয়ে থাকে সেদিকে।কিছুক্ষণ পর বিব্রতবোধ করে পাখি নজর সরিয়ে নেয়।মাথা তুলে বলে,”আপনি! এখানে? “,
শান তখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে পাখিকে দেখছে।কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে পাখি বলে,”কি চাই?”
“বাড়ি চলো”,স্বাভাবিক ভাবে জবাব দেয় শান।অবাক হয়ে পাখি তাকায় শানের দিকে।শানের নজরের কোন হেলদোল নেই।নজর সরিয়ে পাখি কাটকাট গলায় বলে,”বাড়ি!আমার তো কোন বাড়ি নেই।আশ্রিতা ছিলাম।মালিক বাড়ির থেকে বের…… ”
“ওহহ প্লিজ।তোমার ভাঙ্গা রেকর্ড শুনতে আসি নি আমি”,পাখিকে থামিয়ে বলে শান।
রাগে ফোসফোস করছে পাখি।বজ্রকন্ঠে বলে,”তো আসছেন কিসের জন্যে?”
আবারও শান স্বাভাবিক ভাবে বলে,”বাড়ি চলো”
“যাবো না আমি।আপনার মতো গিরগিটি মার্কা লোকের সাথে থাকার কোন ইচ্ছে আমার নাই।”,তেড়ছাভাবে বলে পাখি দরজা লাগাতেই শান দরজায় একহাত দিয়ে আটকে দেয়।পাখি অবাক হয়ে যায়।শান ঠোঁটে ভিলেনি হাসি বজায় রেখে বলে,”তা যাবে কেন?এখানে বসে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলবে আর ফ্যাট বাড়াবে।ওখানে তো কাজ করে খেতে হয়, না?”
পাখির রাগ যেন আর ধরছে না।নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে শানের বুক বরাবর দুহাতে জোড়ে আঘাত করে। বেসামাল হয়ে শান দু’পা পিছিয়ে যায়।পাখি চাপাস্বরে চিল্লিয়ে বলে,”আর কতো ইনসাল্ট করবেন আপনি আমার?এখানে বয়ে এসেও ইনসাল্ট করছেন।কেন কিসের জন্যে?আমি তো চলে এসেছি আপানার থেকে। তাহলে?”,

পাখির চোখে স্পষ্ট অভিমানের ছাপ দেখতে পায় শান।মুচকি হেসে এগিয়ে এসে পাখির ডান হাত চেপে ধরে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে ।হঠাৎ এমন কিছু হওয়ায় হকচকিয়ে যায় পাখি।শানের বুকের একদম কাছে নিজেকে অনুভব করতে পারে।এই প্রথম বিপরীত প্রকৃতির একজন মানুষের এতোটা কাছে এসে অনুভূতিগুলো কেমন মূর্ছা যায় পাখির।শানের গায়ে কড়া পারফিউমের গন্ধে নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম।মূহূর্তে রাগগুলো মিশে জল হয়ে যায়।নিজেকে কোনমতে ধাতস্ত করে পাখি বলে,”ছাড়ুন।পাশের ফ্ল্যাটের কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে।”
শান শান্ত চাহনিতে পাখির অস্থিরতা দেখে বলে,”বাড়ি চলো”

পাখি মাথা তুলে বলে,”যাবো না। বলেছি না?আর কিসের জন্যে নিতে চাইছেন?ইনায়াহ্’র জন্যে?ওতো ওর দিদা না কে হয় তার সাথে আছে কয়দিন ধরে।তাহলে কেন ডাকতেছেন? আবার অপমান করতে?”
শান বুঝতে পারছে সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না।আর এ কয়দিনে এটা বুঝেছে অন্তত চোখের প্রশান্তির জন্যে হলেও পাখিকে তার দরকার।তাই চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে পাখিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চট করে কোলে তুলে নেয়।

পাখি যেন আকাশ থেকে পরে যায় মূহূর্তেই।শানের দিকে অবাক হয়ে বলে,”কি করছেন আপনি?ছাড়ুন আমায়।ছাড়ুন বলছি!”
শান ওর কোন কথা না শুনে সামনে তাকিয়ে কোলে করেই লিফ্ট বেয়ে নিচে নামে।পাখি ছটফট করতেই শান বলে,”এর থেকে বেশি কিছু করি, তার আগে থেমে যাও”
শানের কথা পাখির কর্ণগোচর হতেই পুরো শরীর হিম হয়ে আসে ।কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হয়। আর এক চুলও পাখি নড়ার সাহস পায় না।গাড়ি অবধি পুরো রাস্তা চোখ মুখ খিচে রাখে পাখি।

গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাফি শানের দিকে দেখে আশেপাশে তাকিয়ে নেয় কেউ দেখল কিনা।হকচকিয়ে বলে,”ভাইয়া….. ”
শান কড়াচোখে গাড়ির দরজা খুলতে বলে।রাফি দ্রুত দরজা খুলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।রাফির দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে দেখে নেয় পাখি।

পাখিকে বসিয়ে একহাত চেপে ধরে শান রাফিকে বলে,”গাড়ি বাড়ির পথে নে”
“আআচ্ছা “,শুকনো ঢোক গিলে বলে রাফি
#আসক্তি২
পর্বঃ১৭(বোনাস)
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“ছাড়ুন আমায়।একদম টাচ করবেন না।”,নজর সরিয়ে পাখি কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলে,”হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মি”
শান ডান ভ্রুটা উচিয়ে পাখির দিকে পাশ ফিরে বসে বাম হাতটা চিপে ধরে শক্ত করে।কারণ এতোদিনে যা বুঝেছে পাখি তেজি মেয়ে।হাত ছাড়লে সে গাড়ি থেকে লাফ দিতেও দু’বার ভাববে না।
“আমার কথা আমাতেই এপ্লাই করে লাভ নেই”,স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে শান।
পাখি হাত টা মুচরামুচরি করে বলে,”আমায় কেন নিয়ে যাচ্ছেন?যখন ইচ্ছে হবে অপমান করবেন আবার যখন ইচ্ছে হবে এভাবে জোড় করে আআটকে রাখবেন।তা তো হয় না, না?”,
বলতে বলতে পাখি মিররে তাকায়।রাফির চোখে চোখ পড়তেই কটমট করে পাখি বলে,”তুমি কি দেখছো?তোমাকে তো পরে দেখে নিচ্ছি আমি”
রাফি কাপাকাপা হাতে গাড়ির স্টেয়ারিং ধরে।

শান রাফির দিকে একবার দেখে মুচকি হেসে ওঠে।শানের হাসিতে পাখির রাগ দ্বিগুন বেড়ে যায়। বাম পা দিয়ে শানের ডান পায়ে পারা দেয়।শানের অন্তরাত্মা বেরিয়ে আসারর উপক্রম যেন।কারণ এটা সেই পা যে পা, কাল সকাল রডের আঘাতে খত হয়েছে।

ব্যথায় চোখ মুখ কালো করে পা চেপে ধরে শান।পাখি অনুতপ্তহীন চোখে সেদিকে চেয়ে রাফিকে বলে,”গাড়ি থামাও।”
রাফি কথা না শুনেই গাড়ি চালিয়ে যায়।তিরিক্ষি মেজাজে আবার বলে,”গাড়ি থামাতে বলেছি না?নইলে কিন্তু,নইলে কিন্তু লাফ দিবো এই মূহূর্তে”
পাখির কথায় শান আরো শক্ত করে চিপে ধরে ওর হাত।
রাফি দ্রুত ব্রেক কষে নেয়।শান চট করে ডান হাতে পাখিকে নিজের সাথে চেপে ধরে আর অপর হাতে ইশারা করে ওর পায়ের দিকে।

শান ইতোমধ্যে মোজা জুতা খুলে ফেলেছে।পা টা এগিয়ে পাখিকে দেখতে বলে আবার ব্যথায় কাতরিয়ে ওঠে শান।পাখি চমকে দুহাত মুখে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়।
কালশিটে পরা দাগে নতুন আঘাতের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।কেমন যেন চরম অপরাধ বোধে ছেঁয়ে যায় পাখির চোখ মুখ।

শান পাখির দিকে একবার চেয়ে রাফিকে বলে পূনরায় গাড়ি স্টার্ট করতে।পাখি কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থাকে।এরপর মনে মনে বলে,”কি হইছে হইছে আমার কি?আমাকে তিনি সে রাতে অপমান করে তাড়িয়েছে।একবারও কি আমার দিকটা বুঝেছে?তাহলে আমি আজ কেন তার দিকটা বুঝব?”
পরোক্ষণে রাগে চোখ মুখ শক্ত করে পাখি বলে,”ওসব কিচ্ছু দেখতে চাই না আমি।আমি যাবো না, যাবো না, যাবো না আপনার সাথে।”
শান নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,”অতিরিক্ত জিদ ভালো না”
শানের এমন হেয়ালিময় কথায় পাখি আরো রেগে বলে, “দিবো কিন্তু আরেকটা পারা? ”
“হুমম হুমম শিওর”,বলে শান পা টা এগিয়ে দেয়।
পাখি কাচুমচু করে বলে,”না। আপনি আমায় যেতে দিন।আমি আপনার অপমান সহ্য করতে পারব না”

শান কোন কথা না বলে সামনে তাকায়।পাখি ছটফট করতে করতে থেমে যায়।কিছুক্ষন পর গাড়ি এসে থামে আহমেদ ম্যানশনের সামনে।চায়ের দোকানে কতোগুলো ভদ্রলোক চা খাচ্ছে আর খোশগল্প করছে।তাদের মাঝে সেদিনের কয়েকজন মুরুব্বীও রয়েছে।গাড়ির দুপাশের সম্পূর্ণ জানালা খুলে দেয় শান;উদ্দেশ্য ঐ লোকদেরকে দেখানো।লোক গুলো মাথা উচিয়ে ভিতরে দেখার চেষ্টা করে।এরপর নিজেদের মাঝে বলাবলি শুরু করে।

গাড়ি এসে ভিতরে থামতেই শান চট করে দরজা খুলে বাহিরে বের হয়।রাফিকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে পাখির পাশের দরজা টা খুলে দেয়।পাখি ভিতরে থম মেরে বসে রাগে ফুসতে থাকে।তৎক্ষণাৎ ফোন আসে শানের ফোনে।
“সরি স্যার। আমি জরুরী কাজে আটকে গেছি।পারলে মিটিংটা উইথআউট মি কন্টিনিউ করে নিন।”,ফোনে কাউকে বলে পাখির দিকে একনজর তাকায় শান।পাখি সেদিকে রাগি দৃষ্টিতে দেখে ফট করে চোখ সরিয়ে নেয়।

“কাম”,হাত বাড়িয়ে বলে শান।পাখি দুহাত বুকে গুঁজে বলে,”নো”
শান অবাক হয় পাখির এটিটিউড দেখে।আবার বলে,”সিন ক্রিয়েট করবা না, বেরিয়ে আসো”
পাখি শানের দিকে ঘুরে বসে বলে,”সিন আমি নাকি আপনি ক্রিয়েট করছেন?”
পূনরায় ভ্রু নাচিয়ে বলে,”হুমমমম?”

শান বুঝে গেছে এর সাথে তর্ক করে লাভ নেই। তাই আবারও পাখিকে হাত ধরে এক টানে বের করে আনে।
“আরেএএ,আপনি কি পাগল?”,হকচকিয়ে বলে পাখি।শান কোন কথার তোয়াক্কা না করে দ্বিতীয় দফায় কোলে তুলে নেয় পাখিকে।পায়ের ব্যথায় যে টান পরছে তা শানের কুচকানো চোখ মুখে স্পষ্ট। চোখের ইশারায় রাফিকে কিছু একটা বলতেই সে গাড়ি ঘুরিয়ে কোথায় যেন চলে যায়।

পাখি নড়েচড়ে বলে,”কি শুরু করেছেন আজ?কেন কোলে তুলছেন বার বার?”
“বেশি নড়বা না পায়ে ভীষণ ব্যথা লাগছে”,ব্যথাসূচক শব্দ করে বলে শান।শানের জন্যে মনের কোথাও জমানো মায়াটা চেপে ধরলো পাখিকে।শান্তস্বরে বলে,”নামান, আমি একা ভিতরে যেতে পারব”

শান পাখির দিকে সুক্ষ চোখে তাকিয়ে বলে,”তোমায় চেনা হয়েছে আমার”
এরপর পাখিকে এনে বসায় ড্রয়িংরুমের সোফায়।নিজেও মুখোমুখি আরেকটা সোফায় বসে পা টা ডলতে থাকে।পাখি দুহাত কচলিয়ে বলে,”আমি থাকব না”
শান ওর দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয়।এভাবে কয়েক মূহূর্ত কেটে গেলে পাখি উঠে দাঁড়ায়।শান বজ্রকন্ঠে বলে,”এক পাও যদি বেরিয়েছো পাখি আমার থেকে খারাপ কিচ্ছু হবে না”
থমকে যায় পাখি।শানের দিকে চেয়ে মুখ বাঁকায়।যেটা শানের দৃষ্টিগোচর হয় না।

এরপর ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে নিয়ে আসে।শানের সামনে দাঁড়িয়ে বরফের ট্রে টা এগিয়ে দেয় শানের দিকে।থমথমে গলায় বলে,”মেডিসিন কোথায়?”
শান মাথা তুলে তাকিয়ে ট্রে টা হাতে নিতে নিতে বলে,”লাগবে না ”
“ঢং টা ছেড়ে, ইগো টা ভেঙ্গে যদি একটু বলেন তাহলে আমি মেডিসিনটা আনতে পারি।আর আপনি রিলিফ পাবেন একটু।”,চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা বলে দাঁত ক’পাটি কেলিয়ে রাখে পাখি।শান ছোট ছোট চোখে পাখির দিকে চেয়ে ভাবে,”এই মেয়ের সাথে কিছুতেই পেরে উঠছি না”
“কি হলো বলবেন নাকি সঙ এর মতো দাঁড়িয়ে থাকব?”
“আমার ঘরে ওয়ারড্রোবের উপরের ঝুড়িতে”,বলেই শান বরফের একটা টুকরো ট্রে থেকে উঠিয়ে পায়ে ঘষতে থাকে।

খানিক বাদে পাখি মেডিসিনটা হাতে নিয়ে নামে। এগিয়ে দিয়ে বলে, “হুম নিন”
“মেডিসিন লাগবে না, বললাম না!”,ভরাট গলায় বলে শান।
“আপনি ডাক্তার না হনুমান আমার বুঝে আসে না।কি করে কোন ডাক্তারের মেডিসিনে এতোটা ফোবিয়া থাকতে পারে জানা নেই!”,রাগে গজগজ করতে করতে বলে পাখি।মেডিসিন টা শানের কোলে ছুড়ে দিয়ে সোজা বরাবর অপর সোফাটায় বসে পরে পাখি।শান অবাক হয়ে যায় পাখির ব্যবহারে।
“হা করে না তাকিয়ে, ওয়েন্টমেন্ট টা ম্যাসাজ করে নিন”,শানকে উদ্দেশ্য করে কপোট রাগ দেখিয়ে বলে পাখি।শান ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বরফের আরেকটা টুকরো পায়ে ঘষতে থাকে।

“অসহায়কে কখনো সহায়ত্বের খোঁটা দিতে নেই।বিপদে কারো হাত ছাড়তে নেই”,নিজের মাঝে জমানো কষ্টগুলোকে চেপে রেখে বলে পাখি।শানের কানে কথাগুলো ঢুকতেই হাত থামিয়ে পাখির দিকে মাথা তুলে তাকায়।পাখি বসা অবস্থাতেই দুহাঁটুতে সামান্য ঝুঁকে বলে, “সেদিন রাতে ওভাবে একজন অসহায়কে বের করে দেয়া উচিত হয় নি ডাক্তার সাহেব।ঝড় বৃষ্টির রাত ছিলো।এক একটা মেয়ে মানুষ ”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাখি আবার বলে,”ভাগ্যিস রাফি সেদিন সাহায্য করেছিলো।না হলে কি হতো কে জানে!”

“তোমায় কী করে বোঝাই সেদিন কতোটা মানসিক চাপে ঐরকম ডিসিশন নেয়া।তোমার চলে যাবার পর প্রত্যেকটা মূহূর্ত গিল্টি ফিল করেছি পাখি।না চাইতেও বার বার তোমাকেই খুঁজেছি।বুঝে গেছি অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার লাইফে তৃতীয় নারীর আগমন ঘটে গেছে।জানি না কতোটা দীর্ঘ হতে চলেছে সে পথ”,পাখির দিকে এক ধ্যানে চেয়ে শান বলে।
পাখি শানের দিকে তাকিয়ে প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করে;নিরাশ হয়।উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,”জানি না আজ কেন এভাবে নিয়ে আসলেন!জানতে চাইছিও না।তবে আপনার গত দিনের ব্যবহার মনে রেখে আপনার বাড়িতে থাকা জাস্ট অসম্ভব।আমার জীবনে ঐ দিনটা কখনোই ভুলব না আমি।আমি ঠান্ডা মস্তিষ্কে বলছি আমি এ বাড়িতে থাকতে পারব না”

“সরি”,
কানে আসা সরি শব্দটায় পাখির চোখ মুখের রঙ পাল্টে যায়।বিশ্বাস করতে পারছে না শান তাকে সরি বলেছে।শানের দিকে সরুচোখে প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পাখি।শান সেদিকে চেয়ে আবার বলে,”সরি।সেদিন কিছুটা ডিপ্রেসড ছিলাম”
এবার সত্যি সত্যি সরি কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেলো পাখি।নিজের মাঝে ভাব ধরে রেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।বুকের কাছে দুহাত গুঁজে বলে,”আজকের সরি আগামি দিনের ‘গেইট আউট ফ্রম মাই হাউজ, রাই নাউ’
জানি আমি।এসবের কোন দরকার নাই। আমি থাকব না এখানে”

“তোমরা আবার ঝগড়া করছো!”
দরজায় পরিচিত মিষ্টি কন্ঠস্বরটা কানে আসতেই শান পাখি দুজনেই সেদিকে তাকায়।
হাতের চিপসের প্যাকেট থেকে একটা চিপস মুখে পুরতে পুরতে ইনায়াহ্ এগিয়ে এসে বলে,”মুন সাইন তুমি কোথায় যাওয়ার কথা বলছো?”
পাখি কাচুমাচু করে বলে,”ককই ককোত্থাও নাতো”
“তুমি নাকি আমার জন্যে কান্না করতেছো সেই ভোরবেলা থেকে! রাফি চাচ্চু বললো।তাই তো স্কুল থেকে আমায় এখানে নিয়ে আসলো”,পাখির কোলে উঠে বলে ইনায়াহ্।
পাখি রাগান্বিত চোখে রাফির দিকে তাকাতেই রাফি নজর নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।পাখি রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগে শান বলে,”এ ইয়ে মানে,রাফি গাড়ির দিকে যা হসপিটালে যাবো;কাজ আছে।”
রাফি যেন শানের হুকুমের অপেক্ষায় ছিলো।বাহিরে এসে পাখির চোখমুখের রাগের কথা ভেবে হাফ ছেড়ে বাঁচে।

শান ইনায়াহ্’কে আদোর করে চলে আসতেই ইনায়াহ্ বলে,”সান সাইন তুমি দিদাকে বলে দিও আমি এ বাড়ি এসেছি।নয়ত দিদা কান্না করবে”
ও বাড়ির কথা কানে আসতেই শান স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে যায়।মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় শান।ঘোরলাগা চোখে পাখির দিকে তাকাতেই পাখি রাগে, বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।শান মুচকি হেসে বাহিরে চলে আসে।

🌸🌸

“আরে ডক্টর শান, সকাল পিরিয়ডে দেখলাম না যে?”,হাস্যোজ্বল মুখে প্রশ্ন করে শানের কলিগ কম বন্ধু বেশি নাবিদ।
শান হেসে উত্তর দেয়,”আর বলিস না।পার্সোনাল একটু কাজে আটকে গেছিলাম”
“হবে নাকি এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি?”,অফার করে নাবিদ।
কিছু একটা ভেবে শান বলে,”ভর দুপুরে গরম কফি!তার থেকে বেটার কোল্ড কফি।কি বলিস?”,
“ওকে ডান।চল”
দুজনেই এগিয়ে যায় হসপিটাল ক্যান্টিনের দিকে।

“তোর নামে কিসব কথা বলাবলি হচ্ছে।কিছু কি জানিস সে ব্যপারে”,কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে নাবিদ
শান বিজ্ঞের মতো কিছু একটা ভেবে বলে,”বিশ্বাস করিস? এরকম টা হবে?বা হবার চাঞ্ছ আছে?”
“বিশ্বাস করতে চাই।চাই তুই সবটা নতুন করে শুরু কর।গুজব টা কে বাস্তবে রূপ দে শান।জীবন এতোটুকু না, এতো লম্বা”,দুই আঙ্গুলের ইশারায় কম বেশির পরিমান বুঝিয়ে বলে নাবিদ।
এরপর পাখির আগমন থেকে আজকের সমস্ত ঘটনা খুলে বলে নাবিদকে।নাবিদ মুচকি হেসে বলে,”বস্, এবার ফেসে গেছো বস্ ”
“ওসব কিছুই না।বাদ দে”

ক্যান্টিন থেকে জমিয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে যে যার কেবিনে ঢুকে পরে।শান চশমা ঠিক করে কয়েকটা কাগজে চোখ বুলাতেই নরজায় নক পরে।
“কাম ইন”
“স্যার একজন ভদ্র মহিলা এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে।আপনি অফ ডিউটিতে ছিলেন তাই বসিয়ে রেখেছি”,
“পেশেন্ট?”
“তা তো বলতে পারব না স্যার।তবে দেখে মনে হয়েছে বেশ বড়লোক ঘরের হবে হয়ত”
“ওকে, ভিতরে পাঠাও”,বলেই শান পূর্বের ন্যায় কাজে মন দেয়।

“মে আই কাম ইন”,ভরা ভরা নারী কন্ঠ কানে আসতেই শান মাথা তুলে তাকায়।প্রথম নজরে চিনতে অসুবিধা হয় না এই রমনীকে!
মূহূর্তে শানের সারা শরীর রাগে ক্ষোভে কাপতে শুরু করে।
“রিল্যাক্স শান।এভাবে রেগে যাওয়ার কোন মানে হয় না।জাস্ট কিপ ইওরসেলফ কুউউউল”,নিজের মনকে বুঝিয়ে ধাতস্ত করে শান।
এরপর ঠোঁট গোলাকৃতি করে পরপর কয়েকটা নিঃশ্বাস ছেড়ে শান বলে,”ইয়াহ,ইয়াহ কাম ইন মিসেস আহমেদ”

আগত ভদ্র মহিলা শানের সম্বোধনে বিরক্ত প্রকাশ করে। ধীরপায়ে টেবিলের দিকে আগাতে আগাতে বলে,”কতোবার বলেছি ডোন্ট কল মি উইথ দিস টাইপ অফ চিপ সারনেইম ”
শান রাগি চোখে চেয়ে বলে, “এটাই তোমার পদবী। যদি চাও তো আমি তোমার আসল পদবী সম্বোধন করতে পারি।স্টেইপ……”
“ওহহ শান প্লিজ”

” ডাকতে পারি আর কি;যেটা তোমার আসল স্থান।নিশ্চই সেটা মিসেস আহমেদের থেকে বেশি সম্মানের হবে।তবে তোমার কাছে সেটা ভালো না’ও লাগতে পারে।”,তেড়ছাভাবে বলে শান সুক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

“এতো পিঞ্চ মেরে কথা বলো না।”
“পিঞ্চের কিছু নেই।কি কারণে এসেছো বলো।আর বলে দূর হয়ে যাও”,কটাক্ষ করে বলে শান।
“শুনলাম নিউ রিলেশনশীপে গেছো।তাও আবার যেন-তেন না লিভ ইন!”,সামনে বসে থাকা ভদ্রমহিলা তেড়ছাভাবে বলে ওঠে।
শান মূহূর্তে চোখের পাতা বন্ধ করে। কয়েক সেকেন্ড পরে খুলে টেবিলের উপর দুহাত রাখে।ঝুঁকে এসে বলে,”এ্যানি প্রবলেম?”
“নাহ্ প্রবলেমের কি আছে।খুব তো গলাবাজি করতে কোন নারীকেই নাকি বিলিভ করো না আর।জীবন নাকি একা একাই কাটাবে ব্লা ব্লা ব্লা”
“একজীবনে কি সবাইকে দেয়া সবকথা রাখা সম্ভব হয় মিসেস আহমেদ?হয় না। প্রমান? ইন ফ্রন্ট মি”,বলেই শান ভদ্রমহিলার আগা-গোড়া ইশারা করে

“বেশ ভালো তো।বেষ্ট উইশেষ ফর ইওর ফিউচার।তবে বলি কি শান আমাদের সমাজে এখনো লিভ ইন টা পাকাপোক্ত স্থান করে নিতে পারে নি তাই পারলে বিয়ে পর্যন্ত গড়াও সমাজের কাছে সম্মান পাবে”
“উইশ জানানোর জন্যে এসেছো বুঝি!”
ভদ্রমহিলা থমথমে মুখে চেয়ে থাকে শানের দিকে।

“নিজের মতো সবাইকে মনে করো? তোমার মতো নির্দিষ্ট এমাউন্টে যে সবাই বিক্রি হবে আর তারপর বাবার বয়সি লোকের কাছে গা গড়াবে এমন ভাবাটা বোকামি”,স্বাভাবিকভাবেই বলে শান।
স্বগতোক্তি করে বলে,”তারপরেও থ্যাংকস ফর ইওর সাজেশন।এখন ইউ মে গো নাউ”
শেষের কথাটা বলে শান ধীরভাবে দরজার দিকে হাত ইশারা করে বেরিয়ে যেতে বলে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here