#আড়ালে_অনুভবে
#সাদিয়া_আফরিন_প্রতিভা
#পর্বঃ১৮
মৌমিতা:দয়া করে ছেড়ে দাও আমায়।আমি তো ইচ্ছে করে কিছু করিনি।আহহহ..
দীর্ঘ ৩০ মিনিট ধরে আশরাফ এবং কাব্যের হাতে বাজেভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে মৌমিতা।অনেক মিনুতি করেও তাদের থামাতে পারছে না।
আশরাফ:তোর ঐ ছেলের জন্য আমি আজ প্রভা কে পেলাম না।আর তুই বলছিস তোকে ছেড়ে দেবো?
মৌমিতা:আ আমি তো নিরব কে কিছু জানাইনি।আহহ
কাব্য:কিসের প্রমাণ আছে তুই ওকে কিছু জানাসনি?তোর জন্য আমি প্রভা কে ছেলের বউ করতে পারলামনা।আমার কতো বড় লস হলো তুই জানিস!যাহ,তোর দুই দিনের খাওয়া বন্ধ।
কথাটা বলেই ঠাস করে রুমের দড়জা আটকে দিয়ে চলে যায় আশরাফ আর কাব্য।মৌমিতা আহত শরীর নিয়ে অজ্ঞান হয়ে পরে যায় মাটিতে।
বর্তমান—
হুট করে গাড়ি থেমে যাওয়ায় চমকে ওঠে ইশা। ভাবলো হসপিটাল বোধ হয় এসে গেছে।তবে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো এখনো আসেনি।
ইশা:এখানে গাড়ি থামালে কেনো?
উজ্জ্বল:থামাইনি।মেবি টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে।তুমি একটু বসো আমি দেখছি।
উজ্জ্বল এবার নেমে গেলো।ইশা চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলো কতোই না সুখের দিন ছিলো সেগুলো।
কিছুক্ষন পর উজ্জ্বল আবারো গাড়িতে এসে বসে এবং গাড়ি স্টার্ট দেয়।ইশা বরাবরের মতো জানালার দিকে মাথা ঠেকিয়ে দেয়।চোখ বন্ধ করে আবারো ডুব দেয় ভাবনায়।
৫ বছর আগে——
প্রভা আর নিরব এর বিয়ের প্রায় তিন মাস কেটে গেছে।এই তিন মাসে নিরব প্রতিটা মুহূর্তে প্রমাণ করেছে সে তার দিয়াপাখিকে কতটা ভালোবাসে। কিন্তু ইদানিং প্রায় সাত দিন ধরে সবটা কেমন যেনো বদলে যাচ্ছে।সিনথিয়া আগেও আসতো এ বাড়িতে তবে খুব একটা সময় পেতো না।সেখানে সিনথিয়া এখন প্রায় প্রতিদিন আসে এখানে। আর নিরব যখন বাড়িতে থাকে তখন ই।প্রভার সাথে কথা না বলেই সোজা নিরব এর রুমে চলে যায়। প্রথম প্রথম প্রভার মনে কিছু খারাপ চিন্তা বাসা বাধলেও সে তা সরিয়ে ফেলে।ভেবে নেয় যে শালিরা তো দুলাভাই এর সঙ্গে হাসি তামাসা করবেই।
কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু আরো বারতে থাকে। গত ১০ দিন ধরে তো সিনথিয়া বাসায় ই যায় না, এখানেই থাকে।প্রভার সঙ্গে থাকে তেমন টা নয়। বরং প্রভা একটু গল্প করতে চাইলে দে বিরক্ত হয়। প্রভা ক্লাস এর ফাকে নিরব এর সঙ্গে কেবিনে দেখা করতে গেলেও দেখে সিনথিয়া সেখানে বসে আছে।বাধ্য হয়ে ফিরে আসে সেখান থেকে।
,,
ক্লাস শেষ করে মাত্র বাড়িতে এলো প্রভা।নিরব এর বাবা ব্যাবসার সূত্রে বাহিরেই থাকে।বাসায় এসে কোথাও খুজে পেলোনা সিনথিয়া কে।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে ডাইনিং টেবিল এর সামনে গিয়ে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।
সঙ্গে সঙ্গেই তার ফোনে একটা কল আসলো। রিসিভ করতেই দেখলো এটা তাদের পাশের বাড়ির প্রিয়াঙ্কা আন্টি।
প্রভা:আসসালামু আলাইকু আন্টি।কেমন আছেন?
প্রিয়াঙ্কা:আছি ভালোই।তা তুমি কেমন আছো বলো?
প্রভা:আলহামদুলিল্লাহ আন্টি।বেশ ভালো আছি।
প্রিয়াঙ্কা:তা নাহয় বুঝলাম।কিন্তু সিনথিয়া কে তো ইদানিং বাড়িতেই দেখিনা।আবার সেদিন রাস্তায় দেখলাম তোমার জামাই এর সঙ্গে।সব ঠিক আছে তো?
প্রভা:আ আন্টি আপনি কি বলতে চাইছেন?সব তো ঠিক ই আছে।আর সিনথু তো আমার এখানেই থাকে।
প্রিয়াঙ্কা:দেখো মা,আমি তোমার মায়ের মতো তাই বলছি।পুরুষ মানুষের কোনো ভরসা নেই,একটু দেখেশুনে রেখো কেমন?তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি?
প্রভা:আন্টি আপনি এসব কি বলছেন।নিরব তেমন ছেলেই নয়।আমার ওর উপর পুড়ো ভরসা আছে।
প্রিয়াঙ্কা:দেখো বাবু আমরা বাইরের মানুষজন তোমাদের ভিতরের খবর আর কি করেই বা রাখবো।সাবধান করলাম শুধু।কথায় আছে না, সত্য কথা বললে মানুষের গায়ে লাগে।
প্রভা:আন্টি আমি রাখছি।
প্রিয়াঙ্কা:হ্যা হ্যা রাখো।তবে আবারো বলছি, নিজের স্বামীকে নিজের কাছে বেধে রাখতে শেখো।নাহলে পরে পস্তাবে।এই আমি বলে রাখলাম,হুহ..
কথাটা বলেই ফোন টা কেটে দিলেন প্রিয়াঙ্কা। এদিকে প্রভা শত চেষ্টা করেও প্রিয়াঙ্কার বলা কথাটা ভুলতে পারছে না।
ঠিক তখনি কলিং বেল টা বেজে ওঠে।প্রভা গিয়ে দড়জা খুলতেই দেখে সিনিথিয়া আর নিরব একসঙ্গে ভিতরে আসছে।বাকিদিনের মতোই নিরব প্রভা কে পাত্তা না দিয়ে রুমে চলে যায়।সিনথিয়া চলে।প্রভা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরে তার।কগে তো নিরব হসপিটাল থেকে ফিরেই প্রথমে ওকে জড়িয়ে ধরতো আর এখন!
গত এক মাসে নিরব ওকে একদিনের জন্য ও রাতে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে বলে মনে পরেনা প্রভার।আর তার আগে তো প্রভা কে ছাড়া তার ঘুম ই আসতোনা।
প্রভা আর ভাবেনা।সোজা চলে যায় রুমের দিকে। আজ নিরব এর সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করতেই হবে।
দড়জার সামনে জেতেই আবারো ঝটকা খায় প্রভা।দু পা পিছিয়ে রেলিং এর সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকে তার।ভিতরে সিনথিয়া নিরব কে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।নিরব ও কোনো বাধা দিচ্ছে না।
প্রভা ছুটে চলে যায় সেখান থেকে।সিনথিয়া যেই ঘড়ে থাকে সেখানে গিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে। মুখ চেপে ধরে কান্না থামানোর চেষ্টা করে সে।পরক্ষনে আবারো চোখ মুছে নেয় সে।এখনো নিরব কে অবিশ্বাস করতে পারছেনা সে।
পরিকল্পনা করে সিনথিয়ার সঙ্গে কথা বলবে।
প্রায় ৫ মিনিট পর সিনথিয়া রুমে আসলো। প্রভা কে রুমে দেখে সামান্য ভ্রু কুচকালো সে।
সিনথিয়া:আপু তুই এখানে কি করছিস?
প্রভা:তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।
সিনথিয়া:দেখ আমি খুব টায়ার্ড।তুই সর তো এখান থেকে।
প্রভা:তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেনো সিনথু?আগে তো বলতিস না?
সিনথিয়া:এখন আমি কিভাবে কথা বলবো তা কি তোর থেকে শিখতে হবে?
প্রভা:আমি কঅথা বাড়াতে চাচ্ছি না সিনথু।আমি তোকে এটাই জিজ্ঞেস করতে চাই,তুই বাড়ি যাচ্ছিস না কেনো?
সিনথিয়া:হোয়াট!তুই এখন আমাকে এই প্রশ্ন করছিস?
প্রভা:দেখ সিনথু,আমি ভেবে চিন্তেই বলছি।তুই এখানে থাকলে বাহিরের মানুষ অনেকে নানান ধরণের কথা বলে।তুই জানিস আজকে প্রি..
সিনথিয়া:জাস্ট স্টপ ইট!তোর সাহস কি করে হয় আমাকে এই বাড়ি থেকে বেরোতে বলার।মনে রাখিস,বাড়ি টা কিন্তু তোর না।বাড়িটা নিরব ভাইয়ার।
প্রভা:সিনথুউউউ….
নিরব:সিনথু তো ঠিক ই বলেছে।তুমি কোন সাহসে ওকে চলে যেতে বলো।বাড়িটা আমার।তাই এ বাড়িতে কাকে রাখবো না রাখবো সেটা সম্পূর্নই আমার ব্যাপার। (দড়জা থেকে ভিতরে ঢুকে বললো নিরব)
প্রভা:নির তুমি ওর জন্য আমায় ধমকাচ্ছো?
নিরব:নিশ্চুপ
প্রভা:কি হলো চুপ করে আছো কেনো?নাকি আমি এখন পুড়োনো হয়ে গেছি? (নিরব এর কলার চেপে ধরে কান্নারত হয়ে বলে)
নিরব:প্রভায়ায়া..
প্রভা:আমি এখন দিয়া থেকে প্রভা হয়ে গেলাম? (মলীন কণ্ঠে বলে প্রভা)
নিরব চুপ করে থাকে।প্রভা কাদতে কাদতে নিজের রুমে চলে যায়।না খেয়েই শিয়ে পরে বিছানায়।কিছুক্ষন পর নিরব ও এসে শুয়ে পরে। প্রভা এখনো ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে।যেই মানুষটা এক ফোটা চোখের জল সজ্য কররে পারতো না সে আজ ওকে এভাবে কাদতে দেখেও কিচ্ছুটি বলছে না।কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পরে প্রভা।
কিন্তু পরের সকালটা ছিলো অন্যরকম।কানে ধুক ধুক আওয়াজ আসতেই ঘুম টা ভেঙে যায় প্রভার।চোখ খুলতেই ঠোটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে প্রভার।খুশিতে চোখের কার্ণিশে জল এসে ভীর জমায়।নিরব তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।আজ প্রায় এক মাস পর সে তাকে জড়িয়ে ধরলো।প্রভার মন থেকে সকল ভয় কেটে যেতে লাগলো।বরং নিজের ই খারাপ লাগছে।কাল নিরব এর সঙ্গে ওভাবে ব্যাবহার করা উচিৎ হয়নি।আজ অবশ্যই সরি বলে নিতে হবে।
একবার উঠে যাওয়ার চিন্তা করেও উঠলো না প্রভা।সেই শান্তির স্থলে,তার প্রেমিক পুরুষের বক্ষে আবারো ঘুমিয়ে পরলো।
কিন্তু পরবির্তিতে ঘুম ভাঙতেই দেখলো নিরব তার পাশে নেই।তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে পুড়ো বাড়ি খুজলো কিন্তু কোথাও পেলো না, সিনথু কেও না।আজ শুক্রবার তবুও কই গেলো দুজন।
বেশি কিছু না ভেবে রুমে চলে গেলো।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই তার চোখ কপালে উঠে যায়।কারণ বিছানায় একজন লোক শুয়ে আছে।প্রভা ভয় পেয়ে যায়।
প্রভা:আ আপনি কে?আমার ঘড়ে কি করছেন?
নিরব:তা তো তোমার ভালো জানার কথা। (রক্তচক্ষু নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো নিরব)
প্রভা:ন নিরব এ এই লোকটা কে? (দৌড়ে গিয়ে নিরব কে জড়িয়ে ধরে বলে)
নিরব:(এক ঝটকায় প্রভা কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলে)তোর সাহস কি করে হয় আমার বাড়িতে থেকে অন্য একজনের সাথে পরিকিয়া করার?
প্রভা:নিরব এসব কই বলছো তুমি?আমি এই লোকটাকে চিনিও না।আ আপনি বলুন,আপনি এখানে কি করছেন?
লোকটি:টেনশন করোনা জান,তোমার এতো ভয় পেতে হবেনা।তুমি ওনাকে সত্তিটা বলে দাও। আমরা এখান থেকে দূড়ে চলে যাবো।
প্রভা:(ঠাস করে লোকটার গালে চড় মারে) কি আবোল তাবোল বলছেন আপনি?
নিরব:একদম মিথ্যে কথা বলবি না।আর ওনার নাটক করে কি লাভ?
প্রভা:নিরব তুমি আমায় বিশ্বাস করোনা?
নিরব:বিশ্বাস করতাম।তবে এখন আর করিনা।
প্রভা:নিরববব…
নিরব কিছু না বলে সোজা আলমারির কাছে চলে যায়।একটা কাগজ বের করে প্রভার সামনে এসে ছুড়ে মারে ওর মুখের উপর।
নিরব:নেহ,ডিভোর্স পেপার।আমি সাইন করে দিয়েছি।নিজেও সাইন করে নিস,ভেবেছিলাম তোকে পরে বলবো।কিন্তু আর এক মুহূর্ত ও নয়। বেড়িয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।জাস্ট গেট আউট ফ্রম হেয়ার।
বর্তমান—-
গাড়ি ব্রেক করায় হকচকিয়ে উঠলো ইশা।আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো হসপিটাল এসে গেছে।তড়িঘড়ি করে উজ্জ্বল এর আড়ালে চোখের কার্নিশে জমে থাকা জল মুছে নিলো সে।অতঃপর দুজন একসাথে প্রবেশ করলো হসপিটাল এর ভিতরে।
যতটা সামনে যাচ্ছে ইশার বুকের ভিতর ধুক ধুক করছে।হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।যেনো মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
লিফট এ চার তলায় উঠে যায় প্রভা আর নিরব। লিফট থেকে বেড়িয়ে আনমনে কিছুটা সামনে এগোতেই হঠাত করে একটা বাচ্চা ছেলের সাথে সামান্য ধাক্কা খায়।
#আড়ালে_অনুভবে
#সাদিয়া_আফরিন_প্রতিভা
#পর্বঃ১৯ (বোনাস পার্ট) (বিদ্রঃ পরার অনুরোধ রইলো)
সুপ্তি:সরি সরি,আসলে ও বুঝতে পারেনি। অরিস তোমাকে কতোবার বলেছি এভাবে দৌড়োবে না।
বাচ্চা ছেলেটি মাথা নিচু করে থাকে।ইশার সেদিকে খেয়াল নেই।সে তো সুপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে।পাচ বছর পর নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড কে দেখছে সে।আনমনেই বিড়বিড়ালো, “সুপ্তি!”
ইশার কথা কারোর কানে পৌছোলো না।ইশা এবার অবাক দৃষ্টিতে তাকালো অরিস এর দিকে। ঠিক তখনি পিছন থেকে অঙ্কিত একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে এদিকে এলো,
সুপ্তি:দেখেছো অরিস?কিপ্তি কি সুন্দর গুড গার্ল হয়ে থাকে আর তুমি শুধু ছটফট করো।একদম ব্যাড বয় এর মতো।
অঙ্কিত:মোটেই না।আমার বাবাই কি ব্যাড বয়? (কিপ্তি কে কোল থেকে নামিয়ে বললো)
অরিস:না আমি গুড বয়। (বেশ ভাব নিয়ে বললো)
এদের কথা শুনে ইশা আনমনেই মুচকি হেসে উঠলো।এই পিচ্চি দুটোকে একদম ছোট্ট বেলায় দেখেছিলো।তারপর আর দেখার ভাগ্য হয়নি।
কিপ্তি:মাম্মাম আমরা আঙ্কেল এর কাছে যাবো না?
সুপ্তি:হ্যা মাম্মাম যাবো তো।অঙ্কিত চলো, আপনাকে আবারো সরি বলছি কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
ইশা: ন না আমি কিছু মনে করিনি।
উজ্জ্বল:কি হলো ইশা দাঁড়িয়ে পরলে কেনো চলো।
ইশা:হ হ্যা চ চলো।
কথাটা বলেই কেবিন এর দিকে এগোলো ইশা আর উজ্জ্বল।যতই কাছে যাচ্ছে ততই যেনো বুকের ধুকধুকানি টা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
অবশেষে এসে পৌছোলো কেবিন এর সামনে। উজ্জ্বল এবার দড়জা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো।ইশাও ঞ্চের দিকে তাকিয়েই ভিতরে ঢুকলো কিন্তু চোখ তুলে তাকাতেই শ্বাস আটকে গেলো তার।নিজের অজান্তেই দু পা পিছিয়ে দেওয়াল এর সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাড়ালো সে।
পাশ থেকেই একজন ডঃ বলে ওঠে,
ডক্টর: ভালোই হলো আপনারা চলে এলেন ডঃ ইশা এন্ড ডঃ উজ্জ্বল। ইনি ই হলেন ডঃ নিরব মানে আপনাদের পেশেন্ট।মেইনলি ডঃ ইশার পেশেন্ট। রাতের বেলা হঠাত করেই সেন্সলেস হয়ে যায়। আমরা যতটা আন্দাজ করছি ব্রেইন এ অতিরিক্ত প্রেশার পরার ফলে পেইন হয়।আর তা সজ্য করতে না পেরেই জ্ঞান হারায় উনি।দেখুন আপনারা তো ওনার কন্ডিশন জানেন ই,এখন..
ইশা:গিভ মি টেন মিনিটস প্লিজ।
কথাটা বলেই দৌড়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলো ইশা।উজ্জ্বল কিছুই বুঝতে পারলো না তবুও বেশি কিছু না ভেবে নিরব কে চেক করতে শুরু করে।
এদিকে ইশা ছুটে নিজে কেবিনে ঢুকে দড়জা বন্ধ করে দিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পরে।হাত পা কাঁপছে তার।দু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে,ঠোট দুটো ও অসম্ভব কাঁপছে তার।মনে পরে যায় সেদিনের কথা,,
পাচ বছর আগে সেদিন নিরব এর কথা শুনে আর এক মুহূর্তও ও বাড়িতে থাকেনা প্রভা।ডিভোর্স পেপার এ কাপাকাপা হাতে সাইন করে বেড়িয়ে আস্র বাড়ি থেকে।কিছুটা হাটার পর ই হঠাত করে সামনে থেকে হুট করে একটা গাড়ি আসতে দেখে।সে চাইলে সরে যেতে পারতো তবে সেই সময় তার আর বাচার ইচ্ছে ছিলো না।তাই মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে নেয়।
যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে হসপিটাল এ আবিষ্কার করে।এটা বাংলাদেশ নয়,বিদেশ এ। আয়নায় নিজের মুখ দেখেই আতকে ওঠে সে।পরবর্তিতে ধীরে ধীরে জানতে পারে সেদিন এক্সিডেন্ট এর পর সে ছিটকে একটি নদীর পাশে গিয়ে পরে।ঠিক সেই সময় উজ্জ্বল সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে সপরিবারএ এয়ারপোর্ট যাচ্ছিলো। প্রভা কে ঐ অবস্থায় দেখতে পেয়ে দ্রুত হসপিটাল এ নিয়ে যায়।সেখানে অপারেশন এর মাধ্যমে সে বিপদমুক্ত হয় ঠিক ই কিন্তু তার মুখ বাজেভাবে ক্ষতবিক্ষত ছিলো যার কারণে যে কেউ দেখতে ভয় পাবে।পরবর্তিতে ডক্টর রা প্লাস্টিক সার্জারির সিদ্ধান্ত নেয়।যেহেতু উজ্জ্বল বিদেশেই চলে যাচ্ছিলো তাই তখন প্রভা কে সঙ্গে নিয়েই যায়।প্রভা সেই সময় সেন্সলেস ছিলো।বিদেশে এনে প্লাস্টিক সার্জারি করানো হয়।
এক্সিডেন্ট এর প্রায় এক মাস পর প্রভার জ্ঞান ফেরে।সেই সময় থেকে উজ্জ্বল এর পুরো পরিবার তাকে আলাদা করে দেখেনি।নিজের মেয়ের মতো দেখেছে।প্রথমে তারা নাম জিজ্ঞেস করলে প্রভা কোনো উত্তর দেয় নি।পরবর্তিতে জানায় তারা যে নাম দেবে তাই।তখন উজ্জ্বল এর মা প্রভার নাম দেয় মাহমুদা তাসনিম ইশা।
উজ্জ্বল যখন জানতে পারে ইশা মেডিকেল স্টুডেন্ট তারপর সে ওর পরাশোনা আবারো শুরু করায়।যার কারণে ইশা আর এই পজিশন এ আসতে পেরেছে।
ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে ইশা।কান্নাগুলো বর্তমানে দলা পেকে যাচ্ছে।বিডিতে এসে নিরব এর সঙ্গে দেখা হয়েও যেতে পারে এমন ধারণা তার আগেই ছিলো কিন্তু নিরব তো আর তাকে চিনতে পারবে না।তবে পাচটে বছর পর মানুষটাকে এই অবস্থায় দেখতে হবে তা ওর কল্পনার ও বাহিরে ছিলো।এবার বুঝতে পারছে সুপ্তি আর অঙ্কিত ও নিরব কেই দেখতে এসেছে।ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ইশা।সে জানে নিরব এর কন্ডিশন কেমন।
চিৎকার করে কাদতে কাদতে বলে ওঠে,
ইশা:কেনো?কেনো আমার সঙ্গে সব সময় এমনটা হয়?কি পাপ করেছি আমি আল্লাহ?কেনো আমায় প্রতিবার এমন লড়াইয়ের সম্মুখিন হতে হয়?আমি তো কখনো মানুষটার খারাও চাই নি।আমি তো চেয়েছি সে ভালো থাকুক।তাহলে কেনো?কেনো…. (আবারো কেঁদে ওঠে প্রভা)
।।
।।
সবে মাত্র জ্ঞান ফিরলো নিরব এর।তার পাশেই বসে আছে ডক্টর জিসান।এই লোকটা নিরব কে নিজের ছেলের চেয়ে কোনো অংশে কম।চোখে দেখে না।এই হহসপিটাল এ জয়েন্ট করার পর এই তিন বছর ধরে দেখে আসছে সে নিরব কে।ছেলেটাকে দেখেই প্রতিবার তার মনে হয় যেনো পাথর দিয়ে তৈরি।প্রয়োজন ছাড়া কারোর সঙ্গে কথা বলে না।তবুও যেনো এক অন্যরকম মায়া কাজ করে এই ছেলেটার প্রতি।
জিসান:নিরব তুমি একজন ডঃ হয়ে কি করে এতোটা অসাবধান হতে পারো?তুমি নিজেও যানো তো।আর জন্য প্রেজেন্ট এ ব্রেইন এ প্রেশার নেওয়া কতটা ক্ষতিকর।
নিরব:জানি ডক্টর।আর এটাও জানি আপনারা যে এতো কিছু করছেন তার কোনোটাই কাজে লাগবে না,শুধু শুধুই এতো চেষ্টা করছেন আপনারা।আরে যেখানে আমার নিজের ই জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই।আমি নিজেই কোনো ট্রিটমেন্ট করাতে চাই না সেখানে আপনি কেনো এতো ট্রেন্সড হচ্ছেন!
জিসান:জীবনটা এতো সহজ নয় নিরব।এতো সহজেই জীবনের মায়া ছেড়ে দিচ্ছো?আরে মানুষ বেচে থাকার জন্য কতো যুদ্ধ করে সেখানে তুমি কি করছো?
নিরব মুচকি হাসে।
জিসান:নিরব তুমি হাসছো?আচ্ছা নিজের কথা নাই ভাবলে নিজের পরিবারের কথা তো ভাবো।
নিরব:আমার পরিবার!হা হা হা… আমার কেউ নেই ডক্টর।আমার কিছু হলে কারোর যায় আসেনা।কেউ বিন্দুমাত্র কষ্ট পাবেনা।ও হ্যা, একেবারে কেউ কষ্ট পাবেনা সেটা বললে ভুল হবে,হাতে গোণা কয়েকজন হয়তো কষ্ট পাবে তবে তারাও সময়ের ব্যাবধানে ঠিক হয়ে যাবে।
অবশ্য আমার জন্য কারো কষ্ট না পাওয়াই ভালো।আমি মানুষটা বড্ড খারাপ ডক্টর।তাই তো সব কাছের মানুষেরা আমায় ছেড়ে চলে যায়। একজন যে আমার উপর ভীষণ অভিমান করেছে।তাই তো আমায় ছেড়ে চলে গেলো।তবে এখন সেও চায় আমি তার কাছে চলে আসি।আমিও বড্ড ক্লান্ত ডক্টর,বড্ড ক্লান্ত।এই আড়ালে অনুভবের দিন কাটাতে কাটাতে আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি।তবে হয়তো আর বেশিদিন এই যন্ত্রণা সজ্য করতে হবেনা।একবার আমি তার কাছে চলে যাই,তার সব অভিমান দূড় করেই ছাড়বো।
জিসান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।নিরব এর মুখে এমন কথা সে আগেও শুনেছে তবে এই কথার মানে সে বুঝতে পারে নি।তবে এটুকু বুঝেছে কেউ একজন আছে যার জন্য নিরব প্রতিমুহূর্তে তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে।সেই অজানা মানুষটির উপর মাঝেমধ্যে ভিষণ রাগ হয় জিসান এর।পরক্ষণেই নিজের করা ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে যায়।
_______🌼
“ছেড়ে দাও আমায়,ছেড়ে দাও বলছি।আমি আপুর কাছে যাবো।ছেড়ে দাও না প্লিজ,প্লিজ”
হসপিটার এর বেডে বসে পাগলের মতো কথাগুলো বলে নিজের হাত পাশে থাকা নার্সদের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে সিনথিয়া।চোখ থেকে অনবরত পানি পরছে তার।
সিনথিয়াকে এই অবস্থায় দেখে দ্রুত ভিতরে আসে অঙ্কিত সঙ্গে সুপ্তিও।
সিনথিয়া:ভাইয়া দেখ না ওরা আমায় আপউর কাছে যেতে দিচ্ছেনা।আমি আপুর কাছে যাবো। আমায় আপুর কাছে নিয়ে চলনা।আপু নিশ্চই আমায় খুজছে তাই না,যেতে দে না আমায়।কেনো আটকে রেখেছিস এভাবে।
অঙ্কিত:চুপ কর সিনথু,দোহাই লাগে।তুই কেনো বুঝতে পারছিসনা তোর আপু আর নেই।
সিনথিয়া:নাহহহহ,মিথ্যে কথা বলছিস তুই।তোরা আমায় যেতে দিবিনা তো?ঠিক আছে আমিও দেখবো কি করে আটকে রাখিস আমায়।
কথাটা বলেই হাত পা ছিটিয়ে বারবার পাশে থাকা নার্সদের আঘাত করতে লাগলো।তৎখনাক একজন ডক্টর এসে জোড় করে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দেয়।যার ফলে মুহূর্তেই বেড এ লুটিয়ে পরে সিনথিয়া।
অঙ্কিত:ডক্টর আর কতোদিন এমনভাবে চলবে? আমি যে বোনটার এমন অবস্থা আর সজ্য করতে পারছিনা।
ডক্টর:দেখুন মিঃ অঙ্কিত।সিনথিয়া ব্রেইন এ অতিরিক্ত আঘাত পাওয়ার ফলে প্রায় পাচ বছর কোমায় ছিলো।পাচ বছর পর ওর জ্ঞান ফেরে।আর তারপর থেকে এই একমাস এমনটাই চলছে। এমনভাবে বারবার ওনার ব্রেইন এ প্রেশার ক্রিয়েট হলে আমরা কতোদিন ওনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো জানিনা।
অঙ্কিত:আপনি এসব কি বলছেন ডক্টর।প্লিজ এমনটা বলবেন না।আপনি যদি বলেন আমরা ওকে দেশের বাহিরে নিয়ে যাবো।
ডক্টর:তাতেও কোনো লাভ হবে না। আসলে মেইন প্রবলেম টা এটাই যে,উনি বিশ্বাস ই করছেন না যে ওনার আপু আর নেই।আর যতদিন পর্যন্ত উনি এটা বিশ্বাস না করবেন ততদিন আমরা কিছুই করতে পারবোনা।তাই বলছি,আপনারা এমন কিছু করুন যার ফলে উনি সবটা বিশ্বাস করে নেন।এটাই ওনার একমাত্র ট্রিটমেন্ট। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন।
অঙ্কিত:থ্যাংক ইউ ডক্টর।আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করছি।
#চলবে
[