ইচ্ছেমতি পর্ব -১৮+১৯+২০

#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১৮
#শামছুন্নাহার

হলুদ ছোঁয়া অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে ঠিক রাত দেড়টায়।তারপর ঈশার হাত দুটোকে মেহেদি দিয়ে রাঙ্গিয়ে দিল তার বান্ধবী তূবা। মেহেদির কাজ শেষ করতে করতে তখন বাজে রাত দুইটা।

বসে থাকতে থাকতে ঈশার পা ব্যাথা করছে। রুমে এসে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়েই চিৎপটাং হয়ে পাড়ি দিলো ঘুমের রাজ্যে। মিহি,ঈশা আর তূবা থাকবে একরুমে।বাকিরা কে কোথায় আছে কে জানে!
তূবাও ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরলো। ঘুমে চোখ লাল হয়ে আছে,শুয়েই ঘুম দিল তূবাও। তূবা ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মিহি তোয়ালে হাতে নিয়ে ফ্রেশ হতে যায়।

বিয়েবাড়ি হলেও মধ্যরাতে বাড়িটা নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ।একটু টু শব্দ করলেই দেয়ালের সাথে ধাক্কা লেগে ওই শব্দটা ফের কানে বাজে।
সবে ওয়াশরুম থেকে বের হল মিহি। ফ্রেশ হয়ে এখন ভালো লাগছে তার। ঈশার ও তূবার ডিস্টার্বেব কথা ভেবে রুমের লাইট অন করল না সে। মোবাইলের ফ্লাশলাইট অন করে সেটা টেবিলের ওপরে রাখা। এতেই পুরো রুমটায় কোথায় কি আছে দেখা যায়।ফুরফুরে মেজাজে গুনগুন করে গান গাইছে মিহি,সাথে মুখশ্রীটা তোয়াল দিয়ে মুছে নিচ্ছে। মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই চমকে উঠে মিহি। ওয়াসিফ রুমের মেইন দরজার সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। মিহি প্রথমে ভেবেছিল এটা তার চিন্তাভাবনা হয়তো। হয়তো নিজের মনের ভুল। মিহি তৎক্ষণাৎ হাতে চিমটি কাটে এবং বারকয়েক বার পলক ফেলে চোখ দুটোকে ভালো করে ঘষে নিয়ে ফের আয়নার দিকে তাকায়। কিন্তু না এটা সত্যিই। মিহির চমকানো দেখে ওয়াসিফ হাসলো।মিহি ঘাড় ঘুরিয়ে ওয়াসিফকে অবাক স্বরে বললো–“আপনি এখানে?দরজা তো বন্ধ এলেন কি করে? ”
ওয়াসিফ দ্রুত এগিয়ে এসে মিহির মুখ টিপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো–“আস্তে ওরা উঠে যাবে। এদিকে এসো”
বলেই মিহিকে বারান্দায় নিয়ে গেল।
–“ঈশা সকালের আগে আর জাগবে না। এখন যদি আপনি ওকে কোলে নিয়েও চলে যান ও বিন্দুমাত্র টের পাবে না।”(মিহি)
–“ঢুবলি যে ঘুমকাতুরে সেটা আমি ভালো করেই জানি।কিন্তু ওর ফ্রেড যদি জেগে যায় তবে তোমার সমস্যা।”(ওয়াসিফ)
মিহি একবার রুমের দিকে তাকিয়ে বললো–“ঐটা ঈশার থেকেও মরা। ঈশা বললো ও নাকি আরও বেশি ঘুমকাতুরে। “(মিহি)
–“তবে তো ভালোই হল দুজনে রোমান্স করার বেশি সুযোগ আর সময় পাবো।”(ওয়াসিফ)
–“ফাইজলামি বন্ধ করুন আর এখান থেকে যান।” (মিহি)
–“যাবো না।”(ওয়াসিফ)
–” দরজা তো বন্ধ ভিতরে আসলেন কিভাবে?”(মিহি)
–“আগেই ঢুকে পড়েছিলাম। একটু আগে বারান্দায় ছিলাম। ওরা যখন শুয়ে পড়লো, তুমি লাইট অফ করে দিলে? তখন দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।” (ওয়াসিফ)
–“ভালো করেছেন,এখন যান। আমি ঘুমাবো। “(মিহি)
–“একদিন না ঘুমালে কিছু হবে না। বাই দ্যা ওয়ে শুনো,ঢুবলির আলমারিতে তোমার জন্য একটা প্যাকেজ আছে। বলতে পারো গিফট। সকালেই খুলে দেখবে আমি ঢুবলিকে বলে রাখবো।”
–“আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। আপনার দেওয়া জিনিস আমি কেন নিব?”
–“ভালবাসি তাই।”
–“আপনি বাসেন,আমি না। একই কথা বারবার বলি কানে শুনতে পান না? ভালো কোনো ডক্টর দেখান তাড়াতাড়ি। আর আপনি এত কথা বলেন কেন হু”
–” একটা সত্যি কথা বলি? তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারিনা।”
–“আপনি যাবেন এখন?”

ওয়াসিফের পাগলামি যে এভাবে বেড়ে যাবে মিহি তা কস্মিনকালেও ভাবেনি। হঠাৎ শক্ত করে জড়িয়ে ধরায় মিহি যেন একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। মস্তিষ্ক স্থির হতে সময় নিল। এদিকে ওয়াসিফ মিহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিহির কাধে কপাল ঠেকিয়ে দমবন্ধ করে রইল অনেকক্ষন। এরপর নেশাভরা কন্ঠে শুধালো– তুমি আমার কাব্যের মূলভাব ইচ্ছেমতি, যার জন্য আমার প্রতিটা কাব্য রটে।’

মিহির যেন এই মূহুর্তে আবেগী কথাটা ভালো লাগলো না। চোখ মুখ কুঁচকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
–“এসব ডায়লগ সিনেমাতেই মানায় ওয়াসিফ। ছাড়ুন।”
ওয়াসিফ হাতের বাঁধন আলগা করে দিল। মিহির হাত দুটোকে নিজের হাতের মুঠোয় ভরে ঢিমে যাওয়া গলায় বললো–” নিয়তি ফিয়তি বুজি না,আমাকে ছেড়ে যেও না ইচ্ছেমতি। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।”

চোখে ঘুম নেই মিহির। ওয়াসিফের জন্য কেন যেন খারাপ লাগছে। নিয়তির কথা কেন বললো? তবে কি ওনি সন্ধ্যায় বলা কথাগুলো নিয়ে আপসেট?ভাবলো মিহি। ভিতর থেকে ক্লান্তিকর একটা নিঃশেষ ছেড়ে বিড়বিড় করে বললো–“ডায়লগ হলেও সত্যি ওয়াসিফ। আমার কাব্যেও আপনার জন্য এখন প্রতিটা কাব্য রটে!”

সকালে ঈশাকে গোছল করানোর সময় আরেকদফা মজা করল সবাই। এর আগে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নিল। বিয়েবাড়িতে সকালের খাবারের আয়োজন হল ভোনা খিচুড়ি। গোসল শেষে মেয়েরা সাজতে ব্যস্ত হয়ে গেল। ঈশার জন্য বাড়িতেই পার্লারের দুুজন মেয়ে নিয়ে আসা হয়েছে ।পার্লার থেকে লোক এসেছে বলে ঈশা ঈশার রুমে তূবা,মিহিকে ছাড়া কাউকে রাখেনি। বাকিরা অন্যরুমে সাজছে বোধহয়! ছেলেরা মেহমানদের তদারকি করা শুরু করে দিয়েছে।

–“মিষ্টি আপু এই নাও ভাইয়া বললো এটা তোমাকে দিতে!”
–“কি এটা?”
–“জানি না খুলে দেখো।”

তূবা বললো খাওয়ার পর সাজতে বসবে। এই ভ্যাপসা গরমে সেজে খেতে গেলে নাকি ঘামে সাজ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই তূবা পার্লারের মেয়ে দুজনের সাথে খেতে গেছে। এ সুযোগে ঈশা তার শশুড়বাড়ি থেকে পাঠানো সাজপোশাক সব আলমারি থেকে নামিয়ে খাটের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখছে। এরমধ্যেই ওয়াসিফের দেওয়া মিহির প্যাকেজটা হাতে পড়লো। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে ভাইয়া বলেছিলো এটা মিষ্টি আপুকে দেওয়ার জন্য।
মিহি প্যাকেজটা খুলতেই চক্ষু দুটো হয়ে গেল চড়কগাছ। প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে – লাল রঙ্গের একটা শাড়ী,দু’মুঠো লাল রঙ্গের চুড়ি, এক জোড়া ঝুমকো কানের দুল, সাথে একটা গলার হার। বড় হার যেটাকে সিতা হার বলে। একটা চিরকুটও আছে। ঈশা গিফটগুলো দেখে বরাবরের মতো হেসে বললো –“ভাইয়ার চয়েজ বরাবরের মতোই সুন্দর। চিরকুটের ভাগ নিতে যাবো না,ওটা তুমি আলাদাই পড়।”
মিহি মুচকিহেসে চিরকুটটি খুললো। একটার ভাঁজে আরেকটা চিরকুট। একটাতে লিখা-” আজকের সাজটা এগুলো দিয়েই সাজবেন সাহেবা। যদি কথা না শুনো… তবে কপালে শনি আছে।”
চিরকুটটা পড়ে মিহি কপাল কুঁচকালো। গিফট দিল নাকি থ্রেড? তারপর অপর চিরকুটটা খুললো। –” সুখে থাকার চেয়ে তোমার সাথে থাকার লোভটা আমার বেশি। হঠাৎ করে মন চাইলেই শাড়ী পরিহিত তোমায় ব্যস্ত শহরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য হলেও তোমাকেই চাই।ভালোবাসি ইচ্ছেমতি, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। প্লিজ কখনও ছেড়ে যেও না!”

মাঝেমাঝে ভালোবাসা পেলে আমরা কথা বলা হারিয়ে ফেলি। কেন মানুষ ভালোবাসবে! ভালোবাসার মতো কি আদৌ কিছু করেছি? হিসাব মেলাতে পারিনা। কিছু প্রশ্ন মাথার মধ্যে অবিরত ঘোরপাক খায়। কিন্তু তবুও অনেক আদরে এই ভালোবাসা গুলো জমিয়ে রাখি।
দ্বিতীয় চিরকুটটা পড়ে মিহি বুঝলোনা ছেলেটা তাকে নিজের আবেগ প্রকাশ করল নাকি এটা কোনো অনুরোধ! তারপরেও উপহারগুলো যতটা পছন্দ হয়েছে,তারচেয়ে চিরকুট পড়ে মন তার কোটিগুণে ভরে ওঠেছে।
এমন সময় দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। পার্লারের আপু দুইজন চলে এসেছে। মিহি এগুলা একপাশে রেখে গিয়ে দরজা খুলে দিল। তার একসময় ঈশাকে পুতুলের মতো সাজিয়ে দিল। দরজা খুলতেই সবাই উঁকিঝুঁকি মেরে হাসিমুখে বউকে দেখতে এলো।

ঈশাকে সাজানোর আধঘণ্টা পরেই বরপক্ষ এসেছে। মিহি ঈশার বড় বলে গেইট ধরতে যায়নি। সবাই যখন ঈশাকে ছবি তুলতে ব্যস্ত ওয়াসিফ তখন একবার এসেছিল। মিহিকে দেখে বরাবরের মতোই হৃদপিন্ডে ধুকপুকানির শব্দ বেড়ে গেল। তার দেয়া জিনিসগুলো পড়েছে বলে খুশি হল খুব। দুজনের চোখাচোখি হতেই মুচকি হাসলো দুজন। ওয়াসিফ ইশারা দিয়ে বুঝালো -“আমার কাছে তুমি বরাবরের মতোই সুন্দর।”

ঈশাকে শেষ বিদায় দিয়েই মিহিদের স্বপরিবার বাড়ি ফিরে আসে। মিহি আরও ইচ্ছে করেই চলে এসেছে ওয়াসিফের জন্য। ওয়াসিফ বলেছিলো ‘আগামীকাল একসাথে চলে যাবো আজকে থেকে যাও’। মিহি শুনলো না। ছেলেটা দিনদিন বেশিই করছে। যদি আবার কিছু করে বসে? মিহি চায় না তার প্রতি কেউ বেশিই দূর্বল হয়ে যাক। ‘অতিরিক্ত ভালোবাসার ফল অতিরিক্ত কষ্ট ‘কথাটা বাস্তব। এ কথাটা মিহি মানে। ওয়াসিফ যে ধরনের ছেলে… যদি ভবিষ্যতে তাদের দুজনের মিল না হয় তবে?……

চলবে….

(আজকের পর্বটা একটু ছোট হয়ে গেছে। ভুল হলে ক্ষমাদৃষ্টিতে দেখবেন এবং সংশোধন করে দিবেন।অগ্রিম ধন্যবাদ।)#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_১৯
#শামছুন্নাহার

ফাইনাল পরিক্ষার পর মিহির কিছুদিন কলেজ বন্ধ থাকছে । এ সময়ে হঠাৎ ঢাকা যাওয়ার প্যান। ঢাকায় মিলির খালার বাসা। প্যানটা যদিও মিহির নয়,মিহির মা নীলুফা বেগমের। সকালে মিহির খালা সাজেদা বেগম কল করে কি যেন বলেছে এরপর থেকেই নীলুফা বেগম মিহিকে তাড়া দিচ্ছেন ব্যাগ ঘুছাবার জন্য। হঠাৎ প্যান করায় মিহি তার মাকে জিজ্ঞাস করতেই তিনি বলেন–“আমার পায়ের জন্য ডাক্তার দেখাতে হবে, চল।” সকালের প্যানে বিকেল অর্থাৎ আসরের নামাজ পড়েই তারা রওনা হল ঢাকার উদ্দেশ্যে।


ঈশার বিয়ের আজ এগারো দিন। আরুইল্লাহ, ফিরুইল্লাহ কেটে ফের বেড়াতে এসেছে বাপের বাড়ি। শশুড়বাড়ির মানুষগুলো ভীষণ ভালো। এক বাপের এক ছেলে ঈশার স্বামী। ধন দৌলতের অভাব নেই। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের পশ্চিম পাশের বাড়িটাই তাদের। স্বপরিবার আগে ঢাকা থাকলেও এখন নিজের বাড়ি কুমিল্লাতে চলে এসেছে। হাসানও ঢাকা থেকে কুমিল্লাতে জব নিয়েছে। কাজের সূত্রেই হাসানের সাথে ওয়াসিফের পরিচয়। ফেসবুকে কন্টিনিউ কথা হয় বলে সম্পর্কটা আরও বেশি গভীরত্ব প্রকাশ পেয়েছে।

সন্ধ্যা হতে দেড়ি নেই,শেষ বিকেল বললেই চলে। বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে মিহি। দৃষ্টি বাহিরের পরিবেশে স্থির। চারদিকে তাকালেই সবুজ গাছপালা আর পানিসমৃদ্ধ দীঘি। বর্ষাকালীন সময়। আকাশ কখনও হয় ধূসর রঙ্গে তো কখনও হয় সাদা নীল আকাশ। কখন যে বৃষ্টি হয় তার ঠিক নেই। আস্তে আস্তে আধার ঘনিয়ে এলো গগনে। ভালো লাগছে না কিছুই। বাহির থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মায়ের কাধে মাথা রাখলো মিহি। এমন সময়ই ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। হাত- ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল ঈশার কল। কানে তুলেই সালাম বিনিময় করল দুজন।
–“কেমন আছো তুমি?(ঈশা)
–“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমার কি অবস্থা? শশুড়বাড়ির লোকজন সবাই ভালো তো!”(মিহি)
–“হ্যা সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো। (গাড়ির শব্দ পেয়ে) কোথাও যাচ্ছো নাকি?”
–“হু ঢাকা যাচ্ছি।”
–“হঠাৎ? কই ভাবী তো কিছু বললো না?”
–“আপু জানে না। ওখানে গিয়ে তারপর আম্মু জানাবে হয়তো। আম্মুকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। আমারও তো এক্সাম শেষ তাইনা?”
–“কিসের ডক্টর, পায়ের জন্য নাকি?”
–“হুম।”
–“ঢাকা কোথায় যাচ্ছো? ”
–“বসুন্ধরা। ”
–“ওরে…. ওয়াসিফ ভাইয়াকে তো জানাতেই হয়।আমার খালামনির বাসাও ওখানে।”

ওয়াসিফের কথা বলাতে মিহি একবার মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের সাথে মুচকিহেসে ঈশাকে শুধালো
–” কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি কাউকে বলার দরকার নেই ঈশা। ফরিনা আন্টি জানতে পারলে ওনার বাসায় যাওয়ার জন্য জোড় করবে। খবরদার এটা করো না।”
–“ভাইয়া জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে? আমি বলবই। আচ্ছা বসুন্ধরা কোথায় যাচ্ছো? ”
–“সেটা তো বলা যাবে না। তোমাকে তো আরও আগে নয়। আচ্ছা রাখি এখন, পরে আবার কথা হবে।
–“আরে বলে যাও মিষ্টি আ….’
পুরোটা বলার আগে মিহি ফোনটা কেটে দিল। ওয়াসিফ জানতে পারলে বিষয়টা ভালো হবে না। গতবছরে ঠিক এমন সময়ে মিহি বাসে করে ঢাকা যাচ্ছিলো তার খালামনির সাথে। সেই সময়টায় সে খুব এক্সাইটেড ছিল। মাথায় একটা কথাই ঘুরছিল ঢাকা গিয়ে আশিককে ফেসবুকে এড করে নক দিবে। কবির মতো কথা বলা মানুষটাকে সচক্ষে দেখবে। নিজের মনের কথাগুলো সবগুলাই হল শুধু সচক্ষে দেখা হল না। দোষ অবশ্য আশিকের এটা বললে অন্যায় হবে কারন বছরখানেক পর নক দিলে তাও আবার নতুন আইডি, নতুন প্রোফাইল, নতুন সব না চেনাটাই স্বাভাবিক।

রাত নয়’টা বাজে। মিহি ও তার মা এসেই ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। দূরের রাস্তা বলে মিহির খালামনি আগেই খাবার বেড়ে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছিল। ওরা ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে একটু বিশ্রাম করছে। ঘুম আসতেছে না কিন্তু চোখ বন্ধ করে রাখা মিহির। তার ঠিক আধঘণ্টা পর ওয়াসিফের নাম্বার থেকে মেসেজ আসছে। মিহি সিন করল। নাম্বারটা এখন তার চেনা হয়ে গেছে। মেসেজে লিখা __
–” বসুন্ধরা কোন জায়গায় আছো?”

মেসেজটা দেখার পর মিহির একবার রিপ্লাই দিতে ইচ্ছে করল–“কেন? ঢাকা আসছি বলে কি এসুযোগে ওঠাই নিয়া যাবেন?”
কিন্তু না। রিপ্লাই তো দিলোই না বরং ইচ্ছেটাকে ধামাচাপা দিয়ে দিল। ওয়াসিফ যেহেতু মেসেজ করেছে তারমানে ঈশা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বলে দিয়েছে আমরা ঢাকাতে আসছি। ভাবলো মিহি। তারপর কোথা থেকে যেন ঘুমপরিরা এসে ডাকলো তার টেরই পেল না মিহি।মোবাইল হাতেই চোখ বন্ধ করে নিদ্রারত হল সে।

পরেরদিন সকালে নীলুফা বেগমের জন্য ডাক্তারখানায় সিরিয়াল দেওয়া হয় এবং বিকেলে আসরের পর যে গেছে সেই রাত্রির দশটায় এসেছে। সে সময়টা মিহি তার আট বছর বয়সী ছোট্ট খালাতো বোন স্নেহার সাথে সময় কাটিয়েছে। সাজেদা বেগমের বাসা থেকে ইবনে সিনা হসপিটালে বাসে করে যেতে দশটাকা,আসতে দশটাকা কিন্তু সিএনজিতে দেড়শত টাকা লাগে ঐ একি আসা-যাওয়ায়। বনানীর ইবনে সিনা হসপিটাল। ইবনে সিনাতে মিহির খালাতো ভাই জব করে। পরিচিত ডক্টর বলে সেখানেই গেছে তারা। ডক্টর বলেছে পায়ের হাড্ডি ক্ষয় হয়ে গেছে এবং হাড্ডি বেড়ে গেছে। হাড্ডির অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া অংশটুকুর জন্য হাটলে পায়ে ব্যাথা পায়। তবে পায়ে গরম পানি ঢাললে তা মিশে যাবে এবং ঠিকমত ঔষধ সেবন করলে ভালো হবেন বলে ডক্টর জানিয়েছেন। অনেকক্ষণ গল্পগুজব করার পর রাতের খাবার খেয়ে সবাই নিদ্রায় গেলেন।

মিহিরা ঢাকায় আসছে আজকে তিনদিন। এরমধ্যে ওয়াসিফ অনেক মেসেজ দিয়েছে কোথায় আছে জানার জন্য,একবার মিট করার জন্য। শুধু ওয়াসিফ নয় ফরিনা বেগমও অনেকবার কল করেছে। কলগুলো মিহি ইচ্ছে করে ধরেনি আবার ফোন বন্ধ করে রেখেছিল। সকাল গড়িয়ে বিকেল হতেই আরেকটা কান্ড ঘটে। বিকেলে মিহি আর স্নেহা একসাথে বসে গল্প করছে। খালাতো ভাই আবির চলে গেছে তার চেম্বারে। আর দুই বোন গল্প করছে অপররুমে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। মিহি খুলতে গেলেই একই সময় সাজেদা বেগমও আসেন দরজা খুলতে। মিহিকে বলে–“তুই রুমে যা মেহমান এসেছে। না বলা পর্যন্ত রুম থেকে বের হবি না। যা স্নেহার কাছে যা।”
মিহি মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে রুমে চলে আসে। তার ঠিক দশমিনিট পর মিহির মা রুমে আসে। হাতে থাকা ল্যাভেন্ডার রঙ্গের শাড়ীটা এগিয়ে দিয়ে বলে
–“তাড়াতাড়ি সেজে নে। ছেলেপক্ষ তোকে দেখতে এসেছে।”
মিহির বিস্মিত চাহনি–“মানে?”
–“মানে আবার কি?”রেডি হতে বলেছি রেডি হ। আমি ওদিকটা তোর খালার সাথে আছি। তাড়াতাড়ি কর।”

মিহি যেন একটু বিরক্ত হল। মেহমানদের জন্য উচ্চস্বরে কথা বলতে পারছে না। ক্ষীণ কন্ঠে আওড়ালো –“আম্মু এখানেও? ঢাকাতে এসেও তোমার পাত্রপক্ষ দেখতে হবে?”
–“দেখলেই কি আর বিয়ে হয়ে যায় নাকি? আসছিই তো একারনে…. তাড়াতাড়ি কর আমি যাই।”
বলেই তিনি চলে গেলেন। মিহির মাথায় মায়ের বলা ‘আসছিই তো একারনে ‘বলা কথাটা ঘোরপাক খাচ্ছে। পরক্ষনে ভাবলো দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না।এর আগে কতই এসেছে এটা কি আর নতুন নাকি!

মায়ের দেওয়া শাড়ীটা পড়ে বরাবরের মতো একটু লিপস্টিক দিয়ে সাজ সম্পূর্ণ করে। একটু পরেই নীলুফা বেগম এসে মিহিকে ছেলেপক্ষের সামনে নিয়ে গেলেন। মেয়েদের একটা সমস্যা আছে। হাজার পাত্রপক্ষের সামনে গেলেও অর্থাৎ ওই কাজটাতে সে পুরোনো হলেও যখন নতুন কোনো পাত্র পক্ষের সামনাসামনি হতে হয় তখন তাদের ওই সমস্যাটা উঁকি দিয়ে বসে। সে সমস্যাটা হল অসস্তি। মিহির ছেলেপক্ষ দেখতে আসা ব্যাপারটা আজকে নয় বরং চারমাসের উপরে বলা যায় সেই মিলির বিয়ের দিন থেকে শুরু। কিন্তু এখনও তার কেমন অসস্তি লাগে। তবে এবার একটু খারাপ লাগছে ওয়াসিফের জন্য। যেমনটা লেগেছিল প্রথম পাত্রপক্ষ দেখতে আসায় আশিকের জন্য। কথা বলা থেকে মায়া শুরু,মায়া থেকে ভালোলাগা। সেখান থেকেই তাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে চাওয়া। কিন্তু ততদিনে আশিক তাকে ভুলেই গিয়েছিল। মানুষ যা চায় সবকিছু তো আর পাওয়া মানুষের জন্য শুভ নয়। আশিকের থেকেও ওয়াসিফের জন্য এবার একটু বেশিই খারাপ লাগছে। যদি এই সমন্ধটাই শেষ সমন্ধ হয়? বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো মিহির। ভয়ে চোখের কোণে দুফোটা পানি জমে আসে। কিন্তু কার্নিশ থেকে নিচে পড়েনি। পড়েনি নয় বরং পরতে দেয়নি। পাত্রপক্ষের সামনে আছে যে!

–“কি মেয়ে ফোন ধরছিস না কেন?”(ফরিনা)
–” আসলে আন্টি একটু ব্যস্ত ছিলাম আম্মুকে নিয়ে।”(মিহি)
–“শুনেছি আমি। তাই বলে কল ধরে বলাও যায়না নাকি? বসুন্ধরা কোথায় আছিস?”
–“ইয়ে মানে ক ক কেন আন্টি?”
–“কি আমতা আমতা করছিস মিহি? আমিও বসুন্ধরায় থাকি। বল তো কোথায় আছিস? ”
–“কুড়িল চৌরাস্তা। কাজি বাড়ি বলে এ জায়গাটাকে।”
–“চৌরাস্তাতে তো আমিও থাকি। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাথে, রাস্তার উত্তরে। ওয়াসিফকে পাঠাচ্ছি ওর বাইক দিয়ে চলে আয়।”
–“না না আন্টি আম্মু দিবে না। আর আমরা কালকে বা পরশু চলে যাচ্ছি। অন্য একদিন আসবো।”
–“তোর আম্মুকে সহ নিয়ে আয়। নাহলে ফোনটা দে আমি কথা বলি!”
–“আম্মু মিলি আপুর সাথে কথা বলতেছে।”
–” কার বাসায় থাকিস ঠিকানা দে। ওয়াসিফ যাচ্ছে। ”
–“না আন্টি এখন এই রাত্রিবেলা যাবো না।”
–“সকালে আয়?”
–“ঠিক নেই কালকেও কুমিল্লায় ফিরতে পারি।”

একটা মিথ্যে কথা বললে দশটা মিথ্যেকথা বলতে হয় কথাটা সত্যিই। মিহি এতক্ষণ ফরিনা বেগমের সাথে কথা বলছিল। আজকে পাঁচদিন ধরে ঢাকায় আছে মিহি। খবরটা জানে ফরিনা বেগম। এতবার করে কল করছে যদি ইগনোর করা হয় বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাই উপায় না পেয়ে কল ধরে এবং মায়ের ডক্টর দেখানোর বাহানা দিয়ে দেয় মিহি।
রাত তখন নয়’টা। ওয়াসিফ অফিস থেকে চলে এসেছে সেই অনেকক্ষণ আগে। তার মেসেজের রিপ্লাই, মায়ের হয়ে নিজে মেসেজ দেওয়ার রিপ্লাইও যখন মিহি দিচ্ছিল না তখন ওয়াসিফ তার মাকে মিহির ঢাকা আসার কথা জানায়। সে থেকে ফরিনা বেগমের কল দেওয়া শুরু। মিহি যখন কল ধরল ওয়াসিফ তখন মায়ের সামনে বসা। রাতের খাবার খাচ্ছে আর লাউডস্পিকার দিয়ে ফোনের ওপারে থাকা ব্যক্তির কথা শুনছে।

আজকে বিকেলেই মিহি যমুনা ফিউচার পার্কে ঘুরতে বের হয়েছিল খালামনির সাথে আগামীকাল চলে যাবে বলে এবং পরেরদিন সকাল দশটায় তারা কুমিল্লা আসার জন্য রওনা দেয়।

চলবে…
(আজকের পর্বটা সবচেয়ে অগুছালো মনে হচ্ছে। কষ্ট করে পড়ে নিন।)#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_২০
#শামছুন্নাহার

এইচএসসি পরিক্ষার্থীদের রেজাল্ট বের হয়েছে। ঈশার রেজাল্টও ভালো হয়েছে। মানবিক থেকে প্লাস পাওয়া সহজ কথা নয়। হ্যা এ প্লাস’ই পেয়েছে সে। শশুড়বাড়ির লোকজন বেশ খুশি। সেই খুশিতে হাসান তার অফিসের বসসহ কলিকদের মিষ্টি খাইয়েছে। ঈশার রেজাল্টে সবাই খুশি।

ভর্তির ফ্রম টানা শুরু হয়ে গেছে। ঈশার শশুড়বাড়ি বাড়ি থেকে ভিক্টোরিয়া কলেজ একদম কাছেই। তাই সে চায় ভিক্টোরিয়া কলেজে সাবজেক্ট আসুক। বিয়ে ছাড়াও ঈশার আগে থেকেই ইচ্ছা কুমিল্লাতে পড়লে ভিক্টোরিয়া কলেজে বা সরকারি কলেজে অনার্স পড়ার। এখন যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে তাই ঢাকায় পড়ার কথা মাথা থেকে বাদ দেওয়াই শ্রেয় মনে করে সে। স্কুল, কলেজ না ভাল্লাগলেও ভার্সিটিতে পড়ার সখ ঈশার বরাবরের মতোই। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সে বলেছিলো আর পড়বে না। অথচ হাসানের কথা-“পড়ালেখা ছাড়া আমার বাড়িতে জায়গা নাই। সবচেয়ে বড়কথা তুমি ভালো রেজাল্ট করে,ভালো
স্টুডেন্ট হয়েও লেখাপড়া করতে চাওনা,,,এটা তো হবে না। এখানে থাকলে পড়তেই হবে।” অবশেষে আর কি করা! হাসান গিয়ে ভিক্টোরিয়া কলেজের ফ্রম টেনে আসে।

–“কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”
–“হু বলুন না।”
–“তোমার খালাতো ভাই ওয়াসিফ তোমাকে টুবলি ঢুবলি ডাকে ক্যান?”

হাসানের প্রশ্ন শুনে ঈশা খিলখিলিয়ে হাসে। হাসান ফিচেল হেসে বলে–“হাসতে বলিনি কারনটা বলো!”
–” আপনি আমাকে পরে অপমান করবেন না তো?!”
–” বলবে তুমি?”
–” আচ্ছা। ভাইয়ার সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে নিকনেইম দেওয়া। দুষ্টুমি করে যখন যাকে যে নামে মন চায় তাকে সেই নামেই ডাকে। অবশ্য কখনও কেউ মাইন্ড করে না। তবে আমার নামগুলো দিয়েছে তার কারন আছে।(হাত দিয়ে মুখ ঢেকে শেষ কথাটা বলে)
–” কি কারন সেটা তো বলো।”
–“ভাইয়া আগে ঈশু বলে ডাকতো। একদিন ছাদে সবাই মিলে বসে গল্প করছিলাম। তারপর আমি ওয়াসিফ ভাইয়াকে কি যেন বলেছিলাম সে ক্ষেপে গিয়ে আমাকে পুরো ছাদে দৌড়াচ্ছিল। তারপর দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করে পা লেগে একটা ফুলের টব পড়ে ভেঙ্গে গেছিল। এরপর ভাইয়ার কি যে হাসি!সেদিন থেকেই ঈশু থেকে টুবলি ডাকা শুরু করেছে। ”
–“আর ঢুবলি? ”
–” এটা বললে আপনি পরে আমাকে খুঁচাবেন। বলবো না।”
–” না বললে আমি আরেকটা নাম দিব। কি দিব জানো? সেটা হবে ‘পড়াচোর’।
–” পড়াচোর হলে কেউ প্লাস পায়?”
–“বলবা নাকি ডাকবো পড়া…’
ঈশা মুখ ফুলিয়ে অভীমানি কন্ঠে শুধায় –“বলতেছি।”
হাসান একগালে হাসে।
–“ওয়াসিফ ভাইয়ারা একদিন শীতের সময় বেড়াতে আসছিল। শহরে থাকলেও তার দৈনন্দিন সকালেই ঘুম থেকে জাগার অভ্যাস। আমাদের বাড়িতেও সকালে উঠতে হয়। তো আমি খাটে চাদর মুড়ি দিয়ে পড়তে বসেছিলাম,প্রচুর শীত ছিল তখন। ডিসেম্বর না জানি জানুয়ারিতে। কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারি নাই। বাদরটা এসে দেখে আমি না পড়ে ঘুমাচ্ছি। তখন মাথায় একটা টোকা মেরে বলে–“পড়ায় ডুবে গেলি নাকি ঢুবলি?” আমি থতমত খেয়ে ঘুম থেকে উঠলাম।তারপর থেকেই ঢুবলি ডাকে। আগে রেগে গেলেও এখন ভাইয়ার মুখে ভালোই লাগে।”

ফাস্ট চয়েজেই ঈশা রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাবজেক্টে ভিক্টোরিয়াতে চান্স পেয়েছে। ভর্তির ডেইটও ফিক্স করা হয়ে গেছে। হাসান ঈশাকে ভর্তি করাতে নিতে যাবে আগামীকাল। তাই ঈশা মিলির সাথে দেখা করতে কল করেছে। মিহিও সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু ক্লাস শুরু হবে ঈশাদের ক্লাস শুরু হওয়ার পর। মিহি জানিয়েছে সে দেখা করতে পারবে না। পরে একসময় কলেজে দেখা করবে।


আজ কলেজে প্রথমদিন ঈশার, খুবই এক্সাইটেড সে। কলেজ থেকে তাদেরকে জানিয়েছে তাদের ডিপার্টমেন্টের সবাই যেন শাড়ি পড়ে আসে। প্রথম বর্ষের ছেলেরা ল্যাভেন্ডার রঙ্গের পান্জাবির সাথে সাদা পায়জামা। মেয়েরা ল্যাভেন্ডার রঙ্গের শাড়ী,সাদা ব্লাউজ। দ্বিতীয় বর্ষের ছেলেরা মেরুন কালারের পান্জাবি,সাদা পায়জামা। মেয়েরা মেরুন কালারের শাড়ী, সাদা ব্লাউজ। ৩য় বর্ষের ছেলেরা নীল পান্জাবি, সাদা পায়জামা। মেয়েরা নীল শাড়ী,সাদা ব্লাউজ। চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা কালো পান্জাবি, সাদা পায়জামা।মেয়েরা কালো শাড়ী, সাদা ব্লাউজ। পুরো কলেজের ছেলেমেয়েদের ভীষণ সুন্দর লাগছে আজ। মিহির সাথে ঈশার দেখা হয় সেখানেই। আজকে প্রথম বর্ষের নবীনবরণ হলেও লাস্ট ব্যাচের বিদায় দিন।
বড় ভাইয়েরা বক্তব্য রেখে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের স্বাগত জানান এবং সকল স্যার ম্যাডাম বক্তব্য রেখে,লাস্ট বর্ষের স্টোডেন্টদের কয়েকজন বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেন। এ অনুষ্ঠানেই তাদেরকে বিদায় দেওয়া হয়।

সেই আগের মতোই মিহির দৈনন্দিন কলেজ যাওয়া শুরু হয়। মাঝেমধ্যে ঈশার সাথে দেখাও হয় তার। মিলির চারমাস চলছে। অনেকদিন ধরে বাবার বাড়ি আসে না। ডাক্তাররের কথা অনুযায়ী তার শাশুড়িও নড়াচড়া করতে দেননি। ঈশা বাবার বাড়ি বেড়াতে আসতেই ঈশাকে নিয়ে মিলি চলে আসে তার বাবার বাড়ি।
মিলি যেদিন এলো তারপরের দিনই মিহিকে দেখতে আসে। সেই বিয়েটা যেটা ঢাকা যাওয়ায় খালামনির বাসায় এসেছিল। রাতেরবেলা হঠাৎ করে জানিয়েছে তারা সকাল দশটার পরে দেখতে আসছে। ব্যাপারটা শুধু মিহির মা নীলুফা বেগম ছাড়া কেউ জানতো না।

_

গতদিন শুক্রবার ছিল বলে ওয়াসিফ এবং ফরিনা বেগম কাজের সুত্রে কুমিল্লায় এসেছিলেন। দরকারি কাজ। কুমিল্লা পুরাতন চৌধুরী পাড়ায়,ওয়াসিফদের দেশের বাড়ি। ওয়াসিফের অফিসেও এখন কাজের ভীষণ চাপ। আগে শুক্র,শনি দুদিন বন্ধ থাকলেও এখন শুধু শুক্রবারে থাকে। বেশি চাপ হলে মাঝেমধ্যে আবার শুক্রবারেও অফিস যেতে হয়। কুমিল্লা থেকে ঢাকা আসতে আসতে রাত দশটা বেজে যায়। তারপর বাহিরের থেকে খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই মা ছেলে বাসায় ফিরে। এরপর ক্লান্ত শরীর হেলিয়ে দেয় বিছানায়।
সকালে ঘুম থেকে ওঠে ফ্রেশ হয়ে ওয়াসিফ অফিসে চলে আসে। অফিসের একটা ফাইল ঠিক করার জন্য ফোন বের করতেই দেখে ব্যাটারি লো দেখাচ্ছে। রাতে ফোন ঘাঁটা হয়নি বলে ফোনে যে চার্জ নেই খেয়াল করেনি সে। সকালেও তাড়াহুড়ো করে চলে আসা হল। কয়েকটা চাপ পড়তেই মোবাইল একদম বন্ধ হয়ে গেল। কিঞ্চিৎ পরিমাণ রেগে নাক মুখ কুঁচকে মোবাইলটা স্বজোরে রাখলো সে। তারপর ল্যাপটপ বের করে বাকি কাজগুলো করতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

মিহির মা নীলুফা বেগম তার পুত্রবধূকে নিয়ে অনেকরকমের খাবারের আইটেম রান্না করেছে। এটা দেখে মিহি অবাক হল। শুধু মিহি নয় বাকি সবাইও।সবাই একত্রে জানতে চাইলে তিনি বলেন–“ঈশা আসছে,মিলি আসছে,সাজু আসতেছে আমরাসহ আছিনা? তাছাড়া সাজু জানিয়েছে ওর সাথে নাকি দুয়েকজন আসবে। তাদেরকে আপ্পায়ন করা লাগবো না?”
বাড়িতে মেহমান আসছে তাছাড়া মিলি,ঈশা আছে বলে ব্যাপারটা কেউ ঘাটেনি। মিহিও ঘর গুছিয়ে রেখেছে অন্যদিনগুলোর মতোই।
সকাল বারোটা বাইশে সাজেদা বেগম মিহিদের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। তার সাথে দুজন নয় বরং সাতজন দেখে নীলুফা বেগম বাদে বাকি সবাই যেন একটু চমকালো।তারপর মিহি,মিলি,ঈশা অন্যরুমে গিয়ে বসে আলোচনা করছিল।
–“খালামনির সাথে বাকি লোকগুলো আসছে কেন জানিস?”(মিলি)
–“আমি কেমনে জানবো? তুমি জানো!”(মিহি)
–“আমার মনে হয় তোকে দেখতে এসেছে।”(মিলি)
–“আমারও তাই মনে হচ্ছে ভাবী।”(ঈশা)
–“দেখা যাক। দেখলেই তো বিয়ে হয় না।”(মিলি)
–” কিন্তু তাদেরকে আমি চিনি আপু। আম্মুকে নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পর ওখানে আমাকে একবার দেখতে এসেছিল।”
–“তো কি হইছে? যা দুজনে দুই বাথরুমে যা গোসল করে আয়”(মিলি)”

মৃদুল ফোন করেছে। মিলি কথা বলছে। মিহি ও ঈশা গেল গোছল করতে। কথা বলতে বলতে দুপুরে খাবারের সময় হল। সাজেদা বেগমের সাথে আসা লোকগুলো সবাই খাওয়া-দাওয়া করল। নীলুফা বেগমের সাথে কাজ করছেন মিহির ভাবী রুমা।

খাবারের পর মিহিকে দ্বিতীয়বারের মতো আবার পাত্রপক্ষ দেখলো। মিহির সাথে পরিচয় করে দিল তাদের একেএকে করে। পাত্র, তার মা, বাবা,চাচা,চাচি, মামা ফুফা এসেছে। তারপর মিহিকে দেখা হলে তাদের সামনে থেকে অন্য রুমে চলে যেতে বললো।
ঈশা,মিহি,মিলি দরজার ওপারে আড়িপেতে শুনছিল ওনারা কি বলে। মিহি চলে আসার পর ছেলের চাচা বলতেছে
–“মেয়ে আমাদের আগেই পছন্দ হইছে। আমাগো ছেলেটা এতদিন মেলা ঝামেলায় ছিল তাই আগাইতে পারি নাই। এখন আপনি সব জানেনই। সাজেদা আপাও আমাগো সম্পর্কে সব জানে। এখন আপনারা যদি বলেন তাইলে আমরা আগামো।”
মিহির ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। মিহি ঈশা দুজন দুজনের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে শুকনো ঢুক গিলে তাদের দিকে তাকায়। মিহি অপেক্ষা করছে মায়ের উত্তরের জন্য। নীলুফা বেগম বলেন-
–“মেয়ে আমার বেয়াদব না। আমি বা আমরা গার্ডিয়ান যা বলি ও সেটাই করবে। ছেলে আমাদেরও পছন্দ হয়েছে। আমার কোনো সমস্যা নাই।”
–“ওদেরকে একটু একা কথা বলতে দেই তবে!”(ছেলের
চাচি)
–“না না কথা বলতে হবে না বেয়াইন, আমার কথাই আমার মেয়ের কথা।”(নীলুফা)

মিহি সবার সামনে মাকে গিয়ে বলতে চাইল–” আম্মু বিয়েটা আমি করবো না। করতে পারবো না।ওয়াসিফকে একবার জানানোর সুযোগ দাও প্লিজ।আমি বোধহয় তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। দোহাই লাগে মা, মাফ কর। ” কিন্তু একটু আগে মায়ের বলা ‘মেয়ে আমার বেয়াদব না’ কথাটা মনে আসতেই চুপ হয়ে গেল সে। মাথার উপর বটগাছের ন্যায় বাবাটা যে এখন আর নেই। যার বাবা নেই সেই বুঝবে বিষয়টা।

ছেলের বাবা এতক্ষণ কার সাথে যেন কথা বলছিলেন। ফোনটা না কেটেই তিনি বলেলন–” তবে আজই বিয়েটা হয়ে যাক?”
–“আজকেই? আমাদের তো কোনো আয়োজন নেই।”(নীলুফা)
–“আয়োজনের কি দরকার বেয়াইন আমরা তো কেবল মেয়েকে নিবো।”(ছেলের মা)
নীলুফা বেগম একটু আলাদাভাবে সাজেদা বেগমের সাথে কথা বললেন। তারপর তাদেরকে জানান
— “আচ্ছা ঠিক আছে আমার কোনো আপত্তি নেই। আজকেই বিয়ে হোক!”
–“যাক আলহামদুলিল্লাহ তবে বউ নিয়েই বাসায় ফিরতে পারবো।”
বলেই ছেলের বাবা কাকে যেন ফোন করলেন।আধাঘণ্টার মধ্যে একটা কম বয়সী ছেলে লাগেজ নিয়ে হাজির হল। বউ সাজানোর সবকিছু নাকি এখানে আছে। মিহিকে সাজিয়ে দিতে বললো ছেলের মা। মিহির কেন যেন ভয় হচ্ছে। ঈশার হাতটা শক্ত করে ধরে দু পা পিছালো সে। বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার যন্ত্রনায়।মাকে দুবার বলেছেও বিয়েটা করবে না। কিন্তু নীলুফা বেগম যেন আজ কারো কথাই কানে নিচ্ছে না।

মিহিকে সাজানোর দায়িত্বটা ঈশাকে দিয়েছে। মিহি একবার মিলির পায়ে পড়ে গিয়েছিল বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য। বে’চারা মিলি বুঝলই না বোনের মনে কি তোলপাড় চলছে। উল্টো মিহিকে দেখে মিলির কান্না পাচ্ছে বলে সে রুম থেকে বের হয়ে গেছে। মিহি ও ঈশা ছাড়া এখন রুমে কেউ নাই। মিহি দৌড়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আটকে দিল ভিতর থেকে। ঈশাকে জড়িয়ে কান্না করছে সে। মিহির সঙ্গী হল ঈশাও। দুজন দুজনকে জড়িয়ে কান্না করে অনেকক্ষণ। এরমধ্যে ওয়াসিফকে অনবরত কল করছে ঈশা। বারবার উওরে একটাই কথা–“দুঃখিত,কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটি এই মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”

সন্ধ্যার কাছাকাছি। মিহিকে সবার সামনে ডাকছে।হয়তো একটু পরই সে অজানা, অচেনা একজন মানুষের জীবনসঙ্গী হয়ে যাবে।
মিহির গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে হেচঁকি উঠে গেছে তার। সেরকমভাবেই বউ সাজলো সে। ঢিমে যাওয়া গলায় শুধালো –“ঈশা শেষবারের মতো আর একবার ফোন করে দেখোনা প্লিজ! ”
ঈশা কল করল ওয়াসিফকে। লাউডস্পিকার দিয়ে মিহির কাছে হাত বাড়িয়ে দিল ফোনটা। বরাবরের মতো একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে উঠে

–” আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহুর্তে বন্ধ আছে। একটু পরে আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ। ”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here