ইস্ক সাহেবান পর্ব -১৩

#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১৩||

★অন্যমনস্ক হয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ইশরা। ইফতির অসুস্থ চেহারাটি চোখের সামনে ভাসছে। ফুলের মত বোনের এমন বেহাল দশা দেখবে ইশরা ভাবতেও পারে নি। ভাগ্য বলে চালিয়ে দিলেও ইশরার রাগ হচ্ছে। ভাগ্যের উপরই হচ্ছে। কেন এমন ভাগ্যে? এমন ভাগ্যে কে চায়? রাগের মাত্রা বেড়ে যেতেই ইশরা ছাদের রেলিং চেপে ধরে শক্ত করে। ইফতির চেয়েও প্রচন্ড রাগি ইশরা। ইফতি যেখানে শান্তশিষ্ট, নরম মনের মানুষ ইশরা ঠিক বিপরীত। নিজেকে আর নিজের বোন ছাড়া সে কারো সাথে ভালো ব্যবহার করে না। বাবা মায়ের উপরও তার রাগ জমে আছে। বোনের সাথে থাকতে দেয় নি বলেই বাবা মায়ের সাথেও তার খুব একটা বনিবনা হয় না। দিনের অবসত সময়টা সে ইফতির সাথেই কাটিয়ে দিত ফোনকলে। কিন্তু সেই ইফতিই আজ এত দিন ধরে কথা বলছে না। সব কিছু ভাবতেই বুক ফেটে কান্না আসছে।

ফোনে কথা বলতে বলতে ইবাদ ছাদে চলে আসে। ছাদে প্রবেশ করতেই ইশরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইবাদ থেমে গেল। ভেতরে প্রবেশ করলো না। কথা শেষ করে ছাদ থেকে বেরিয়ে আসে। ছাদ থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে যেতেই সিগারেটের গন্ধ নাকে আসে। ভ্রু কুঁচকে ইশালের রুমে উঁকি দিতেই দেখলো চেয়ারে বসে আছে ইশাল। ইবাদ হালকা হেঁসে ভেতরে প্রবেশ করে।

—–এই যে নেশা খোর?

ইশাল ইবাদের দিকে তাকালো,

—–নতুন ট্যাগ?

—-এখানে সিগারেট না খেয়ে ছাদে গিয়ে খা। পাশেই ইফতির রুম, আর স্মেল বাহিরে যাচ্ছে….

—-ওকে… নেক্সট টাইম থেকে….

—–নেক্সট কেন? এখন খাচ্ছিস এখন যা..

—–যাচ্ছি। ইশাল কথা না বাড়িয়ে ছাদে চলে গেল।

ছাদে প্রবেশ করতেই ইশাল আর একটি সিগারেট ধরালো। সিগারেট এ টান দিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো ইশরা। মেয়েটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখলেই ইশালের মাথা খারাপ হয়ে যায়। চোখ সরিয়ে নিলো সে। হাতে থাকা সিগারেটের দিকে তাকিয়ে রইল। ইশরা এগিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।

—-আপনি ডাক্তার?

ইশরার প্রশ্ন শুনে ইশাল তার মুখের দিকে তাকালো,

—-হুম! কেন?

—-স্মোকিং কজেস ক্যান্সার..! আপনারাই বলেন তাই না?

ইশাল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশরা একটু এগিয়ে এলো, একহাত বাড়িয়ে সিগারেট হাত থেকে নিয়ে ফেলল। ইশাল হাতের দিকে তাকিয়ে ইশরার দিকে তাকালো। সিগারেট ফেলে দিয়ে পা দিয়ে চেপে ধরে বলল,

—–ডাক্তার, ডাক্তারের মত থাকুন দেবদাসের ভং ধরবেন না। কথাটা বলে ইশরা ছাদের রেলিংয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ইশালের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এসব কি বলল? অতীত বর্তমানের দুটি কথার এত মিল ভাবতেই ইশালের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। সামনে তাকাতেই দেখলো ইশরা রেলিংয়ের পাশে। দুটি মানুষের মাঝে বিস্তর ফারাক। কথা মিললেই কেউ কারো মত হয়ে যায় না। ধীর পায়ে পিছিয়ে গিয়ে ছাদ থেকে বেরিয়ে আসে ইশাল।

★ ইফতির পরিবর্তন লক্ষ্য করছে ইবাদ। ধীরে ধীরে মেয়েটির পাগলাটে স্বভাব কমে আসছে। শুধু মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ইফতির সুস্থতা ইরফানের কাছে লুকিয়েছে ইবাদ। যদি ইরফান আবারও বিগড়ে দেয়।
ইফতি কে খাবার দিয়ে ইবাদ সামনে বসে পড়ে,

—–আপনি তো নিজের হাতেই খেতে পারেন এখন। খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি…!

—-আজ না খেলে হবে না ডাক্তার? অসহায় মুখ করে কথাটি বলে ইবাদের মুখপানে চেয়ে রইলো ইফতি।
ইবাদ চেয়ার নিয়ে এগিয়ে এসে প্লেট হাতে তুলে নিল,

—-নিন হা করুন। তাড়াতাড়ি এটা ফিনিশ করুন।

—-কিন্তু ডাক্তার…..

—–চুপ…ইবাদের হালকা চোখ রাঙানিতে ইফতি চুপসে গেল। চুপচাপ খেয়ে নিল। খাবার শেষে ওষুধ খাইয়ে ইফতি কে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ইবাদ। রুম থেকে বের হতেই ইরফানের মুখোমুখি হলো।

—-তুই এখানে?

এতক্ষন ইরফান সবটা দেখছিল। কতটা যত্ন সহকারে ইবাদ ইফতির সেবা করছে। একজন ডাক্তার হিসেবে না। তাহলে..? ইরফান কে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইবাদ আবারো বলে উঠলো,

—-কি হলো?

—-না এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তোর সাথে দেখা হয়ে গেল। ইফতি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

—-হ্যাঁ ঘুমিয়ে পড়েছে।

—-ওহ্ আচ্ছা চল।

দুজনেই চলে আসে।

★ ——–আমি ইফতিকে ভালোবাসি ইশাল। আমি ৬টা মাস যার সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম সেই মেয়েটিই ইফতি। আর এটা আমি তখন জানলাম যখন ইফতি অসুস্থ হয়ে পড়ল। আমি আর বলতে পারলাম না যে আমিই ওর ডাক্তার!! কি করে বলতাম তুই বল? যে মানুষ টা সামান্য কথা বোঝে না সে মানুষ কি করে বুঝবে ইশাল। আর সবচেয়ে বড় সত্যি কি জানিস? সেই একই মানুষকে ইরফান ভালোবাসে। ইরফান আমাকে যখন বলেছিল তখন আমি ওর সঙ্গ দিয়েছিলাম। আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম ইফতির সাথেই ওর…. কথাটা বলেই ইবাদ চোখ বন্ধ করে নিল। কিছুক্ষণ পর বলে উঠলো
—নিজেকে অনেক সামলে আমি ওর ট্রিটমেন্ট শুরু করি। স্পেশাল ট্রিটমেন্ট শুরু হওয়ার আগেই তোকে নিয়ে আসি। তুই আমাকে সাপোর্ট করেছিলি। নাহলে এত দূর আমি করতেই পারতাম না। কিন্তু ইশাল? যেদিন সকালে ইরফানের ঘরে গেলাম সেদিন জানতে পারলাম যে?

—-কী জানতে পারলি?

—-ইরফানই ইফতিকে অসুস্থ করে দিয়েছে। ইফতির রক্তে আমি যে মেডিসিন এর নমুনা পেয়েছিলাম সেটাই আমি ইরফানের কাছে পেয়েছি। মুহুর্তেই আমার সবটা অন্ধকার হয়ে গেল। আমি ভাবতে পারছিলাম না। আমি ইরফানের কাছ থেকে ইফতির ট্রিটমেন্ট এরকারনেই লুকিয়েছিলাম। আমি ইফতি কে হারাতে চাই না ইশাল। ওর কন্ঠস্বর আমার সব কিছু শান্ত করে দেয়। ওকে হারিয়ে ফেললে আমি…. ধপ করে বসে পড়ে ইবাদ। ইশাল অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইলো। ইবাদকে ধপ করে বসে পড়তে দেখে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে৷ ছেলেটির মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে মাথা উঁচু করে লম্বা শ্বাস ফেলল। ইবাদের পাশে বসে পড়ে সে। ইবাদের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,

—–আমি তোকে বলেছিলাম তো ইফতির কিছু হবে না? কিছু হবে না ইফতির। আর তোর ইফতি তোরই থাকবে। কেউ কেড়ে নেবে না। আমি কেড়ে নিতে দেব না। এটা তোর প্রাণপ্রিয় শত্রুর প্রমিস। বলেই মৃদু হাসলো ইশাল। ইবাদ উত্তরে কিছুই বলল না। শুধু ইশালের মুখপানে চেয়ে রইলো।

★ছোট বেলা থেকে ইবাদের সাথে ইশালের বনিবনা তেমন একটা ছিল না। বন্ধুমহলে ইবাদ আর ইশাল ছিলো সম্পুর্ণ আলাদা দুটি মানুষ। ইবাদ যেখানে শান্ত ছিল ইশাল সেখানে আগুনের মত ছিল। যেকোনো ভুলে ইশাল ইবাদকে দোষারোপ করতো। কোনো অপরাধ না করেও তার দৃষ্টিতে ইবাদই ছিলো মস্ত বড় অপরাধী। কিন্তু ইবাদ ছিল তার বিপরীত। ইশালের নামে কোনো অপবাদ এলেই তা নিজের ঘাড়ে নিয়ে ইশাল কে সেভ করা ছিল তার একমাত্র ধর্ম। সরাসরি দুজনের ফাটাফাটি হলেও পেছনে দুজন দুজনের জান ছিল। দুজনে যখন ডাক্তার হয়ে বের হলো তখনই ইশাল অনেক দূরে চলে গেছিলো। ইবাদ আর ইশালের খোঁজ পায় নি। কিন্তু একটা সময় ইশাল পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ভেঙ্গে পড়ে। নিজের সাথে ইশাল যুদ্ধ করতে থাকে, টিকে থাকার লড়াইয়ে ইশাল আশে পাশ্র কাউকে পেল না। ইশালের এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী ছিল তার ভালোবাসার মানুষ। ভালোবাসার মানুষটাই যে তার চারপাশ এভাবে বিষিয়ে দেবে ইশাল ভাবতে পারে নি। ঠিক সে মুহুর্তে ইবাদের হাত ধরে বেরিয়ে আসে সেই পরিস্থিতি থেকে। বন্ধু মহলের কোনো বন্ধুই ছিলো না। যাকে ইশাল শত্রু মনে করতো সেই মানুষটিই ইশালকে সঙ্গ দিয়েছে দুঃসময়ে। পুরোনো কথা ভাবতেই ইশালের মাথা খারাপ হয়ে গেল। রেলিং ঘেষে বসে পড়লো ছাদের কিনারায়,

——শত্রু ভেবেছিলাম আমি তোকে। কিন্তু কোনোদিন শত্রুতা করি নি। যে তুই আমার জীবনের সমস্ত দাগ মুছতে ব্যস্ত সেই আমি তোর জীবনে নিজের অজান্তে এত বড় একটা দাগ বসিয়ে দিলাম। আমি নিজেকে সত্যিই তোর শত্রু হিসেবে প্রমাণ করলাম। আমি মানুষই না শা’লা। নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটাকেই আমি…… বলেই দু হাতে মাথা চেপে ধরলো ইশাল।

দূর থেকে ইশালকে নিজের মাথার চুল নিজে টানতে দেখে ইশরা কপাল কুঁচকে নিল। এই ঠান্ডায় লোকটা ছাদের বসে আছে কেন? অদ্ভুত..! ইশরা এগিয়ে গিয়ে ইশালের পাশে বসে পড়ে। ইশরার উপস্থিতি টের পেতেই নিজের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিল সে। ইশরা তার দিকে তাকিয়ে বলল,

—–কি ব্যাপার এখানে বসে আছেন যে?

এ কয়দিনে বেশ ভালোই ভাব হয়েছে দুজনের। ইশরা প্রয়োজনে ইশালের কাছেই ছুটে আসে। একটি বদমেজাজী মেয়ের আবদার, প্রয়োজন মেটাতে ইশাল নিজেকে সর্বক্ষণ প্রস্তুত রাখে। ইশালকে চুপচাপ দেখে আবারাও জিজ্ঞেস করলো,

—–কি হলো ডাক্তারবাবু?

—–কখনো কখনো নিজের কর্মের প্রতি ঘৃণা হয়। কারণ ফলস্বরূপ প্রিয়জনদের কষ্ট আর আর্তনাদ চোখের সামনে ভাসে।

—–এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না। কারণ আগে এটা জানতে হবে ওটা ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছেন নাকি অজান্তেই….

—-অজান্তে..

ইশরা ঘুরে আসন পেতে বসলো।

—–মাঝে মাঝে হয়ে যায়। অজান্তে নিজের প্রিয়’র চেয়ে প্রিয় মানুষ গুলোর ক্ষতি আমাদের দ্বারা হয়ে যায়। আসুন একটা গল্প বলি? আমি খুব ছোট ছিলাম। তো একদিন আমরা সবাই খেলছিলাম। খেলতে খেলতে একটি মেয়ে আমাকে ধাক্কা দিলো, আমি পড়ে গেলাম। আমার মেয়েটির উপর রাগ বসে গিয়েছিল। ও আমাকে বিনাকারণে ধাক্কা কেন দিলো। আমি ওকে আঘাত করতে গিয়ে ইফতি কে আঘাত করে ফেললাম। নিজের অজান্তেই নিজের বোন কে আমি আঘাত করে বসি। আমার তখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছিলো। আঘাত টা আমি অজান্তেই করেছি, পরে যখন জেনেছি যে যাকে আঘাত করেছি সে আমার বোন ছিল তখন, আমি আমার সেই ভুল টা শুধরে নিলাম। আমার বোনের সেবা যত্ন করে সুস্থ করে তুললাম।
আমি এটা তো জানি না আপনি নিজের অজানতে কি ভুল করেছেন তবে একটা কথা বলবো, যাই করে থাকুন সেটা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করুন। এভাবে একা একা বসে নিজেকে দোষ দিলে তো ঠিক হয়ে যাবে না? তাই নিজেত ভুল শুধরে নিন। শেষের কথা বলতে বলতে ইশরা নিজের গায়ের শাল খুলে একটু এগিয়ে ইশাল এর গায়ে জড়িয়ে দিল। ইশাল এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ইশরা হালকা হেঁসে বলল,

——আজকে অনেক ঠান্ডা পড়ছে। বেশিক্ষণ বসে থাকবেন না। কথা শেষ করেই ইশরা উঠে চলে গেল। ইশাল মেয়েটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। যেতে যেতে এটা বুঝিয়ে দিলো ইশরা এখন তাকে কি করতে হবে। গায়ে জড়ানো শালের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো ইশাল।

চলবে….???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here