#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-২১||
★ইরফান কে দেখে ইফতি একটু অবাক হলো। পা দিয়ে ফ্লোরে থাকা কাঁচ সরাতে সরাতে এগিয়ে আসে ইরফান। রকিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে বসে পড়ে ইফতির সামনা-সামনি। হাতের কুনুই চেয়ারের হাতলে ঠেকিয়ে দুই হাত একজোর করে থুতনিতে ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে ইফতির দিকে তাকিয়ে আছে। ইফতির শুকনো মুখের দিকে মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইরফান। ইফতি হাতে থাকা বাকি চুড়ি গুলো খুলে ফেলল। চুড়ি খুলতে খুলতে বলল,
—আমার অনেক খিদে পেয়েছে। আমার জন্য খাবার আর পানি নিয়ে আসুন। সারাদিন আমি উপোষ। ইফতির কথা শুনে ইরফান ভ্রু কুঁচকালো। ইরফানকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইফতি বলল,
—কী দেখছেন? কী বলেছি কানে যায়নি? আপনি কী ভেবেছেন আমি কান্নাকাটি লাফালাফি করবো? মোটেও না। এমনিতেও ওই বিয়েতে আমার মত ছিল না। ভালোই হয়েছে। এখন যান আমার জন্য খাবার নিয়ে আসুন।
ইফতির কথা শুনে ইরফান বুঝতে পারলো ইফতি ইবাদের আসল পরিচয় জানে না। ইফতি যদি জানতো ইবাদই ইফতির পছন্দের মানুষ ইফতি এতোক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থাকতো না। একদিক দিয়ে ভালোই হলো। ইরফান পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেন কল দিল।
★ইরফানের হোয়াইট হাউজ বান্দরবানে। সেখানেই সবাই উঠেছে। সারাদিন অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ইফতির কোনো হদিস পেল না। ইবাদ এখনো ফেরেনি। ইশাল ইবাদ কে বার বার কল করেই যাচ্ছে। কিন্তু ইবাদ রিসিভ করছে না। ইশাল বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। পাশে তাকাতেই দেখল ইশরা বারান্দায় বসে আছে। দুজনের বারান্দা পাশাপাশি। ইশরা ফ্লোরে বসে আছে দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে। ইশাল নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ইশরার রুমের দরজা খোলা ছিল। তাই ইশালের আসতে অসুবিধা হয়নি। বারান্দায় এসে ইশরার পাশেই বসে পড়ে ইশাল। ইশরার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে রেখেছে মেয়েটি। সারাদিন হয়তো কিছু খায়নি। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে আছে। কিছু চুল উড়ে উড়ে ঘর্মাক্ত মুখে লেপ্টে যাচ্ছে। ইশাল দূর ঠোঁট উঁচু করে ফু দিতে থাকে। ইশরা কপাল কুঁচকে মাথা দেয়াল থেকে আলাদা করল। পাশে ফিরে ইশাল কে দেখে থতমক্ত খেয়ে গেল। একটু পিছিয়ে রেলিংয়ের পাশে গিয়ে বসল। ঢোক গিলে বলল,
—-আপনি এখানে?
—–না ঘুমিয়ে আপনি এখানে কী করছেন?
—–কিছু না। ঘুম আসছিলো না, তাছাড়া রুমে অনেক গরম। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল ইশরা।
—-আপনি অনেক বদলে গেছেন।
—-এতক্ষণে মনে হলো?
—ইশরা?
—হুম?
—-আম’সরি। ইশরা চটজলদি ইশালের দিকে তাকালো। ইশাল একটু এগিয়ে এসে বসলো,
—-অনেক চেষ্টা করেও আপনার কন্টাক্ট নাম্বার পাইনি। আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু….
—এসব থাক। আপনি যান ঘুমান রাত অনেক হয়েছে। কথাটি বলেই ইশরা উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিকে পা বাড়াতেই হাতে টান পড়লো। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখল ইশাল হাত ধরে রেখেছে। হাতের দিকে তাকিয়ে ইশালের দিকে একবার তাকালো ইশরা। অন্ধকারেও ইশালের ফর্সা মুখ আবছা দেখা যাচ্ছে। হাফ ফ্রেমের চশমাটার গ্লাস চিকচিক করছে। ইশরা চোখ সরিয়ে নিল। নিজেকে আর দুর্বল করে ফেলতে চায় না সে। অনেক কষ্টে নিজের সমস্ত অনুভূতি চাপা দিয়েছে। আর চায় না! চোখ ঝাপসা হয়ে এল। নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,
—-চাইনা! কিছু চাইনা। চলে যান আপনি। আর কষ্ট দেবেন না। ইশরার হাত শক্ত করে ধরে একটানে নিজের কাছে এনে জড়িয়ে ধরলো ইশাল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
—–সরি! বুঝতে পারিনি। মাফ করে দাও। একটা সু্যোগ দাও। নিজেকে ছাড়িয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো ইশরা।
—-আমার মাঝে আর ভালোবাসা নেই। লাভ নেই। রাত অনেক হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ুন। বলেই ইশরা ভেতরে চলে গেল। ইশাল ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। কী করে ইশরার মৃত অনুভুতিদের জাগিয়ে তুলবে সে? ইশরাকে আর হারাতে চায় না। একবার হারিয়ে রাতের ঘুম, দিনের শান্তি সবকিছু হারাম করেছে । আর না! ইশরাকে আর হারিয়ে যেতে দেবে না ইশাল।
★খাওয়া শেষে ইফতি ইরফানের দিকে প্লেট এগিয়ে দিল। ইশারায় হাত মোছার জন্য টিস্যু চাইলো। ইরফান পকেট থেকে নিজের রুমাল বের করে দিল। ইফতি হাত মুখ মুছে বলল,
—–ফ্লোরে কাঁচ কেন রেখেছিলেন? যাতে আমি পালিয়ে যেতে না পারি?
—-তোমার ভয় লাগছে না?
—কী জন্য? কী কারণে? কেন ভয় লাগবে? আপনি বাঘ? নাকি আমি বাঘের খাঁচায়? কোনটা?
—-তোমাকে তোমার বিয়ের আসর থেকে নিয়ে এসেছি আমি। বাড়ির সবাই চিন্তা করছে! কেন এনেছি জানো?
—-কেন এনেছেন? যে কারণেই এনেছেন ভালো করেছেন। বিয়েটা ভেস্তে দেওয়ার জন্য থ্যাংকস।
—-আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি চাই তুমি আমার সাথে থাকো। তোমাকে না দেখে এতটা মাস কীভাবে ছিলাম তুমি জানো? ইরফানের কথায় ইফতি স্তব্দ হয়ে গেল। ইরফানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
—-আপনি বাসেন। কিন্তু আমি না। আমি না আপনাকে পছন্দ করি না আপনার বন্ধুকে। প্রসঙ্গ যদি বেছে নেয়ার হয় তাহলে আপনাদের কাউকেই আমি বেছে নেব না। কারণ আমি অন্য একজনের মাঝে আবদ্ধ। আশাকরি বুঝেছেন? আমার সাথে এই বিষয়ে আর কোনো কথা না বললেই খুশি হবো। ইফতির কথা শুনে ইরফান চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। এগিয়ে এসে ইফতির সামনে বসে বলল,
—-তাহলে শুনে রাখো। হয় তুমি আমার হবে নয়তো আমি তোমায় কারো হতে দেব না। আমার পছন্দের জিনিস আমি না পেলে নষ্ট করে দিতে ভালোবাসি। হয়তো আমার নয়তো কারো নয়।
ইরফানের কঠিন কন্ঠের কথাগুলো শুনে ইফতি হেঁসে উঠল। ইফতিকে হাসতে দেখে ইরফান ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
—-আপনি যত যাই করেন আমি ভয় পাওয়ার পাত্রী নই। যত পাহারা দেওয়ার দিয়ে নিন। খুব বেশি সময় আপনি আমায় আটকে রাখতে পারবেন না। চ্যালেঞ্জ।
—-আপাতত এই চ্যালেঞ্জ শুনে রাখো, তোমার হবু বর আশেপাশেই আছে। তাই তোমাকে এখানে রাখা যাবে না। আমার চ্যালেঞ্জ এটাই ইবাদ জানতেও পারবে না তুমি কখন ওর চোখের সামনে দিয়ে বান্দরবান ছাড়বে।
—-আপনাদের যা খুশি করুন। আপাতত সরুন আমি ঘুমাবো। ইফতির ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে ইরফানের রাগ হচ্ছে। কিন্তু ইফতর মুখের দিকে তাকালেই সেই রাগ উধাও হয়ে যাচ্ছে। মায়াবী চোখের মেয়েটির দিকে তাকালেই সমস্ত গরম মেজাজ টা নিমিষেই বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ের উপর রাগ করে থাকা যাবে না।
★—–ইফতিকে যদি জানিয়ে দিতি তাহলে এতকিছু হতো না। তোর ভুল তুই ওকে তোর পরিচয় বলিসনি। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই ইশালের ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাহিরে আসতেই ইবাদকে দেখে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ইবাদকে চিন্তিত দেখে উপরোক্ত কথাটি কঠিন কন্ঠে শুনিয়ে দিল ইশাল। ইশালের কথা শুনে ইবাদ তার দিকে তাকালো।
—-তোর ও মনে হয় ইফতি পালিয়েছে?
—-হ্যাঁ! কারণ ও তোকে না ও ডাক্তার কে ভালোবাসে।
—-আমার আসল পরিচয় জানলেও এই বিয়েটা হতো না। থেমে যেত। এখন যেমন থেমে গেছে। জানলেও একই ঘটনা ঘটতো। ইবাদের কথা শুনে ইশাল ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
—-মানে? কী বলছিস তুই? ইফতি পালায়নি? না পালালে কোথায় ও?
——আমার আশেপাশেই আছে, হয়তো বেশিক্ষণ থাকবে না।
—–মানে? তুই কী বলছিস? আমি তোর কথার মানে বুঝতে পারছি না।
—– বোঝার মত সেই মন মানসিকতা আপনার নেই। আপনি তো ধরেই নিয়েছেন আমার বোন পালিয়ে গেছে। ইশরার কন্ঠ শুনে পেছনে ফিরে তাকালো ইশাল। ইশরা এগিয়ে এসে ইবাদের পাশে দাঁড়ালো।
—-আপনি যা ভাবছেন আমিও তাই ভেবেছি। কিন্তু হতেও পারে এমন কিছুই না।
—-আবার হতেও পারে এমন কিছু! বলেই ইবাদ ঘুরে রেলিং ধরে দাঁড়ালো।
—-আপনারা কী নিয়ে কথা বলছেন?
—-আপনি না বুঝলে আপনাকে বোঝানো অসম্ভব। চারপাশ চোখ বুলিয়ে দেখুন মি. ফায়াজ। ফারিসের কথা শুনে ইশাল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
—- ইরফান! বলেই মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল ইশাল।
—-হ্যাঁ আমরা সবাই এখানে কিন্তু উনি এখানে নেই। কোথায় উনি? সারারাত কোথায়? রাতেও ওনার রুম খালি ছিল।
—–কিন্তু..?
—–নিজের বন্ধুকে চেনেন না? কখন কী করে তার খেয়াল রাখা উচিৎ। ফারিসের কথা ইশালের কেন জানি না সহ্য হলো না। ঝাঁজালো কন্ঠে বলল,
—-আপনি আমায় দোষারোপ কেন করছেন? আমি কী ওকে বলেছিলাম যে, ইফতিকে কিডন্যাপ কর?
—-এমনটা করলে তো হয়েই যেত। নিজের কপাল কে দোষ দেওয়া ছাড়া তখন আর কোনো উপায় জানা থাকতো না।
—–আপনি..
—–থামুন! কী শুরু করেছেন? ঝগড়া বন্ধ করুন প্লিজ। শুনুন…
ইশরার কথায় ইবাদ পেছনে ফিরে তাকালো..
—-আপ….
পরপর তিনটা শুটের শব্দ ভেসে এলো। চারজন ত্রস্ত নয়নে বাহিরের দিকে তাকালো। ইশরা ইবাদের দিকে তাকাতেই ইবাদ বাহিরের দিকে দৌঁড় দিলো। ইবাদের পেছন পেছন ইশাল আর ফারিস ও ছুটে।
চলবে….??
|| ইতি টানতে চাইছি কিন্তু পারছি না কেন? 🤧||