#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-২৩||
★১মাস পর_______
চৈত্র মাসের শেষের দিক। হালকা গরম ভাব অনুভব হয়। হয়তো কিছুদিন পরই গ্রীষ্মের আগমন ঘটবে। বাতাসের পর গরম ভাব টা তারই জানান দিয়ে যায়। ইবাদ নিজের রুমের বারান্দায় বসে আছে। সামনে গরম চায়ের কাপ থেলে ধোয়া উঠছে। যা একটু আগে মারিয়াম রেখে গেছে। ইবাদ একদৃষ্টিতে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। বারান্দার দুপাশে গাছ থাকার সুবাদে ইবাদের ব্যালকনিতে রোদ আসে না। ব্যালকনিটা বেশ ঠান্ডা। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে একটু সূর্যের কিরণ উঁকি দেয়। তাতে অবশ্য খুব একটা গরম লাগে না। ইশাল এসে ইবাদের সামনে থাকা সিঙ্গেল সোফাটাই বসে পড়ে। ইবাদকে বাহিরে তাকিয়ে থাকতে দেখে একবার বাহিরে তাকাল। তারপর টি-টেবিলে থাকা চায়ের কাপের দিকে তাকাল। ইবাদের মনোযোগ পেতে ইশাল গলা খাঁকারি দিল। ইবাদ দৃষ্টি ঘুরিয়ে ইশালের দিকে তাকাল।
—কী হলো?
—-এক মনে, এক ধ্যানে কী দেখছিলি?
—-কিছু না। বলেই চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিল ইবাদ। মারিয়াম এসে আরো এককাপ চা রেখে গেল। ইশাল মারিয়াম কে বলল,
—–মারু!
—–জি ভাইয়া?
—-আমি এখনই চা খাবো না। বাহিরে যাবোতো।
—–আচ্ছা। মারিয়াম চা নিয়ে চলে গেল।
ইশাল ইবাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
——-আজ ইফতিকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিবে। তুই যাবি না? ইশালের কথা শুনে ইবাদ তাকালো। চায়ের কাপ রেখে বলল,
—–গিয়ে কী হবে? এমনিতেও ভালো লাগছে না। তোরা যা।
——ইবাদ এই একমাসে তুই একবারও ওকে দেখতে যাসনি। এমন টা না যে তোর সময় নেই। তুই ইচ্ছে করেই যাসনি। যাওয়ার কথা বললেই হাজার বাহানা দিয়েছিস যেমন এখন দিচ্ছিস। কেন এমন করছিস? মেয়েটা অনেকবার তোর খোঁজ করেছে! ইশালের কথা শেষ হতেই ইবাদ হালকা হাসলো।
——-তোর সমস্যা কী জানিস? তুই সব জেনেও আমার সমস্ত কিছুর খবর রাখার পরও বোকার মত কাজ করিস। তুই যা আমি যাবো না। সাবধানে পৌঁছে দিস।
—–তোকে কিছুই বলার নেই। বলেই ইশাল উঠে দাঁড়ালো। সামনের দিকে পা বাড়াতেই ইবাদ পিছু ডাকলো।
——শোন!
——-কী?
—–ইরফানের কথা জিজ্ঞেস করে?
——-এখনো করেনি।
——না করলেই ভালো। আর যদি করে তাহলে সামলে নিস। সত্য ধামাচাপা দেওয়ার দায়িত্ব তোর।
——হুম। গেলাম।
—–যা। ইশাল চলে যেতেই ইবাদ উঠে রেলিংয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশপানে একবার তাকালো। হয়তো ইরফান কে মিস করছে। ইরফান নেই! না আছে এই পৃথিবীর বুকে, না আছে তাদের কাছে। ইরফান চলে গেছে অনেক দূরে। সেদিন ইফতি যখন জ্ঞান হারিয়ে খাদের দিকে ঢলে পড়ছিল। ইবাদ ইফতিকে ধরতে হাত বাড়ালে ইরফান ইবাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ইবাদ কিছুটা দূরে ছিটকে যায়। আর ইরফান ইফতির হাত ধরে ইফতিকে টেনে ইবাদের বুকের দিকে ঠেলে দিলো। কিন্তু ইরফান নিজে বাঁচতে পারেনি। জায়গাটা নিচের দিকে ঢলে থাকায় ইরফান টাল সামলাতে না পেরে খাদে পড়ে যায়। ইরফান পড়ে যাওয়ার সময় ইবাদ ইফতিকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে গেলেও ইরফান কে ধরতে পারেনি। অতল, গভীর খাদে ইরফান তলিয়ে যায়। আর ইফতি? ইবাদ ইফতিকে ছেড়ে দেওয়ার ফলে ইফতি পাহাড় থেকে পড়ে যায়। গড়াতে গড়াতে ইফতি নিচে চলে আসে। এতে ইফতি অনেক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তারপর থেকেই ইফতি হাসপাতালে অ্যাডমিট। আজ এক মাস পর ইফতি বাড়ি ফিরবে। ইবাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল,
——যেতে যেতে সবচেয়ে বড় অবদান আমার জীবনে রেখে গেলি। ঋণী করে গেলি আমায় আজীবনের জন্য! তোর ঋণের ভার আমি আজীবন বয়ে বেড়াব।
এই একমাসে ইবাদ একবারও আসেনি। আজও না। ইফতি বার বার দরজার দিকে তাকালো কিন্তু না ইবাদের দেখা মিলল না। ইশাল, ইশরা, ফারিসদের দেখেই ইফতি দরজার দিকে তাকালো।
——ইশরা!
—-হু।
——আর কেউ আসেনি।
——কেউ আসেনি। সবাই ব্যস্ত বাড়িতে। চল
—–আচ্ছা।
ইশরা ইফতিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে নামিয়ে নিয়ে আসে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গাড়িতে ইফতি কে তুলে দিতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। ইফতি গাড়ি থামাতে বললেও থামালো না। ইশাল, ইশরা, ফারিস হাসপাতালের সামনেই দাঁড়িয়ে রইল।
★গাড়ি থামলো মাহসান বাড়ির সামনে। এইবাড়ি চিনতে ইফতির একটুও কষ্ট হলো না। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির চারপাশ একবার দেখে নিল ইফতি। বাড়িটা মরিচবাতি দিয়ে সাজানো। পুরো বাড়ির পরিবেশ কিছুটা আলাদা। ইফতি ভেতরে যাওয়ার আগেই নাহিদা বেগম বেরিয়ে আসেন। ইফতিকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলেন।
—–আয়!
—–মা এখানে?
—–আগে আয় তারপর দেখবি। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো ড্রয়িংরুমে একজন উকিল বসে আছেন। আর অন্যজন কাজী। ইফতি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই নাহিদা বেগম বলল,
—–পুরো একমাস তুই ছিলি না ইফতি। ইবাদ বাড়ির সাজ খুলতে দেয়নি। এই বাড়ি সাজানোর উদ্দেশ্য ছিল তুই এইবাড়িতে বউ হয়ে আসবি। কিন্তু তা হলো না। তাই ইবাদ এই সাজ রেখে দিল। আর আজকেই তোর নানা সব ব্যবস্থা করেছেন বিয়েটা আজই হবে ইফতি।
——কিন্তু…..
——আর কিন্তু না। চল তুই আমার সাথে। ইফতিকে রুমে নিয়ে গিয়ে একটি গোলাপি শাড়ি পরালো। হালকা সাজ। অল্পকিছু গহনা। তারপর নিচে নিয়ে আসে। সোফায় বসানোর পর ইফতি আশেপাশে একবার দেখলো। ইবাদকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ইফতি। কাজী বিয়ের কার্য শুরু করার একটু আগেই ইবাদ এসে ইফতির সামনের সোফায় বসে পড়লো। ইবাদকে এক নজর দেখে ইফতি নেত্রমণি নত করে নিল। ইবাদ একবারও ইফতির দিকে তাকালো না। বিয়ে পরানো শেষে সবাই যখন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠলো তখন ইবাদ চলে গেল। ইফতি ডাকতে চেয়েও পারলো না। কত কত কথা জমে আছে অথচ কিছুই বলতে পারছে না। ইবাদ সুযোগই দিচ্ছে না। সুস্থ হলেও ইফতির শরীর যথেষ্ট দুর্বল। তাই দুপুর গড়াতেই ইফতি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। মৃদু বাতাসে উড়ছে রুমের পর্দা। খাটের চারপাশে থাকা পর্দাগুলোও দুলছে মৃদুভাবে। খাটের মাঝখানেই আছে গোলাপি কাতান শাড়ি পরিহিত নিদ্রাগত ইফতি। দরজা খুলতেই একটি মিষ্টি ঘ্রাণ এসে ইবাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় ছুয়ে দিল। ইবাদ চোখজোড়া বন্ধ করে নিল। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে খাটের পাশে দাঁড়ালো। পর্দা সরাতেই সর্বপ্রথম ইফতির নিদ্রাগত মুখশ্রীর দিকে নজর পড়লো। ইবাদ পাশেই বসে পড়লো। দুহাত ভর্তি চুড়ি, হাতে মেহেদী। আজকেই দিয়েছে যার কারণে ঘ্রাণ ইবাদের নাকে অনায়াসে আসছে। ইবাদ ইফতির বামপাশে এক হাত, আর ডান পাশে একহাত রেখে ইফতিকে দুহাতের মাঝে আবদ্ধ করে নিল। একটু ঝুঁকে বলল,
—–সেদিনের পাগলামি আমি কোনোদিন ভুলবোনা সাহেবান যেদিন আপনি বার বার বলছিলেন আপনি কাউকে ভালোবাসেন। কপালে চুমু দেওয়ার জন্য অনেকটা কাছে চলে আসে ইবাদ। কিন্তু দিলো না সরে এল। উঠে দাঁড়িয়ে হালকা হেসে বলল,
——একটা মাস আমাকে না দেখে যতটা কষ্ট আপনি পেয়েছেন ততটা কষ্ট আপনাকে দেখা না দিয়ে আমি পেয়েছি। আর খুব বেশি না, কয়েকঘন্টা অপেক্ষা করুন। বলেই পর্দা টেনে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে ইবাদ।
★ফোন বাজছে! ঘুমটা ফোনের রিংটোন এর শব্দে ভেঙ্গে গেল। ইফতি উঠেই ফোন রিসিভ করলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল ইশরার ত্রস্তব্যস্ত কন্ঠস্বর।
——-ইফতি দাদু হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আমরা তাই আজকে এখানেই থাকবে। তুই প্লিজ একটু ম্যানেজ করে নে। আর হ্যাঁ ভয় পাস না কেমন?
—অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মানে? দাদুতো সকালেই এখানে ছিল।
—–হ্যাঁ ছিল। কিন্তু একটা কাজে এসেছিল ওরা এদিকে কিন্তু এখন আর যাওয়া হয়নি। তুই সাবধানে থাকিস।
——সবাই ওখানে?
——হ্যাঁ আচ্ছা রাখছি। ইশরা আর কিছু না বলেই কেটে দিল ফোন। ইফতি কল করতে চাইলো কিন্তু ফোনে ব্যালেন্স না থাকায় তা হয়ে উঠলো না। ফোন রেখে বিছানা ছেড়ে নামলো ইফতি। বারান্দার দিকে পা বাড়াতেই দেখলো বাহিরে অন্ধকার। কয়টা বাজে? তাড়াতাড়ি এসে ফোন হাতে নিয়ে পাওয়ার অন করে। রাত ৯টা! ইফতি একহাত মাথায় চলে গেল।
——এতক্ষন ঘুমিয়েছি আমি? হায় আল্লাহ! কোন দুপুরে শুয়েছিলাম। ইফতি তাড়াতাড়ি ফোন রেখে বেরিয়ে আসে। ড্রয়িংরুমে এসে লাইট অন করে মারিয়াম কে কয়েকবার ডাকলো। মারিয়াম নেই! পুরো বাড়ি অন্ধকার। শুধু ড্রয়িংরুমের লাইট জ্বলছে। মারিয়াম কে ডাকাডাকি করার পর ইফতি পেছনে ফিরতেই ইবাদের সাথে ধাক্কা খেল। সাথে ভয়ও পেল।
——আ আপ আপনি?
—-কেন? আশা করেননি আমায়?
—–না ইশরা ব বলছিল য যে…..
—-কী বলছিল?
—–বা বাড়ি বাড়িতে কেউ নেই।
—–হুম নেই। মাত্র উঠেছেন আপনি?
—–হ্যাঁ।
——যান ফ্রেশ হয়ে নিন। বলেই ইবাদ চলে গেল। ইফতি কিছুই বলতে পারলো না। ইবাদের সামনে সব গুলিয়ে গেল। গাল ফুলিয়ে নিজের রুমের দিকে হাটা দিল। রুমে প্রবেশ করতেই দেখল বিছানায় একটি ব্যাগ রাখা। ইফতি এগিয়ে গেল। ব্যাগের পাশেই রাখা একটি চিরকুট। তাতে লেখা ”Open it up’! ইফতি ব্যাগ খুলতেই দেখলো সাদা শাড়ি। আর একটি বক্সে সাদা আর গোল্ডেন চুড়ি। ইফতির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই দেখলো ড্রেসিংটেবিলের উপর আর একটি চিরকুট। তাতে লেখা ‘ Come to the roof’! ইফতি হাসলো। রুম থেকে বেরিয়ে ছাদের দিকে গেল। ছাদের দরজা বন্ধ। বন্ধ দরজায় লেখা ”I am waiting ‘! দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই ইফতি ভড়কে গেল। পুরো ছাড ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। অন্ধকার ইফতি ভয় পায়। বিকট একটি শব্দ ভেসে আসে। ইফতি দু হাতে কান চেপে ধরলো। আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই দেখলো পুরো ছাদ আলোকিত। ছাদ আলোয় ঝলমল করছে। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ইফতি চারপাশে চোখ বুলিয়ে হাসলো। হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে এলো সেই অতি পরিচিত সেই কন্ঠস্বর,
—–আমার ভেতরবাড়ি এই আলোর চেয়ে হাজার গুণ আলোয় আলোকিত করে দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ সাহেবান! ইফতি পেছনে ফিরে দাঁড়ালো। সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত মানুষটি কয়েকহাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে সেই মোহনীয় হাসি। সেই মোহময় দৃষ্টি। ইবাদ এক কদম এগিয়ে আসে। আর বলে,
——আমার প্রেমমঞ্জিলে আপনাকে স্বাগতম সাহেবান।
চলবে…..??
|| আমার মাথায় কিছু আসে না বিশ্বাস করেন!🙂||