,,পর্ব-২ শেষ পর্ব
#এ_কেমন_ভালোবাসা?
,,জিনাত আফরোজ
পরের দিন সকালে আমাকে আর অভিকে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে আমার শাশুড়ি মা একটু হতাশই হলেন। উনি হইতো ভাবছিলেন অভি আমাকে মেরেছে এটা নিয়ে অনেক কিছু হবে।
আগের মতো হলে হইতো কিছুই হতো না কিন্তু কালকে ওদের আড্ডায় যা শুনছি তারপর না হয়ে পারে না।
নাস্তা দেওয়ার সময় অভির সামনে নিজেকে শান্ত রাখলেও মনকে শান্ত রাখতে পারছি না।
তারপরও অতি কষ্টে মুখে হাসি এনে বলি
– অভি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো মাইন্ড করবে না তো?
অভি আমার কথা শুনে একটু চমকে উঠে আমার দিকে তাকায় কিন্তু আমার চোখ মুখের সরলতা দেখে বলে
– হ্যাঁ বলো তুমি কিছু বলবে আর আমি মাইন্ড করবো ভাবলে কি করে।
– সত্যি সত্যি বলবে কিন্তু,
– আরে হ্যারে সত্যি বলবো, বলো।
– তুমি কি বিয়ের আগে কাউকে পছন্দ করতে?
অভি এবারও চমকে উঠে আমার দিকে তাকায় আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে রাখি।
এবারও আমার চোখে মুখে কিছু না দেখে ও হেসে ওঠে বলে।
– হঠাৎ ২ বছর পর এই প্রশ্ন?
– এ প্রশ্ন তো অনেক আগের, যেদিন মা আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে সেদিন আরও বেশি করে মনে পড়ে। তুমি এতো হ্যান্ডসাম, সুন্দর তুমি কাউকে পছন্দ করো না বা মেয়েরা তোমার জন্য পাগল না এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?
এবার অভি হো হো করে হেসে উঠে বলে
– তাহলে এ ব্যাপার, শুনো মা কি বলছে না বলছে মন খারাপ করো না আর হ্যাঁ কালকের জন্য সরি। আর কখনো এরকম হবে না জান।
আমি বিড় বিড় করে বলি
,,আর কখনো এরকম হওয়ার জন্য তুমি থাকবেও না অভি।
অভি ভ্রু কুঁচকে বলে
– কি বিড় বিড় করছো?
– না, সব ঠিক আছে কিন্তু তুমি কাউকে পছন্দ করো কি-না এটা তো বললে না।
অভি প্রথমে খুব কৌশলে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে কিন্তু আমিও নাছোড় বান্দা আজকে কথা আদায় করেই নিবো। অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর বলে
– একজনকে খুব পছন্দ করতাম তবে সেটা একতরফা ছিলো। মেয়েটা ওর ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে আসতো। আমি দূর থেকে ওকে দেখতাম ওর গ্রামের আসপাশে ঘুরতাম। হঠাৎ একটা কাজে বাবা ঢাকায় পাঠায় এসে শুনি ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ভাবছিলাম সব শেষ করে দিই কিন্তু পরে নিজেকে সামলে নিই। তারপরও মাঝে মাঝে দূর থেকে দেখে চলে আসতাম। কিন্তু বিশ্বাস করো বিয়ের ১ বছর আগে থেকে ওকে ভুলে নতুন করে সংসার করার কথা ভাবি। তাই আর কখনো ওর কাছে যেতাম না। বিয়ের পর আর কখনো ওর কথা একবারও মনে পড়েনি। কারণ আমি তখন তোমাকে পেয়ে গেছি আমার আর কাউকে দরকার নেই।
অভির কথার ধরণে যে কেউ ওকে বিশ্বাস করে নিবে। কিন্তু সত্যিটা কি সেটা তো আমি জানি। অভির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলি
– কত সহজে সত্যি মিথ্যা এক করে বলে ফেললে। তোমার তাকে কেন মনে পড়বে যে তোমার সব সময় সামনেই থাকে।
– কি হলো নাস্তা করছো না যে? মন খারাপ হয়ে গেছে তোমার স্বামী আগে অন্য কাউকে ভালোবাসতো শুনে?
– আরে না কি যে বলো না আমি তো জানি তুমি আমায় কতোটা চাও কতোটা ভালোবাসো।
– হুম, আমি তাহলে যাই নিজের খেয়াল রেখো।
এ বলে অভি আমার কপালে চুমু দিয়ে চলে যায়। ওর এ ভালোবাসা গুলো আগে শরীরে শিহরিত বয়ে আনলেও। আজকে ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। তারপরও শান্ত হয়ে বসে থাকি যা করার দ্রুত এবং সাবধানে করতে হবে। এখানে আর এক মুহূর্তও না।
কার কাছে কথা গুলো শেয়ার করবো বুঝতে পারছি না। ছোট ভাইকে বলবো, ও খুব ইমোশনাল যদি কাউকে বলে দেয়। না-কি বড়ো ভাইয়াকে বলবো। পরে সিদ্ধান্ত নিই কাউকে বলবো না আমার অবর্তমানে ওরা বিপদে পড়ুক তা আমি চাই না।
আম্মাকে কল দিয়ে কান্না করতে করতে বলি
– আম্মা বাবাকে খুব মনে পড়ছে, বাবার অসুস্থতার কথা বলে শ্বাশুড়ি মাকে বলেন আমি আজকে আমাদের বাড়িতে যাবো।
– তোর বাবা তো সারা বছরেই অসুস্থ থাকে, এভাবে আসার দরকার নেই অভিকে নিয়ে আসিস।
আম্মা প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না যদি অভি রাগ করে। কিন্তু আমাকে তো আজকে বের হতেই হবে তাই আরও কান্না করতে থাকি। পরে আম্মা শ্বাশুড়ি মাকে বলে রাজি করায়। আমিও অভির কাছে কল করে কান্না কাটি করি। ও বাবার অসুস্থতা সিওর হয়ে রাজি হয়।
শ্বাশুড়ি মায়ের ঘর থেকে উনার ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশনটা লুকিয়ে ব্যাগে রেখে দিই। যা যোগাড় করার আজকে মধ্যে করতে হবে এই সুযোগ আর আসবে না।
প্রথমে বাবার বাড়ি যাই ওখানে দুপুর বেলা খাওয়া-দাওয়া করে সবাইর থেকে বিদায় নিয়ে ইসমাঈলের বাড়িতে যাই। আমার শাশুড়ি থেকে শুরু করে সবার সাথে দেখা করি।
তারপর দূরে একটা ফার্মেসি থেকে শাশুড়ি মায়ের কথা বলে প্রেসক্রিপশনের দেওয়া ঘুমের ওষুধ কিনে আনি। আর একটা ধারালো ছু*রি দূর থেকে কিনি। যাতে কেউ আমার কাজ শেষ হওয়ার আগে জানতে না পারে।
সন্ধ্যার আগে অভিদের বাড়িতে ফিরে আসি। ও আমি আজকে ফিরে আসবো ভাবেনি। আমাকে দেখে অনেক খুশি হয়। আমিও হাসি খুশিতে রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে শ্বাশুড়ির রুমে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিই। শ্বাশুড়ি মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উনি যদি জানতেন কি কারণে আমি উনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি তাহলে এখনি আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কোন মায়েই চাইবে না তার সন্তানকে কেউ খু*ন করুক। সে যতো বড়োই অপরাধ করুক।
অভি আর আমার জন্য কফি বানিয়ে আনি। ও খুব খুশি হয়ে বলে
– বাহ আজ কাল তো দেখি আমার বউ আমি কিছু বলার আগেই বুঝে যায়। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছিলো কফি এনে অনেক উপকার করছো।
আমি কিছু না বলে মুচকি হেসে ওর হাতে ঘুমের ঔষধের ওভার ডোজ দেওয়া কফি দিই। নিজেও নিই তবে ওর থেকে অল্প। একবার ভাবছি এ পাপ কাজ করবো না কিন্তু আমি আর নিতে পারছি না ইসমাঈল আর ইশানা (আমার মেয়ে) ওরা আমায় আকুল হয়ে ডাকছে আর বলছে মা একে ছেড়ে দিও না ও আমাদেরকে তোমার কাছ থেকে আলাদা করে দিছে। আর তুমি আমাদের কাছে চলে আসো। আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি বেঁচে থাকলে এমনিতেই জেলে যেতে হবে। তার চেয়েও ওদের কাছে চলে যাবো।
অভি আস্তে আস্তে ঘুমের দেশে চলে যাচ্ছে। ওকে বলতেও ঘৃণা হচ্ছে আমি ওকে কেনো কীভাবে মা*র*বো। তবে আমি ডায়েরিতে লিখে যাচ্ছি কেনো আমি ওকে মেরেছি।
অভি পুরোপুরি ঘুমের দেশে চলো গেছে আমি একের পর এক ছু*রি চালিয়ে যাচ্ছি। ওকে যতবার ছুরি মারছি ততবার আমার মেয়ের আর্তনাদ দেখতে পাচ্ছি । কি করে পারলো ও এমনটা করতে আমার সুখের সংসার ছারখার করতে? এ কেমন ভালোবাসা ওর?
,, আমাকে যখন ও ফুফুর বাড়িতে দেখে তারপর থেকে আমাকে ফলো করতো। আমি একটু আধটু অনুমান করলেও তেমন গুরুত্ব দিইনি। কেননা অনেকেই প্রেমের প্রস্তাব দিতো। আমি ভাবছিলাম তাদের মধ্যে কেউ। তারপরের ঘটনা তো ও বলছেই সকালে। আমার আর ওর বিয়ের এক বছর আগে থেকে আমাকে ফলো করা বন্ধ করে কারণ ওর পথের কাটা ইসমাঈলকে ও সরিয়ে দিয়েছে।
ইসমাঈলরা যেদিন এক্সিডেন্ট করে তার দুইদিন আগে আমরা অনেক দূরে একটা প্রজোক্ট এলাকায় ঘুরতে যাই। যেহেতু ও আমায় ফলো করতো তাই জানতো আমরা কোথায় যাচ্ছি। ও আমাদের পিছু পিছু যায়। ইসমাঈলরা এক্সিডেন্ট করার পরে আমার একবারও মনে হয়নি ওদেরকে কেউ প্ল্যান করে মারতে পারে। তাই আমার মনে ছিলো না ওইদিন একটা ছেলে আমায় কিছু একটা বলে সেটা আর কেউ না অভি ছিলো। যেটা ইসমাঈল শুনে আমি ভালো করে শুনেনি। ইসমাঈল রাগের মাথায় অভিকে থা*প্প*ড় মা*রে। অভি আমার পিছন ফিরে ছিলো তাই ওকে দেখতে পাইনি। তারপর ইসমাঈল আমাদের নিয়ে বাড়িতে চলে আসে।
অভি এটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি। এক তো আমাকে পায়নি, তার উপর ইসমাঈলকে নিয়ে আমি সুখে ছিলাম। এখন আবার ইসমাঈল এতো গুলো মানুষের সামনে ওকে থা*প্প*ড় মারছে ওর ইগোতে লাগে। সব মিলিয়ে রাগের পাহাড় তৈরী করে আর সে রাগের পাহাড় গিয়ে পড়ে আমার ভালোবাসা আর আদরের সন্তানের উপর।
সেদিন যখন অভির বন্ধুদের আড্ডায় আমি যাই। সেদিন অভি ওদেরকে বলতেছে আমাকে থা*প্প*ড় মেরে ওর খারাপ লাগছে। তখন ওর অন্য একটা বন্ধু বলে এরকম একটা থা*প্প*ড়ের জন্য তুই ওর পরিবারকে ট্রাক ছাপা দিয়ে মেরে ফেলছিস। এখন খারাপ লাগার কী আছে?
তখন অভি রেগে গিয়ে বলে
– ওকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু ওই ইসমাঈল কী করলো আমার ভালবাসা কেড়ে নিলো আবার আমাকে অপমান করলো? এটাই হওয়ার ছিলো ওর সাথে। আমি জিতে গেছি এখন দীপ্তিও আমার কাছে।
কথা গুলো শুনার পর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি এরকম সাইকো ভালোবাসা আমার কোন দরকার নেই। যে ভালোবাসায় ত্যাগ নেই শুধুই ভোগ আর হিং*সা অতঃপর খু*ন।
ডায়েরিতে আর কিছু লিখা নেই। যে লিখতো সেও না ফেরার দেশে চলে গেছে। এতোক্ষণ পযর্ন্ত পুলিশ অফিসার শামীম আহসান ডায়েরিটা পড়ে সবাইকে শুনাচ্ছে। একদিকে মেয়েকে ধরে দীপ্তির বাবা-মা আত্মীয় স্বজনরা কান্না করছে।
অন্য দিকে অভির রক্তাক্ত দেহ জড়িয়ে ধরে ওর মা কান্না করছে। পুরো গ্রামের মানুষ এক হয়ে গেছে। কেউ ভাবতেই পারেনি অভি এমন বা ওর সাথে এমন কিছু হবে।
ভালোবাসলেই যে পেতে হবে কেমন কোন নিয়ম নেই। ভালোবাসায় হার জিত থাকেই তাই বলে জোর করে তো আর ভালোবাসা আদায় করা যায় না। আর যদিও যায় তার পরিনীতি খুবই করুণ হয়। ভোগে নয় ত্যাগেই সুখ।
~সমাপ্ত ~