#এই_মনের_আঙিনায়[৫]
#কুরআতুল_আয়েন
হঠাৎ বর্ষণে যেনো পরিবেশ একদম শীতল হয়ে আছে।মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ!আদুরী সবেমাত্র কলেজ থেকে এসেছে।নিঃশব্দে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।আদুরীর মনের পরিবর্তন ঘটেছে!বিশাল পরিবর্তন!ফারিহার বিয়ে থেকে আসার পর আদুরী অনুভব করে নিজের মন গহীনে জমে থাকা সুপ্ত এক অনুভূতি!যেই অনুভূতি শুধুমাত্র ফারাজ’কে ঘিরে।বড়আপা’র মুখে শুনেছে এই বয়স’টা নাকি আবেগের!এক কথায় রঙিন চশমার মতো!অর্থাৎ,চোখের দেখাতে সবাকেই ভালো লাগবে।কিন্তু আদুরীর তো তা হয় নি!এই প্রথম কারোর জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো!সেই সাথে উতলা!এতেও যেনো থেমে নেই ঠিকই তো ফারাজের জন্য হৃদপিণ্ড স্পন্দন দিয়ে উঠে!এগুলোও কি আবেগ!আদুরী ক্ষান্ত হয়!ভেতরে ভেতরে অনেকটাই পুঁড়ছে।মন চায় লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ফারাজের সামনে গিয়ে বসে থাকতে।আদুরী বেশ খাণিকটা চিন্তিত নিজের এই বেহাল অবস্থা দেখে!মাঝেমধ্যে নিজের উদ্ভট চিন্তাভাবনার কথা ভেবে নিজেই নিজেকে শাসিয়ে উঠে।নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানায়!ছি ছি!তার কিছুক্ষণ বাদেই যেই লাউ সেই কদু!মনের উপর তো আর কারোর হাত নেই।তেমনি মনের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে দুষ্কর এক কাজ!আদুরী আর ভাবলো না!দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছাড়লো।মনে মনে ঈশিতার উদ্দেশ্যে বললো,
‘ওও মেঝোআপা একি হলো আমার অবস্থা!তুমি তো বলেছিলে নানুবাড়ি গিয়ে আমার ভালো লাগবে।কিন্তু আমি তো নতুন এক উপলব্ধি করতে পারছি।চেয়েও যেনো বলতে পারছি না।লজ্জা লাগছে তোমাদের সবার সামনে।’
আদুরী ঘরে প্রবেশ করলো বেশ এলোমেলো ভাবেই!ঈশিতা আলমারি ঘাটাঘাটি করছে।আদুরী বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো।ঈশিতার দিকে চোখ নিক্ষিপ্ত করে বললো,
‘কি খুঁজছো মেঝোআপা আমার আলমারিতে!’
ঈশিতা জবাবে বললো,
‘আম্মার খয়েরী রঙের জামদানি শাড়িটা।’
‘আম্মার আলমারিতে গিয়ে দেখো।এখানে নেই!’
ঈশিতা ভ্রুকুটি কুঁচকে বললো,
‘আম্মা’ই তো বললো তুই নাকি পড়েছিলিস শাড়িটা!’
‘পরে রেখে এসেছিলাম।কিন্তু কেনো মেঝোআপা!’
‘ভার্সিটি’তে প্রোগ্রাম আছে।’
‘আমায় নিয়ে যাবে মেঝোআপা!’
‘শাড়ি পড়ে যাবি?’
‘আম্মা দিবে!’
‘কোন শাড়িটা পড়বি!’
‘আম্মার ওই যে কালো জামদানি শাড়িটা পড়বো।’
‘আচ্ছা!বিকালে তৈরি করে দিবো।’
আদুরী খুশিতে গদগদ ভাব!ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে যেনো মাত্রাতিরিক্ত খুশি লাগছে।মন ভালো করার যেনো এটাই একমাত্র উপায়।ঈশিতা আদুরীর মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে চলে গেলো।
রাত দশ’টা!ঈশিতা আর আদুরী মাত্রই ফিরেছে।আদুরী শাড়ি ধরে হাঁটছে।বৃষ্টির পানিতে শাড়ির নিচ টুকু ভালোই ভিজেছে।আশেপাশের খেয়ালে এখন নেই!ঈশিতা বসারঘরে এসেই জোর গলায় বলে উঠলো,
‘আরে!ফারাজ ভাই কখন এসেছো।’
আদুরী চমকে উঠলো!গোল গোল চোখের চাহনি নিক্ষেপ করে তাকালো সোফায় বসা ফারাজের দিকে।ফরমাল পোশাক।আগের সেই দৃষ্টি।ঈশিতা এগিয়ে গেলেও আদুরী আগায়নি!আগের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ফারাজ সৌজন্যমূলক হাসলো।ঈশিতা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘কোথায় গিয়েছিলিস!’
‘ভার্সিটির একটা প্রোগ্রাম ছিলো।তুমি কখন এসেছো।’
‘কিছুক্ষণ হলো এসেছি।কিছু কাজ ছিলো আর একদিনে করা সম্ভব হয়নি তাই এই সুযোগে ছোট ফুপির বাসায় একটা ট্যুর দিতে চলে এসেছি।’
‘খুব ভালো করেছো।তোমার তো আসাই হয় না।যাক কাজের জন্য হলেও আসা হয়েছে!’
ফারাজ হাসলো!কিন্তু দৃষ্টি আদুরীর উপর।ঈশিতা’কে ডিঙিয়ে আদুরীর উপর ফারাজের দৃষ্টি ফেলতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।তারপরও ফারাজ যেনো এই দৃষ্টির মাধ্যমে নিজের স্বাদ মেটাচ্ছে।ঈশিতা কিছুক্ষণ কথা বলে আদুরীর দিকে ফিরে বললো,
‘তুই এখনো এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো।ফারাজ ভাই’কে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছিস না কেনো আদু?ফারাজ ভাই আমাদের সবার বড়।তোর তো আরো বড়।’
আদুরী উশখুশ করছে!জিহবা দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিলো।ঈশিতার কথার প্রত্যুত্তরে শুধু ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো।ঈশিতা ফোন আসায় ফারাজ’কে বলে তড়িঘড়ি করে চলে গেলো।আদুরীর যেনো এবার যায় যায় অবস্থা।ফারাজ আরামে বসে পড়লো।পা’য়ের উপর পা তোলে বসেছে!এক দৃষ্টিতে আদুরীর দিকে তাকিয়ে রইলো।আদুরী চোখ নামিয়ে নিলো।ফারাজের হাবভাব সবই বুঝতে সক্ষম।আদুরী আর দাঁড়ালো না।দু’হাতে শাড়ি ধরে দিলো এক দৌড়।আচমকাই এমন হওয়ায় ফারাজ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো।পরমুহূর্তেই ঠোঁটের আদলে হাসি ফুটে উঠলো!
খাবার টেবিল থমথমে হয়ে আছে!জাকির সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে রাহেলা খাতুন’কে বললেন,
‘আমার ছোটআম্মা কই!ছোটআম্মা কি খাবে না!’
রাহেলা খাতুন চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
‘আদুরীর পেট খারাপ করেছে।বদহজম থেকে এই অবস্থা।কয়েকবার ওয়াশরুমেও গিয়েছে।’
জাকির সাহেব মুখখানা আরো গম্ভীর করে বললেন,
‘ছোটআম্মার এই অবস্থা কীভাবে হলো?’
‘ঈশিতার সাথে তার ভার্সিটি প্রোগ্রামে গিয়েছিলো।সেখানে গিয়ে ঝাল খাবার খেয়েছে খুব।তারপর থেকেই পেটে ব্যথা।’
জাকির সাহেব হায় হায় করে উঠলেন।ভাত খাওয়া যেনো লাটে উঠেছে।জাকির সাহেব খাবার টেবিল ত্যাগ করে আদুরীর ঘরের দিকে ছুটলেন।না দেখা পর্যন্ত শান্তি নেই।ফারাজ সবই খেয়াল করেছে।রাহেলা খাতুন ফারাজের দিকে মুরগীর মাংস এগিয়ে দিতেই ফারাজ বাঁধা দিয়ে বললো,
‘আমি আর খাবো না ছোটফুপি।রাতে এমনেতেই খাওয়া বেশি হয় না।তুমি খেয়ে নাও!’
রাহেলা খাতুন উষ্ণ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘আমি একটু পরে খাবো।আগে আদুরী’কে দেখে আসি।’
রাহেলা খাতুন চলে গেলেন।পাশ থেকে ঈশিতা বলে উঠলো,
‘বুঝলে ফারাজ ভাই আদুরী অনেক আদরের।দেখো না পেট ব্যথার জন্য আব্বা আম্মার চিন্তার শেষ নেই।’
ফারাজ কিছু বললো না।চুপচাপ খাবার শেষ করলো।তবে,মনে মনে আদুরীর জন্য ঠিকই চিন্তিত হলো!
_______
সকালে ঘুম থেকে উঠে আদুরী অনেক খুঁজেও ফারাজ’কে পেলো না।রাতে পেট খারাপ ছিলো বিধায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।জেগে থাকলেই যেনো ওয়াশরুমের চাপ এসে আদুরীর দফারফা করে দিয়ে যায়।কিন্তু সকালে উঠেই মন বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।ফারাজ’কে না পেয়ে নিঃশব্দে চোখের অশ্রুও বিসর্জন দিয়েছে।আদুরীর মনে জমা হলো অভিমানের স্তূপ!দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন কেটে যায়!আদুরী সবকিছু ভুলে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠলো।সামনেই বোর্ড পরীক্ষা।এখন যেনো সবকিছু ভুলে যাওয়াই শ্রেয়!অবশ্য,এর মাঝে ফারাজের সাথে আদুরীর আর দেখা না হলেও আদুরীর মনে ফারাজ ঠিকই রয়ে গিয়েছে!যার ফলস্বরূপ,গভীর রাতে আদুরীর বুকটা যেনো হাহাকার দিয়ে উঠে!
আদুরীর পরীক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে!ভর্তি পরীক্ষার জন্য রাত-দিন পড়ছে।বড়আপা,মেঝোআপা দু’জন মিলেই সহযোগিতা করছে।আর মাত্র ক’টা দিন আছে!টেবিলে বসে আদুরী মনোযোগ দিয়ে প্রাণীবিদ্যার রক্ত চ্যাপ্টার টা পড়ছিলো।বিছানার উপর বসে আছে ঈশিতা।কোলে সুবহান।সুহানা আদুরীর এডমিশনের জন্য এখানে এসেছে।গাইডলাইন’টা মূলত সেই দিচ্ছে।সুহানা ঈশিতা’কে বললো,
‘ফারিহা নাকি কনসিভ করেছে।’
জবাবে ঈশিতা বললো,
‘শুনেছি!বড়মামা’রা মিষ্টি নিয়ে আসবে বোধহয়!এই খবরটা’র জন্য এতোদূর মিষ্টি নিয়ে আসাটা কষ্টের হয়ে যাবে না বড়আপা!’
‘বড়’মামার টাকা পয়সার অভাব নেই।গাড়ি আছে আসতে কষ্ট কিসের!আসতে দে!তাঁদের কাছে এগুলো পানিভাত!’
আদুরী কর্ণপাত করলো!কান খাড়া করে রেখেছে আরো কিছু শুনার আশায়!কিন্তু আশা বিফলে গিয়েছে।সুহানা আর ঈশিতা সুবহান’কে নিয়ে চলে গেলো।ঘরে পড়ে রইলো আদুরী একা!
চা নাস্তার কোনো কমতি নেই!সোফায় সবাই বসে আছে।আড্ডা বেশ ভালোই জমেছে!কুসুমা বেগম হাসিমুখে বললেন,
‘দিন যে কীভাবে কেটে যায় তা বুঝাই যায় না!এখন শুধু আমার ফারাজ’কে বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে তুললেই আমার নিস্তার!’
রাহেলা খাতুন বললেন,
‘ফারাজ আসলো না যে বড়ভাবি!’
কুসুমা বেগম গর্বের সাথে বললেন,
‘ফারাজ এখন অনেক ব্যস্ত রাহেলা।তোমার বড় ভাই’য়ের ব্যবসা নিজে সামলাচ্ছে!তাকে এখন আর আগের মতো পাওয়াই যায় না।’
‘ফারাজের জন্য কি মেয়ে ঠিক করে রাখা?’
‘না!তবে,মেয়ে খুঁজছি।ভালো ঘরের মেয়ের সন্ধান পেলেই বিয়েটা তাড়াতাড়ি করেই সেরে ফেলার ইচ্ছে আছে আমার।’
‘ফারাজ রাজি আছে বড়ভাবি!’
‘ফারাজ আমার কথাতেই উঠবে বসবে।আমার কথার রহিত করবে না!’
আদুরী স্তব্ধ হলো।কথাগুলো শুনে ভেতর’টা যেনো ভূমিকম্পের মতো কম্পন দিয়ে উঠলো!চোখ ফেটে কান্না আসার ভাব!আদুরী ফেঁসেছে!খুব ভালো ভাবেই ফেঁসেছে!আদুরী কোনোমতে সবার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখলো।মনে এসে হানা দিলো অভিমান,দুঃখ,কষ্ট!
জাকির সাহেব চিন্তায় মগ্ন!আদুরী ভর্তি পরীক্ষা’য় যে এইভাবে পিছলে যাবে তা ভাবার বাহিরেই ছিলো।বড় মেয়ে,মেঝো মেয়ে তো ভালোভাবেই এই সময়’টা পাড়ি দিয়েছে।কিন্তু ছোট মেয়ের বেলায় যে তার উল্টো!রাহেলা খাতুন চা নিয়ে জাকির সাহেবের সামনে রাখলেন।চিন্তায় মগ্ন দেখে কিছু বললেন না।উল্টো ঘুরতে নিলেই জাকির সাহেব রাহেলা খাতুন’কে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘বড়আম্মা’কে একটু আসতে বলো তো বাসায়।’
রাহেলা খাতুন ভ্রুকুটি কুঁচকে বললেন,
‘কিছু কি হয়েছে সুহানার আব্বা!’
‘কি হবে!বড়আম্মা’কে কি আমি আসতে বলতে পারি না।’
‘সেটা বলছি না।আচমকাই ফোন দিয়ে আসতে বললে তো এইজন্য জিজ্ঞেস করেছি।’
‘দরকার আছে বলেই ফোন দিতে বলেছি।’
রাহেলা খাতুন কিছু বললেন না।স্বামীর মুখ’টা যেনো আজকে একটু বেশিই গম্ভীর।কারণ জানলেন না!এমনকি জিজ্ঞেসও করলেন না।
তারপরের দিন!জাকির সাহেব বড় মেয়ে আর মেঝো মেয়ের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্তঃ নিয়ে আদুরী’কে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে এসেছেন।নিজেই নিজের মন’কে স্বান্ত্বনা দিলেন হাতের পাঁচ আঙুল তো আর সমান হয় না!বড় দুই মেয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে বলে যে ছোট মেয়েকেও পড়তে হবে তার কোনো মানেই হয় না।আর সবচেয়ে বড় কথা হলো রিযিক!রিযিক যার যেখানে টেনে নেয় সেখানেই যেতে হবে।তার উপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ক্ষমতা যেহেতু আল্লাহ দিয়েছেন সেহেতু এই সুযোগ কোনোমতেই জাকির সাহেব সহ বাকিরাও হাতছাড়া করতে চাননি!
সময় বহমান!নদীর স্রোতের মতো তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।সেই সাথে আদুরীর মনে জমে উঠেছে অভিমানের স্তর!বেদনার স্তর!মনে মনে ফারাজের নাম’টা থাকলেও যেনো অভিমান কমে নি!
চলবে..