এক চিলতে রোদ ২ পর্ব -২৮+২৯

#এক_চিলতে_রোদ-২
#Writer_Nondini_Nila
(কপি করা নিষেধ)

২৮.

দুইটা বাচ্চা ছেলে মেয়ে একটা চেয়ার নিয়ে ঝগড়া করছে। মেয়ে বাবুটা বসে ছিলো ছেলে বাবু টা মেয়ে বাবুটা কে থাপ্পর মেরে টেনে নিচে নামায়। এবার মেয়েটা কান্না করে দিয়ে খামচি দিল ছেলেবাবুকে তারপর তাকে ধরে টেনে নামায়। এবার দুজনেই টানাটানি করছে আর এক চেয়ারের দুজনের এক জন রাজত্ব করার জন্য ঝগড়া করছে। আমি বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবার দুজনেই ভালো গড়াগড়ি খাচ্ছে এগিয়ে যাব ভাবছিলাম তখনই তাদের মা এলো দুজনকে বকতে বকতে। মেয়েটা তার মা’র কাছে গিয়ে ছেলেটার নামে বিচার দিলো। এবার ছেলেটার মা ও এলো দুজন দুজনের মায়ের কাছে গিয়ে বিচার দিতে লাগলো। দুজনের বিচার দেওয়া আর গাল ফুলিয়ে নিজেদের দিকে তাকাতে দেখে আমি হেসে দিলাম। কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেছি দশ মিনিট হলো। সবাই রুম ঠিক করে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি একাই একজন রুমে ঢুকে ফ্রেশ না হয়েই আবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এইসব কীর্তিকলাপ দেখছিলাম।

‘একা একা দাড়িয়ে হাসছো কেন?’ পুরুষালী কন্ঠ কানে এসে বারি খেতে আমার সমস্ত ধ্যান-ধারণা ভেঙে গেলো। চমকে পাশ ফিরে তাকাতেই ইহানকে ভ্রু যুগল কুটি করে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থেকে থমকালাম। আস্তে ধীরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আচমকা কানের কাছে কারো কথার আওয়াজ পেয়ে ভয় পেয়ে গেছিলাম।

‘হুয়াই আরন্ট ইউ টকিং অ্যাবাউট ইউর প্রবলেম?’

‘নো প্রবলেম! একা কোথায় আমি তো ওই বাচ্চা দুটোর কান্ড দেখে হাসছিলাম।’ বলেই হাত বাড়িয়ে সামনে দেখলাম। ইহান ভ্রু কুটি করে সামনে তাকালো।
সামনে কাউকে না দেখে বলল, ‘আর ইউ ম্যাড? কি সব বলছো! ক‌ই বাচ্চা?’

আমি চমকে সামনে তাকিয়ে দেখলাম ফাঁকা কেউ নাই। এরা কোথায় গেল। সিওর মাকে বিচার দিতে দিতে চলে গেছে।

‘এখানেই ছিল। খুব ঝগড়া করছিলো। চলে গেছে এখন।’

‘ তো তারা চলে গেছে তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছো কেন? সবাই ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে আর তুমি তার কোন কিছু করছ না। উল্টা বাচ্চা দের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বাচ্চাদের কীর্তিকলাপ দেখছো? গাধা একটা। রুমে যাও আর ফ্রেশ হ‌ও গিয়ে।’

বলেই বড় বড় পা ফেলে সামনে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি নাকের পাটা ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি‌। আমাকে গাধা বললো। গন্ডার কোথায় তুই গাধা তো ব‌উ গাধা। বিরবির করে বকতে বকতে রুমে চলে এলাম। রুমে আরেকজন আছে। ইহানের মামাতো বোন ফারজানা আপু। আমাকে তার সাথে থাকতেই দিয়েছে। তিনি বিছানায় শুয়ে হাট উঁচু করে পায়ের উপর পা তুলে ফোন টিপছে। আমাকে দেখেই মিষ্টি করে হেসে বললো,

‘ ঊষা তুমি কোথায় ছিলে তোমাকে ডাকলাম আমি যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো।’

আমি বাথরুমে ঢুকে গোসল করতে গেলাম। ফারজানা আপুকে আমার প্রথম সাক্ষাতেই খুব ভাল পছন্দ হয়েছে। উনি ইহানের সেম ব্যাস। যাকে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম সেই মেয়েটা হচ্ছে আমি আমার মেজ কাকার মেয়ে কলেজে পরে নাম জেরিন। সেই সেই ধাক্কা খেয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছিলো আমি প্রথমে মেয়েটার উপর তীব্র রাগ প্রকাশ করলেও নিজেরই বড় বোন হয় জানার পরে রাগ মাটি হয়ে গেছিলো। ইহান তো বোন বলেই এতো কেয়ার করছিল আর আমি কিনা কি ভাবছিলাম।
নিজের বোকামী তিনি নিজেই অবাক।
বাইরে এসে দেখলাম ফারজানা আপু ঘুমিয়ে গেছে আমি তার পাশে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো দুপুরে। বাইরে আসতেই ইমা আপু টেনে আমাকে খাবার রুমে নিয়ে গেলো। আপুর সাথে আমাকে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু ওই জেরিন তা হতে দেয়নি। জোর করে আপু সাথে থেকেছে আপু তিনজন মিলে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু জেরিন আমাকে এলাও করলো না। আমিও আপুকে মানিয়ে ফারজানা আপুর সাথে তার রুমে চলে এলাম।

খাবার টেবিলে বসে আরেক ঝটকা খেলাম। আমার পাশের চেয়ারে জেরিন বসেছে। আমি বসতেই ফিসফিস করে কানের কাছে বললো,

‘ ইউ প্রসেড মি ইন দি মর্নিং। আই নো ইউ।’

জেরিনের কথা শুনে আমি বিহ্বল হয়ে তাকালাম ওর দিকে। জেরিন আমার দিকে বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে। আমি ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি কেউ শুনে ফেললে সর্বনাশ হবে। আমি ভেবেছিলাম মেয়েটা কিছুই দেখেনি এ তো দেখছি সব জানে। কিন্তু তখন মেয়েটা আমার কথা কাউকে বললে না কেন। সবাই জানলে খুব বকবে নিশ্চয়ই আমাকে। জেরিনকে নিয়ে সবাই কতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আমি দেখেছি। এখন আমার কি হবে। ধুর কি আবার হবে আমি ইচ্ছে করে পড়েছিলাম নাকি।

তখন ইহান এসে বসলো আমার ডান পাশের সিটে। আমি চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। আশেপাশে আর একটা সিট ও খালি ছিলো না তাই বোধহয় এখানে বসেছে। কিন্তু ইহানের পাশে বসে খেতে হবে ভেবেই অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। ইহানকে দেখে জেরিন কথা থামিয়ে দিলো। আর কিছু বললো না। আমি অবশ্য প্রথম কথা ছাড়া আর কোন কথাও শুনিনি ও।
আমি আড়চোখে ইহানের দিকে তাকাতে তাকাতে খাবার না দেখেই মুখে পুরে নিলাম। প্লেটে যে আমার জাত শত্রু আছে তা দেখলাম ও না। ওইভাবেই চিংড়ি মাছের বড়া দিয়ে খেয়েই যাচ্ছি। অন্য কিছু নিচ্ছি না। এতোটাই অন্য মনষ্ক ছিলাম যে চিংড়ি তে যে আমার মারাত্মক এলার্জি আছে মনেই ছিলো না। খাওয়ার মাঝেই আমার গলা গাল চুলকানি উঠলো। স্বাভাবিক ভাবেই চুলকাচ্ছি। এবার পিঠ হাত চুলকাচ্ছে ধ্যাত এতো চুলকাচ্ছে কেন শরীর। ঘুমানোর আগে তো গোসল ও করেছি। তাহলে চুলকানি হচ্ছে কেন? খাওয়া অফ করে চুলকাচ্ছি। হঠাৎ জেরিন চেঁচিয়ে উঠলো,

‘ ও মাই গড কি হয়েছে এসব।’ বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলো। আমি বোকা চোখে তাকিয়ে আছি। হাত এখনো আমার গলায়। জেরিনের কথা শুনে সবাই আমার দিকে তাকাতেই আতকে উঠলো। আমি বুঝতে পারছি না এমন করে তাকিয়ে আছে কেন সবাই আমার দিকে। ফারজানা আপুর কথা শুনে আমি নিজের গলায় ও হাতের দিকে তাকালাম। লাল লাল ফোসকা পড়ে আছে। যেখানেই চুলকাচ্ছি সেখানেই এমন হয়ে যাচ্ছে
আমি চোখ বড় করে দেখছি এমন তো আমার চিংড়ি গেলে হয় এখন এমন হলো কেন? আমি তো আজ চিংড়ি খায়নি। প্লেটে তাকাতেই চমকে উঠলাম। ছিটে সরে গিয়ে বললাম,

‘ আমাকে চিংড়ি দিয়েছেন কেন এটাতে তো আমার খুব এলার্জি আমি সহ্য করতে পারিনা। এখন কি হবে।’
সারা শরীর লাল করে ফেলেছি আমি চুলকাতে চুলকাতে। ইহান একবার আমার প্লেট তো একবার আমার দিকে তাকিয়ে তেরে এলো আমার দিকে।আমার রেখে চিৎকার করে বললো,

‘ তোমার মতো অপদার্থ আমি আর একটাও দেখিনি। মাথা খারাপ নাকি তোমার। সমস্যা আছে তাও কোন সাহসে এটা মুখে দিয়েছো ইডিয়েট। কোন কমনসেন্স নাই তোমার!’

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। ইমা আপু দৌড়ে আমার কাছে এসে পানি খাওয়ালো তারপর আমাকে নিয়ে রুমে এলো। ওষুধ বের করে হাতে দিলো। আমি ওষুধ খেয়ে ও শান্ত হতে পারছি না। শরীর ব্যাথা করছে। নিস্তেজ হয়ে আসছে।
ইহান দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মনে মনে রাগে ফুঁসছে এতটা কেয়ারলেস কেন মেয়েটা!!

ঘুম ভাঙলো রাতে চুলকানি কমেছে ফোসকা ও চলে গেছে হালকা লাল হয়ে আছে শুধু এখন‌। ইমা আপুর রুমেই এখনো শুয়ে আছি। পাশে মলম রাখা আপু দিয়ে দিয়েছিলো বোধহয়। রুমে কেউ নাই আমি একাই তাই উঠে পরলাম ফটাফট।
বাইরে এসে দেখলাম সবাই গোল হয়ে বসে আছে। আর কালকের প্লান করছে রিফাত ভাইয়ার কাল আসবে এখানে। আমি ও তাদের যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। তাদের কাছ অবধি পৌঁছাতে পারলাম না। হঠাৎ কেউ আমার হাত শক্ত করে ধরে নিলো। হাঁটা থামিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি ইহান। আমি বললাম,

‘ কি হয়েছে?’ প্রশ্নতুক চোখ তাকিয়ে বললাম।

‘ কোথায় যাচ্ছ?’ আমার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ইহান পাল্টা প্রশ্ন করল।

‘ ওই যে ওইখানে। সবাই গল্প করছে আমি একাই রুমে শুয়ে ছিলাম। তাই তাদের সাথে গল্পে জয়েন করতে যাচ্ছি।’

‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! এই শরীর নিয়ে এখন আড্ডা দিতে যাচ্ছ। চুপচাপ রাতের খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকো যাও।

কি আমি তো। তিন ঘণ্টার মত ঘুমিয়ে ছিলাম এখন আবার ঘুমাবো কেন? আর আমি এখন একদম ঠিক আছি।’

‘স্টুপিড গার্ল তোমার মত মাথামোটা আমি দুটো দেখিনি চিংড়িতে যেহেতু তোমার সমস্যা তারপরও তুমি ওইটা কোন আক্কেলে খেয়েছিলা?’

আমি ধপ করে মাথা নিচু করে ফেললাম আর ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। কি করে ইহানকে এখন বোঝাবো যে আমি শুধু মাত্র তার জন্য কতটা অস্বস্তি আর অন্যমনস্ক ছিলাম।এতটাই অন্যমনস্ক ছিলাম যে চিংড়ি মাছ খেয়ালই করিনি চিংড়ি মাছ কে অমৃত ভেবে খেয়ে গিয়েছে।

‘কি হল কথা বলছো না কেন? তোমার মত কেয়ারলেস মেয়ে আমি দুটো দেখি নাই!’

‘আচ্ছা আমি না হয় কেয়ারলেস তাহলে ইহান ভাইয়া আপনি না হয় আমার একটু টেক কেয়ার করুন! এখানে তো আর আমার আব্বু আম্মু নাই যে তারা টেক কেয়ার করবে। আর আপনি আমার বড় ভাই হিসেবে একটু না হয় আমার খেয়াল রাখুন‌।’

‘ আবার ভাইয়া বললে? তোমাকে আমি ভাইয়া বলতে মানা করেছিলাম না?’

‘কেন মানা করেছিলেন? আপনি তো আমার ভাই হোন। তাহলে ভাইকে কি আমি এখন মামা বলবো?’

‘ মামা!! হোয়াট? কিছুই বলার দরকার নাই।’

‘ কেন দরকার নাই। অফকোর্স দরকার আছে ভাইয়া আপনি এত বড় আমার থেকে আপনাকে কি নাম ধরে ডাকা যাবে। মামা, ভাইয়া, খালু, চাচা কিছু একটা তো বলতেই হবে তাই না। এখন আপনি বলুন আপনাকে আমি কি বলব? ভাইয়া বলতো যদি সমস্যা হয় তাহলে আমাকে মামা কাকাই বলতে হবে!!’

ইহান আমাকে টেনে রুমে নিয়ে আসলো। বিছানার উপর সাজানো প্লেট দেখতে পেলাম। মুরগির গোশত দিয়ে ভাত রাখা। আমাকে সামনে বসিয়ে খেতে বলল, আজেবাজে কথা বলা অফ করে।

আমি তাও বললাম, ‘ এত ইম্পর্টেন্ট একটা কথা আপনার কাছ আজেবাজে মনে হচ্ছে বলেন না আমি আপনাকে কি বলবো?

‘ উফফ এতো পাগলামো করছো কেন? আচ্ছা ভাই ই ব‌ইলো। মামা কাকা থেকে এটা বেটার।’

আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম, ‘ ওক্কে ভাইয়া!’
#এক_চিলতে_রোদ-২
#Writer_Nondini_Nila
(কপি করা নিষেধ)

২৯.( ১ম অংশ)

‘ এখনো কি চুলকায়?’

মুখের খাবার ফিনিশ করে বললাম, ‘ নাহ। কিন্তু শরীর ব্যথা হয়ে আছে হালকা।’

আমার কথা শুনে ইহান বিছানায় থেকে উঠে দাঁড়ালো আর বেরিয়ে গেলো। ইহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আরেক লুকমা ভাত মুখে তুলে নিলাম। খাওয়া শেষ হতেই ইহান হাতে ট্যাবলেট নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমি ভ্রু কুটি করে বললাম,

‘এটা আবার কিসের ওষুধ?’

‘ব্যথার ওষুধ খেয়ে নাও ব্যথা কমে যাবে!’

‘ না না আমি আর ওষুধ খাব না। আমি এমনিতেই ঔষধ খেতে পাই না আমার মনে হয় গলায় বিধে আছে। তখন খুব খারাপ লাগছিল তাই খেয়েছিলাম। এখন আমি আর কোন ঔষধ খাব না।এই ব্যাথা এমনিতেই সেরে যাবে।’

‘ কিভাবে সারবে সেটা আমি তোমার কাছে শুনতে চাইনি। ওষুধ এনেছি তাড়াতাড়ি ফিনিশ করো। বাড়তি কথা শুনতে চায় না।’

‘আরে আপনি আমাকে জোর করছেন কেন? আর আপনার কথা মত আমি এটা খাব কেন! আপনি কি ডাক্তার? ইমা আপু তো আমাকে এটা দেন নি। এই ঔষধ আমিটা খাব না।’

‘ জেদ করো না ঊষা। একটা ব্যথার ওষুধ তোমার শরীর ব্যথা থাকবে না এটা খেলে। ইমা আপু তখনই বলেছিল এটা খাওয়ার কথা কিন্তু তুমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলে এজন্য আর ডাকিনি ডাকলে তুমি আরো চুলকাতে শরীর। এতে তোমার অবস্থা খারাপ হতো।’

‘ আমি চুলকানোর মধ্যে ঘুমালাম কি করে?’

‘এলার্জি ট্যাবলেট এর সাথে তোমাকে ঘুমের ওষুধ ও খাইয়েছিলে।’

‘তবুও আমি এখনই ওষুধ খাব না কিছুতেই না!’

ইহান যখন আমাকে কোন ভাবেই বলে রাজি করাতে পারল না তখন রেগে গেলো। রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়ে। আচমকা ইহান আমার বাহু শক্ত করে চেপে ধরল। এমনিতেই শরীর ব্যথা তার ওপরে আর এমন শক্ত করে খামচে ধরায় আমি ব্যাথায় আহ করে উঠলাম।
ইহান সেদিকে লক্ষ্য করলো না আমার দু গাল চেপে ধরে ঔষধ মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। আমি যে ফেলবো তারও উপায় নাই। ওভাবে চেপে ধরে পানি আমার মুখের ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে ওষুধ মুখে না গিলে রাখার জন্য মুখ আমার তেতো হয়ে গেল। বমি পাচ্ছে আমার এখন না গিলে কি উপায় আছে। অজ্ঞতা আমাকেই খেতেই হলো।
বিতৃষ্ণার মুখ আমার তেতো হয়ে গেছে। ইহান আমাকে ছাড়তেই কাঁদো কাঁদো মুখ করে তার মুখের দিকে তাকালাম। ফাজিল আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। তা দেখে রাগ আমার মাথায় উঠে গেল। রাগের মাথায় ইহানের উপর ঝাপিয়ে পড়লাম। দুহাতে কিল ঘুষি মারতে লাগলাম।

‘তোমার তো সাহস কম না তুমি আমার গায়ে হাত তোল!’

‘আমার অনেক সাহস বুঝেছেন। দেখেন কি করেছেন এমনিতেই শরীর ব্যথা হয়ে আছে। তার উপর আপনি আবার আমার হাত আর গাল টিপে আঘাত করেছেন।’ গাল ফুলিয়ে বললাম।

ইহান আমার দিকে তাকিয়ে এক হাত উঁচু করে গালে স্পর্শ করল। আমি তা দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি ইহানের দিকে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে এভাবেই স্পর্শ করায়।
তারপর হঠাৎ করেই গাল ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। আর বললো,

‘ ব্যথার মলম এনে দিচ্ছি লাগিয়ে নিও। আমার কথা ভালোমতো শুনলে তো আর ব্যথা পেতে হতো না। দোষ এখানে তোমারি বেশী।’

বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

আমি আশ্চর্য মাত্রায় অবাক হয়ে তাকিয়ে র‌ইলাম। তারপর আমিও বেরিয়ে সবার সাথে গিয়ে বসলাম।
পরদিন দুপুরের পর‌ই দেখলাম ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে উপস্থিত হলো ইহানের ফ্রেন্ডের দল। আমি দেখলাম ফারিয়াকে ভালো করে ছিঃ একটু ও লজ্জা বলতে নাই। কি বাজে পোশাক টাই না পরেছে ছিঃ।
নাক ছিটকালাম আমি। রাতে মেহেদীর অনুষ্ঠান কে কি করবে তাই নিয়ে সবাই প্লান করছিলো। তখন এদের আগমন। মুক্তা আপু সবার সাথে কথা বলে আমাকে দেখে জরিয়ে ধরলো। আর কেমন আছি জিজ্ঞেস করল।
আমি হেসে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন?

‘ আমিও খুব ভালো আছি। বিয়ে খেতে এসেছি ভালো না থেকে পারা যায়।’

ইহান এখানেই ছিলো বন্ধুদের পেয়ে উঠে তাদের নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। সবার রুম ঠিক করে দিতে। আমরা আবার বসে পরলাম সবাই। নাচ গান করবে কে সেসব কথা হচ্ছে আমাকেও নাচে জয়েন করতে বললো। কিন্তু আমি সরাসরি মানা করে দিলাম এসব আমার দ্বারা সম্ভব না। কিন্তু জেরিন নাচের কথা শুনে লাফিয়ে উঠলো। ও চেঁচিয়ে বললো, ‘ আমি ডান্স করবো।’
মেয়েটা বিদেশে ছোট থেকে বড় হয়েছে তবুও বাংলায় স্পষ্ট কথা বলতে পারে। এটা আমাকে অবাক করেছে। ও তো আমার বোন ওর সাথে এই দ্বন্দ্ব আমার একদম ভালো লাগছে না। সব ঠিক করে নিতে চাইছি কিন্তু হচ্ছে না। ও আমাকে সহ্য করতেই পারে না। এখানে আসার পর আমি ইলা আপুকে দেখিনি। তিনি আছেন কোথায়? তার বোনের বিয়ে অথচ তার খবর নাই। এক রকম দেখতে দুজন আমি ভাবছিলাম তাদের একসাথে দেখে দেখবো দুজনের অমিল কি আছে কিন্তু হায় কপাল আমার এখানে আসার পর আর তার দেখা পেলাম না‌। ইমা আপু আমাকে নিজের এক পাশে ও আরেকপাশে জেরিনকে বসিয়েছে। আমি ইমা আপুকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ আপু, ইলা আপু ক‌ই? আসার পর থেকে তাকে দেখলাম না তো।’

‘ ও তো বান্দরবান গেছে।’

‘ বিয়েতে উপস্থিত থাকবে না?’

‘ আজ তো র‌ওনা হয়েছে। সন্ধ্যার আগে পৌঁছে যাবে।’ বলেই মিষ্টি করে হাসলো। আমি ও হাসলাম।

রাতে যারা নাচবে তারা প্র্যাকটিস করতে লাগলো। আর আমরা যারা নাচবো না তারা দর্শকের ভূমিকা পালন করলাম। গালে হাত দিয়ে সবার নাচ দেখছি সবাই মোটামুটি সুন্দর নাচে। জেরিন কে দেখে মনে হচ্ছে অর ডান্স এর অভিজ্ঞতা ভালো।কথায় কথায় একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল জেরিনকে,

‘তুমিতো খুব সুন্দর ডান্স পারো তুমি কি আগে ডান্স শিখতে?’

‘ হ্যা। আর আমি তো সমস্ত অনুষ্ঠানের ডান্স করি স্কুল-কলেজ সব জায়গায় ডান্সে পারফরম্যান্স করে সব সময় ফার্স্ট হ‌ই। আমাকে কেউ হারাতে পারে না। আমার অনেক গুন আছে কিন্তু এখানে অনেকে আছে যারা সব কিছুতেই কাঁচা।’ গর্ব করে বললো।

কথাটা একটু জোরেই বলেছে বলার পর আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ছিল। আমাকে শোনানোর জন্য বলেছে বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমি একটু হিংসে হলো না আগের হলে হয়তো করতাম কিন্তু আমার নিজের আপন লোক তাকে আমি হিংসা কেন করব!
ইহানকে দেখলাম ফোন কানে ধরে এগিয়ে আসছে। এখানে সবাই নাচতে দেখে আর এগিয়ে এলো না। পেছনে ঘুরে চলে যাওয়ার ধরলো। কিন্তু কি ভেবে জানি আবার এগিয়ে এসে আমার দিকে তাকালো। আমি সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলাম। ইহান ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো গটগট করে। আমি ও উঠে দাঁড়ালাম আর হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিম পাশে চলে এলাম। দুপুরের কিছুটা আগে রিফাত ভাইয়া রাও এসে হাজির হয়েছে। এক পাশ তাদের জন্য বরাদ্দ অপরপাশ আমাদের। বর কনে সবাই হাজির দারুন। এদের মেহেদী গায়ে হলুদ সব একসাথে হবে মজার ব্যাপার।

এপাশে আসতে আমার রিফাত ভাইয়ার আম্মুর সাথে দেখা হয়ে গেলো আর তিনি আমাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করল কেমন আছি। আমি ভালো আছি আপনি কেমন আছেন আন্টি?
আন্টি আমার কথা শুনে বলল, তুমি যেন ইমার কি হও?

আমি সাথে সাথে বলতে গেলাম, ‘আমি তো ইমা আপু বোন।’

আন্টি বলল,’ কেমন বোন?’

এবার আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। এবার কি বলবো। আমি কেমন বোন হয় এটা তো কেউ জানে না। এখন যদি টা সত্যিটা বলে দিই তাহলে যদি ঝামেলা হয় না না থাক সত্যি বলবো না।

আমার দিকে উনি তাকিয়ে আছেন প্রশ্ন তুক চোখে। আমি সেদিন রাস্তায় দেখা হওয়ার ঘটনা বললাম। তারপর আপুর আমাকে আপন করে নেওয়ার কথা বললাম।
উনি সব শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর চলে গেছো আমি ঘুরতে ঘুরতে আবার এদিকে চলে‌ এলাম।

রাতে ইমা গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চোখ ফেরানো দায় হয়ে যাচ্ছে। খুব মিষ্টি লাগছে।
জেরিন টিয়ার মধ্যে গোলাপি মিক্সড করা লেহেঙ্গা পরেছে। ওকেও খুব সুন্দর লাগছে। সবাই কমবেশি সেজেছে। আমি পরেছি মিষ্টি রঙের টা। এটাই সেদিন ইমা আপু চয়েজ করে কিনে দিয়েছিলো। আজ সেটাই পরলাম। আমাকে ফারজানা আপু সাজিয়ে দিয়েছে। সাজ কমপ্লিট করে বেরিয়ে এলাম। ইমা আপুর কাছে এসে বসলাম তাকে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি তার মেহেদীর সাজ দেখছি। ইমা আপু আমাকে দেখেই বললো,

‘ মাশাআল্লাহ, আমার পিচ্চি বোনটাকে তো খুব কিউট লাগছে। ‘

‘ ধন্যবাদ আপু‌। তোমাকে যা লাগছে না দুলাভাই দেখলে আর চোখ ই সরাতে পারবে না। দুদিন পরের বিয়ে আজ করতে চাইবে।’

আপু লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিলো। তখন রিফাত ভাইয়ার এগিয়ে এলো‌। ইহান ও তাদের সাথেই এসেছে। সামনে নাচ চলছে। এক দল যেতেই জেরিন এলো প্রথমে একাই নাচলো তারপর সবাইকে টেনে নিলো। ইমা আপুকে ও ছারলো না।তাকেও নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু আপুর অনুরোধে তাকে ছেড়ে দিল। তাকে ছেড়ে আচমকা আমার হাত টেনে ধরে।আমি চমকে গেলাম।

‘ আমি না আমাকে টানছো কেন আমি তো নাচতে পারি না প্লিজ প্লিজ আমাকে না।’

কিন্তু কে শুনে কার কথা জেরিন আমাকে অনুরোধ করতে করতে উঠে টানতে টানতে ড্যান্স ফ্লোরে নিয়ে গেল। আমি লজ্জায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।এখন অবশ্য ডান্স ফ্লোর ফাকা না ভর্তি অনেকে নাচছে। তার মধ্যে ফারিয়া কেউ দেখতে পেলাম এই এতক্ষণ তাকে আমি দেখি নাই। বেগুনি কালারের লেহেঙ্গা পড়েছে পেট পুরো বেরিয়ে আছে।লেহেঙ্গা টা সুন্দর দেখতে সুন্দর লাগছে কিন্তু এমন অসভ্যের মত পেট বের করে রেখেছে বলে আমি আবার নাক ছিটকালাম। হিন্দি মেহেন্দি মে নাচনে ওয়ালা গানটা চলছে। আর সবাই উরাধুরা নাচছে। জেরিন এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে নাচাতে লাগল। এক হাতে ধরে রেখেছিলাম লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গা এমনিতেই একটু লম্বা। এজন্য ধরে রেখেছিলাম। কিন্তু এবার আমার হাত থেকে পড়ে গেল লেহেঙ্গা। আর এদিকে জেরিন আমার কথা শুনছেই না আমি যে বলতেছি আমি নাচবো না ছারো। কি একটা ঝামেলা বলুন তো!!

জেরিন আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল আরেক দিকে আমি মাঝখানে এসে পড়েছি। আর নাচের সবার ধাক্কাধাক্কিতে আমার অবস্থা নাজেহাল। কোনরকম সবাইকে ধাক্কিয়ে দুক্কিয়ে বেরিয়ে আসতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু তখন পাশ থেকে কেউ আমার পিঠে ধাক্কা মেরে দিলো আমি আঁতকে উঠলাম।নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও পারলাম না কারণ লেহেঙ্গায় পা বেজে গেছে এবার সোজা হতে পারছি না। পরে যাচ্ছি আমি। চিৎকার করে উঠবে তখনই একটা পুরুষালী ঠান্ডা হাত আমার কোমর জড়িয়ে ধরে পরা থেকে বাঁচিয়ে দেয়।আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে থরথরিয়ে কাঁপছি‌। লোকটা আমাকে টেনে সোজা করে নিরিবিলি জায়গা এনে দাড় করালো। আমি চোখ খুলে ইহানকে দেখলাম। মিষ্টি কালারের শার্ট পরেছে মারাত্মক লাগছে।

এদিকে ইহান ঊষাকে বকার জন্য টেনে নিয়ে এসেছে কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে আর বকতে পারছে না।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অপূর্ব লাগছে ঊষাকে।

ইহান দৃষ্টি সংযত করে বলল, ‘ মেহেদি দিয়েছো??’

আমি বললাম, ‘না!’

“কেন দিবে না? যেটা পারো না সেটা করতে যাও কেন আমি বুঝতে পারিনা‌। এখনই তো পরে একটা কেলেঙ্কারি বাজাতে। হাত পা ভেঙ্গে।’

‘ আমি কি ইচ্ছে করে গিয়েছি নাকি আমাকে জেরিন আপু জোর করে নিয়েছে। কতো মানা করলাম শুনলোই না। আর এখন আমি পড়ে যেতাম না। কেউ ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছে আমাকে।’

‘ তোমার মত গাধাকে সবাই ধাক্কা আর জোর‌ই করবে। যাও মেহেদী দাও সবাই দিচ্ছে দেখছো না।’

‘এই আপনি আমার মেহেদী দেওয়া নিয়ে পাগল হয়েছেন কেন? আমার ইচ্ছা হলে দেবে না হলে নাই। সেটা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?’

ইহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘তোমার হাত যদি আমি খালি দেখি। তাহলে তোমার খবর আছে।’

বলেই ইহান চলে গেলো। আমি মুখ কালো করে ইহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি। কি ডেঞ্জারাস ছেলে রে বাবা কিভাবে থ্রেট দিয়ে গেল। যেন আমি ওনার গার্লফ্রেন্ড।
#এক_চিলতে_রোদ-২
#Writer_Nondini_Nila
(কপি করা নিষেধ)

২৯.( ২য় অংশ)

হলুদ শাড়ি পড়ে সবাই রেডি হয়ে নিয়েছি। বাঙালি স্টাইলে শাড়ি পড়েছি। শুধু আমি না সবাই এক স্টাইলে। এক রকম কাপড় পরেছি। সবাই এক সারি বেঁধে দাঁড়ালে কেউ কাউকে চিনতেই পারবে না শুধু লম্বা আর শর্ট এই টুকুই ডিফারেন্স। এ ছাড়া আর কোন ডিফারেন্স নাই। ছেলেরা টিয়া কালারের পাঞ্জাবি পরেছে। জাস্ট অসাম লাগছে সবাইকে।
ঠোঁটে গাঢ় করে লাল লিপস্টিক, কানে ঝুমকা, হাত ভর্তি লাল হলুদ মিক্সড চুড়ি, কোমরে বিছা, চুল বিনি কানের কাছে তাজা গোলাপ ফুল, কপালে টিপ, চোখে মোটা কাজল। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখছি। নিজেকে দেখে নিজেই চোখ সরাতে পারছি না। কি সুন্দরী না লাগছে আমাকে। এতো সাজ আমি রিমার বোনের বিয়েতেও সাজিনি। আহা রিমার কথা মনে পরে গেলো বেচারা খুব আসতে চাইছিলো কিন্তু ওর কপাল খারাপ। রিমার বোন রিমঝিম আপুর ননদের বিয়ে আর ইমা আপুর বিয়ে এক সাথে পরেছে। তাই ও সেখানেই গেছে যাবে নাই বা কেন ওখানে যে ওর বয়ফ্রেন্ড আছে।

আমি সব বাদ দিয়ে নিজেকে দেখে নিজেই ক্রাশ খাচ্ছি। কপালের টিকলি নাড়াচাড়া করে ঠিক করে গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে এলাম। স্টেজের কাছে যাব বলে আমি হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন কারো বুকের সাথে বাড়ি খেলাম। কপাল ঘঁষে রেগে সামনে তাকালাম। একটা ছেলে হ্যাবলার মতো হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার রাগ তুরুঙ্গে উঠে গেলো। একেতে ধাক্কা দিয়েছে তার উপর আবার সরি না বলে হা করে তাকিয়ে আছে কেমন লুচু ছেলে।

আমি দুহাতে তালি দিয়ে তার ধ্যান ভাঙিয়ে বললাম,

‘ মশা মাছি ঢুকে পেট খারাপ হয়ে গেলো আপনার ছিঃ হা অফ করুন। ‘ নাক ছিটকে বললাম।

ছেলেটা আমার কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো
আর সাথে সাথে মুখ বুজে ফেললো। আমি আবার বললাম,

‘ ভদ্রতা শেখেননি। ধাক্কা দিয়ে সরি বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না উল্টা হা করে তাকিয়ে ছিলেন। যতসব ফালতু লোক।’

বলেই আমি পাশ কাটিয়ে চলে‌ এলাম। ছেলেটা আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ও তাকিয়ে ছিলো আমি লক্ষ্য করলাম না।

ইমা আপু আর রিফাত ভাইয়া পাশা পাশি বসে আছে। তাদের মাঝে পাতলা এটা আবরণ জাস্ট। দুপাশ দিয়ে দুজনকেই হলুদ দেওয়া হচ্ছে। কেবল শুরু হয়েছে মনে হয়। কারণ কেবল বড় রা দিচ্ছে।
আমি এক সাইডে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছি। আমার কাছে এসে দাড়ালো ফারিয়া। ওকে দেখে আবার রাগ হলো। পাতলা নেটের হলুদ শাড়ি পরছে। আমার কাছে এসে বললো,

‘ হাই ঊষা!’

আমি কিছু বললাম না। সামনের তাকিয়ে র‌ইলাম। তা দেখে ফারিয়া রেগে গেলো তা দেখে। রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগে কোথা থেকে ইহান চলে এলো। ইহানকে দেখে কটমট চোখে তাকিয়ে চলে গেলো ফারিয়া। ইহান আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখতে লাগলো। কপাল কুঁচকে। আমি মুখে হাসি এনে তাকিয়ে আছি। ইহান নিশ্চয়ই আজ আমার রুপের প্রশংসা করবে। আমি সেই খুশিতে দাঁত কেলিয়ে ভাব নিয়ে চেয়ে আছি।

ইহান আমাকে পরোক্ষ করা শেষ করে আরেক পা এগিয়ে এসে আমার মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। ওর চোখে মুখে আমি নেশা দেখতে পাচ্ছি। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তো এমন দৃষ্টি দেখে সুখের সাগরে ভাসছি।
আমার তো প্রশংসা শুনার জন্য আর তর স‌ইছে না তাই আমি আহ্লাদী সুরে বললাম, ‘ আমাকে কেমন লাগছে?’

আমার কথা ইহানের কানে যেতেই ইহানের সম্মতি ফিযে আসে। আর ছিটকে দূরে সরে যায়। অপ্রস্তুত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ কি বললে?’

‘আমাকে কেমন লাগছে?” আবার বললাম।

ইহান আমার কথা শুনে ভ্রু কুটি আরে তাকিয়ে আছে। আমি শুনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। আমার সমস্ত আশা ভঙ্গ করে ইহান তাচ্ছিল্য করে বললো,

‘ জগন্য লাগছে। আটা ময়দা মেখে একদম প্রত্নীর মতো লাগছে। একটু মানায়নি তোমাকে। এমন বাজে করে কে সাজিয়ে দিয়েছে তোমাকে। এর থেকে তো কম সাজেই মুটামুটি ভালো দেখায়।

বলেই চোখ মুখ কেমন করে ফেললো। আমার হাসি খুশি মুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গেলো। ইহানের কথা শুনে আমার কান্না পেয়ে গেলো। আমি অনেক কষ্টে কান্না আটকে হাতের মুঠোয় শাড়ির এক অংশ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
ইহান চলে গেছে আমার চোখের কোনে জল জমে উঠেছে। আমি তা মুছে নিলাম। ইমা আপু আমাকে হলুদ দেওয়ার জন্য ডাকছে আমি যেতে পারছি না। আমার আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।
চলে যাব তখন আবার সেই ছেলেটা এসে হাজির
হলো। যে ছেলের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম। ছেলেটা আমার কাছের এসেই হেসে বললো,
‘ হাই বিউটিফুল গার্ল! আই এম শুভ্র! ইউ?

আমি কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে আচমকা ছেলেটা আমার হাত ধরে আটকে ফেললো। আমি চমকে উঠলাম,

‘ সরি সরি কিছু মনে করবেন না। আপনার কি মন খারাপ??

‘ নাহ। কিন্তু আপনি আমার হাত কেন ধরলেন হোয়াই?

‘ আই এম ভেরি সরি। আমি আসলে খারাপ ইনটেনশণ থেকে হাত ধরি না। আপনি কি আমার উপর বিরক্ত?’

‘ যেভাবে ধরেন‌ এটা আপনার উচিত হয়নি। আর আমি আপনার উপর শুধু বিরক্ত না রাগ ও। ‘

‘ তখনকার জন্য আই এম সরি। আপনার নামটা কি জানতে পারি?’

‘ না।’

বলেই চলে‌ যাওয়া ধরলাম। ফারজানা আপু এসে আমার হাত ধরে বললো, কি ব্যাপার ক‌ই যাও। আসো সবার হলুদ দেওয়া তো শেষ হয়ে গেল তুমি দিবে না।’

‘ আমার ভালো লাগছে না আপু। তোমরা দাও। আমি রুমে যাবো মাথা ব্যথা করছে।’

‘একি কথা একটু দিয়ে রুমে যে ও। আসো সবাই কত মজা করছে দেখো। ভালো লাগবে।’

আমার কথা না শুনেই টেনে নিয়ে গেলো।না চাইতেও আপুকে হলুদ লাগালাম। আপু ও আমার গালে হলুদ লাগিয়ে দিলো। আর মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে তোর মুখটা আমার কালো করে রেখেছিস কেন?’

আমি কিছুনা বললাম। আপু হাত টেনে বসিয়ে দিলো তার পাশে আর বললো,

‘ সত্যি করে বল। কেউ কিছু বলেছে?’

আমি চুপ করেই আছি। তাকে এখন কিভাবে বলবো তার ভাইয়ের জন্য আমার মন খারাপ। এটা কেমন দেখায়। তাই চেপে গেলাম। আমি উঠে রিফাত ভাইয়াকে ও একটু হলুদ ছুঁয়ে দিলাম।আর স্টেজে থেকে নেমে এলাম। জেরিন রা সবাই হলুদ নিয়ে দৌড়াচ্ছে। আমি ভয়ে এক কোনে দাঁড়িয়ে আছি আমাকে ও না কখন ভূত করে দেয়। তাই লুকিয়ে আছি।

আর সবার দিকে দিকে তাকিয়ে হাসছি। ইহানের জন্য নিজের আনন্দ মাটি কেন করবো। উনাকে তো আমি কেয়ার‌ই করবো না আর। ভাই হয়ে বোনকে এই ভাবে বললো ব‌দমাইশ লোক একটা। কখনো তোর ভালো হবে না দেখিস।

সবার মজা করা দেখে আমি হাসছিলাম কিন্তু কার যেন এই হাসিটা পছন্দ হলো না। তাই তো আমার হাসি কেড়ে নিলো এককা পুরুষালী হাত। আমি কিছু বুঝার আগেই লোকটা আমার বাম হাত মুচড়ে ধরলো। ব্যাথায় আমার চোখের কোনে জল জমতে লাগলো। আমি , কেরে বলে তাকানোর আগেই লোকটা আমাকে টেনে একটা অন্ধকার বদ্ধ ঘরে ঢুকে গেলো। আর ঢুকেই দরজা খট করে লাগিয়ে আমাকে দেয়ালে ঠেসে ধরল। লোকটা একদম আমার গা ঘেষে দাড়িয়ে আছে। ভয়ে আমার বুক কাপছে। লোকটার পারফিউম এর ঘ্রান আমার পরিচিত লাগছে কিন্তু বুঝতে পারছি না। লোকটা যে ইহান দুই মিনিট লাগলো বুঝতে। জানালা বেদ করে এক চিলতে আলোতে আমি তার মুখটা স্পষ্ট দেখলাম। সাথে সাথে আমার ছটফটানি কমে গেলো। আমি বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনী আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে। উনি আমার বাম হাত মুচড়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

‘ হাউ ডেয়ার ইউ! তোমার সাহস কি করে হলো ওই ছেলেটাকে হাত স্পর্শ করতে দেওয়ার??’

আমি কেঁপে উঠলাম ইহানের কথা শুনে। সাথে বিস্মিত হলাম। উনি জানলো কি করে শুভ্র আমার হাত ধরেছে?

‘ আমি ব্যাথা পাচ্ছি!’ নিচু স্বরে বললাম।

আমার কথা কানে যেতে হাত ছেড়ে দিলো। কিন্তু আমার কাছে থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো না। তার প্রত্যেকটা শ্বাস প্রশ্বাস আমি শুনতে পাচ্ছি। সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আচমকা ইহান আমার পায়ের কাছে বসে পরলো হাঁটু গেড়ে আমি হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। কি করছেন উনি এমন প্রপোজ স্টাইলে বসছে কেন? আমাকে প্রপোজ করবে নাকি?

আমি ধরেই নিয়েছি প্রপোজ করবে। আমি তো লজ্জায় লাল নীল হচ্ছি কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমার বাম পা টেনে ধরলো আমি চমকে পেছাতে চাইলাম কিন্তু সম্ভব হলো না। আমি তো দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আছি পেছাবো কি করে? আমি পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছি পা টানছে কেন? উনির মাথা গেলো নাকি?

‘ পা দাও।’

‘ মানে আপনি ঠিক আছেন? এমন করছেন কেন? আমার পা টানছেন কেন?’

‘ স্টুপিড! পা উঁচু করো!’

‘ কিন্তু….

ইহানের রাগী চোখের মনি দেখে ভড়কে গেলাম আমি। আর কাঁপতে কাঁপতে পা উঁচু করলাম।
ইহান আমার পা টেনে নিজের হাঁটুর উপর রেখে একটা পায়েল বের করে পায়ে পরিয়ে দিলো। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। এটা আমার টা না নতুন এটা। ইহান পায়েল পায়ে পরিয়েই আচমকা নিচু হয়ে ওর ওষ্ঠের স্পর্শ করলো। আমি কোমল স্পর্শ পেয়ে দুহাতে শাড়ি খামচে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। আমার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন।আমি টেনে পা সরিয়ে দৌড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। ইহান এটা কেন করলো? উনি কি তাহলে আমাকে ভালোবাসেন?

বাকিটা সময় আমার স্বপ্নের মতো কাটলো ইহান আমাকে ভালোবাসে। আমি সিউর খুশিতে আমার নাচতৈ ইচ্ছে করছে। আমি নাচতে নাচতে অনুষ্ঠানে চলে এলাম।
রাতে অনুষ্ঠান শেষে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘুমানোর চেষ্টা করছে। আর আমি আনন্দে ঘুমাতে পারছি না। তাই উঠে বেরিয়ে বাগানে চলে এলাম। ঝলমলে আলোতে আর আকাশে পূর্ণ চাঁদের আলোতে অপূর্ব লাগছে সময়টা। আমি ইহানের মুখটা ভেবে মুচকি মুচকি হাসছি আর সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ সামনে একজন নর নারী কে দেখতে পেলাম। আমি এগুতে ইহান আর ফারিয়াকে দেখলাম। ইহান ফারিয়ার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে গোলাপ হাতে বলছে ‘ আই লাভ ইউ’
দৃশ্যটা দেখে আমার সব আনন্দ হাওয়া হয়ে গেলো সেকেন্ড এ। আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এসব কি হচ্ছে। ইহান ফারিয়াকে ‘ ভালোবাসি’ বলছে কেন? উনি তো আমাকে ভালোবাসে। তাহলে কি আমার ভাবনা সব ভুল ছিল? উনি আমাকে ভালোবাসেন না। আমার কি যেন হলো ইহান আমাকে ভালোবাসে না ভাবতেই তীব্র কষ্ট হতে লাগল। আমার মাথার যন্ত্রনা হতে লাগল। আমি ওখানেই জ্ঞান হারাতে লাগলাম। তখন দেখতে পেলাম শুভ্র নামের ছেলেটি আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। আর আমার দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছে,

‘হ্যালো এই যে ম্যাডাম কি হয়েছে আপনার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলুন আমাকে!’

আর কোন কথা শুনতে পেলাম না। আমি অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়লাম তার বাহুতে‌ই।

#চলবে…..
#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here