এক চিলতে রোদ ২ পর্ব -২৬+২৭

#এক_চিলতে_রোদ-২
#Writer_Nondini_Nila
(কপি করা নিষেধ)

২৬.

মাঝরাতে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল আমার। ইহানের সাথে সময় কাটানোর চাও পর যতটা মন ভালো ছিল তার থেকে দ্বিগুন খারাপ হয়ে গেল স্বপ্ন দেখার পরে। সারা শরীর আমার ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। কপালে ঘাম হাত দিয়ে মুছতে মুছতে চিৎকার করে উঠে বসেছি বিছানার উপর। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আমি। ভয়ে আমার হাত পা অনবরত কাঁপছে।‌ এসির মধ্যে আমি এতোটা ঘেমে গেছি। লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম তিনটা বাজে। এমন একটা বাজে স্বপ্ন কেন দেখলাম! বাবা তো আজ বাসায় নাই। আগেও কত সময় বাবা বাসার বাইরে থেকেছে ক‌ই কখনো তো এমন খারাপ স্বপ্ন দেখি নাই। আজ তাহলে কেন? তাহলে কি বাবার কোন বিপদ হলো? আমি ভয়ে ছুটে এলাম আম্মুর রুমে। আমাকে এমন হাঁপাতে দেখে আম্মু ঘুম থেকে উঠে বসলো ধরফরিয়ে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে? আমি কথা বলতে পারছিনা আমাকে জাপ্টে ধরে স্বপ্নের কথা বললাম। আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

‘খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস। এ সব স্বপ্ন সত্যি হয় নাকি। ভয় পাসনা শয়তান আমাদের এমন বাজে স্বপ্ন দেখিয়ে বিভ্রান্ত করে। স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না। কি অবস্থা করেছিস সামান্য স্বপ্ন দেখে এতটা হাইফাই হয়।’

আমি বললাম, ‘আমার খুব ভয় করছে তুমি আব্বুকে একটা কল করো না প্লিজ! সুস্থ আছে কিনা জিজ্ঞেস করো! না হলে আমি ঘুমাতে পারবো না।’

আমার ভীতু মুখ দেখে আম্মুর ও চিন্তা হচ্ছে কিন্তু আমার কাছে প্রকাশ করছে না। আমার জন্য কল করলো কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। তাই বললো,

‘তোর আব্বু ঘুমাচ্ছে। মাঝ রাতে কে জেগে বসে আছে বলতো। এখন ফোন ধরবে না সকাল কথা বলে নিছ এখন ঘুমা।’

আমি মানলাম না আরো কয়েকবার কল করলাম পঞ্চম বার আব্বু ঘুমধুম কন্ঠে রিসিভ করে হ্যালো বলল। এবার আমি শান্তি পেলাম। কথা না বলেই ঠাস করে আম্মুর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আব্বুর কন্ঠ শুনে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি আব্বু সুস্থ আছে এখন আমি শান্তি। আম্মু আব্বুর সাথে দুইএকটা কথা বলে রেখে দিলো।

পরদিন বিকাল বেলা আব্বু বাসায় আসে। আব্বুকে কাছে পেতে‌ই জাপ্টে ধরে বসে ছিলাম। স্বপ্নটা একদম বাস্তব এর মতো লেগেছে মনে হয়েছে আমি হারিয়ে ফেলেছি আব্বুকে। আব্বু আমার ছেলেমানুষি দেখে হাসাহাসি করলো। কিন্তু আমার কোন হেলদোল হলো না। আমি সত্যি ভয় পেয়েছি
আমাকে ছুয়ে তার বুকে মাথা রেখে আমার ভয়টা কেটেছে।

আজ শুক্রবার আব্বু বাসায় আছেন। দুপুরবেলা ডিনার করতে ডাইনিং টেবিলে বসে আছি সবাই। আববু আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে সেই নিয়ে কথা হচ্ছে। তখন কলিং বেল বেজে উঠল। এই সময় আবার কে আসলো তিনজনে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি উঠতে যাবো। আমার আগে আম্মু চলে গেল দরজা খুলতে। আমি আব্বুর সাথে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে পরিকল্পনা করছে কোথায় যাব। আব্বু দুইদিন ছুটি নেবে আমাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য। কথা বলতে বলতে তাকিয়ে দেখি ইহান। হাসি মুখে আম্মুর সাথে কথা বলতে বলতে আসছে। আমার কথা থেমে গেলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এই সময়ই ইহান এখানে কি করছে? আমি বড় বড় চোখ করে ইহানের দিকে তাকিয়ে আছি। ইহান আমার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে আব্বুর দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। দাঁড়িয়ে থেকে এক দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ও মা অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবছি পাগলের মতো দাঁড়িয়ে পরলো কেন?

আচমকা আমার আব্বুকে চাচচু বলে চিৎকার করে জাপ্টে ধরলো ইহান। আমি ও মা হা করে তাকিয়ে আছি। আব্বু নিজেও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পরেছে চেয়ার থেকে‌।

দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে তারা পূর্ব পরিচিত। খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাদের মধ্যে। আব্বুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখ ছল ছল করছে। ইহান আব্বুকে ছেড়ে বললো,

‘ চাচ্চু তুমি? কতোদিন পর তোমাকে দেখলাম। কিন্তু আমার তোমাকে চিনতে একটু ও কষ্ট হয় নি। তোমাকে কতো মিস করেছি জানো। হুট করেই কোথায় হারিয়ে গেছিলে তুমি? সবাইকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে আমার সাথে রাগারাগী করতো তাই আস্তে আস্তে আর তোমাকে খুঁজতাম না। আর আজ হঠাত করে তোমাকে খুঁজে পেলাম!’

বাবা বললো, ‘ কেমন আছিস তোরা?’

‘বাকি সবার কথা জানিনা কিন্তু আমি তো ভালো নেই! তুমি কেন আমাদের ফেলে চলে এসেছো। কেন আর বাড়ি ফিরে যাও নি। দাদু কত কান্না করা তোমার কথা ভেবে। আর তখন আব্বু বকা দেয়। আব্বু এমন কেন করে?’

‘ আমি যে তার কথা শুনি নি তাই।’

‘কি কথা শোনোনি তুমি?’

‘মা কেমন আছে রে?’কথা ঘুরিয়ে বলল।

‘ দাদু বেশি ভালো না। বয়সের সাথে নানান রোগ বাসা বেধেছে বিছানা থেকেই তো উঠতে পারে না।কয়েদিন সুস্থ তো কয়েকদিন বিছানায় পরে থাকে।’

‘ আর ভাইয়া ভাবি কেমন আছে?’

‘ ভালোই। ‘

‘ তুই এখানে কি করে?’

একথা জিজ্ঞেস করতেই ইহান মাথা ঘুরিয়ে আমারও মার দিকে তাকালো। আমি আর মা একসাথে দাঁড়িয়ে তাদের কোথায় গিলছিলাম। ইহান আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘আমার মাথায় কিছু ঢুকছে চাচ্চু তুমি এখানে! আন্টি আর ঊষার সাথে কি করছো?’

ইহানের কথা শুনতেই আব্বু বলে উঠলো, ‘ তোর চাচি। আর ঊষার আমার একমাত্র মেয়ে। তোর বোন।’

‘ হোয়াট? হাল্কা চেঁচিয়ে উঠলো। তারপর ঊষার দিকে তাকিয়ে বলল,‌ বোন!! ইমপসিবল।’

আমি বোকার মতো সব কথা শুনলাম। আর এতোক্ষণে আমার মাথায় সব ঢুকলো। ইহান আমার বড় চাচার ছেলে। আমার আব্বু রা তিন ভাই। ইহান বড় চাচার ছেলে। আমার দাদি আছেন। আর আমার মেজ চাচারা নাকি বিদেশ থাকেন। আমার আমার আব্বু তিনি বাসা থেকে দূরে আছেন। কারণ তিনি তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে আমার আম্মুকে বিয়ে করেছেন। এটা কেউ মানতে পারেনি। এজন্য বাবা বাসা ছেড়ে বের হয়ে এসেছিল আম্মুর হাত ধরে। তারপর থেকে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।
ইহানকে নিয়ে আমরা খেতে বসলাম। আমি খাচ্ছি কম দুজনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছি বেশি। ইহান ও আব্বু দুজনে উজ্জ্বল মুখে গল্প করে যাচ্ছে।

খাওয়া শেষে আমি ফিসফিসিয়ে আম্মুকে বললাম,

‘ আম্মু তুমি ইহানকে চিনলে না কেন?’

‘ আমি কি করে চিনবো আমি কি ওকে আগে দেখেছি নাকি!

‘ আব্বুর সাথে বিয়ের পর কি একদিন ও আমার দাদুর বাসায় যাওনি তুমি?’

‘ একদিন গেছিলাম। সেদিন শুধু তোর বড় চাচা, চাচি আর তোর দাদিকে দেখেছি আর কাউকে দেখি নি তো।’

‘ ওহ্।’

ইহানের সাথে আমার আর কথা বলা হলো না। তিনি বিকেল ভর আব্বুর সাথে কাটালো। তারপর সন্ধ্যায় চলে গেলো। আব্বু থাকার জন্য অনুরোধ করছিলো। কিন্তু ইহান থাকে নি। বাসায় এসব জানাতে না করলো আব্বু। কিন্তু দাদুর সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করতে বলেছে ইহান কে।
ইহানের চলে যাওয়ার সময় আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলাম।
আজ আমি আমার দাদুর বাড়িটা ও খোঁজে পেলাম। এতে আমার আনন্দ হ‌ওয়া উচিত নাকি তারা আমাদের নানু বাসার সবার মতো ঘৃণা করে ভেবে কষ্ট পাবো বুঝতে পারছি না। ইহান সম্পর্কে আমার ভাই। কিন্তু আমি তো তাকে ভাই ভাবি না আর ভাবতেও পারবো না। আচ্ছা আব্বুর সাথে তাদের ঝামেলা না হলে আমি ছোট থেকেই ইহান কে চিনতাম। একসাথে থাকতাম। একবাসায়। উফ কি ভালোটাই না হতো কিন্তু তা তো সম্ভব না। আচ্ছা নানুবাড়ির সবার সাথে যেমন আমাদের ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে সেই ভাবেই যদি দাদা বাড়ির সবার সাথেও হয়ে যেতো কত্তো ভালো হতো।

দাদু বাড়ির হদিস পাওয়ার পর থেকে সে বাড়িতে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা পোষন করলাম নিজের মধ্যে। কিন্তু সেই বাসায় আমি যাবো কিভাবে। আব্বু তো কখনো যাবেনা। গালে হাত দিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে এইসব ভেবে যাচ্ছি। হুট করেই ইমা আপু্র কথা মাথায় এলো তিনি তো ইহানের বোন তারমানে আমার চাচতো বোন।‌ তার মাধ্যমে তো আমি যেতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ।আপুর সাথে আমার একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল। তাই তার নাম্বারটা আমার কাছে আছে। আমি ছুটে এসে আপুকে কল করলাম। ইহান একটা ছেলে মানুষ তার মাধ্যমে তো আর তার বাসায় যেতে পারি না।
আধা ঘন্টার মত আপুর সাথে কথা বললাম।আপু তার বাসা যাওয়ার কথা অনেক বার বললো। আগে আমি মানা করলেও আজকে আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেছি।
আমি আপুকে বললাম ঠিকানা দিয়ে দাও আমি চলে আসব একাই। আপু বলল না আমি তোমাকে গিয়ে নিয়ে আসব তোমার ঠিকানা আমাকে দাও। আমি জড়াজড়ি করে বললাম,

‘আমি একা আসতে পারবো তুমি চিন্তা করো না
তুমি শুধু আম্মুর সাথে একটু কথা বলো! না হলে আমাকে যেতে দেবে না।’

আপু আচ্ছা বলে আম্মুকে ফোন দিতে বলল। আমি ছুটে গিয়ে আম্মুর কাছে ফোন দিলাম। আম্মু কে কার সাথে কথা বলবো! এসব জিজ্ঞেস করে অস্থির করে ফেলছে। আমি উত্তর না দিয়ে তার কানে দিয়ে বললাম,, ‘ কথা বলো। ‘

আম্মু কথা বলতেছে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি। ফোন রেখে আমার দিকে‌ বাড়িয়ে বললো,

‘ আচ্ছা যা। কিন্তু তোর আব্বু যেন নি জানে তুই ওই বাসায় গিয়েছিস।’

‘কিচ্ছু জানবে না আম্মু কিন্তু তুমি কিভাবে বুঝলে ইমা ওই পরিবারের কেউ?’

‘বোকা মেয়ে! প্রথম দিন‌ই যে ইহানকে ইমার বোন বলেছিলি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি!’

আমি ইশ বলে জিভ কামড়ে চলে এলাম আমি একদম মন ভোলা ধ্যাত।
দুইদিন পর ইমা আপু ফ্রী আছে শুনেই চলে এলাম সকাল সকাল। এখানে আসার পর আমার খাতির যত্নের অভাব হচ্ছে না। সবাই মিলে আমার খাতির যত্ন করছে। আমি সবাইকে মন ভরে দেখছি। বাসার সবাইকে দেখছি। এটা তো আমারই বাড়ি। আব্বুর সাথে যদি তাদের দ্বন্দ্ব না হতো তাহলে তো আমি এখানে বড় হতাম আমার ছেলেবেলা আমার শৈশব কৈশোর সব এইখানে কাটতো। আমাকে একাকিত্ব ভোগ করতে হতো না। তখনই ইমা আপুকে আমি ছোটবেলা থেকেই আপু বলতে পারতাম। ইশ কতো ভালো হতো। মন খারাপ হয়ে গেল। আমার যে দাদু তিনি পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রাখে। তার সাথে আমার একবার কথা হয়েছে। তিনি রুমের বাইরে আসতে পারে না তার হাঁটু ব্যথা। ব্যথা কমলে লাঠি ভর করে একটু আকটু হাঁটেন। কিন্তু ইদানিং নাকি ব্যথা বেরেছে এজন্য তিনি নড়াচড়া করেন না। তাই তার কাছে গিয়ে আমি দেখা করে এসেছি গল্প করেছি।

কথায় কথায় তাকে আমি দাদু বলে ও ডেকেছি। তিনি আমাকে দাদু বলে ডাকার সম্মতি ও দিয়েছেন। দশটার দিকে এ বাসায় এসেছি তারপর দুপুরে লাঞ্চ করেছি। ইমা আপুর বোন ইলা অপুকেও এক ঝলক দেখেছিলাম তিনি খুব একটা কথা বলেনা অহংকারি টাইপের। তার মাকেও আমার তেমনই লাগে। কিন্তু আমার সাথে ভালো বিহেভ‌ই করেছে।

সবকিছু মন মত হলেও সবাইকে পেয়ে আনন্দিত হলেও এই সবকিছু মাঝে আমি ইহান কে মিস করেছি। আসার পর থেকে আমার দু’চোখ তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে চারপাশে ঘুরেছি। কিন্তু তার দেখা পাইনি। তিনি আদৌ বাসায় এসেছে কিনা। তার খবর আমি জানিনা। কথায় কথায় ইহানের রুমে এক নজর দেখে ছিলাম। কিন্তু সেই দিকে যাওয়ার সাহস হয়নি। আর ইমা আপুর রুমে আর ইহানের রুমের অনেকটা ব্যবধান। মাঝখানে দুইটা রুম পরে। তাই আমি শুধু তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু বিকেলে গল্পের সময় জানতে পেলাম ইহান নাকি কাল থেকে বাসায় নাই। ফ্রেন্ডের জন্মদিন ছিলো কাল সেখানে আছে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল ইস ইহান বাসায় থাকলে কত ভালো হতো। আমাকে দেখে চমকে যেত তা রিয়াকশন আমি দেখতে পারলাম না। আর কতদিন ধরে হামকে দেখে না তাকেও আমি দুচোখ ভরে দেখতে পারতাম। কিছুই হলো না মন খারাপ করে ইমা আপুকে বললাম,,

‘ এখন আমি চলে যাব আপু।’

‘এই না আজকে তুই থাকবি। আজ কোনো যাওয়া হচ্ছে না। কাল আমি তোকে তোর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবো।’

‘কি বলছে সারা দিন তো থাকলাম। রাত থাকতে পারবো না আব্বু আম্মু খুব রাগ করবে।’

‘ কিছু হবে না আমি তাদের ম্যানেজ করে নেব তুই কোন চিন্তা করিস না নিশ্চিন্তে বসে থাক।’

‘আরেক দিন এসে থাকবো প্রমিজ। প্লিজ আজকে জোর করো না আজকে চলে যায়।’

আপু নাছোড়বান্দা আমাকে আজকে যেতে দেবেই না। তিনি ফোন করলো আম্মু কে আর মাও কি সুন্দর রাজি হয়ে গেলো। লাউড স্পিকার ছিল তাই আমি তাদের কথোপথন সব শুনতে পেলাম। এবার আর কি থাকতেই হলো। আমার মনটা ভালো নাই। ইহান আজ ও নিশ্চিত আসবে না বাসায় বন্ধুর বাসায় থেকে যাবে। এখানে থাকলে আরো তার কথা মনে পড়ে বেশি। কারণ রুম ভর্তি তাদের ফটোর অভাব নাই। কিন্তু আব্বুর একটা ফটোও এই বাসায় খুঁজে পেলাম না। এতটাই রাগ যে আব্বুর একটা ফটো ও রাখিনি।

ডিনারের পর ইমা আপুর রুমে শুয়ে পরলাম। আপু ল্যাপটপে কি যেন কি করছে আমি দুই একটা কথা বলি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সকালই উঠে পরলাম। রাতে অনেকবার জেগে ছিলাম অন্য জায়গায় আমার ঘুম ভালো হয় না কিন্তু চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিলাম আমি। সকালের আলো ফুটতেই উঠে বাইরে চলে এলাম। সারা বাড়ি শুনশান নিস্তব্ধ। এত সকালে কি বোধ হয় ওঠেনা।নামাজ পড়ার জন্য আমার সকাল সকালে উঠতে হয় কিন্তু আবার আমি ঘুমায় যাই। কিন্তু আজকের ঘুমালাম না নিস্তব্ধ বাড়িতে আমি একাই এদিক ওদিক ঘুরঘুর লাগলাম। আমি এত আস্তে আস্তে পা ফেলে হাঁটছি কেউ আমাকে এখন দেখবে চোর‌ই ভাববে। ঘোরাঘুরি করতে করতে এখানে দরজার সামনে এসে দাড়ালাম। তিনি তো বাসায় নাই। তাই আমার রুমের ভেতরে ঢোকার ইচ্ছা জাগল। ইহানের রুমটা দেখার ইচ্ছা সংযত করতে পারলাম না। আশেপাশে আরেকবার তাকিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। এবার আমি ইহানের রুমটা দেখবো খুব ভালো করে।
#এক_চিলতে_রোদ-২
#Writer_Nondini_Nila
(কপি করা নিষেধ)

|অতিরিক্ত পর্ব|

আমার হার্ট বিট জোরে জোরে বিট করছে। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করে পেছনে ঘুরলাম। বেডরুমের জানলা দরজার সবকিছু বন্ধ তাই বাইরের মৃদু আলো রুমে আসতে পারেনি। ডিম লাইটের আলোতে আমি কিছুই যেন দেখতে পেলাম। তাই বড় বড় পা ফেলে চলে গেলাম জানলার কাছে আর পর্দা সরিয়ে বাইরের আলো ভেতরে ঢোকার রাস্তা করে দিলাম। লাইট জ্বালালাম না এইবার রুমটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আর এই বাইরে মৃদু আলোতে বিছানায় দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। চাদর মুড়ি দিয়ে কে যেন শুয়ে আছে বিছানায়। ইহান তো বাসায় নেই তাহলে এখানে কে শুয়ে আছে! ভূওওওওত নয় তো। আমি চিৎকার করতে গিয়ে ও মুখে হাত চেপে ধরলাম। থরথর করে কাঁপছি আমি। রুম দেখার শখ নিমিষেই দূর হয়ে গেছে। আমি ভয়ার্ত চোখে বিছানার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার হাঁটু কাঁপছে। ঘনঘন পলক ফেলছি। আমি কাঁপা চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। কমপক্ষে দশ কদম যেতে হবে বের হতে চাইলে তা সম্ভব না। ভূত টা আমাকে দেখলেই ঘাড় মটকে দেবে। আমি শব্দ হীন পায়ে পা ফেলতে লাগলাম। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তেছি। কেন যে পাকনামো করে এই রুমে আসতে গিয়েছিলাম। আমি বিছানা ক্রস করতে যাব তখন চাদর গায়ে ভূত টা নরে উঠলো। আমি এটা দেখে ভয়ে আরো কাপাকাপি করতে লাগলাম। আর অসাবধানতা বিছানায় সাথে পায়ে বেজে
ধপাস করে বিছানায় পরে গেলাম। আল্লাহ বাঁচিয়ে দাও এবারে মতো। আমি আর জীবনে পাকনামো করবে না। বলেই কান্না করতেছি। বিছানার পরে আমি ধরেই নিয়েছে আমাকে এবার মেরেই ফেলবে এই ভূত টা‌। আমি ঠাস করূ বিছানায় পরতেই ভূতের ঘুম উবে গেল। তিনি চাদর ফেলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। আমি চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে দোয়া-দরুদ পড়ছি। আর ভূতটা বিরক্তিকর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,

‘হোয়াট ইজ দিস? হোয়াট আর ইউ ডুইং হেয়ার?’ ইহানের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে।

পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর কানে আসতেই আমার দোয়া পড়া বন্ধ হলো। আমি অবাক চোখ তাকালাম। তাকাতেই দেখলাম আমার সামনে উদাম গায়ে বসে আছে। ঘুমঘুম ভাব চোখে মুখে। আমাকে দেখে আশ্চর্য মাত্রায় পৌঁছেছে।

ইহানকে দেখেই আমার ছুটে গেছে আমি বেড থেকে উঠে বসলাম। আর বোকা গলায় বললাম,

‘ আপনি শুয়ে ছিলেন তার মানে? আর আমি কতো কিছু ভাবছিলাম। ইশ কি ভয়টায় না পেলাম। আগে যদি জানতাম এটা আপনি। তাহলে আমাকে শুধু শুধু এতো ভয় পেতে হতো না।’

ইহান চমকানো গলার স্বরে বললো, ‘ তততুমি আমার বাসায় আমার বেডরুমে কি করছো?’

‘ আগে আমার কথার উত্তর দিন। আপনি না কাল আপনার ফ্রেন্ড এর বাসায় ছিলেন। আপনার ফ্রেন্ডের জন্মদিন। বাসায় আসলেন কখন??’

‘ তুমি জানলে কি করে আমার ফ্রেন্ডের জন্মদিন??’

‘ যেভাবে এখানে এসেছি সেই ভাবেই জেনেছি। বলুন বাসায় কখন আসলেন?’

‘ রাতেই এসেছি। আর তুমি এই বাসায় কিভাবে এলে এতো সকালে সত্যি করে বলো?’ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইহান আমার দিকে।

‘ ইটস ম্যাজিক!’

আমার কথা শুনে ইহান চোখমুখ কঠিন করে ফেললো। আমার বাহু শক্ত করে ধরে টেনে বিছানা থেকে নামলো।

‘ফাইজলামি না করে সত্যি করে বলো তুমি এই ভোরে আমার রুমে আমার বাসায় কি করে এলে?’

‘আরে এমন করছেন কেন? এটাতো আমারও দাদু বাসা। আমিতো এখানে আসতে পারি তাইনা। চাচাজানের সাথে যদি আব্বুর ঝামেলা না হতো তাহলে কি আমি বাড়ির বাইরে থাকতাম? তখন কি আমাকে এভাবে বলতে পারতেন?’

‘উফফ, একদম নাটক করবেনা তুমি বাসায় আছ তাতে আমার কোন সমস্যা নাই। কিন্তু তুমি আমার রুমে কি করছ সেটা বলো। একটা ছেলের রুমে তুমি এভাবে ঢুকে পড়লে লজ্জা করে না তোমার??’

‘ লজ্জা করবে কেনো আমি কি জানতাম যে আপনি রুমে আছেন! আমিতো ভেবেছি আপনি বাসায় আসেনি না। ইমা আপু তো তাই বলল আপনি হয়তো আসবেন না। এর জন্যই তো আমি আসলাম না হলে কি আমি আসতাম নাকি!’

ঊষা নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে আর লজ্জায় লাল-নীল হচ্ছে এটা দেখে ইহান ব্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করল,

‘কি হচ্ছে তুমি এমন লজ্জায় লাল হচ্ছ কেন? পাগল হয়ে গেলে নাকি! আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো তুমি এবাসায় কবে এলে কার সাথে এলে?’

আমি মাথা তুলে বললাম, ‘আমার না লজ্জা করছে!’

ইহান আমার কথা শোনে ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে বললো, ‘ হোয়াট? বলতে বলতে নিজের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল কারণটা। বিরক্তিকর একটা শ্বাস ফেলে বলল,

‘ ঢং,একটা নিষ্পাপ ছেলে নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। আর তোমার মত ধানি লঙ্কা এসে তাকে অত্যাচার করে ঘুমের মধ্যে এসে বলছে কিনা সে আবার লজ্জা পায়!!’

‘ কি বললেন আপনি আমি ধানি লঙ্কা আর আপনি নিষ্পাপ ছেলে!’

‘ এই যাও তো তুমি যেভাবে আসার এসেছ আমার রুম থেকে বিদায় হও। সকাল সকালে এসে হাঙ্গামা শুরু করে দিছো। বের হও আমার রুম থেকে আমি ঘুমাবো।’

বলেই ঠাস করে ইহান বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমি কটমট চোখে ইহানের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ইহান চোখ বন্ধ করে ছিল হুট করেই চোখ বন্ধ অবস্থায় বলে উঠলো,
‘ একটা ছেলের দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা করে না। যাও বের হ‌ও আমার রুমে থেকে।’

এতো বড় অপমান? রুমে এসেছি বলে এইভাবে তারিয়ে দিলো। খাটাশ একটা। বিরবির করে বকতে বকতে বেরিয়ে এলাম ঠাস করে দরজা খুলে।
ইহান চোখ মেলে আমার যাওয়া দেখে ঘুমিয়ে পরলো।
সকালে খাবার টেবিলে বসে আছি। ইহান এমন ভাব করে বসে আছে যেন আমাকে চেনেই না‌ আমি ভেংচি কেটে খাবার খাচ্ছি। ইমা আপু হসপিটালে যাবে তাই তার সাথেই চলে এলাম বাসায়। ইহান আমাদের আগেই চলে গেছে খাবার খেয়ে তিনি বেরিয়ে গেছে কোথায় জানি। আসার আগে আমি দাদুর সাথে আরেকবার দেখা করে এলাম। তিনি আমার দিকে স্নেহের চোখে তাকিয়ে ছিলো।

.
আজ আব্বুর সাথে আমি আম্মু ঘুরতে যাচ্ছি। সারাদিন আজ ঘুরবো। রাতে ডিনার করে বাসায় আসবো। আম্মুকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। বেগুনি কালারের শাড়ির পরেছে। আব্বু আর আমি সোফায় বসে আম্মুর জন্য ওয়েট করছিলাম।
আম্মু আসতেই দেখলাম আব্বু এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমমু্ এলেই আমরা বেরিয়ে পরলাম। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে আটটায় রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম ডিনার করার জন্য সবাই ক্লান্ত এখন। আম্মু বলল খাবার প্যাক করে নেওয়ার জন্য। আমিও তাই বললাম। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে খাওয়া যাবে। এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আব্বু তাই বললো আচ্ছা। খাবার আসা অব্দি বসে ওয়েট করেছি তখন ইহানকে দেখলাম আমি।‌
ফারিয়া আর ইহান পাশাপাশি বসে আছে। ফারিয়া কি কি জানি বলছে আর কাঁদছে। ইহান বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে আছে। সাথে ফারিয়াকে শান্ত করার চেষ্টা ও করছে। আমি হাঁ করে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ আম্মু ইহানকে দেখলো। আর দেখেই চিৎকার করে উঠলো,

আমি গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি। ফারিয়ার সাথে ইহানকে দেখে আমার একটু ও ভালো লাগছে না।
ইহান আম্মুর কথা শুনেই চমকে আমাদের দিকে তাকালো। আর সাথে সাথে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে এগিয়ে এলো।

আম্মু আব্বুর সাথে কথা বলছে। আমি তাদের কথা গিলছি। আর আড়চোখে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। ফারিয়া এবার কান্না থামিয়ে আমার দিকে কটমট চোখে করে তাকালো। তারপর উঠে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ফারিয়ার পোশাক দেখে আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। ছিঃ নির্লজ্জ বেহায়া মাইয়া। কি ছোট টপস পরছে। কালো টপস গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। হাতা কাটা গলা বড় অর্ধেক শরীর বেরিয়ে আছে। আমি চোখ সরিয়ে বিরবির করে বললাম,
‘ শরীর দেখিয়ে ইহানকে বশ করতে চায় বেহায়া কোথাকার!’

ইহান ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ ফারিয়া এটা আমার ছোট চাচা- চাচী। আর চাচ্চু এটা আমার ফ্রেন্ড ফারিয়া।’

চাচ্চু বলতেই ফারিয়া জোর পূর্বক হেসে হাই আন্টি আঙ্কেল বললো। আম্মু কেমন করে জানি তাকিয়ে আছে। আম্মুর যে ফারিয়া কে একটুও পছন্দ হয়নি বোঝায় যাচ্ছে। ফারিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ ও এখানে কি করছে??’ বলে ইহানকে প্রশ্ন করলো।

ইহান আমাকে কি বলে পরিচয় করায় তা দেখতে তাকিয়ে আছি। কিন্তু আমার আর জানা হলো না‌। তার আগেই আমার আম্মু বলে উঠলো,

‘ আমাদের একমাত্র মেয়ে ঊষা।’ বলেই আমার দিকে একবার তাকিয়ে হাসলো আম্মু।

ইহান কে আমাদের টেবিলে বসতে বললো। ইহান বসলো। আব্বুর সাথে‌ কথা বলছে। ফারিয়া ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসলো। আম্মু ফারিয়ার কাছে আমাকে নিয়ে কথা বলছে আমি মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি। আব্বু খাবার এখানেই দিতে বলেছে ইহানের দেখে। তাই হলো। ডিনার রেস্টুরেন্টের করতে হলো। ফারিয়া আর ইহান চলে গেলো। আমি ভেবেছিলাম বাইক এনেছে ইহান কিন্তু না ইহান গাড়ি নিয়ে এসেছিলো। সেটা করে চলে‌ গেলো বিদায় নিয়ে আমরাও চলে এলাম।

আমি খালি ভাবছি ইহান আর ওই ফারিয়া একসাথে বসে করছিলো কি? কি কথা বলছিলো আর ও ফারিয়া কাঁদছিলো কেন? আমাকে তো দেখতেই পারে না দেখলেই রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে। ওরা একসাথে একা ছিলো ভেবেই খারাপ লাগা এসে ঘিরে ধরলো আমাকে।
আমি এগারোটার দিকে ইহানকে কল করলাম। আমার ঘুম আসছে না বিছানায় এপাশ ওপাশ করে ফোন করেই বসলাম। কিন্তু রিসিভ হলো না। আবার করলাম। হলো না। রেগে আর করলাম না।
#এক_চিলতে_রোদ-২
#Writer_Nondini_Nila
(কপি করা নিষেধ)

২৭.

আরমোড় ভেঙে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ না হয়েই বাইরে চলে এলাম। আসার অবশ্য কারণ আছে।কারণটা হলো বাইরে আমি হাসির শব্দ পাচ্ছি জোরে জোরে। এই ভোরে কে এসেছে বাসায় যার সাথে আম্মু আব্বু এমন হাসাহাসি করছে। আব্বু বাসায় আছে কিন্তু হাসিতে আমি একটা অপরিচিত হাসির শব্দ পাচ্ছি ঠিক চিনে উঠতে পারছিনা। এটা আম্মু-আব্বুর না মনে হচ্ছে তিনজনের হাসি। হাসির রহস্য উদঘাটন করতে আমি ‌ বিছানা থেকে নেমে ড্রয়িং রুমে চলে এলাম। ড্রইং রুমে আসতেই ইহানের হাসি মাখা মুখটা ভেসে উঠলো। তিনজনে বসে কি যেন কথা বলছে আর গলা ফাঁটিয়ে হাসছে। আমি কপালে সুক্ষ্য চিন্তার ভাঁজ ফেলে ভাবছি,কি কথা বলে এত হাসছে তারা! আর সকাল সকাল ইহান‌ই বা এখানে কি করছে?
কালকের রাতের কথা মনে পড়তেই রাগে আমার নাক লাল হয়ে গেল। দুই বার ফোন করেছিলাম রিসিভ করেনি। এত ভাব দেখাতে পারে। গা জ্বলে উঠে আমার।আমি কপালে আর মুখে এলোমেলো হয়ে আসা চুল গুলো সরাতে সরাতে রাগে ফুঁসছি।হঠাৎই ইহান হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকাল আর সাথে সাথে ওর হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। আমি চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছি। কিন্তু ইহানের চাহনি একদম আলাদা। হা করে তাকিয়ে আছে।পলক ফেলছে না। আমি কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছি। কিন্তু ইহানের দৃষ্টি আমার কাছে নেশাময় লাগছে। অপলক তাকিয়ে আছে। আমি ইহানের এমন দৃষ্টি দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। আমার চোখ রাঙ্গানি কি তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি এমন হা করে তাকিয়া আছে কেন?

আমি চিন্তা করতে করতে নিজে দিকে তাকালাম। আর দিলাম এক চিৎকার সাথে সাথে উল্টা ঘুরে ভৌ দৌড়। ওরনা বিহীন প্লাজো আর গেঞ্জি পরেই চলে গিয়েছিলাম ঘুমঘুম চোখে। ওই ভাবে দেখে নিয়েছি আমাকে ইহান তাই তো ওমন হা করে তাকিয়ে ছিলো। ছিঃ কি বেশরম ছেলে!! পেছনে থেকে আম্মুর ডাক শুনেছি কিন্তু আমি থামিনি।
ফ্রেশ হয়ে রুমেই বসে আছি আমার হাতে ফোন। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে ইহানের নাম্বার। ইহান কল করছে আমি রিসিভ করছি না। করবো না। রুম থেকেও বের হবো না ভাবছি। ইহান না যাওয়া পর্যন্ত আমি রুমের বাইরে যাব না। কিন্তু আম্মুর ডাকে টিকতে পারলাম না। যেতেই হলো।

আব্বুর খাওয়া শেষ। আমার দেরি হলো কেন জিজ্ঞেস করেছে আমি কোন রকম কাটিয়েছি মিথ্যা বলে। তারপর আব্বু উঠে বেরিয়ে গেলো অফিসে। আমি ইহানের সামনের চেয়ার টেনে বসলাম। চুপচাপ খাচ্ছি। ইহান ফিসফিস করে কি যেন বলছে আমি পাত্তা দিচ্ছি না।
খেয়েই রুমে চলে এলাম। আমি আসার কিছুক্ষণ পর‌ই ইহান ও রুমে এলো আর দরজা আটকে ফেললো। আমি লাফ দিয়ে নেমে পরলাম বিছানায় থেকে।

‘ এ-একি আপনি আমার রুমে এসেছেন কেন? আর দরজা আটকালেন কেন??’

আমার কথার উত্তর দিলো না ইহান। সারা রুমে চোখ বুলাতে লাগলো। তারপর বিছানায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে পরলো আয়েশি ভঙ্গিতে তারপর বললো,

‘ বাচ্চাদের মতো রুম সাজিয়ে রেখেছো দেখছি। এ রুমে আসলে তো সবাই বাচ্চা খুজবো কিন্তু তোমাদের বাসায় কোন পিচ্ছি বাচ্চা নাই। আছে সেতো বড় বাচ্চা।’

একথা শুনতেই আমার মনে পরে গেলো আমিও ইহানের রুম দেখতে গেছিলাম আর ইহান কি ভাবটাই না নিয়েছিলো।

আমি বললাম, ‘ বের হোন বলছি আমার রুম থেকে। আপনি কোন সাহসে আমার রুমে এসেছেন? নিজের রুমে গেছিলাম বলে কতো অপমান করেছেন এখন আবার আমার রুমে এসে আমার বিছানায় বসে আছেন উঠুন আর বের হোন।’

আমার কথা কানে নিলো না ইহান। ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পরলো।

‘ আরে আরে কি করছেন! বের হতে বলছি শুতে না। আমার বিছানায় শুচ্ছেন কেন? আমাকে অপমান করেছিলেন আপনার রুমে গিয়েছিলাম বলে এখন আমার রুমে আসতে লজ্জা করলো না আপনার।’

‘ না তো লজ্জা করবে কেন? আমি তো আর কারো ঘুমের সুযোগ নিয়ে আসে নি। আর তাছাড়া আমার এতো লজ্জা নাই। লজ্জা তো নারীর ভুষণ আমি নারী না।’

আমি তেরে বিছানায় কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাগ না আমার অভিমান হচ্ছে এখন।আমি অভিমানী গলাতেই বললাম, ‘ কি বললেন আমি সুযোগ নিয়েছি কি করেছি? আমি তো বলেছি আমি জানতাম না আপনি বাসায় আছেন জানলে কি যেতাম। আর তাছাড়া ও গিয়েছি বলে ওইভাবে অপমান করবেন কেন?’
ইহান কিছু বললো না। আমি আবার বললাম,

‘ কাল কল করলাম রিসিভ ও করলেন না এতো ভাব কেন আপনার। ভাবে মাটিতে পা পরে না যেন। কল করলে রিসিভ করেন না বাসায় আসলেও কথা বলতে চাইলে আমাকে এমনভাবে ইগনোর করেন যেন আমাকে চেনেন ই না। আর ভুল করেও যদি কখনো ফোন রিসিভ করেন যা তা বলে ফোন রেখে দেন। আপনি আমার সাথে এমন করেন কেন আপনি জানেন আপনি আমার সাথে এমন করলে কত কষ্ট লাগে আমার। সবকিছু অসহ্য লাগে। রাগ হয়। অভিমান হয়। কান্না পায়। আবার সব ভুলে সেদিন আপনাদের বাসায় গিয়েছি বলে কেমন করলেন। ওটাতো আমার ও দাদু বাসা। আমি কি সেখানে যেতে পারব না। আজ যদি আব্বুর সাথে চাচাজানের সমস্যা না হত তাহলে কি আমি ও বাসার বাইরে থাকতাম। আপনার মত আমিও ওই বাসায় বড় হতাম। আগে না হয় আপনি আমার অপরিচিত ছিলেন। কিন্তু এখন তো তা না এখন তো আপনি আমার সম্পর্কে ভাই হোন।এটা জানার পর থেকে আমি আপনার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করছি আর আপনি আমাকে সম্পূর্ণ ইগনোর করছেন। কেউ তার বোনের সাথে এরকম করে বোনের সাথে কেউ ভাব দেখায়? আগে তো এমন করতেন না। আর এখন আমি আপনার পরিবারের কেউ জানার পর থেকেই এমন ভাব দেখানো শুরু করছেন কেন ? বড় ভাই কি বোনের সাথে এরকম করে বলুন!’ অভিমানে আমার চোখ দুটো ভড়ে উঠেছে। পলক ফেললেই তা গাল বেয়ে পরবে।

ইহান ফট করেই উঠে দাঁড়ালো। আর সোজা আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমি গাল মুছে ইহানের দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠলাম। ভয়ে পিছিয়ে গেলাম। ইহান রক্ত লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ইহানের রাগের কারণটা বুঝতে পারছে না। আমি তো ভেবেছিলাম যে আমার কথা শুনে উনি ইমোশন হবেন আর আমার সাথে ভালো করে কথা বলবে। ক্ষমা চাইবে। কিন্তু এ তো দেখি উল্টা হলো উনি তো রেগে বোম হয়ে গেছে মনে হচ্ছে‌।

ইহান এগিয়ে আমার কাধ চেপে ধরলো শক্ত করে আর কঠিন গলায় বলল, ‘ কি বললে তুমি ভাই? বোন মাই ফুট! গাধা আরেকদিন ভাই বোনের ভালোবাসা দেখাতে ফোন বা কথা বলতে আসলে থাপ্পড়িয়ে গাল লাল করে ফেলবো ইডিয়েট। মাইন্ড ইট।’

বলেই গটগট করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। আমার আম্মু সাথে পাশের বাসার রিতা আন্টি দেখা করতে আসায় তাকে নিয়ে আম্মু রুমে গিয়ে কি যেন করছিলো। ইহানকে সোফায় বসিয়ে। তখন ইহান সুযোগ পেয়েই আমার রুমে এসেছিলো। এখনো আম্মু রুমেই আছে। ইহান রাগে গজগজ করছে সোফায় বসে। আম্মু আসলেই চলে যাবে তাই উপরের দিকে তাকাচ্ছে। আমি তো থ মেরে কতোক্ষণ ওইখানেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে আম্মু তাড়াতাড়ি চলে এলো রিতা আন্টি কে নিয়ে। তখন আম্মু কে ইহান বায় বলে হতদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো।

আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবটাই লক্ষ্য করলাম। আমার মাথায় হাত ইহান আমাকে ভাই বোনের ভালোবাসা দেখাতে মানা করলো কেন? আমাকে কি বোন ভাবা যায় না এতটাই অপছন্দ করেন উনি আমাকে।

নাকি???

তুলির সাথে সব শেয়ার করার পর জানতে পারলাম ইহান আমাকে হয়তো খুব ভালোবাসে এজন্য বোন বলায় রাগ করেছে নাহলে খুব অপছন্দ করে এজন্য কিছুই ভাবতে চায় না। আমি চিন্তায় পরে গেলাম। ইহান আমাকে কি সত্যি ভালোবাসে? আমার তো মনে হয় না। ভালো বাসলে এতোটা খারাপ বিহেভ করতে পারতো বলে মনে হয়না।
আমি আর তাকে নিয়ে ভাববো না বলে ভাবলাম। কিন্তু আমার ভাবনাকে সত্যি হতে দেবে না বোধহয় প্রকৃতি। ইহানের ওপর দুর্বলতা নিজের মধ্যে পেয়েছিলাম।
সেটা আমি কাটিয়ে নিতে চেয়েছিলাম দূরে থেকে কিন্তু এখন তো দেখছি একদম সারাদিন আমার তার সাথেই থাকতে হবে এমন বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। চোখের সামনে তিনি ঘুরঘুর করবেন।কিন্তু নিজের দাদা বাড়ি আপন মানুষদের সাথে মেশার, থাকার লোভটা তো আমি সামলাতে পারলাম না এজন্যই তো ইমা আপুর বিয়ের খবর শুনেই আমি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেলাম। আব্বু আম্মুকে ও দাওয়াত করেছে ইমা আপু এসে। কিন্তু অদ্ভুত হলো ইমা আপু আব্বুকে চাচচু বলে নি। অপরিচিতদের মতো কথা বলেছে সৌজন্য নিয়ে। পরে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়েছে আপু যখন আব্বু আম্মুকে রাজি করালো তারপর যখন আমাকে ফিসফিস করে বলল,

‘ঊষা আমি কিন্তু জেনে গেছি তুই আমার চাচাতো বোন। আমার ছোট্ট মিষ্টি বোন। কিন্তু আমি
তাদের এখনই সবটা জানাতে চায় না যে আমি তাদের ভাইয়ের মেয়ে। জানলে তারা বিয়েতে কখনো যাবেনা। আর তারা না গেলে কখনই তারা মুখোমুখি হবেনা। আর তাদের মুখোমুখি হওয়া টা খুব দরকার।’

বিয়েটা যেহেতু কমিউনিটি সেন্টারে হবে এ জন্য একদিন আগে ইমা আপু দের সাথে আমার সেখানে যেতে হবে। আর আব্বু রাজি হয়েছে তারা শুধু বিয়ের দিন যাবে এর আগে যেতে পারবেন। ইমা আপু তাতে কোন আপত্তি করেনি।
১. মেহেন্দি, ২.গায়ে হলুদ, ৩. বিয়ে।
তিন দিনের অনুষ্ঠান। ইমা উডবি রিফাত ভাইয়া রা ও সেখানে উপস্থিত হবে খুব মজা হবে। ইমা আপুরা একদিন আগেই যাবে সেদিন আমাকে তাদের বাসায় যেতে হবে। সেখান থেকে কমিউনিটি সেন্টারে তাদের সাথে যাব। তার আগেরদিন একদিন আপু আমাকে নিতে এসেছিল বিয়ের শপিং করার জন্য। সেদিন ইহান ও ছিলো সেখানে আমার সাথে কথাও বলেছে স্বাভাবিক ভাবেই। সেদিনই রিফাত ভাইকে দেখেছি। আপু আমাকে জোর করে একটা ড্রেস কিনে দিয়েছে আমি অবশ্য নিতে চাইনি
কিন্তু এমন ভাবে জোর করলো না নিয়ে ও পারলাম না। ড্রেসটা আমি বাসায় আনিনি বিয়েতে যেতে হবে তখন যেন নিয়ে যায় সেটা বলে দিয়েছি।
আজ‌ই সেই দিন আমি ইমা আপুদের বাসায় চলে এলাম। বাসা ভর্তি লোকজন। সবাই কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আমি ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি কাউকে চিনি না সবাই অপরিচিত। এ বাসায় আমি ইমা আপু, ইলা আপু, ইহান, চাচি জাদু আর চাচাকে ছাড়া কাউকে চিনি না। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছি তখন কারো সাথে জোরে ধাক্কা খেলাম। আর ধাক্কা খেয়ে দুজনেই পরে গেলাম আমি অসাবধানতায় তার উপর পরলাম। আমি মানুষটার হাঁটুতে বসে পরেছি। তাকিয়ে দেখলাম একটা ফর্সা মেয়ে। বিদেশিদের মতো ফর্সা আমি আঁতকে ওঠে দাঁড়িয়ে পরলাম। আর মেয়েটা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিয়েছে। আমি অসহায় মুখ কথূ তাকিয়ে সরি বলছি। মেয়েটা ভালোই ব্যাথা পেয়েছে কারণ তার কোলে বসে পরেছিলাম আমি। আমি ঢোক গিলে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখছি কেউ আমাকে লক্ষ্য করেছে কিনা আমি উল্টা ঘুরে দৌড় দিলাম।মেয়েটা আমাকে দেখে নি কারন সে হাঁটু ধরে কাঁদছে।
আমি দৌড়ে ইহানে সামনে এসে পরলাম ইহান কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড? হুয়ে আর ইউ রানিং লাইক দ্যাট?’

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম,

‘ ক‌ই কিছু না তো এমনি। সবাই আমাকে রেখে চলে গেল কিনা ভেবে দৌড়াচ্ছি।’

ইহান কতোটুকু বিশ্বাহ করলো জানি না বললো, ‘ মনে হল চুরি করে ধরা খাওয়ার ভয়ে দৌড়াচ্ছ!’

আমি কিছু বলতে যাব। পেছন থেকে চেঁচামেচি আসতেই ইহান আমাকে রেখে এগিয়ে গেলো আমিও গেলাম সেই মেয়েটাকে নিয়ে সবাই আদিখ্যেতা করছে। আর মেয়েটা ফর্সা মুখ লাল করে ফেলেছে কাঁদতে কাঁদতে।
ইহান ও মেয়েটার কাছে গিয়ে চোখের জল মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘ কি হয়েছে মিষ্টি? কাঁদছিস কেন?’

ইহানের এত কেয়ার করা দেখে আমার রাগে সারা শরীরে আগুন ধরে উঠলো মনে হয়। আমি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছি। ইহানের এমন কেয়ার করা আমার মোটেও ভালো লাগছে না একটুও না।

#চলবে…
#চলবে……
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here