#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ০৩
বিয়ের পরের দিন-ই এভাবে বিপাকে ফেঁসে যেতে হবে, ভাবতেই পারেনি স্পৃহা। সকালে ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসতেই আদ্রের মা মিসেস সামায়রা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। কোনো রকম ভণিতা না করে সরাসরিই বলে ফেললেন,
-বিয়ের প্রথম সকালের নাস্তা বাড়ির নতুন বৌকে তৈরি করতে হয়- এটাই এ বাড়ির নিয়ম। তোমাকেও এটা মানতে হবে। পারবে তো?
নিয়মটা বেশ অদ্ভুত লাগলো স্পৃহার কাছে। বাড়ির কারো সাথে ভালো করে পরিচয় পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি ওর। অথচ প্রথমদিনেই ওকে রান্নাঘরে যেতে হবে। তারওপর ও রান্নাবান্নাও তেমন একটা পারে না। তাই একটু ইতস্তত করে বললো,
-আসলে আমি……
-চিন্তা করো না। সার্ভেন্টরা তোমায় হেল্প করবে। তেমন সমস্যা হবে না।
অনেকটা জোর করেই স্পৃহাকে রান্নাঘরে ঠেলে পাঠিয়ে দিলেন মিসেস সামায়রা। বাড়িতে অতিথিরা গিজগিজ করছে। আশেপাশে সার্ভেন্টেরও অভাব নেই। কিচেনে ঢুকতেই তারা স্পৃহাকে সব জিনিসপত্র কোথায় কোনটা রাখা আছে, দেখিয়ে দিলো। স্পৃহা কাঁপা কাঁপা হাতে কাজ শুরু করতেই সব সার্ভেন্ট বেরিয়ে গেল। স্পৃহা বেশ অবাক হলো। ওদের তো তাকে হেল্প করার কথা ছিল। চলে গেল কেন? সব কাজ যে তার এখন একাই করতে হবে, এটা বোঝা শেষ।
আদ্র ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো, সবাই বসে গল্প করছে ঠিকই। কিন্তু স্পৃহাকে কোথাও না দেখে পর কপালে আপনাআপনি-ই ভাজ পড়ে গেল। মিসেস সামায়রাকে ডেকে বললো,
-স্পৃহা কোথায়, মা? ওকে তো কোথাও দেখছি না!
প্রশ্নটা মিসেস সামায়রার কেমন যেন অপছন্দ হলো! ঈষৎ অপ্রসন্নের সুরে বললেন,
-স্পৃহা এখানে নেই।
-ও যে এখানে নেই, সেটা আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি। কোথায় আছে, সেটা কি জানো তুমি?
-কোথায় আবার? কিচেনে আছে। নতুন বৌ প্রথম দিন ব্রেকফাস্ট তৈরি করে, এটা আমাদের বাড়ির নিয়ম। জানো না তুমি?
আদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
-এরকম কোনো নিয়ম আছে নাকি? কই আমি তো কখনো শুনিনি!
মিসেস সামায়রা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
-তুমি এর আগে কোনো বিয়ের ফাংশন এটেন্ড করোনি, তাই জানো না! এটাই নিয়ম।
-কিন্তু মা, এতো জনের খাবার ও একা তৈরি করতে পারবে তো!
-তোমার কী মনে হয়? আমি ওকে জিজ্ঞেস করিনি? ও নিজেই বলেছে ও পারবে!
-ওহ!
আদ্র ঠোঁট গোল করে একটা ছোট শ্বাস ছাড়লো। মিসেস সামায়রা আর কিছু বললেন না। বিরক্তি নিয়ে অন্য দিকে চলে গেলেন।
স্পৃহা বহু কষ্টে রুটিগুলো তৈরি করলো যদিও এটা রুটিও তেমন ভাবে গোলাকার হয়নি। তবে মোটামুটি চলে আর কি! কিন্তু রুটির সাথে কী বানাবে? কিছুই তো ভালো করে রান্না করতে পারে না। আশেপাশে একবার তাকিয়ে ফোনটা হাতে নিল। এখন একজনই পারে তাকে সাহায্য করতে। কল দিয়ে কয়েকবার রিং হতেই রিসিভড হলো।
-পিহু! তুই? এতোদিন পর কল দিলি? আমি তোর সাথে …
-প্রান্তি!!! এসব কথার সময় নেই। কীভাবে রান্না করতে হয়, সেটা তাড়াতাড়ি বল!
প্রান্তি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,
-কীভাবে রান্না করতে হয় মানে? কিসের রান্না?
-মানে সবজি টাইপ ভাজি, আর মিষ্টি জাতীয় কিছু একটার রেসিপি বলে দে জাস্ট!
প্রান্তি অবাক হয়ে বললো,
-কিন্তু তুই এসব জেনে কী করবি? তুই রান্না করছিস? ইউটিউব দেখেই তো…
-অতো সময় নেই, সুযোগও নেই। তাড়াতাড়ি বলবি তুই? নয়তো আমি ফোন রাখলাম।
-আচ্ছা, বলছি! বলছি! শোন।
_______________________
-ফেমাস রকস্টার প্রণব মেহরাজ চৌধুরীর কি এই সাধারণ ব্যক্তিটার কথা মনে আছে?
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এমন কথা শুনে প্রণবের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। সে কাটকাট গলায় বললো,
-ইট’স অনলি প্রণব মেহরাজ, আদ্র! নট চৌধুরী। চৌধুরী পদবিটার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এটা তোকে নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবে না নিশ্চয়ই!
আদ্র মুখ বাকিয়ে বললো,
-না, আমার মনে আছে। এখন আমি তোর ওপর রেগে আছি, বুঝেছিস? নিজে রেগে এখন কেসটা উল্টে দিস না। আমি তোর বেস্টফ্রেন্ড, কিন্তু ত্…
-এই এক মিনিট! তুই রেগে আছিস কেন বল তো! আমি তো বলেছিলাম আমার নিউ অ্যালবাম নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত এখন! তোর বিয়েতে আসার সম্ভাবনা অনেক কম।
-তাই বলে একবার কনগ্র্যাচুলেইট তো অন্তত করা উচিত! ফোনও দিলি না একবার। আরে আমায় কেন ফোন দিবি? আমি তো আর সেলিব্রিটি নই, আর না আমাকে দেশ-বিদেশের মানুষ চেনে! আমি …
আদ্রের কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রণব ভ্রু কুঁচকে বললো,
-ওয়ে ড্রামাবাজ!!! নাটক বন্ধ কর। তুই আমার কাছে কী, সেটা তুই নিজেও ভালো করেই জানিস।
আদ্র ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। মাথা চুলকে বললো,
-তো কবে দেখা করছিস?
-সামনে স্পেশাল গিফট ওয়েট করছে তোদের জন্য। আমার ব্যস্ততা শেষ হোক। তারপর।
আদ্র ইতস্তত করে বললো,
-আর আঙ্কেল, আ…
কথাটা আর শেষ করতে পারলো না আদ্র। প্রণব তাড়া দিয়ে বললো,
-এখন রাখি। অডিশন আছে। বায়।
প্রণব যে ইচ্ছে করেই কথাটা এড়িয়ে গেল, আদ্র সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কিছুই বলার নেই। এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস-ই সঙ্গী!!
______________________
নাস্তা তৈরির ঝামেলা মিটিয়ে সবে মাত্র ঘরে ফিরলো স্পৃহা। রান্না নিয়ে কেউ তেমন খারাপ কিছু বলেনি বলে সে একটু স্বস্তি পেয়েছে। এতক্ষণ শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে রাখা বাঁ হাতটা বের করলো ও। হাতের তালুতে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। জ্বলছে প্রচুর। চোখ দিয়ে আপনাআপনি-ই পানি পড়ছে। নিজের পরিবারে থাকতেও অবহেলা-অনাদরে থাকতে হয়েছে ওকে। একমাত্র ভাই ছাড়া কারো ভালোবাসা পায়নি সে। এখানেও কী একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে ওকে?
-স্পৃহা!!! বিকেলে রিসিপশন। একটু প……
বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে স্পৃহার দিকে তাকাতেই কথা আঁটকে গেল আদ্রের। এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-কাঁদছো কেন, স্পৃহা? কী হয়েছে?
স্পৃহা চমকে মুখ তুলে তাকালো আদ্রের দিকে। হাতটা তাড়াতাড়ি আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো সে। আমতা আমতা করে বললো,
-তেমন কিছু না! ঐ এমনি আর কি! বাড়ির সবার কথা মনে পড়ছিল খুব।
কথাটা কেমন যেন বিশ্বাস হলো না আদ্রের! সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
-বিকেলে তো আমরা ঐ বাড়িতে যাচ্ছি-ই! মন খারাপ করো না।
স্পৃহা কিছু বললো না। মাথা নাড়ালো শুধু।
_________________________
আহির নিজের হাতে থাকা কাগজগুলো বেশ মনযোগ সহকারে দেখছে। চশমার আড়ালে থাকা চোখ দুটোতে পানি টলমল করছে ওর। বুকের ভেতর ভারী হয়ে উঠছে বারবার। কেন যে ওকে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হলো? নিজে তো শান্তি পাচ্ছে-ই না, অন্য দিকে আরেকজনের কষ্টের কারণ হতে হচ্ছে তাকে।
-পাপা! পাপা!! আমার সাথে খেলা করবে বলেছিলে না তুমি?
আহির কাগজগুলোর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো, তার চ্যাম্প ছোট্ট একটা ব্যাট আর বল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আনিলা এগিয়ে এসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
-আশফি! পাপা এখন বিজি আছে তো! বিকেলে খেলবে তোমার সাথে।
আহির আশফিকে নিজের কোলে নিয়ে হাসি মুখে বললো,
-কে বলেছে পাপা বিজি? আ’ম অলওয়েজ দেয়ার ফর মাই বয়! তাই না, চ্যাম্প?
আশফি খুশি হয়ে আহিরের হাতের মুঠোয় মুঠো মিলিয়ে বললো,
-ইয়েস! মাই পাপা ইজ দ্য বেস্ট!!
আনিলা মুখ কালো করে বললো,
-কিন্তু আহির! তুমি এভাবে…
-আনিলা, প্লিজ! আমি চাই এনজয় করতে। এসব মামলা হ্যান্ডেল করতে করতে নিজের ওপরই ক্লান্ত আমি। একটু আনন্দ তো আমি ডিজার্ভ করি!
আনিলা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। হাত কচলে বললো,
-আজ তো পিহুর রিসিপশন! যাবে না সেখানে?
আহির মলিন হাসলো শুধু। সে হাসির আড়ালে চাপা কষ্টটা আনিলা ঠিকই বুঝতে পারছে। আহির আর বাক্য ব্যয় না করেই বেরিয়ে গেল।
-চলবে…