#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৪৬)
ঢাকার বুকে তখন সন্ধ্যা। কমে এসেছে আলোর ছটা। বেড়েছে বিয়েবাড়ির হৈ-হুল্লোড়। ক্রমে ক্রমে হচ্ছে অতিথিদের আগমন। একেকজন কে একেকভাবে আপ্যায়নে ব্যস্ত সিকদার বাড়ির কর্তৃরা৷ মাগরিবের আজান পরায় সাউন্ড সিস্টেম আপাতত বন্ধ। জিরোচ্ছে ওটা।
এসি বাড়িতেও মানুষের গায়ের ভ্যাপ্সা গরম ছোটাছুটি করছে। ঘেমে -নেয়ে অস্থির সাদিফ। পরনের পাতলা শার্ট চুপচুপে। একটুখানিক স্বস্তি মিলছে না মস্তিষ্কের।
প্রচণ্ড হাঁস-ফাঁস করছে সে । কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবার দুপাশে মাথা নাড়ছে। যতবার মাথা নাড়ছে ততবার ছি! ছি! বলছে। সে কতগুলো বছর ধরে পিউকে ভালোবাসে,বিয়ে করতে চায়৷ এই শুদ্ধতম চাওয়ার পেছনে আর কোনও কারণ নেই।
অথচ আজ সামান্য মারিয়াকে শাড়িতে দেখে ওমন হা করে চেয়ে ছিল? না সাদিফ,তুইত চরিত্রহীন নোস। তবে এমন করলি কেন? আচ্ছা,মৈত্রী মেয়েটাও ত শাড়ি পরেছে,মারিয়ার থেকেও দ্বিগুন সেজেছে৷ ওর দিকে কেন তাকালি না তাহলে? মারিয়ার দিকেই কেন তাকালি? তার ক্ষি*প্ত মেজাজ আরও খা*রাপ হয়। নিজের প্রতি তিঁতিবিরক্ত হয়ে শার্টের বোতাম খুলে দেয়। কয়েকদিন যাবত প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ শহর। বাইরে গেলেও যেন চামড়া পু*ড়ে যায়। টগবগ করে মাথার ঘিলু। তার থেকেও অতিষ্ঠ সে নিজের ওপর। যতবার নিজের বোকামি, হ্যাংলামির কথা ভাবছে ততবার হচ্ছে এমন। বেশ অনেকক্ষন কাটল তার টানাপোড়েন। স্বীয় মস্তিষ্কের দন্দ্ব। কুলকিনারা হীন সমদ্রে অসহায় নাবিক মনে হলো নিজেকে। শেষে, পরমুহূর্তে নিজেকে বাঁচাতে,অমোঘ যুক্তি সাজালো। মনকে বোঝাল,
‘ মারিয়া আমার বন্ধু। সম্পর্কটা আগে যেমন তেমন থাকলেও এখন তো ভালো! তাই ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকানো অন্যায় কিছু নয়। মেয়ে দেখলেই খেয়ে ফেলা টাইপ,কিংবা মুখ দিয়ে লালা ঝড়ছে এরকম কুৎসিত নজরে তো চায়নি। উহু,একবারও না। সব সময় এলোমেলো থাকা মেয়েটিকে,প্রথম বার শাড়ি আর খোপায় দেখে একটু ভালো লাগা এমন দোষের কিছু নয়!’
সাদিফ মাথা ঝাঁকাল। এই যুক্তির সঙ্গে সে সহমত। পছন্দ হয়েছে কথাগুলো। কিন্তু কোথাও একটা খটকা রয়ে গেল। সোফায় বসে পরল কাজ ফেলে। আজমল তাকে দেয়ালে লাইট বসানোর কাজ দিয়েছেন। সেটিং করেছে ইলেক্ট্রিশিয়ান, এখন শুধু সাজাবে সে৷ সাদিফ মাঝপথে লাইট গুলো পায়ের কাছে ফেলে ঝিম ধরে বসে থাকে। নিজের চরিত্র নিয়ে কেমন যেন সন্দেহ জাগে। এই যে সে আরেক মেয়ের দিকে তাকিয়েছে,কয়েক সেকেন্ডের জন্যেও অপলক চেয়ে থেকেছে,এটা কি পিউকে ঠকানো হলোনা? তাহলে তাকালো কেন? মারিয়াকে কি ভালো লাগতে শুরু করছে আজকাল? সাদিফ সচেতন ভাবে মাথা তুলল। নো, নো বলে আওড়াল। ঠিক তক্ষুনি সামনে কাকতালীয়ের মতো হাজির হলো মারিয়া। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ একি আপনি বসে আছেন কেন? উম,ফাঁকিবাজি করা হচ্ছে? আমি কিন্তু আঙ্কেল কে জানিয়ে দেব। ‘
সাদিফ তাকাল। তার কপালেও ভাঁজ পরেছে তখন। মারিয়া দুষ্টুমি করে হাসল। ওমন করে তাকাতে দেখে বলল,
‘ ভ*য় পেলেন? আরে মজা করলাম। জিরোচ্ছেন? শরবত খাবেন? টায়ার্ড?’
এতক্ষনের চিন্তিত সাদিফ নিমিষে হেসে জানাল,
‘ নো থ্যাংক্স। বলেছেন যে এটাই অনেক।’
কাল তুমি বলার পর,আজ আবার আপনিতে ফিরে আসায় মারিয়ার হাসি কমে এলো খানিক। তবে ধরা দিলো না। জিজ্ঞেস করল,
‘ আমি কি আপনাকে হেল্প করব?’
সাদিফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’ করতে পারেন। হেল্পিং হ্যান্ড পেতে কার না ভালো লাগে?’
‘ আচ্ছা কী করতে হবে?’
উৎসাহি চিত্ত মারিয়ার।
‘ এই যে লাইট গুলো দেখছেন,আমি টুলের ওপর দাঁড়ালে একটা একটা করে আমার হাতে দিলেই হবে। পারবেন?’
মারিয়া কাঁধ উঁচায়,’ এ আর এমন কী? আচ্ছা দাঁড়ান,আমি এক্ষুনি গ্লাসটা রেখে আসছি।’
তার হাতে গ্লাস ছিল জুসের। নিজেই খেয়েছে। সেটা রাখতে ডায়নিং টেবিলের দিকে ছুটল। সাদিফ চেয়ে থাকল সেদিকে। তারপর চমৎকার করে হেসে ফেলল। বুকে হাত রেখে দেখল, না, হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক। তার গতিবিধি ঠিকঠাক। এই যে এতক্ষন মেয়েটা সামনে দাঁড়িয়ে এত কথা বলেছে,সে নিজেও ঠিক ছিল। সেই তখনকার মত একবারও জগত ভুলে চেয়ে রয়নি। তার মানে ওটা ছিল সেকেন্ড খানেকের ইনফ্যাচুয়েশন। হয়ত ফার্স্ট টাইম শাড়ি পরা দেখেই হয়েছিল। তবে আর চিন্তার কিছু নেই। সে ভালো,ভদ্র ছেলে আগেও যেমন ছিল,এখনও আছে,ইনশা -আল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকবে।
সাদিফ বুকভরে শ্বাস নিলো। মারিয়ার সাথে তুমিতে নামা যাবে না। বি*পদসংকুল সম্বোধন এসব। কখন না মাখোমাখো সম্পর্ক মায়ের চোখে পড়ে,আর তিনি বিয়ে ঠিক করতে বসে পরেন। এই বাড়ির মহিলাদের তো কাজই এই, এর সাথে ওর,ওর সাথে এর বিয়ে নিয়ে ভাবা।
পিউয়ের জন্য মাঝেমধ্যে ভীষণ ভালো লাগা কাজ করে তার। এই যে মেয়েটা তার মত এত লয়্যাল একটা বর পাচ্ছে লাইফে? ও কি আদৌ রাখে এই খবর ? জানলে খুশিতে দু তিনটে আছা*ড় খেত নিশ্চয়ই? সে তুষাতুর চোখে আশেপাশে তাকাল। পিউ কে খুঁজল নিরবে। মেয়েটাকে ভালো করে দেখাই হলো না আজ। সামনে এসেছিল যদিও,সে-ই দ্যাখেনি। আজও শাড়ি পরেছে,কেমন লাগছে ওকে? সেদিনের মতোই অপরুপা নিশ্চয়ই!
***
পিউয়ের দুনিয়া ঘুরছে। বক্ষে উত্থাল-পাতাল। তার মধ্যে থাকা হৃদয়টা টলছে দ্বিগবিদিক। চিনচিন করছে সেখানে। তুষারের ন্যায় জমে গিয়েছে ধূসরের এই হঠাৎ কাছে আসায়। শাড়ির পাড় ভেদ করে তার উন্মুক্ত পেটে শক্ত হাতের, নরম স্পর্শে দেহের শিরা-উপশিরা স্তব্ধ।
সেই ক্ষনে ধূসর চা*প প্রয়োগ করল সেখানে। ফল স্বরুপ পিউ পেছন দিকে হেলে এলো। এক রকম তাকে,তার পিঠকে টেনে, খিঁচে বুকের সাথে মেশাল ধূসর। ওমনি পিউয়ের গা শুদ্ধ হাই ভোল্টেজের মত ঝাঁকুনি দিলো। হাত থেকে এঁটো খালি প্লেট টা পরে গেল মেঝেতে। ঝনঝন শব্দ করে নিভে গেল। কাচের প্লেট হলে ভে*ঙে গুড়িয়ে যেত নির্ঘাত। অথচ এই শব্দ পিউয়ের উদ্বোলিত তনুমনের কাছে কিচ্ছু না। এর থেকেও জোরে চলছে তার বক্ষস্পন্দন। ওর থেকেও জোড়াল তার শ্বাস- প্রশ্বাস। ধূসর তার কাধের ওপর অবিন্যস্ত চুল গুলো স্বযত্নে সরিয়ে দিলো এক পাশে। চুড়ি পরা হাতটা মুঠোতে নিলো। আঙুলে- আঙুল স্লাইড হলো। সেই শিরশিরে আঙুল উঠে এলো চুড়িতে। একটা একটা করে ছুঁয়ে গেল। ধূসর আঙুলের ভাঁজে আঙুল ডোবায়। পিউ নড়তে চড়তে ভুলে গেছে। বিস্ময়ে হতবিহবল সে। নি:শ্বাস গলার কাছে বন্দি। কাঁ*পার তোপে, হাঁটুর হাড় খুলে যেন পা দুটো আলাদা হয়ে যাবে এখন।
ভেতর ভেতর নিজের এই কাঁ*পা-কাঁ*পির প্রতি ফুঁ*সে উঠছে কখনও। তার মন জানে,প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা মুহুর্ত সে চায় ধূসর ভাই কাছে আসুক। একটু প্রেমিক সুলভ আচরণ করুক। বিমোহিত চাউনীতে চেয়ে দেখুক তার গোলগাল মুখবিবর। অথচ যখনি আসে,সেই ভার নিতে সে অক্ষম। শরীরের কাঁপা-কাঁপি আর হৃদপিন্ডের লাফা-লাফির দ্বায়ে সে বিদ্বিষ্ট,দিশেহারা ।
ধূসর আচমকা তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। বাহুতে অচিরাৎ টানে পিউয়ের হাত দুটো গিয়ে আকড়ে ধরল তার পাঞ্জাবির কলার। ধূসরের একটা হাত জায়গা পেল ওর লতানো কোমড়ে। যা থেকেও চুইয়ে পরছে ঘাম।
পিউ চোখ বুঁজে ফ্যালে। গাছের পাতার ফাঁক গলে বাইরের হলুদ আলো এসে নিক্ষে*প হয় তার মুখমন্ডলে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যে নামানোয়, ঘরের আলো তখনও নেভানো। ধূসর মনোযোগ দিয়ে দেখল সেই মুখ। হলুদ শাড়ি পড়নে, মেয়েটিকে এই আলোয় ঠিক যেন প্রতিমার মত লাগল তার। কাঁ*টা কাঁ*টা নিঁখুত মুখশ্রীর অদ্ভূত এক প্রতিমা।
সাউন্ড সিস্টেম তখন বেজে উঠল। ফুল ভলিউমে চলছে ‘ তুমি ছুঁয়ে দিলে হায়,আমার কী যে হয়ে যায়। ‘ গানটা। পিউ চট করে আঁখি মেলল। হতবাক হয়ে পরল শুনেই। এই গান,এই সময়ে কে ছাড়ল? তার মনের কথা কি পড়ে ফেলল কেউ? কিন্তু ঘরে যে ওরা দুজন।
রাদিফের থেকে ফোনটা কে*ড়ে নিলো সাদিফ। মাথায় একটা চাটি মা*রার সাথে, ক*ষে একটা ধ*মকও ছু*ড়ল হিজিবিজি গান বাজানোয়৷ এটা গান হলো? কী বাধাই করার মত লিরিক্স! এসব মুরুব্বিদের সামনে শোনা যায় না কি। ছেলেটা মন খারাপ করে ঠোঁট উলটে নীচে নেমে আসে। সাউন্ড সিস্টেম মেতে ওঠে অন্য গানে। সালমান খানের বিখ্যাত ঠান্ডা ঠান্ডা, ‘দিল দিওয়ানা’ গান শুনে ছোট ছেলেটা মুখ ভ্যা*ঙায়৷ বুক চিনচিন গান এখন কী ট্রেন্ডে আছে ভাইয়াতো আর জানেনা। ব্যাকডেটেড কোথাকারে!
★
পিউ ভাবতে গিয়ে যখনই মাথা নামায়,ধূসর এক আঙুল দিয়ে চিবুক উঁচু করে ধরল। চোখাচোখি হলো দুজনের। নিখাদ দৃষ্টিতে মিলে গেল পিউয়ের সরল চাউনী। কালো আইরিশ দুটোতে গুলিয়ে গেল সে। শ্যামলা চেহারার পুরুষটিকে সৌম্যদর্শনে বরাবরের মতো তুঙ্গে তুলল। এই ঘোষণা সে সহস্রাধিক বার করেছে। তবু যেন ক্ষ্যান্ত হচ্ছে না মন। শান্তি পাচ্ছেনা অন্তঃস্থল।
ধূসরের ধাঁরাল চোখ দুটো ঘুরে এলো তার অধর হতে। তারপর সমগ্র গ্রীবায়,চক্ষু,গাল,ভ্রু,পল্লবের একটা ছোট্ট চুল ও বাদ পরেনি তাতে। বড় তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখে গেল, হরিনী নয়নজোড়ায়, স্বযন্তে টানা কালো কাজলের প্রলেপ।
পিউয়ের দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাসের সাথেই তার ত্রস্ত এক প্রশ্ন ছুটে এলো,
‘ কার জন্য সেজেছিস এত?’
পিউ চটক কে*টে তাকাল। শান্ত কণ্ঠের এমন সাবলীল প্রশ্নের ভার কয়েকমুহুর্ত তাকে নিস্তব্ধ করে রাখে। ধূসরের চোখে চকচকে দুষ্টুমি। জানা উত্তর শুনতে চাওয়ার জন্য অধর ঘেঁষে ছুটছে চিকণ হাসি। পিউ মাথাটা নামিয়ে নিলো। বলতে চাইল,
‘ আপনার জন্য। আপনি ছাড়া কে আছে আমার?’
কিন্তু কথা ফুটল না। কন্ঠরোধ হয়ে আটকে থাকল গলবিলে। পরপর সাহস যোগাল,প্রয়াস চালাল। ধূসর ভাই নিজে থেকে এত কাছে এসেছেন। কেন এসেছেন? ভালোবাসেন বলেইত। নিশ্চয়ই তাকে কোনও সুযোগ দেয়ার ছুঁতোয়। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না পিউ। আজ বলতেই হবে। ওনার পেছনে, মনে মনে যা সারাক্ষণ বলিস,আজ সব বল। বল, আপনার জন্য সেজেছি। জানতে চা, সুন্দর লাগছে আমায়?
পিউ জ্বিভে ঠোঁট ভেজায়। শ্বাস ঝেড়ে প্রস্তুতি নেয় বলার। সেই মুহুর্তে বাইরে থেকে রাদিফের গলা ভেসে এলো। উদগ্রীব হয়ে ওকে ডাকছে ছেলেটা।
‘ পিউপি কোথায় গেলে? তোমার বন্ধু এসেছে,খুঁজছে তোমায়। এই পিউপুকে দেখেছো?’
প্রশ্ন করা আগন্তুক’ না’ বলে চলে গেল। হুশে এলো দুজন। যত্রতত্র দুজনের থেকে ছিটকে দুদিকে সরে গেল। পিউ এক মুহুর্তে দাঁড়াল না। ফ্লোর থেকে ফেঁটে যাওয়া মেলামাইনের প্লেট হাতে তুলে দুরন্ত পায়ে ছুটল। ঝুনঝুন করে বেজে গেল তার পায়ের নুপুর। ধূসর আড়চোখে সেই শব্দের দিক চেয়ে রয়। গা পুড়*ছে উষ্ণতায়। বুক লাফাচ্ছে শীতলতায়। এ কেমন টানাপোড়েন? সে এসির ফুল ভলিউম বাড়িয়ে ক্লান্ত ভঙিতে,শুয়ে পরল বিছনায়।
তানহা এসেছে। বেস্টফ্রেন্ডের বোনের বিয়ে,সে না আসলে চলে? বসার ঘরে তাকে বসিছেন সুমনা। নাস্তাও খেতে দিয়েছেন এর মধ্যে। রাদিফকে পাঠিয়েছিলেন পিউকে খবর দিতে। সেই মতই ছেলেটা হুলস্থূল বাধিয়ে গলা ছেড়ে ডেকেছে। তানহা আগেও এ বাড়িতে এসেছিল। পিউয়ের জন্মদিনে শুধু। এসেছে,কেক কে*টেছে,উপহার দিয়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু এবার থাকবে সপ্তাহখানেক। বিয়ের আমেজ না যাওয়া অবধি পিউ ছাড়বেনা ওকে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষার চাপে,বাড়ি থেকে মঞ্জুর করতে চায়নি তাদের আবদার। পিউ তার মাকে দিয়ে ফোন করানোর পরই তানহার মা রাজী হয়েছেন। মুরুব্বিদের আবেদন তো ফেরানো যায়না! তানহা আগেভাগে তৈরি হয়েই এসেছে। সবার সাথে থিম মিলিয়ে লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি। পিউ আস্তেধীরে সিড়ি বেয়ে নামল। এতটা সময় তানহাকে ফোন করে,কখন আসবি? কতদূর আছিস? বলে বলে অস্থির হওয়া মেয়েটা, আচমকা ওকে দেখে কেমন খুশি হলো না। এই অসময়ে আসার জন্য উলটো বিড়বিড় করে কড়া বকা-ঝকা করল। কী হোতো এখন না আসলে? রাদিফ না ডাকলে? ধূসর ভাই আরেকটু কাছাকাছি থাকতেন! ভাবতেই পিউয়ের মেরুদণ্ড, অনুষ্ণ স্রোতে ভেসে যায়। তানহা ওকে দেখেই মুখে হাসি টেনে এগিয়ে গেল৷ স্ফুর্ত চিত্তে শুধাল,
‘ কেমন আছিস?’
পিউ হাসল। ভেতর ভেতর ধূসরের কাছে বেশিক্ষণ থাকতে না পারার আক্ষেপে ফেঁটে গেলেও, প্রকাশ না করে বলল,
‘ ভালো। তুই? আসতে অসুবিধে হয়নি তো?’
‘ না না। বাবার গাড়ি নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। ‘
সুমনা বললেন,
‘ তুই কি খাচ্ছিলি?’
হাতে ভাতের প্লেট দেখে প্রশ্ন করেছেন তিনি। পিউ নরম চোখে তাকাল সেই থালার দিকে। সামনে ভেসে উঠল ধূসরের আঙুল চেটে খাওয়ার দৃশ্য টুকু। মুহুর্তে রক্তে রক্তে বইল শিহরন। অস্বাভাবিক ভাবে চোখ বুজে ফের খুলল। উত্তর দিতে গিয়ে গলা কাঁ*পল ঈষৎ। বলল,
‘ হহ্যাঁ।’
‘ আচ্ছা,যা হাত ধুঁয়ে তানহাকে নিয়ে ওপরে যা। আমি পুষ্পকে নিয়ে ছাদে যাই। সময় হয়ে এলো অনুষ্ঠানের।’
পিউয়ের পাশ কাটিয়ে প্রস্থান নিলেন তিনি। তানহা সুযোগ বুঝে ওকে দুহাতে আকড়ে ধরে বলল,
‘ জানিস কী হয়ে….’
বলতে বলতে থমকাল সে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
‘ একি, তুই কাঁ*পছিস কেন এত?’
পিউ অসহায় চোখে চাইল। তানহা চিন্তিত গলায় বলল,
‘ তোর কি শরীর খা*রাপ লাগছে?’
‘ আমার বোধ হয় হার্ট অ্যা*টাক হবেরে! ‘
তানহা আঁত*কে উঠল ‘ এমা, কেন?’
পিউ ওর হাতটা নিয়ে নিজের বুকের বা পাশে রাখল। জিজ্ঞেস করল’ কিছু ফিল করতে পারছিস?’
তানহা নিজেই চমকে গেল তার বুক কাঁ*পুনি দেখে। চোখ দুটো গোল গোল করে তাকিয়ে রইল। পিউয়ের দৃষ্টি বদলাল শিথিলতায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তানহা কিছু বুঝতে পারছে না সে জানে। ওর বোঝার সাধ্যিই বা কই!
তার মত ভালো কে বুঝবে, ধূসর ভাইয়ের দূরে যাওয়া যেমন তার মন খা*রাপের কারণ,তার হঠাৎ এমন কাছে আসার চমক,ডেকে আনে মরণ।
***
পুষ্পকে ছাদে নেয়া হলো। অতি সাদরে বসানো হলো স্টেজে। বাড়িটার ছাদে প্রচুর জায়গা। রেলিং ঘেষে লাগানো গাছ,আর এক কোনায় বসানো লোহার চেয়ার -টেবিল ছাড়া পুরোটা ছাদই ফাঁকা প্রায়। এতে অবশ্য সুবিধাই হয়েছে ওদের। নাঁচানাঁচির জন্য শক্তপোক্ত স্টেজ আর মেহমান বসানোর ভালো জায়গা মিলেছে।
পুষ্পর গালে সবার আগে আমজাদ সিকদার হলুদ ছোঁয়ালেন। এই বিয়েতে একমাত্র নাখোশ ছিলেন তিনি, অথচ ক্রমে ক্রমে মেয়ের হৃষ্ট চোখমুখ তার সমস্ত মনঃস্তাপ ভুলিয়ে দিচ্ছে। একে একে মিনা বেগম, আফতাব, রুবা সবাই হলুদ লাগালেন। ধূসরের পাল্লা এলেও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তার পদধূলি তখনও ছাদে পরেনি।
পুষ্প মন ভরে হাসছে। গাল দুটো দুপাশ থেকে ফুলে উঠছে হাসিতে। যেন জায়গা পাচ্ছেনা গেড়ে বসার।
একটু আগেই চলে গিয়েছে ইকবাল। যেমন চোরের মত এসেছিল,ওমন চোর হয়েই গিয়েছে। বেশ কয়েকবার এমন পাঁচিল টপকে আসায়, দক্ষ সৈনিকে পরিনত হয়েছে ও। সেই প্রথম যেদিন এসেছিল,পুষ্পর এখনও মনে আছে,হাত,হাঁটু ছিলে একাকার হয়েছিল তার।
অথচ এখন,কী আরামসে স্পাইডার ম্যানের মত পাঁচিল লাফিয়ে পার হয়। তবুও প্রতিবার পুষ্পর বুক ঢিপ-ঢিপ করে।
আজও করেছে। সে নিশ্চিত, কারো বাড়িতে চুরি করতে দিলে ইকবাল অনায়াসে করে ফেলবে। কেউ জানবেইনা। এই যে বিয়ে বাড়ির অগণিত লোকের ভীড়ে এসে কনে কে চুমু খেয়ে গেল,কেউ টের পেয়েছে? কথাটা ভেবেই তার গাল জোড়া র*ক্তাভ হয়। তখন ইকবালের ওমন আকষ্মিক প্রেম আ*ক্রমনের ভার সামলাতে সময় লেগেছে অনেক। ছেলেটা মাঝেমধ্যে এত পাগলামো করে! এই যে এখন লজ্জায় বারবার হাত চলে যাচ্ছে ঠোঁটে। ফেরার সময় মারিয়ার দিক তাকাতেই পারছিল না। মেয়েটা শুধু মিটিমিটি হেসেছে। তার লিপস্টিকে ভর্তি ঠোঁট দুটো হঠাৎ খালি হয়ে যাওয়ায় সে কী ঠাট্টা! কুন্ঠার মিষ্টি যন্ত্র*নায় আজ তাকে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছু*ড়ে ফেলেছে ইকবাল।
সাদিফ যেদিকেই যায়,মৈত্রীর চোখ সেদিকে। কেমন ক্যাবলার মত চেয়ে থাকে। কী দ্যাখে এত? ওমন ন্যাকা- ন্যাকা, লজ্জা, লজ্জা ভাব করে তাকানো দেখে গা পিত্তি জ্ব*লে যাচ্ছে তার। দাঁত চেপে* হজম করছে। না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সইতে। পুষ্পর বিয়ে উপলক্ষে তার বন্ধুরাও এসেছে। জটলা বেধে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ওরা। দুজনের গলায় ক্যামেরা ঝুলছে। সাদিফ ফুরসত পাইনি নিজেরটা আনার। এত কাজ! এর মধ্যে আবার মৈত্রীর তাকানোর জ্বা*লায় লুকিয়ে থাকছে। বন্ধুদের জটলার মধ্যে ঢুকে বাঁচতে চাইছে এক প্রকার। নিজেকে আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা তার! যখনি সামনে থেকে সরছে,মৈত্রীর নেকলেস জড়ানো গলাটা রাজহাঁসের মত উচু হয়ে আসছে। চোখেমুখে ফুটছে গোয়েন্দাগিরি৷ যেন সে কী না কী! ওকে খুঁজে না পেলে মেয়ের জীবন বৃথা! সাদিফ মনে মনে নিজের কপাল চাপড়ায়। যার এমন করে তাকানোর কথা তার খোঁজ নেই,আর এই মেয়ে!
সেই সময় পিউয়ের দিকে একবার তাকাল সে। মেয়েটা স্টেজের দিক নিষ্পলক চেয়ে আছে। ঠোঁটের কোন ঘেষে মিষ্টি,মিহি হাসি। চারপাশের লাল সবুজ আলোগুলো তীর্যক ভাবে মুখে বসেছে। খোলা চুলের আস্ত এক হলুদ পরী যেন!
সাদিফ সিদ্ধান্ত নিলো ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। শার্টের দুই হাতা ঠিকঠাক করে পা বাড়াল, এর আগেই তানহা ফোন হাতে ছুটতে ছুটতে পিউয়ের কাছে এসে থামল। থেমে গেল সে। বাড়ানো পদযূগল ইউটার্ন করে অন্যদিকে হেঁটে গেল।
তানহা হাঁপাচ্ছে। ঘন ঘন শ্বাস তুলে ডাকল,
‘ পিউ,পিউ!’
পিউ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পুষ্পকে বাড়ির সবাই হলুদ মাখাচ্ছে, এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখার মাঝে বাধা পেয়ে সে বির*ক্ত বোধ করল।
‘ কী?’
তানহা বুকে হাত দিয়ে একটু ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করে। সিড়ি বেয়ে দৌড়ে ওঠায় ক*ষ্ট হয়ে গিয়েছে। সময় নিয়ে বলল,
‘ ধূসর ভাইয়ের স্টোরি দেখেছিস?’
‘ স্টোরি দিয়েছেন?’
‘ দেখিস নি?’
পিউ দুপাশে মাথা নাড়ল।
‘ দ্যাখ এক্ষুনি দ্যাখ।’
তানহার কণ্ঠ অধৈর্য। পিউ নিজের ফোন খুলে ফেসবুকে ঢুকল। সার্চ লিস্টে সবার ওপরেই ধূসরের নাম। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাইত চোখ লাগিয়ে বসে থাকে ওখানে। আইডিতে ঢুকে দেখল কোনও স্টোরি নেই। তবে চার ঘন্টা আগে টাইমলাইনে একটা ছবি পোস্ট করেছে। তাও গেটের কাছে পার্লামেন্টের লোকজন নিয়ে একটা গ্রুপ ফটো।
তারপর তানহার দিক তাকাল। অনীহ কণ্ঠে বলল,
‘ এটা দেখার কী আছে? এমন ভাব করলি যেন আমার সাথে কাপল পিক দিয়েছে।’
তানহা বিভ্রান্ত হলো। পিউয়ের ফোনটা হাতে নিয়ে ঘেটেঘুটে দেখে বলল,
‘ কী আশ্চর্য! তোর এখানে শো করছেনা কেন?উনি কি তোকে হাইড করে দিয়েছেন?’
‘ কী শো করবে?’
‘ এইত এক ঘন্টা আগে যেটা পোস্ট করেছেন। ‘
তানহার চোখ-মুখ সিরিয়াস। পিউ এবার আগ্রহী হলো। বলল,
‘ দেখি তোর ফোন।’
তানহা নিজের ফোন বের করে দেখাল। সত্যিই স্টোরি দেয়া। তবে, ছবি-টবি নয়, ইংরেজি অক্ষরে সাজানো কয়েকটা লাইন মাত্র।
‘ যত বার তুই শাড়ি পরিস,ততবার আমি ম*রে যাই,খু*ন হই। বুঝতে পারি,আমার শক্ত মনের প্রথম দূর্বলতা তুই হলেও তোর পড়নের শাড়ি সেই দূর্বলতা টেনেহিঁচড়ে বাইরে আনতে সক্ষম।( ইন ইংলিশ) ‘
চলবে
যেই মাত্রাতিরিক্ত গরম! আমার মাইগ্রেনের সমস্যা থাকায়, ফোনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনা। তাই ছোট করে দিলাম।
আর একটা কথা,আপনাদের অনেকের অভিযোগ থাকে,ধূসর-পিউকে কম কম রাখছি। সামনেও এভাবেই পাবেন। কিংবা হঠাৎ দেখবেন একটা পর্বে শুধু ওরাই। সেটা প্লট আর থিমের ডিমান্ড অনুসারে। আপনারা আমার মত তিনটে জুটিকে সমান গুরুত্ব দিতে পারছেন না। আমি এর আগেও বলেছি,প্রত্যেকটা জুটির ছোট ছোট ব্যাপার গুলো আমি তুলে ধরব। ধরছিও। গল্পের মূল চরিত্র ওরা হলেও পার্শ্ব চরিত্রের কেউ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।