একজোড়া পায়রা পর্ব -১৯

#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট১৯

শ্বশুর মশাই আমার হাতে একজোড়া বালা দেন।বেশ ভারী বালাটা। এটা নাকি আমার দাদি শ্বাশুড়ির বালা।নিজের একমাত্র নাতবৌয়ের জন্য তিনি বালাটা রেখে গেছেন।বালা জোড়া আমার হাতে দিয়ে তিনি বলেন,,,

-আম্মা এই বালাজোড়া তোমার জন্য রেখে গেছেন।শুভ্রের মাকে বলেছিলাম তোমায় বালাটা দিতে কিন্তু সে বলেছিলো আমি আসলে আমিই যেন তোমার হাতে তুলে দিই বালাটা।

আমি মুচকী হাসি।আমার শ্বশুর মশাইও যথেষ্ট ফ্রী মাইন্ডের মানুষ।বলতে গেলে এই বাসার সবাইই বেশ ফ্রী মাইন্ডের হাসিখুশি মিশুক মানুষ। শুধু শুভ্রই একটু চুপচাপ। চুপচাপও না।উনি অনেকটা মিচকা শয়তান টাইপের।যা ফাজলামো করবে তা আড়ালেই করবে। মানুষের সামনে সে ভাজা মাছ উলটে খেতে পারেন না।

আজ এশা আর নাবিল ভাইয়ার বিয়ে।অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে তারা এক হতে যাচ্ছে।ঢাকারই কোনো এক কনভারসন সেন্টারে ওদের বাগদান হবে।বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবো।শাশুড়ির পছন্দ করে কেনা কাবিনের শাড়িটায় বের করেছিলাম পরে যাওয়ার জন্য।কিন্তু শাশুড়ী মা নিজেই আলমারি থেকে নিজের একটা শাড়ি বের করে দেন।

-আম্মু আমার তো শাড়ি আছে।
-আরেহ পরোই না এটা।দাঁড়াও তোমায় একটা জিনিস দেখাই।

কথাটা বলে আলমারি থেকে এলবাম বের করে একটা ছবি আমার হাতে দেন আম্মু।বেশ পুরোনো ছবিটা।সাদা কালো ছবিটায় বাচ্চা কোলে স্ত্রী সোফায় বসে আছেন।আর তার কাঁধে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে স্বামী দাঁড়িয়ে আছেন।আদি যুগের পোজ তো এগুলোই।চেহারা দেখে আন্দাজ করতে পারি যে এরা আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ী।কোলের বাচ্চাটা হয়তো শুভ্র।দুটো দাঁত উঠেছে।হাসিটায় যে কেউ পাগল হয়ে যাবে ইশ কি সুন্দর একটা বাচ্চা।আগে যে শুভ্র এমন গুলুমুলু নাদুসনুদুস ছিলো তা এখনকার লম্বা হ্যাংলাপাতলা শুভ্রকে দেখলে বিশ্বাসই হবে না।ছোটবেলার মতো শুভ্র এখন অতটা হাসেন না।প্রায়শই পেঁচার মতো গম্ভীর করে রাখেন।

-ছবিটায় আমি, তোমার শ্বশুর আর শুভ্র।

শাশুড়ি মার কথায় আমার ধ্যান ভাঙে।আমি শাড়িটা বিছানায় রেখে আম্মুকে বলি,,,

-অনেক ইয়াং দেখাচ্ছে আপনাদের ছবিতে।
-দেখাবে না কেন?মাত্র আঠারো তখন বয়স আমার।আর তোমার শ্বশুরের একুশ কি বাইশ!
-বিয়ে হয়েছিলো কখন আপনাদের?
-কম বয়সেই।ষোল বছর বয়সে।আমি তখন সদ্য মেট্রিক পাশ করি আর তোমার শ্বশুর নতুন নতুন আর্মিতে ঢুকেছে।ছবিতে আমায় যে শাড়ি পরা দেখছো ওই শাড়িটাই ছবিতে আমি পরে আছি।
-এখনো কত যত্ন করে রেখে দিয়েছেন!
-হুম।আমার ছেলের বউ মানে তোমার জন্য।তাই শাড়িটা বের করে দিলাম আর কি!
-আর আমায় শাড়ি ধরতেই দাও না।

শিশিরের কথায় আমি আর আমার শ্বাশুড়ি মা ঘুরে তাকাই। দেখি সেই আগের মতো দরজায় হেলান দিয়ে মন দিয়ে আমাদের কথা শুনছে।

-তুই এত পাকনামো করিস কেন শিশির?কতবার বলেছি বড়দের কথার মাঝে বা হাত দিবি না।
-আমার কি শাকচুন্নির মতো লম্বা হাত আছে যে এখানে দাঁড়িয়ে আমি তোমাদের কথায় বা হাত দেবো?
-আবার মুখে মুখে তর্ক!দেবো এক চড়।

মায়ের বকুনি খেয়ে শিশির আমার পেছনে লুকায়।যে কোনো দুষ্টুমিতে ধরা খেলেই মেয়েটা আমার কাছে এসে লুকায়।

-মেঘ আর দেরি করো না।গিয়ে গোসল করে সাজতে বসো। শুভ্র বলে গেছে আজ তাড়াতাড়ি আসবে।
-আপনি আব্বু যাবেন না?
-নাহ।তোমরাই মজা করো গিয়ে।আর শিশির, যা তুইও গোসল করে নে।ওদের সাথে যাবি নি।

আমি ছবিখানা আম্মুর হাতে দিয়ে শাড়ি নিয়ে নিজের ঘরে চলে যাই।গোসল করে বের হয়ে এসে দেখি শুভ্র এসেছে।ঘড়িটা খুলে ড্রেসিন টেবিলে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।মাস্ক টা খুলে যে ই না বিছানায় শুতে যাবে ওমনি আমি,,,,

-খবরদার বিছানায় শুবেন না।একটু আগেই বিছানা গুছিয়েছি।আপনার ওই ময়লা শরীরকে বিছানা থেকে সত্তর হাত দূরে রাখুন।গোসলে যান।

শুভ্র ভেবাচেকা খেয়ে যায়।আদুরে গলায় বলে,,,

-এমন করো কেন জান ?এক্টুই তো শুবো!
-আগে গোসল করে আসেন। বার বার আমি বিছানা ঝাড়তে পারবো না।

আমি ঝাড়ি খেয়ে শুভ্র ক্লান্ত শরীর নিয়ে ওয়াশরুমে যায়।আমি চুল ঝেড়ে শাশুড়ী মায়ের দেওয়া শাড়িটা পরি।জামদানী শাড়ি হওয়ায় আমার কুচি ঠিক করতে সমস্যা হয়।শিশিরকে ডাক দেবো ও গোসলে।এই মেয়ে আবার গোসলে সময় নেয় বেশি।কোনো রকমে শাড়িটা পরে ড্রেসিন টেবিলের সামনে সাজতে বসে যাই।সাজুগুজুতে আমি আবার একেবারে কাঁচা।লিপস্টিক আর আইলাইনারেই আমার সাজ হয়ে যায়।তাই সাজতে বেশি সময় লাগলো না।এরই মধ্যে শুভ্র গোসল করে বের হয়।আমি উনাকে কুচি করার কথা বলার আগেই উনি বলেন,,,

-কুচি ঠিক করে দিতে হবে?

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সুচক জবাব দিই।উনি কুচি ঠিক করায় লেগে যান।তারপর নিজে রেডি হন।শিশিরকে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পরি।

কনভারসন সেন্টারে গিয়ে দেখি বধু বেশে এশা স্টেজে বসে আছে।লাল শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওকে।আমি যেতেই আমায় জড়িয়ে ধরে এশা কেঁদে দেয়।কাঁদতে কাঁদতে বলে,,,

-দোস্ত দোস্ত!তুই যে আমার কত বড় উপকার করছিস তুই নিজেও জানিস না।
-হুদাই ঢং।কাঁদিস না মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে।আর আমি কিছুই করি নাই।আংকেল আন্টিকে শুধু একটু বলছি তোদের মেনে নিতে।
-আজকে তোদের স্পেশাল ভাবে খাওয়াবো।

এশা শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলে,,,

-এইটাই তোর ওই পাকনা স্টুডেন্ট আইমিন ননদ?

আমি এশার কথার জবাব দেওয়ার আগেই শিশির বলে,,,,

-পাকনামির কি আছে এখানে?ভাবিকে তো ভাবিই বলবো।

এশা হেসে দেয়।ফটোগ্রাফার পাশেই বসে ছিলো। সে ফটোগ্রাফারকে ডাক দিয়ে বলে,,,,

-এই ভাইয়া আসেন ছবি তুলেন।

এশা আর আমি প্রায় এক ধাঁচেরই।দুজনেরই ছবি উঠার খুব নেশা।ওর বিয়ে এইরকম ধুম ধামে হলেও আমারটা অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশে হয়েছে।তাই সেভাবে ছবি তোলা হয় নি।আফসোস রয়ে যাবে।বিয়ে তো মানুষের জীবনে একবারই আসে তো!ফুলও এসেছে দেখা যায়।এই মেয়েটা খুব ভদ্র।চুপ চাপ বসে আছে।হঠাৎ খেয়াল করলাম একটা ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকী মুচকী হাসছে!প্রেমে পড়েছে বোধহয়। দেখতে তো খারাপ না ফুল।ভালোই প্রপোজ পেয়েছে।কিন্তু কাওকেই পাত্তা দেয় নি এই মেয়ে।

খাওয়া দাওয়া বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে আমরা ইয়াং জেনারেশন সব এক হয়ে আড্ডার আসর নিয়ে বসি।কথার কথায় শুভ্রকে আপনি বলে ডাকায় অনেকে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।এশা বলে,,,

-ভাই তিনমাস হয়েছে তোদের বিয়ের!এখনো জামাইকে আপনি বলিস!ফেসবুকে তো তুই ম্যারিড স্ট্যাটাসও দেস নাই।
-আমার আপনি বলতে শরম করে।

কথাটা বলেই ঢং করে লজ্জায় মুখ ঢাকি।এশা চড় মেরে বলে,,,

-আজকে শুভ্র ভাইয়াকে তুমি বলবি।
-বুঝাও তোমার বান্ধবীকে।আমিও কত করে বলি আমায় আপনি না বলে তুমি বলতে।কিন্তু তোমার বান্ধবী আমার কথা শুনেই না।

শুভ্রও এশার সাথে তাল মেলাতে থাকে।সবার চিৎকার চেচামেচির এক পর্যায়ে আমি শুভ্রকে তুমি বলেই ফেলি।সবাই একযোগে বলে উঠে “মাশাআল্লাহ,মারহাবা”

রাত্রে শুয়ে ফেসবুকিং করছিলাম।হঠাৎ করেই মার ফোন আসে।রিসিভ করে সালাম দিই।মাও সালামের জবাব দেন।ভালোমন্দ, দিনকাল কেমন যায়, জিজ্ঞেস করছিলো।হঠাৎ করেই মা বলে উঠে,,,

-তোর দাদি কথা বলবে। তোর দাদির সাথে একটু কথা বল।

না জানি দাদি কত কথা শুনাবে।আমি শুকনো ঢোক গিলি।

-হ্যালো ছেড়ি কিবা আছো?
– আসসালামু আলাইকুম দাদি।ভালো আছি তুমি কেমন আছো?

শুকনো গলায় বলি আমি।দাদি সালামের জবাব দিয়ে বলে,,

-ভালা আছি।তোর জামাই কিবা আছে?
-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।
-ও না আইলে আমার ঘাউড়ামির লাইগা তোর জীবনডাই নষ্ট হইয়া যাইতোরে!আমায় মাফ কইরা দিস তুই। ঘাউড়ামি কইরা তোর লগে মেলা অন্যায় করছি।
-তুমি হঠাৎ এই কথা বলছো!
-শান্ত তোরে আমার সম্পত্তির লোভে বিয়া করবার চাইছালরে।আর এইন্না নিয়া ওর মায় আমারে উস্কাইতো যাতে তোর লগে ওর বিয়া দিই।পরে আমি তোরে তোর ভাগের যে সম্পত্তি দিমু ওইন্না শান্ত লই যাইতো।
-তুমি এইগুলা জানলে কিভাবে?
-শান্তকে পাশের বাইত্তে তোর এক বান্ধবীর বিয়া হইছে না?ওতে ভিডিও কইরা ওগো কথা বার্তা আমায় দেহাইছে।তোর জামাই কাছে আছে?হে তো আবার নেতা মানুষ।
-জ্বী আছে কথা বলবা?
-দে একটু কই কথা!

আমি শুভ্রের হাতে ফোন দিই। বেশ ভালোই অনেকক্ষণ ধরে শুভ্র আর দাদি কথা বললো।শুভ্রও একে একে দাদির সাথে আমার শ্বাশুড়ি,শ্বশুর মশাই ননদের কথা বলিয়ে দেয়।কথা শেষ হলে শুভ্র জানায় দাদি আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি সবাইকে নিয়ে বাসায় যেতে বলেছেন।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here