একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ৪০+৪১

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৪০
রোকসানা আক্তার

“ভাই তোর দয়াও চাই,মাফও চাই আর আমারে বকিস না।মোবাইল সাইলেন্ট মোডে রেখে নূরীর সাথে কথা বলতেছিলাম।একটু তো বোঝার চেষ্টা কর ভাই আমার।”
“ওহ,তাহলে এই ব্যাপার!শালা হাঁদারাম প্রেমলাপ করতে গিয়েছিলি!তাইতো ভাবি ব্যাঁটা এত বিজি ক্যাঁ!”
পাশ থেকে অশ্রু খিলখিল হেসে দেয়।আবরার হাসির আওয়াজ শুনতে পেয়ে আকস্মিকতায় বলল,
“কে রে তোর পাশে?”
“তুই জেনে কি করবি?”
“প্লিজজ কস না!রুমকি ভাবী তাইতো?”
“ভাবীর সাথে ফ্রী হতে অরুনকে কখনো দেখেছিস?”
“নাহ।তাইলে কে?প্লিজজ বল তর সইছে না আমার।”
“বলবো।আগে মিরপুর-১ শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে আয়।”
“ত-তুই ওখানে!?”
“জ্বী।”
“ক-কিন্তু কার সাথে গিয়েছিস?”
“আমার পা নেই?”
“আছেতো।তোর পাশে কে!”
“বললামতো আগে আয় তারপর দেখবি।”
“আই’ম সো এক্সাইটেড অরু!দশমিনিটের মধ্যেই দেখবি সামনে।”
“এই ওয়েট ওয়েট..নূরী কি তোর সাথে আছে?”
“হুম ও তো আমার সাথেই।ওকে নিয়েই আসতেছি। আর টেনশন নিস না দ্রুতই চলে আসবো।রাখ।”
“এই দাঁড়া দাঁড়া।তোর মোবাইল সাউন্ড একটু লো করতো।”
“লো-ই করা।ক্যান কোনো সমস্যা হইছে?”
“নূরীকে সাথে নিয়ে আসিস না। তুই একাই আয়।”
“নূরী আজ আসার পর থেকে খালি তোর কথাই কইছে।তোকে নিয়ে টেনশন করতে করতে শেষ বেচারী।তাই না নূরী?”
নূরীও আবরারের সাথে তালে তাল মিলিয়ে ওপাশ থেকে বলল,
“হ্যাঁ ভাইয়া আবরার ঠিক বলেছে।আমি আপনার সাথে একটু দেখা করবো।কতটা দিন হয়ে গেল আপনাকে দেখে নি।”
অরুন ঝিমসে যায়।চোখবুঁজে একটা দম নেয়।অরুনের আর জবাবের অপেক্ষা না করে কটকট করে কল কেটে দেয় আবরার।অরুন সিটের উপর আনমনে বসে।নূরীর সাথে দেখা হওয়া মানেই উটকো ঝামেলা।এটা বলে,ওটা বলে মুখে একদম লাগাম ছাড়া।আবরার কোন পূর্ণকাজে অপূর্ণ করলো যে এমন মেয়ে পছন্দ হতে হলো।এখন ভালোয় ভালোয় মিষ্টি কথায় অশ্রুর সামনে থেকে বিদেয় করতে পারলেই হলো।ভেবেই অরুন গলায় খেঁকারি টানে।অশ্রু অরুনের দিকে তাকায়। বলল,
“আপনার কাজিন কল করেছে,না?”
অরুন অবাক চোখে তাকায়।জিজ্ঞাসূচকে তাকাতেই অশ্রু আবার বলল,
“তোহিয়া আন্টির ছেলে।”
“হু,ঠিক ধরেছ।কিন্তু তুমি জানো কিভাবে?”
“তোহিয়া আন্টি বলেছেন।আপনাদের বাড়ি যাওয়ার পর একমাত্র উনার সাথেই আমার ভালো খাতির হয়।বাদবাকি যত পাবলিক ছিলো সবাই মুখ গোমড়া।কথাই বলে না।দেখেই বুঝা গেলো একেক জন ভাবের হাড্ডি।তোহিয়া আন্টি আমায় খুবই আদর করেছেন।সত্যিই উনি আসলেই অনেক ভালো যা তুলনাহীন।”
“হুম অশ্রু।খালামণিকে পেয়ে কখনো মায়ের অভাব বুঝিনি।”
“জানি আমি সব।”
“ভালো।শুনে খুশি হলাম আমার ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে পেরেছ।যাইহোক, কথা যেটা আবরার এবং নূরী এখন আমাদের এখানে আসতেছে।তোমার প্রবলেম হবে নাতো অশ্রু?”
“আরেহ, না না। আমিতো কারো সঙ্গ পেলে এক লাঁফে তার গলায় ঝুলে যাই।”
“বুঝতে পারলাম মিশুক টাইপের তুমি।”
অশ্রু হেসে দেয়।তারপর এভাবে দুজনের খুনসুটি আলাপ চলতে থাকে।কিছুক্ষণ সময় কাটার পর বাইকের হর্ণ বাজার শব্দে অরুনের টনক নাড়ে।পেছনে তাকিয়ে বাইকে আবরার এবং পেছনে কাঁধ চেপে বসে আছে তার জানেমন।অরুন খানিক টুকু হাসার চেষ্টা করে।আবরারও হেসে দিয়ে অশ্রুকে ইঙ্গিত করে ভ্রু উঁচায়।অরুন ইশারাতে বুঝায় ধৈর্য্য ধর জানতে পারবি।আবরার সম্মতি দিয়ে বাইক থেকে নামে এবং নূরীও।দুজনে এদিকে হাঁটে।অরুন সিট ছেড়ে দাড়িয়ে অশ্রুকে বলল,
“অশ্রু আবরাররা চলে এসছে।”
অশ্রু তড়িঘড়ি পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে যায়।আকাশের গাঢ় লালিমার আবৃত্তে চারদিক আবছা আলোর মাঝে একজোড়া মানব-মানবী একে-অপরের হাতে হাত রেখে এদিকটায় আসছে।এদের চোখেমুখে উচ্ছাসের আভা।চোখগুলো ছলছল।মুখে রাঙ্গা হাসি ঝুলা।দেখেই মনে হয় এরা খুব নিষ্পাপ।এদের মাঝে নেই কোনো রাগ,নেই কোনো অনুরাগ।আছে ভালোবাসা,শুধুই ভালোবাসা!
চমকে উঠে অশ্রু।অন্তঃগোপনে শব্দহীন একটা ঢোক গিলে ।মাথাটা বামদিকে খানিক মুভ করে অরুনের দিকে তাকায়।আবছা আলোয় অরুনের হাবভাবে তেমন কিছু স্পষ্ট বুঝা গেল না।আবরার কাছে এসেই বলল,
“কিরে অরু,হঠাৎ এখানে?আর উনি কে চেনতে পারলাম না ঠিক।”
“বলবো।এসেই তো হাঁপিয়ে গেছিস।আগে হাঁপানি কমা।”
“তর সইছে না।তাড়াতাড়ি বল।”
অশ্রু ফিঁকে হেসে দেয়।অরুনও মুঁচকি হাসে।তারপর অরুন হাসি থামিয়ে অশ্রুর দিকে ফিরে বলল,
“অশ্রু,এ হলো আবরার এবং এ হলো নূরী।সম্পর্কে দুজন ইয়ে।”
োপাশ থেকে আবরার বললো,
“ইয়ে টা কি,হ্যাঁ!সুন্দরভাবে বলতেও জানিস না।”
“তাহলে সরাসরি গার্লফ্রেন্ড এবং বয়ফ্রেন্ড বলে লজ্জা দিয়ে দিই?”
“বলেইতো দিলি।”
“হা হা হা হ হা।আর আবরার এন্ড নূরী ইনি হলেন অশ্রু।আবরার তো চিনতে পেরেছিস আই থিংক।”
আবরার ভাবতে থাকে।আবরারের ভাবার ভঙ্গিমা এমন যে কে হতে পারে বুঝে উঠতেই পারছে না।ব্যর্থ মুখ নিয়ে বলল,
“চেনতে পারলাম না।ডিটেইলস বল।”
“বুঝলে বুঝ,না বুঝলে হাদা খা গাধা।আর ডিটেইলসে যাচ্ছি না।”
কথার মাঝে হঠাৎ নূরী বলে উঠলো,
“আমি বুঝেছি।নিশ্চয়ই ভাবী।না ভাইয়া?”
অরুন থতমত খায়।অশ্রু লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে আনে।অরুন অশ্রুর দিকে তাকিয়ে নূরীকে থামাতে উঠে লেগে যায়।নূরী কি আর থামে?সে লাগামহীন কথা ছাড়তে থাকলেই তা গপাগপ।বলল,
“ভাবী এত্ত সুন্দর,ইয়া মাবুদ!ভাইয়ার চয়েজের তারিফ না করে পারলাম না ।আবরার তুমি ঠিকই বলছিলে ভাইয়ার চয়েজ মানেই হান্ড্রেড এ হান্ড্রেড।”
নির্বাক অরুন বেসামাল।নূরীকে থামাতে পারছে না।আবরারের হাতে জোরে চাপ দিয়ে ধরে আর চোখের ইশারায় বলল,
“প্লিজজ ভাই ওরে একটু থামা।মানসম্মান সব উড়িয়ে দিল যে।”
আবরার ভ্যাবাচ্যাকা।এই সেই অরুনের ভালোবাসার অশ্রু!মাম্মাতো তলে তলে ভালোই টেম্পু চালাতে জানে।যাইহোক,বাসায় গিয়ে আচ্ছামত একটা দোলাই দিতে হবে।এখন একটহ মানসম্মানটা রক্ষা করি।শতহোক কাজিনতো।ভেবেই আবরার প্রসঙ্গটা পাল্টাতে নূরীর দিকে ফেরে।মুখে কৃত্রিম হাসি বজায় রেখে বলল,
“ইয়ে নূরী,তোমার ভুল হচ্ছে।ভাইয়া তার পঁচিশ বছর জীবনে এখনো সিঙ্গেল লাইফ বিলং করছে তাতো তুমি জানো।”
“কিন্তু তুমি যে বললে ভাইয়া অশ্রু নামের কাউকে পছন্দ করে!”
“আরেহ পছন্দ করলেই কি গার্লফ্রেন্ড হয়ে যায় নাকি?”
কথার মিনিং-এ কথাটা বলে ফেলল।হায়রে এবারতো আবরার শেষ।তাড়াতাড়ি জিব কেটে অপরাধ চোখে অরুনের দিকে তাকায়।অরুন কি আর স্বাভাবিক!সে তো চোখমুখ লাল করে আবরারের দিকে তাকিয়ে আছে।আর অশ্রু?সে তাদের এমন অভিনয় দেখে
চোখের দৃষ্টি নিচে ধাবমান করে মুখ চেপে হাসছে। বেচারী আবরার নাজেহাল বসর আবার বলে উঠলো,
“ওহ না না কি থেকে কি বলতেছি।মানে বলতে চাইলাম যে অরুন অশ্রু নামের কাউকে চেনে।আর এই তুমি তা কই থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো।আগ বাড়িয়ে কথা বলার অভ্যেসটা তোমার এখনো গেল না।ইয়া মাবুদ!”
“এই তুমি….।”
“আহা নূরী আবার!অশ্রু আপু আপনাকে বলতেছি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। আসলে ওর..
বাকিটুকু মাথায় হাত রেখে ইঙ্গিতে বোঝায়।অর্থাৎ নূরীর মাথায় একটু প্রবলেম আছে।
অশ্রু হেসে দেয়।নূরীর এবার চরম রাগ উঠে যায়।দাঁতগুলো গটাং গটাং কটমটিয়ে বলা শুরু করলো,
“আমার মাথায় প্রবলেম আছে না?থাকবো না এখানে আর এক মুহূর্তেও।চলে যাচ্ছি,হু।”বাচ্চামো ভঙ্গিতে বলেই পা বাড়াতে থাকে।অশ্রু পেছন থেকে হাত টেনে ধরে।নূরীর সামনে গিয়ে দাড়ায়।মুখে হাসি বজায় রেখে বলল,
“তুমি উনাদের কথায় সিরিয়াস হও কেন?আমি কিছু মনে করিনি।”
“দেখো তো কিভাবে পঁচাচ্ছে আমাকে।”
“আহা,বাদ দাও।তুমি খুব মিষ্টি।মিষ্টি মেয়েরা মুখটাকে এভাবে তিক্ত করে রাখলে মানায় না।”
নূরী বেখেয়ালি হেসে দিয়ে উঠে।আর অশ্রুকে এক লাফে জড়িয়ে ধরে।
তা দেখে অরুন মুঁচকি হেসে দেয়। সাথে আবরারও।আবরার অরুনের কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে,কিরে মাম্মা ভাবী তো বেশ সুন্দর!প্রশংসা না করে পারলাম না।গ্রেট মাম্মা গ্রেট!

অরুন আবারো মুঁচকি হাসে।আর তার অস্পষ্ট চাহনি অশ্রুর মুখখনা দেখতে থাকে।মনের মাঝে এক অন্যরকম শিহরণ দোল খেয়ে যায়।আকাশে-বাতাসে পুরো পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার ছোঁয়া।
তার প্রিয়সীকে সর্বোচ্চ ভালোবাসার সম্ভাষণে রেখে অতি সুখে গান গেয়ে যায় প্রাণোচ্ছলে।
আহা,এই বুঝি বসন্তের দোলা।
ছুঁয়ে যায় আমার খা খা মনভোলা।
ভালালগা, ভালোবাসা সবটাই তোমাতে ব্যাকুল।
একটুখানি ভালোবাসা দিবে কি প্রিয়
একটুখানি বিশ্বাসের ভরসায়।
পুঁড়ে যাবো,ছিঁড়ে যাবো,হারিয়ে যাবো সবটাই তোমাকে না পাওয়ার বৃথায়।

আবরার একটু পেটুক টাইপের।এখানে আসার আগে গ্রিল এবং মালাই খেয়ে এসেছিল এখন সেগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে।এখন অরুনকে বাহবা দিয়ে রেস্টুরেন্ট যেয়ে পেটটাকে শান্তি দিতে পারলেই হলো।অরুনের আজ বিশেষ ব্যক্তি আসছে বলে কথা আজতো আর কম খাওয়াবে না,অঢেল খাওয়াবে।ভেবেই আবরার গলায় খেঁকারি টানে।বলল,
“তো অরুন অশ্রু আপুতো আসছে অনেকক্ষণ হলো আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।অতিথি মানুষ আর কতক্ষণ এমন নির্জন জায়গায় কাটাবে।”
“হুম,এইজন্যে তোকে নিয়ে আসা।আমারতো আর জনসম্মুখে যাওয়া পসিবল না তাই তুই, নূরী এবং অশ্রু যা।
বলেই অরুন মানিব্যাগ বের করে।ওখান থেকে পাঁচ হাজারের মতো বের করে আবরারের হাতে দেয়।তারপর আবার বলল,
“ভালো কোনো ক্যাফেতে যাস।”
অরুন যাবে না শুনে আবরার থতমত খায়।থমথমে গলায় বলল
“তুই যাবি না মানে!”
“বাসা থেকে ডাক্তার ইসমাইল আঙ্কেলের চেম্বারে যাবো বলে বের হই।তাও বাবা বাসায় ছিলেন না বলে খালামণিকে কোনোমতে বুঝিয়ে আসি।এখন ক্যাফে গেলে অনেকেই দেখবে আর একথা বাবার কান অব্দি না গিয়ে থাকবে না।বুঝলি?”
“বুঝলাম।তবে তোকে ছাড়….!”মুখটা বেজার হয়ে আসে আবরারের।অরুন যেহেতু যাবে না তাই অশ্রুও যাবে না ভেবে মনস্থির করে।বলল,
“আসলে ১ ঘন্টা ওভার।আমার বাসায় যেতে হবে।বেশিক্ষণ হয়ে গেলে মা কিছু মনে করবেন।প্লিজজ আজ আসি।প্লিজজ..!
“আহা আপি,মাত্র আধাঘন্টার কার্বার।বেশিক্ষণ সময় লাগবে না।তাছাড়া গেস্টকে কেউ এভাবে ছাড়ে না। তুমি বললেই মেনে নিব তাতো হবে না।”
“নূরী,আরেকদিন ইনসাল্লাহ যদি আবার কখনো একত্রিত হই।”
বলেই অশ্রু একফাঁক অরুনের দিকে তাকায়।অরুন বলল,
“অশ্রু,বাসায় গিয়ে মাকে একটা বাহানা দিতে পারবা না?”
“আসলে আমার মা খুব হার্ড।১ ঘন্টার এক সেকেন্ডও হেরফের হলে উনার মুখের সামনে কথা বলা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।”
অরুন দৃঢ় শ্বাস ছাড়ে।অশ্রুর অবস্থানের কথা ভেবে সায় দেয়।
হাঁক ছেড়ে বলল,
“বেশ।তাহলে চলো ছেড়ে দিয়ে আসি।”
“আরেহ নাহ নাহ।এটুকুর পথ গাড়ি লাগবে না।আমি রিক্সাতেই চলে যাবো।”
অরুন মাথা নেড়ে মেনে নেয়।আবরার একটা রিক্সা দাঁড় করায়।অশ্রুকে রিক্সাতে উঠে বসে।অরুন দাঁড়িয়ে অশ্রুর দিকে তাকিয়ে আছে।অশ্রু সবাইকে বিদায় জানিয়ে রিক্সা চলতে থাকে।অশ্রুর মনের ভেতর উতালপাতাল ঢেউ খেলে যায় নূরীর বলা সেই কথাগুলোয়। মস্তিস্কে বার বার টক্কর খায়।অরুন সত্যিই তাকে ভালোবাসে?সত্যিই পছন্দ করে!আচ্ছা তাহলে আজ অরুন বললো না কেন?!অন্যমোডে কথা বললো কেন!
ভাবতে ভাবতে অশ্রু রিক্সার পেছনে তাকায়। দূর থেকে অরুনকে এখনো দেখা যাচ্ছে।তার দৃষ্টি এই রিক্সায় আবদ্ধ।অশ্রুর রিক্সা যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা গেছে অরুন ততক্ষণ পর্যন্ত দাড়িয়ে থেকেছে।
অশ্রর মুখে একটা অজানা হাসি ফুঁটে উঠে।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৪১(পাওনা পর্ব)
রোকসানা আক্তার

অশ্রু ক্লান্তিমনে বাসার কলিংবেল চাপে।নুজিফা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।দরজা বরাবর ডাইনিং থেকে দেখা যায় সোফায় বসে এক লাটবাহাদুর পায়ের উপর পা রেখে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে।তা দেখে অশ্রুর ভ্রু’দুটো কুঁচকে আসে।সে ভেতরে ঢুকে সোফার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।আকস্মিকতা কন্ঠে বলল,
“কী ভাইয়া,আপনি নাকি পরসু আসবেন!”
অশ্রুর ক্ষীণস্বর কানের পাশ দিয়ে ঘেঁষতেই বিপুল রিমোর্ট একপাশে রাখে।তারপর তীক্ষ্ণ চোখে অশ্রুর পা থেকে মাথা অব্দি দেখতে থাকে।বিপুলের এরকম দৃষ্টির কারণে অশ্রুর রাগ উঠে যায়।বলল,
“এত ন্যাঁকা বন্ধ করে আমার কথার জবাব দেন।”
বিপুল পা সরিয়ে সরু হয়ে বসে।ভ্রু বেঁকে বলল,
“এসে মনে হয় তোর অনেক বড় ক্ষতি করে ফেললাম!”
অশ্রু চোখের দৃষ্টি অন্যদিক করে চুপ হয়ে থাকে।বিপুল বসা থেকে দাড়িয়ে যায়।খরখর গলায় বলতে থাকে,
“এই তোর এত ভাব কীসের বলতো আমারে!তোর চোখে কি আমাকে মানুষ মনে হয় না!নাকি রাস্তার শুয়োর মনে হয় বলতো!”
“ভাইয়া লিমিট বজায় রেখে কথা বলবেন!আপনাকে কেউ কিছু বলেছে?”
“বলে নি।তুইতো মহাসাধু তুই কিছু বলতে আসবি কেন!”
পারুল বেগম বাইরে চেঁচামেচি শুনে ডাইনিং এ আসেন।কোনো কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বলেন,
“হচ্ছেটা কী এখানে?এত চিৎকার-চেঁচামেচি কীসের?”
নুজিফা কাছে এসে বলল,
“ভাইয়া আসছে বিধায় আপু জিজ্ঞেস করলো আজ আসছে কেন পরসুতো আসার কথা।তাই এই নিয়ে ভাইয়া আপুর মাঝে কথা কাটাকাটি হয়।”
বিপুল দাঁড়িয়ে না থেকে অন্যদিকে চলে যায়।পারুল বেগম তেলে-বেগুনে লাল হয়ে যান।অশ্রুর দিকে অগ্নিচক্ষু নিক্ষেপ করে বলেন,
“বেশি বেড়ে গেছিস,না?এখন আর কারো কথা গায়ে যায় না।নিজে যা বলিস সবই ঠিক মনে করিস, না?আজ তোর বাবা আসুক তারপর বলবো মেয়েকে কেন এত মাথায় চড়িয়ে চড়িয়ে অবাধ্যতায় নিয়ে গেছে!”
“মা এসব তুমি কি বলছো!?”
“চুপ একদম চুপ।মেহমানের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা জানিস না!বাসায় মেহমান আসলে মানুষ মেহমানের সাথে এরকম ব্যবহার করে?”
“আমিতো উনাকে কিছুই বলিনি!”
“না বললে ও এতটা রাগ হবে কেন!তুই কিছু বলেছিস বিধায়ই ও রেগেছে।মানুষকে সম্মান দিতে শেখ অশ্রু!”
বলেই পারুল বেগম চলে যায়।অশ্রু রুমে চলে আসে।দরজা বন্ধ করে ব্যাগটা বিছানার উপর ছুঁড়ে দিয়ে ব্যথিত মনে বসে পড়ে।কি এমন বললাম যে এতটা ক্ষেপে গেলেন, বাহরে!আর মাও না বুঝে উনার সাথে আমাকেই অপদস্ত করলেন।এই দুনিয়াতে ভালো বললেই খারাপ হয়ে যায়।আজ উনিইতো বললেন বিপুল ভাইয়া দু’দিন পর আসবেন এটা জিজ্ঞেস করছি আর কি এমন দোষ হয়ে গেল!?
থাকুক বাবাকে বললে বলুক গা।আমিতো কোনো দোষই করিনি।মনে মনে বলেই অশ্রু ওড়না টা একপাশে রেখে দাড়িয়ে যায়।
ভাবনাগুলোকে আর মুহূর্তে মনে জায়গা না দিয়ে সোঁজা বাথরুমে চলে যায়।তারপর হাতমুখ ধুঁয়ে ফ্রেশ হয়।
রাতে ডিনার করতে এসে কারো সাথে তেমন কথা বলেনি।অশ্রুর মনে যে ভয়টা ছিল বাবা ডাইনিং এ বসার সঙ্গে সঙ্গেই মা একগাদা অভিযোগ করবে তা আর করেনি।প্রাণ যাওয়া অশ্রু প্রাণ ফিরে পায়।মনে মনে মাকে একশোটা থ্যাংকস দেয়।তাছাড়া বাইরে বেরুনোর কথাও বলেনি।ভেবেই অশ্রু খুশি হয়ে বিছানার চৌকাঠে আধশোয়া বসে।হুট করে দরজা ঠেলে বিপুল ভেতরে প্রবেশ করে।অশ্রু হকচকিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসে।বলল,
“আপনি?”
“কথা আছে তোর সাথে।”
“মাকে উস্কানি দিয়ে আমাকে আচ্ছামত গাল শুনিয়ে আবার কি বলতে আসছেন?”
“আমি জানি তুই আমার উপর রেগে আছিস।তোর রুমে এলাম একটুতো বসতেও বলিস নি।
“চেয়ার রাখা আছে,মোড়া রাখা আছে ধরে ধরে কি বসিয়ে দিতে হবে?হাত-পা সবারই আছে।”
বিপুল অশ্রুর কথায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে নিজে গিয়েই চেয়ারে বসে।কৃত্রিম হেসে বলল,
“তোর প্রতি আমার স্যাম্পেথিকটা অনেক বেশি অশ্রু।জানি না কেনজানি তোর সামান্য কথাও আমার বুকে এসে তীরের মতো লাগে।সহ্য হয়না।মাথার রক্ত গরম হয়ে যায়।নিজেকে কন্ট্রোল করা হারিয়ে ফেলি।মনে পড়ে তুই একদিন আমার ব্রার্থডে আমাদের বাড়ি গিয়েছিলি আর তুই আমার হাতের কেক খাস নি।কেমন ধমক ধমক কথা বলে রুমে চলে যাস।সেদিন সবার সামনে নিজেকে কন্ট্রোল করলেও পরে তোকে একা পেয়ে থাপড়ানোর জন্যে হাত তুলি।কিন্তু থাপ্পড় দিতে বিবেক বাঁধা দেয়।মাঝে মাঝে তোর প্রতি আমার আনকন্ট্রোল বিহেভিয়ার আমাকেই বিরক্ত করে।
আর আজও তাই হয়েছে।প্লিজজ রাগ করিস না।তুই ডিনারেও কারো সাথে তেমন কথা বলিস নি।”
বলেই থেমে আবার বলল,
“আর আজ আমার আসার কথা ছিলনা।তুইতো জানিস আমি সচরাচর বাসে আসি। ট্রেনে কখনো আসিনা।কিন্তু হরতালে তো ট্রেন বন্ধ থাকে না।যখন কথাটি মাথায় আসে তখনই ডিসিশন চ্যান্জ করে ফেলি ট্রেনেই আসবো।এমন বড় বিপদে যে কোনো ওয়েতেই হোক তাড়াতাড়ি আসাটা ব্যাটার হবে।যখন ট্রেনে আসবো বলে ফুঁপিকে জানবাো ওমনি মা নিষোধ করেন।বলেন জানানোর দরকার নেই গেলেই দেখবে।তুই এখন তাড়াতাড়ি রওনা কর।মায়ের কথা মেনে নিই।এই হলো ব্যাপার।যাইহোক,আসার কারণটা বলে দিলাম।এবার তুই ঘুমা।অনেক রাত হয়েছে।”
বিপুল চলে যায়।অশ্রু দরজা বন্ধ করে হ্যান্ডব্যাগটা খুঁজে মোবাইলটা হাতে নেয়।তারপর কম্বল টেনে বিছানায় শুয়ে ডিসপ্লে অন করে।মুহূর্তে স্ক্রিনের সামনে ভেসে উঠে অরুনের চারপাচঁ বার কল দেওয়ার লিস্ট।অশ্রু চমকে যায়।মায়ের সাথে রাগ করে মোবাইলটা আর হাতে নেওয়া হয়নি।তাড়াতাড়ি অশ্রু অরুনকে ব্যাক করে।দু”বার রিং হওয়ার পর অরুন রিসিভ করলো।বলল,
“খুব বিজি, অশ্রু?”
“হুম।কাজিন এসছে।”
“ছেলে নাকি মেয়ে?”
“ছেলে।”
“ওহহহ!তার সাথেই এতক্ষণ কথা বলেছিলে?”
“হু।” হ্যা-বোধক উত্তর দিয়েছে অরুন জিলাস ফিল করতে।বুঝতে তার মনের অনুভূতি।আসলেই অশ্রুর প্রতি তার কেমন ফিলিংস।
তবে অরুনের কথায় তেমন জিলাস ফিল হলো।সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দেয়।
“গুড।রিলেটিভদের সময় দেওয়া ভালো।আর চেষ্ট করবে আরো সময় দিতে।”
নিমিষে ছলছলে দু’খানা চোখ অশ্রুর ছোট হয়ে এলো।ইশ ভাবলো কি আর হলোটা কি!নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছে হয় এখন।নিজেকে যথেষ্ট আগকে অশ্রু বলল,
“দোয়া করবেন।”
“বাসায় কখন পৌঁছেছো?”
“আসতে বেশিক্ষণ লাগেনি।এই ধরুন পাঁচ ছয় মিনিট।”
“ওহ।”
“আপনার?”
“আমার চল্লিশ মিনিট লেগেছে।আর আবরারের এক ঘন্টা।”
“উনার এত সময় লাগার কারণ কি?”
“মিরপুর থেকে ধানমন্ডি গিয়েছে।চিপাচাপা গলির মধ্যে নূরীর বাসা।ওদিকটায় যেতে সময় বেশি লেগেছে।তারপর আবার উত্তরা ব্যাক করেছে।”
“বুঝলাম।”
“তো ডিনার করেছো?”
“কিছুক্ষণ আগে কম্প্লিট হলো।আপনার?”
“আমারও।”
“আবরার ভাইয়া কি বাসায়?”
“হুম।যেতে দিই নি হলে।একদম বেঁধে রেখে দিয়েছি আজ সাথে।কাল থেকেতো আর সঙ্গে পাবো না।”
বলেই অরুন হাসার চেষ্টা করে।সে হাসির শব্দে অশ্রুর বুকটা চিনচিনিয়ে ব্যথা করতে থাকে।ব্যথার অনুভূতিটা এতই প্রখর যা অশ্রু চোখবুঁজে সহ্য করতেও কঠিন হয়ে যায়।অশ্রুর চুপ থাকা দেখে অরুন আবার প্রসঙ্গে টেনে বলল,
“জানো, আবরার এখন কি করে?”
“কী করে?”
“নূরীর সাথে প্রেমালাপ চলছে।ভাগ্য খুবই ভালো।নিজের সুখ-দুঃখ, রাগ-অভিমান সব শেয়ার করার মতো সঙ্গী পায় সাথে।অথচ আমাদের দেখো কাউকে নিজের কাতর মনের কথাগুলোও সপাতে পারিনা।”
এমুহূর্তে অশ্রুর ভীষণ কান্না করতে ইচ্ছে হয়।কেনো এত মায়া হচ্ছে?কেন এতটা কষ্ট অনুভব হচ্ছে।বুকটা ছিড়েখুঁড়ে যদি কষ্টের সীমা দেখা যেত!মনের ক্রন্দনের সবগুলো ধ্বনি একত্রিত হয়ে বলতে চায়, আমিইতো আছি সাথে অরুন।একটুখানি বিশ্বাস করো আমায়।আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে তোমার সবকথা শুনবো।তোমার ঠোঁটে ভাসা প্রতিটি কথার নিঃশ্বাস শ্রবণ করবো।এইতো বুকটা হালকা লাগছে।খুব হালকা।
আফসোস তা আর বলা হয়ে উঠলো না।অভাগী অশ্রু একটা দৃঢ় নিঃশ্বাস ছাড়ে।তারপর বলল,
“বিয়ে করে ফেলুন।”
অরুন খিলখিল করে হেসে দেয়।ধাঁধায় পড়ার মতো ভান করে বলল,
“জেলে গেলে এই অপরাধীকে কে আর বিয়ে করবে!কেউই করবে না।”
“যে মানুষ আপনাকে আগে ভালোবাসতো,সে পরেও বাসবে।”
“গ্যারান্টি দিতে পারবা?পারবা না।বর্তমানে ক’জন মেয়ে এরকম, বলোতো?সর্বাদিক গেলে ওয়ান পার্সেন্ট খুঁজে পাওয়াও ভার।যাইহোক ঘুমিয়ে যাও।ঘুমে ডিস্টার্ব হলো।বায়।”
অশ্রুর ইচ্ছে হয় বলতে,নাহ অরুন আপনি বলুন।আমার ঘুমের কোনো ডিস্টার্ব হয়নি।বরঞ্চ কল কেটে দিলে আজ সারা রাত আর ঘুমোতে পারবো না।নির্লিপ্ত অশ্রু নির্বাক।ভেবেও মনের কথা গলায় এসে আঁটকে যায়।তারপর প্রকাশিত কন্ঠে ওই কথাটাই মেনে নিলো।
আচ্ছা,বায়।”
কেটে দেয় অরুন।অশ্রু মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।উতলা মন বুঝে না বাঁধা,তবুও বাঁধা পড়ে যায় বিবেকের কাছে।মোবাইলটা বালিশের পাশে রাখে।কাঁত হয়ে শুয়ে চোখবুঁজে। মনটা হাজারো জল্পনা কল্পনার রেখা আঁকতে থাকে।কল্পনায় ভাসে অরুনের হাতের উপর হাত রেখে কথা বলতেছে।অরুন কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বাতাসে উড়ে তার(অশ্রুর) বেসামাল চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনের দিকে গুঁজে দিচ্ছে।কতটা ভালোবাসা এ দুটি মানুষের।কতটা তৃপ্ততা বুঝা বৃথা।

কল্পনার মাঝেই অশ্রুর হেঁচকি উঠে যায়।তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে উঠে বসে।টেবিলের উপরে রাখা জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে টগবগিয়ে খেয়ে নেয় পুরোটা।বুকে হাত রেখে নিঃশ্বাস ছাড়ে।আবার শোয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিবে তার আগেই মোবাইল থেকে টুন টুন শব্দ হয়।অশ্রু মোবাইল হাতে নিয়ে ডিসপ্লে অন করে।অরুন একটা মেসেজ করেছে।অশ্রু ইনবক্সে অপশনে ঢুকে অরুনের মেসেজে চোখ বুলায়।লেখা,
“তুমি অনন্য,অসাধারণ!তোমার সুন্দরের তুলনা দেওয়া আমার উপ্ত মনটা ব্যর্থ।বিধাতা তোমাকে কি দিয়ে গড়েছেন জানতে ইচ্ছে হয় খুব।তোমার এই সৌন্দর্য্য রয়ে যাক চিরকাল!”

চলবে…
(ও দুদিন দিতে পারিনি আসলে খুব ব্যস্ত ছিলাম।পড়ালেখা জানেনতো একটা প্যারা😑)
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here