#কিছু_অধ্যায়(পর্ব_৬)
#লেখায়_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
আমার বিষন্ন মনে কতকিছুই না ভাবতে লাগলাম। আর সবকিছুকে ঘিরে বোধহয় একজনই ছিল।
ভেবেছিলাম পাত্রকে সরাসরি না করে দেব আর অনেককিছু বলে দেব। কিন্তু হল কী? উল্টো আমার কথাগুলোই আমাকে শুনিয়ে দিল।
এসব ভাবতে ভাবতে অকস্মাৎ সেদিনের কথাটি মনে পরে গেল। আদ্রিয়ান বলেছিল,
” সবকিছু যে সত্যি হবে এমন কেন মনে হয়?
কারো সাজানো কথাই তো কেউ উল্টো শোনাতে পারে।”
এই কথাগুলো মনে পরে মাত্রই কয়েকটা ক্যালকুলেশন করে ফেললাম। আমার সাজানো কথাই আমাকে শোনালো। কিন্তু সে কীভাবে জানলো? যতটুকু মনে পরে, যেদিন দেখতে আসলো সেদিনই তার সাথে পরিচয়। তার আগে তো দেখিনি।
আমি উত্তর খুঁজছি। কিছুক্ষণ পরে খোঁজ পরলো আমার। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। তবে এতক্ষণ বাড়িতে মেহমান থাকলেও আমার রুমে কেউ উঁকিঝুঁকি দেয়নি। মাসুদ আংকেলের পরিবারের সামনে অবধিও যাইনি আজ। ক’দিন পরে তো বউ করেই নিয়ে যাবে। আমার লুকানো অনুভূতি গুলো বোধহয় আড়ালেই থেকে যাবে কোনো এক নতুন পথচলার জন্য। আর যার জন্য ভাবছি সেও হয়তো তার গার্লফ্রেন্ড নামক মানুষটির সাথে ভালোই থাকবে।
আমি আমার রুম থেকে বেড়িয়ে সবার সামনে যাচ্ছি। তখন সবার সাথে কমবেশি দেখা হল, কথা হল। তবে এক মুহূর্তে আমি থমকে গেলাম। বাকরুদ্ধ হয়ে খানিক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। সেদিন আদ্রিয়ানের সাথে যে মধ্যবয়স্ক মহিলা এসেছিল সেও আছে। আমায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ডাকলো। বলল,
” বসো। আমায় চিনতে পেরেছ?”
” জি।”
” আমি তাসবিহার আম্মু। এখন তো ভালোভাবেই চেনার কথা।”
তার কথাশুনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। সে এখানে কেন? তাও এই সময়ে। আমি আশেপাশে তাকিয়ে মানুষ দেখায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। তখন প্রায় সবাই এসে পাশে বসেছে। তাসবিহাকেও দেখা গেল। বেশ শান্তশিষ্ট ভাবে আমার পাশে এসেই বসলো। একপর্যায়ে ওর মা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,” মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন?”
আমি মৃদু হেসে বললাম, ” এমনি।”
সে মাথায় হাত রাখে। তারপরে বলে,” মন খারাপ? তবে মন খারাপের কারণগুলো মনে চেপে না রেখে বরং মুক্ত করে দাও।”
তার কথা শুনে আমি তার মুখপানে তাকাই। তার মুখের হাসি প্রশস্ত ছিল। আমি খানিকটা নিভে যাই। সেদিন তাকেই বলেছিলাম, ছেলেমেয়ের ইচ্ছে গুলোকে মুক্ত করে দিতে। আজ সেই কথাগুলোই তিনি ফেরত দিলেন।
আমি হতাশ হয়ে বসে রইলাম। সবাই সেখানেই উপস্থিত। মাসুদ আংকেল আর তার স্ত্রী রেহানা বেগম আমার দু’পাশে এসে বসলেন। তার কিছুটা দূরেই আব্বু আর আম্মু। রেহানা আন্টি ব্যাগ থেকে কাঁকন বের করে হাতে পরিয়ে দিলেন। গালে হাত রেখে বললেন,
” মেয়ে হয়ে ঘরে যাবে তো, আম্মু?”
আমি ততক্ষণে নিশ্চুপ হয়ে আছি। এই বুঝি আমার পুরনো অধ্যায়টা মুছে যাওয়ার সময় হল। আমায় নিশ্চুপ দেখে তাসবিহার মা বলল,” ছেলেমেয়ের যেহেতু পছন্দ-অপছন্দ থাকে তাই সেই ইচ্ছেগুলোকে মুক্ত করে দাও না! তোমার যদি কোনো পছন্দ থাকে নির্ভয়ে বলতে পারো। ”
আমি নিভে যাই। কী বলবো? কিছুই যে বলার নেই আমার। একপাক্ষিক কিছু হয় বুঝি?
আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। সবাই কেমন এলিয়েন দেখার মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যা বলবো তার থেকেও বড়ো কথা হল, একজন মেয়ে হয়ে কীভাবে মা- বাবা, বড়োদের সামনে নিজের পছন্দের কথা বলি! এরজন্য বেশি অস্বস্তি হল। তবুও আত্নবিশ্বাস বলে একটা কথা আছে। যদি আত্নবিশ্বাসে নির্ভর করে বলেই ফেলি তাহলে অনেকেই বলবে, মেয়েটি চক্ষুলজ্জাহীন। তখন আরেক কাণ্ড ঘটে যাবে। আমার ভীষণ বেগে কান্না করতে ইচ্ছে করলো। এতকিছু ভেবেচিন্তে মেয়েদেরই কেন কথা বলতে হবে? না হলে একটু ভুল-ত্রুটি হলেই আশেপাশের মানুষজন জেঁকে ধরবে।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,” বিয়েটা তো আর ছেলেমানুষী নয়! আমি বরং পাত্রের সাথেই সরাসরি কথা বলবো। আগে বিবেচনা করবো তারপরে বড়োদের উপরে ছেড়ে দেব।”
আমার কথায় সবাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে সম্মতি দিল। আমিও ভরসা পেলাম।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া একসাথেই করলাম সবাই। তবে আংকেলের ছেলে উপস্থিত ছিল না। তার না-কি কীসের কাজ আছে সেজন্য আসতে পারবে না। আমারও ভালো লাগলো, সে আসেনি তাই। এতগুলো মানুষের সামনে অবশ্য নার্ভাস, অস্বস্তি সবকিছুই ঘিরে থাকতো। এজন্য বেশি খুশি হলাম। কিছুদিন আগের আমি আর এখনের আমি এর মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য হয়ে গেছে। আগে যা মন চাইতো বলে ফেলতাম। কে কী ভাববে সেসবে আমার কোনোকালেই মাথাব্যথা ছিল না। আর এখন? আমি কিছু বলার আগে ভেবে নেই। এই ভালোমানুষির বিষয়টা আগে ছিল না। আদ্রিয়ান আসার পর থেকেই কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেছি। তার সাথে খুব সাবধানে কথা বলতে হত। এই বুঝি সে কষ্ট পাবে আমার কোনো কথায়। বা মন খারাপ করবে। ইশ, মানুষটা এরকম কেন! কেমন যেন তার কথাবার্তার ধরণ। একটা ভালো লাগা কাজ করে। অবশ্য এ ভালোলাগাটা অন্যরকমের ভালোলাগা ছিল। হয়তো তাকে ভালো লাগায় বিধায় তার সবকিছুই ভালোলাগে।
আমি হতাশ হয়ে যাই। কী হবে সামনের দিনগুলোতে! এসব ভেবে ভেবে আমার দুপুর চলে গেল। খুব সাধারণ আমি, এক অসাধারণ মানুষের জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছি।
সে কেন বুঝতে পারে না আমায়? আদৌও বুঝবে কি-না কে জানে? সবকিছুর সমাপ্তি ঘটলো বলে।
পথ তো আলাদা হওয়ার পথে চললো।
বিকেলে মা খবর দিল যে, তার সাথে না-কি আজকেই দেখা করতে হবে। তার না-কি খুব তাড়া আছে। কাজকর্ম ফেলে দেশে আসছে। কতগুলো দিন চলে গেল দেশে ফেরার। অথচ বিয়ে হল না।
আমি অন্যমনস্ক হয়ে বললাম, এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করতে আসছে কেন? আমার কি কোনো ইচ্ছে নেই? সবার কথা মত বিয়ে করবো, তাও তাড়াহুড়োতে। শপিং, ঘোরাফেরা কতকিছু বাকি আছে। অথচ তোমরা কী করছো? সবকিছুতে নিজেদের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দিচ্ছো। অন্ততপক্ষে তার সাথে দু-চারটে কথা বলার সময়তো দিবে! দু-চারদিন দেখা করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে তো দিবে!
আমার কথা শুনে স্বাভাবিক ভাবে মা বলল,” আর কোনো অভিযোগ আছে?”
মায়ের কথা শুনে আমার ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলি,’ অভিযোগ নয়তো কী? যখন তার সাথেই বিয়ের বন্দোবস্ত করবা তাহলে ছোটো থেকেই বলা উচিত ছিল। তার সাথে ঝগড়া না করে বন্ধুত্ব করতাম৷ এতগুলো বছর বিচ্ছিন্ন না থেকে টুকিটাকি কথা বলতাম। তাহলে সবকিছু ইজি থাকতো। আর এতদিন সিংগেল হয়েও ঘুরে বেড়ায়ে হত না।’
আমার কথা শুনে মা চোখ বড়োবড়ো করে তাকিয়ে আছে। আমি ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইলাম। মনের কথা তো বলেই দিলাম। যা ভাবার ভাবুক, আমার কী! এখন তো মুখে কিছু বলবে না একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত আমি। তা-ই এত ভাবাভাবি করছি না।
মা কিছুক্ষণ পরে বলল,‘ সবকিছুই সহজ আছে। তুই প্যাঁচাচ্ছিস বলেই সবকিছু প্যাঁচ মনে হচ্ছে। কী একটা কথা সারাক্ষণ মাথায় বয়ে বেড়ায় আর আমাদেরও কান ঝালাপালা করে ফেলে। ছোটো বেলায় ঝগড়া! এটা কেমন কথা শুনি? ছোটো সময়ে তো একটু আধটু তর্কাতর্কি মারামারি হতেই পারে। সেটা এখন বয়ে বেড়ানোর কী আছে?’
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম,‘ আচ্ছা মানলাম। ওটা আজাইরা কথা। বাড়তি কথা। তাহলে এতদিনে কেন চুপচাপ রইলে? একটু জানাতে পারতে যে তার সাথেই আমার বিয়ে হবে। তাহলে অন্তত কথা টথা বলে ইজি হত বিষয়টি। এখন যদি অন্যকোথাও মনটন চলে যায়, তখন কী হবে!’
শেষের কথাটা বলে জিভ কাটলাম। বেশি কথায় কথা বাড়ে। সেটা চিরন্তন সত্য। আজকেই হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম। এখন তো অতিরিক্ত কথা বলতে বলতে আসল কথাটাই বলে দিলাম। এখন কী হবে? মায়ের রিয়াকশন কী হতে পারে সেদিকে খেয়াল না করেই কম্বল টেনে শুয়ে পরলাম। যা হবার হবে, এখন আপাতত লুকাতে হবে। আপাতত কম্বল ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই।
তবে অনুভব করলাম মা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। তারপরে চলে গেল।
দুপুরের খাবারের পরে না ঘুমালে আমার শান্তি নেই। আজও ঘুমিয়ে গেলাম। মাগরিবের আযানের আগে ঘুম থেকে উঠে হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় বসে রইলাম কিছুক্ষণ। গায়ের আলসেমি ভাবটা ছাড়াচ্ছি।
নামাজ আদায়ের পরে মা আসলো আবারও। আমি ছোটো ছোটো চোখ করে তাকালাম। তাকে পাত্তা না দিয়ে চুলে তেল দিতে লাগলাম। মা বিছানায় গিয়ে বসলো। তারপরে বলল,‘ ও তো সেই কখন থেকে ফোন দিয়েছিল৷ কীরে তুই দেখা করবি না?’
আমি মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মনোযোগী হলাম।
মা খানিকটা কাছে এসে দাঁড়াল। বলল,‘ এত তেল তো জীবনেও দিসনি। এখন দিচ্ছিস যে?’
‘ তুমি পর করে দিচ্ছো এখনই। তেল দিলেও হিসেব দিতে হবে!’ আমি কাঁদার অভিনয় করে বললাম।
মা রেগে তাকাল। ‘ ফাজিল মেয়ে! তোরে মাইরে টানে। এখন অভিনয় করার সময় তোর!’
আমি হোহো করে হেসে বললাম,‘ রাগলে তোমায় যা লাগে না মা! একদম নায়িকার মত।’
মা হেসে ফেলল। আমি ভাব করার জন্য বললাম, ‘ আমার চুলগুলো অপুষ্টিতে ভুগছে৷ তুমি তো নিজের মেয়ের কত খেয়াল রাখো। বকেঝকে খাবার খাওয়াতে বসো। আর আমি আমার এত আদরের সন্তান চুলকে একটু যত্ন করবো না! আমি তো এতটা খারাপ নই।’
মা থামলো না। ভাবলেশহীন ভাবে বলল,‘ আমার পেটেই তো তুই হইছো৷ তোর পেটে তো আমি হইনি! তোর সব ধান্দা বাজী আমি হারে হারে জানি। এত তেল দেওয়ার কারণ কী? তুই দেখা করবি না! সেজন্য এমন তেলে চুপচুপে হয়ে আছো?’
চকিতেই গলা শুকিয়ে গেল আমার। মা দরজা থেকে বেড়োনোর সময়ে বলল,‘ এই তেল নিয়েই বাইরে যাবি। চেঞ্জ কর এখন। ওদের বাসায় যাচ্ছি। ডিনার সেখানে করবো। দাওয়াত আছে।’
মা আবার আসলো। বলল,‘ ভালো ড্রেস পরবি কিন্তু। মানুষজন থাকবে সেখানে।’
আমি মাথা নাড়ালাম। পিংক কালারের গাউন পড়লাম। চুলের তেল ঢাকার জন্য ম্যাচিং হিজাব পড়লাম। হাতভর্তি চুড়ি। আর একটু মুখ ঘষামাজা।
তাদের বাসাতে যেতে আধঘন্টা সময় লাগলো। ড্রয়িংরুমে চুপচাপ স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকতে হল। কিছুই যে চিনি না। সকালে তাসবিহাকে জিজ্ঞেস করতাম, ওর সাথে কীসের আত্নীয়তা! আবার কেমন যেন লাগলো ব্যপারটা। তাই জিজ্ঞেস করিনি। অতিথি মানুষের কাছে এতকিছু জিজ্ঞেস করতে নেই।
কয়েকজন ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো। আমার থেকে ছোটরাও। আমার অস্বস্তি লাগলো। একদিকে বড়োরা কথা বলছে অন্যদিকে কয়েকজন দেখছে। একটা ছোটো মেয়েকে ডেকে বললাম….
#চলবে
( এই পর্বেই শেষ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পর্বটি বড় হয়ে যায়। তাই ১৪০০ শব্দ নিয়ে এ পর্বটি দিলাম।)