#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
পর্ব-১৮
২৬.
সকালে পৃথী ট্রে হাতে রুমে ঢুকে।বিছানার দিকে চেয়ে দেখে অয়ন এখনো বেঘোরে ঘুমচ্ছে।তার এক হাত পশ্চিম দিকে উল্টে আর আরেক হাত দক্ষিণ দিকে মেলে। পড়নের গেন্জিটাও গাঁয়ে নেই।তা বিছানার একপাশে ছিটকে পড়ে আছে।মাথার অবস্থা বললে ত আরো নাঁজেহাল অবস্থা।আর তারসাথে বিছানা,বালিশ,চাদরেরও সেইম অবস্থা। পৃথী এক নজরে সব স্কিন করে হাতে থাকা ট্রে টা এবার টেবিলের উপর রাখে।তারপর অয়নের দিকে এগিয়ে এসে। অয়নের কানের কাছে হাতদুটো এনে হাতে থাকা সবগুলো রেশমি চুড়ি একসাথে নাড়াতে থাকে!তন্দ্রা চোখে চুড়ির ক্ষীণ শব্দ কানে যেতেই অয়ন হালকা নড়ে উঠে।তা দেখে পৃথী হেসে ফেলে।তারপর আবার জোরে জোরে চুড়িগুলো নাড়াতে থাকে -টু টাং,টিং,টং
“প্লিজ পৃথী এরকম করো না। একটু ঘুমুতে দাও।”
“আর ঘুমতে হবে না!অনেক বেলা হয়েছে।এখন উঠুন।”
“বেলা হয়নি।”
“এখন দশটা বাঁজে!”
অয়নের আর কোনো হেলদোল নেই।কোমর অব্দি থাকা পাতলা চাদরটা মাথার দিকে টেনে এনে আবার ঘুমতে ব্যস্ত হয়ে যায়।তা দেখে,
“আপনি সত্যি ই উঠবেন না?এখন কিন্তু মুখে পানি ঢালতে বাধ্য হব!”
পৃথী কথাটা বলার সাথে সাথেই অয়ন চাদরটা একপাশে ছিটকে ফেলে উঠে বসে।হাত-পা ছড়িয়ে লম্বা একটা হাই তুলে।তারপর বলে,
“বউ?তোমার স্বামীকে মুখে পানি ঢালার কথা কেউ আজ-অব্দি সাহস করে বলতে পারে নি।তুমি বলে ফেললে।তোমার জন্যে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনেক ভালোবাসা।”
“এত ঢং ঢাং বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন ত!চা বানিয়ে এনেছি। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
“সত্যি তোমার নিজ হাতে চা বানালে?কোথায় চা?”
“আগে বাথরুমে যান!পরে দেখাচ্ছি। ”
“আচ্ছা যাচ্ছি!”
বলেই অয়ন বাধ্য ছেলের মতন বিছানা থেকে নেমে যায়।তারপর ড্রেস চ্যান্জ করতে কাবার্ডের দিকে এগুতে গেলেই পৃথী বাঁধা কন্ঠে বলে,
“ড্রেস নিতে হবে না।আমি একটা চুজ করে বাথরুমে রেখে দিয়ে এসেছি।ওটা পড়বেন।”
অয়ন এবার ক্ষীণ চোখে পৃথীর দিকে তাকায়।তাকানোর ভঙ্গিমা টা অপ্রস্তুত বোধ!মানে পৃথী তারজন্যে ড্রেস চুজ করে বাথরুমে রেখে আসবে এটা যেন তার বিশ্বাস ই হচ্ছে না।এই পিচ্চি একটা মেয়ে! ..আচ্ছা এটা কি দায়িত্ব বোধ থেকে করেছে?তবে দায়িত্বটা ত এখনো তার মাঝে যায় না।ভাবনার মাঝেই,
“কি হলো দাঁড়িয়ে কেন!তাড়াতাড়ি যান না?”
অয়ন নড়ে ওঠে।মাথা হেলিয়ে বাথরুমে এসে দরজা চাপায়।ভেতরে ঢুকেই আরেকটা চমক খায়।তা হলো অয়ন কাল রাতে যে ড্রেসটা ভিঁজিয়ে রেখেছিল তা এখন বালতিতে নেই।মনে হয় কেউ ধুঁয়ে ফেলেছে।কিন্তু ফুলমতি ত দুপুরে এসে সব জামাকাপড় ওয়াশ করে যায়।সে ত ধোয়ার কথা না।তাহলে এত সকালে কে ধুতে পারে!পৃথী নয়তো?
২৭.
ত্রিশ মিনিটের মধ্যে অয়নের গোসল শেষ হয়।বাইরে বেরিয়ে দেখে পৃথী পিরিচে খাবার সাজাচ্ছে!অয়ন সোফায় এসে বসে।
“পৃথী?বাথরুমে জামাকাপড় গুলো ভিঁজিয়ে রেখেছি।সেগুলো ফুলমতিই এসে ধুঁয়ে যাবে।তোমাকে ধুঁতে হবে না।আর তোমার গুলোও ধুঁবে না।ফুলমতি ধুঁবে সব।বুঝতে পেরেছ?”
“গোসল করতে এত দেরী হলো কেন আপনার?”
পৃথীর কথার প্রসঙ্গ পাল্টানো দেখে অয়ন এবারো আরেক দফা চমক খায়।তবে এবার আর আগের মতন চুপ থেকে নয়।সোঁজা সোফা থেকে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে পৃথীকে কান চেপে ধরে বলে,
“এই মেয়ে এত দায়িত্বশীল হয়েছ কবে থেকে,হু?নাক টিপলে এখনো গড়গড় করে দুধ বের হবে!”
“য়ু লাগছে। ছাড়ুন।”
“ছাড়বো না।আগে বলো এরকম যেন আর কখনো না দেখি!”
“ছাড়ুন না?”
“আগে কথা দাও এরকম আর কখনো করবে না?”
“আহা ছাড়ুন।ব্যথা পাচ্ছি।”
“ব্যথা পেয়ে মরে যাও।তারপরও ছাড়বো না।”
পৃথী ত আর সহে থাকার মেয়ে না।ধপ করে অয়নকে একটা ঠেলা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়।কানে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“একদিন আপনিই ত বললেন আমি বয়সে যথেষ্ট ম্যাচিউরত।কিন্তু স্বভাবে বাচ্চা!”
“এইজন্যে এত দায়িত্বশীল হতে শিখেছ?”
“নাহ!”
“তোমাকে দায়িত্বশীল হতে হবে না।তুমি আমার সেই বেইবি ই থাকো।তুমি আমাকে বকবা,অভিমান করে মারবা। আর আমি তোমাকে সেখানে বাচ্চাদের মতন আদর করবো আরল কত কি!”
“নির্লজ্জ!”
“এখন ত খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে। কি করবো বলো ত?নিজেকে কন্ট্রোল রাখতে পারতেছি না!”
বলেই অয়ন দুষ্টমির ছলে পৃথীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।দেখে পৃথী কি রিয়াকশন করে।কিন্তু পৃথী ত পৃথী বলে কথা।পৃথীর রিয়াকশন কি আর না হয়ে থাকে?
“এই নাহ নাহ।কাছে আসবেন না।আমি কিন্তু চিৎকার দিব।”
এমন সময় দরজা ঠেলে ফাহাদ ভেতরে ঢুকে।ঢুকেই বেচারী অপ্রস্তুত হয়ে যায়।কারণ পৃথী দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে।আর অয়ন পৃথীকে চেপে দাঁড়িয়ে।ইস কি লজ্জা!ফাহাদও যেমন পেয়েছে লজ্জা, তেমনি পৃথীও!অয়ন পায় নি।বন্ধু মানুষ একটু রসিকতা দেখতেই পারে।এতে আহামরি কি এমন দোষ হয়ে যাবে?ফাহাদ গলায় খাঁকারি টেনে বলে উঠে,
“মনে হয় অসময়ে চলে আসলাম।”
“আরেহ নাহ নাহ।কোনো অসময় না।এটাই সময়।তাই না পৃথী?”
পৃথী অয়নের দিকে খুব কড়া চোখে তাকায়।এভাবে কিছুক্ষণ থেকে তারপর অয়নের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ফাহাদের দিকে তাকায়।মুখে একটা সৌজন্যমূলক হাসি টেনে ফাহাদকে বলে,
“ভাইয়া,এখানে বসুন।আপনার জন্যে নাস্তা নিয়ে আসতেছি।”
“ভাবী একঘন্টা আগে আমি নাস্তা করে এসেছি।”
“কিছু হবে না।অন্তত এক কাপ চা খান।আর একঘন্টার ভেতর মানুষ দশ কাপ চাও শেষ করতে পারে।বুঝতে পেরেছেন?”
বলেই পৃথী চা আনতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
“তা বাসায় হঠাৎ সকাল সকাল কি কারণে আসলি,বল।”
“তোর ফোন যে কাল কাজী অফিসে আমাকে দিয়ে গেছিস তা খেয়াল আছে তোর?এই নে তোর ফোন!”
“উফস দোস্ত মনেই ছিল না!”
“সবে ত শুরু হলো।সামনে আরো কত কি ভুলবি।এমন সময় আসবে আমাকেও ভুলে যাবি। ”
“আরেহ নাহ তোকে কখনোই ভুলবো না।তুই ত আমার জানের জান।”
“রাখ তোর মিঠাই কথা।”
“হা হা হা হা হা হা।”
“তা রাতে বাসর কেমন হলো?”
“শালা এই গরম চা দেখছিস? একদম তোর মুখে ঢেলে দিমু!”
“হা হা হা হা হা হা…।মজাও বুঝিস না?”
এরইমাঝে পৃথী চা নিয়ে চলে আসে।ফাহাদের দিকে,
“ভাইয়া নিন।”
ফাহাদ চায়ের কাপ হাতে নেয়।
“থাংকস ভাবী।”
“ওয়েলকাম।”
“আর আপনিও আমাদের সাথে বসুন ভাবী।”
“নাহ নাহ আপনারা খান আমি পরে খাবো।”
“আরেহ বসো!”
“নাহ।”
“নাহ বললে হবে না পৃথী। বসো।”
তারপর আর কি দুটো মুখরের কথার সাথে পেরে উঠতে না পেরে পৃথী বাধ্য৷ মেয়ের মতন বসে পড়ে।সবার নাস্তা করার পর্ব শেষ হয়ে আসলে এমন সময় অয়নের ফোন বেঁজে উঠে।অয়ন চায়ের কাপটা নিচে নামিয়ে প্যাকেট থেকে ফোনটা হাতে তুলে।তাকিয়ে রহিমার কল।রহিমা কল করেছে তা ফাহাদ এবং পৃথীকে না বলে অয়ন কলটা সন্তপর্ণে রিসিভ করে,
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। ”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। বাবা?আমি ত আবার আরেকটা বিপদে পড়ে গেলাম।ফাহাদ তোমাকে কালকের ব্যাপারে কিছু বলেছে?”
“নাহ ত আন্টি।কি হয়েছে?”
“বাবা..? ”
“জ্বী,বলুন?”
“পৃথী কাল বিয়ে মুখ থেকে পালিয়ে গেছে!মেয়েটার কার সাথে পিরীত ছিল কে জানে।আমি ত এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না।আর মেয়েটা কি করলো.. শেষপর্যন্ত আমার সব মানসম্মান শেষ করে দিয়ে গেল!”
“আন্টি প্লিজ কাঁদবেন না।একদমই কাঁদবেন না।ও হয়তো দুইদিনের ভালোবাসার পেয়ে আগের সব ভুলে গেল! মার ভালোবাসা ভুলে গেল।কিন্তু এটা বুঝে নি পৃথিবীতে মার ভালোবাসা ছাড়া দ্বিতীয় আর কিছুই হতে পারে না।এ এটার প্রায়শ্চিত্ত নিশ্চয়ই একদিন পাবে!”
“বাবা বিশ্বাস কর কিনা জানি না আমি কাল রাতে একটু ছিটেকও ঘুমাতে পারি নি।তোমার বন্ধু না জানি আমাকে কতটা খারাপ ভেবেছে।তোমার বন্ধুর বাবাও এবং ওখানে যারা যারা ছিল সবাই।”
“কেউ খারাপ ভাবে নি আন্টি। আপনি খামোখা টেনশন নিয়েন না।”
“মেয়ে ভুল করলে প্রথমে সবাই মায়ের দিকে আঙ্গুল তুলে।যে মার শাসনের অভাবে মেয়ে ওরকম কাজটা করেছে।আসলে সত্যিই বাবা আমি মেয়েকে শাসন করতে পারি নি।আমি ব্যর্থ মা।ব্যর্থ নারী!”
“আন্টি প্লিজ আর মন খারাপ করবেন না।সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি পৃথীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।আর যে ছেলের সাথে পালিয়েছে তাকেও খুঁজে বের করবো।খুঁজে পেলেই একদম হাত-পা ভেঙ্গে গুড়িয়ে আপনার সামনে নিয়ে আসবো।”
“ধন্যবাদ,বাবা।অনেক ধন্যবাদ।এটাই চেয়েছিলাম।”
তারপর রহিমা শোকভরা ব্যথা নিয়ে ওপাশ থেকে ফোন রেখে দেয়।আর অয়ন তার ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখার পর পরই পৃথী টপ করে বলে উঠলো,
“মা কল করেছে,তাই না?”
“হু।”
“মা জানি আমাকে নিয়ে কতটা কষ্ট পেয়েছেন!কোন মুখ নিয়ে মার সামনে দাড়াবো!”
“তুমি ত হাত-পা সোঁজা রেখে দাঁড়াতে পারবে উনার সামনে আর আমাকে ত হাত-পা ভাঙ্গা অবস্থায় উনার সামনে দাঁড়াতে হবে।”
ফাহাদ খিলখিল করে হেসে উঠে।হাসতে হাসতে বলে,
“পুরাই জোশ একটা কথা বললি। কি অভিনয় টাই না এখন ভাবীর মার সাথে করলি।”
“এখন মাকে কিভাবে এই ব্যাপারটা বলবো?মা ত আমাকে খুব অভিশাপ দিচ্ছেন।আমি এই অভিশাপের গ্লানি টানতে পারবো না।”
“অপেক্ষা করো পৃথী।সব ঠিক করে দিব।জাস্ট সময়।ওকে?”
পৃথী আর প্রতিত্তর করলো না।চুপ করে রইলো।ফাহাদ এবার ব্যস্ত হয়ে ওঠে,
“দোস আমার চেম্বারে আবার যেতে হবে।এখন উঠি।”
“ওকে।তাহলে আবার আসিস সময় করে।”
“আচ্ছা।ভাবী আসলাম।”
“জ্বী ভাইয়া আবার আসবেন কিন্তু।”
“অবশ্যই আসবো।”
পৃথী নৈঃশব্দে মাথা নাড়ে।নৈঃশব্দতার মাঝে জড়িয়ে আছে একরাশ লজ্জা আর সংকোচ !আল্লাহর কি পরিহাস!সে কাল যার স্ত্রী হত সে আজ তার ভাবী।
চলবে…