#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_১৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
গ্রামের সরু পথ। রাস্তার দুদিকে ধানের ক্ষেত। বাংলা বৈশাখ মাসের ধান কাটা পর্ব চলছে। ক্ষেতের একপাশে ছয় থেকে সাতজন কৃষক ভাত খাচ্ছেন। কাজের ফাঁকে সামান্য বিশ্রাম আরকি! আভাদের গাড়ি ছুঁটে চলেছে অবিরত। আভার কানে হেডফোন। গান বাজছে,
“দেখেছি রুপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা। ”
বরাবরই বাংলা গানের প্রতি আভার দুর্বলতা বেশি। তবে আগে এমন ছিলো না। বছরখানেক আগেও হিন্দি গান মানেই ছিলো আভার জন্যে আস্ত এক ভালোলাগা। তবে বয়স বাড়ার সাথেসাথে অন্যান্য পছন্দের সাথেসাথে গানের পছন্দও বদলে গেলো।
হঠাৎ আভার ফোনে মেসেজ টোন বাজলো। আভা ফোনের স্ক্রিন অন করে চোখের সামনে ধরলো। আহনাফের মেসেজ। আভা ঠোঁটে হাসি টেনে মেসেজ দেখলো। আহনাফ লিখেছেন, ” কোথায় তুমি? ”
আজকে হঠাৎ-ই গ্রামের বাড়িতে আসার পরিকল্পনা হয়েছে। বাবার মন দাদুমনির অসুখ শুনেই কু ডাকা শুরু করেছে। তাই কালবিলম্ব না করে মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাগপত্র কাধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন নিজেদের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বরাবরই বাবার তাড়াহুড়োর কারণে নাকে মুখে ঘর তালা দিয়ে বের হয়েছে ওরা। আহনাফকে জানানোর সময় ছিলো না। তার ফলাফলস্বরপ এখনকার এই মেসেজ। আভা ছোট্ট করে মুঠোফোনের কিবোর্ড চাপলো,”গ্রামে যাচ্ছি। ”
ফিরতি বার্তা পাঠানোর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আহনাফের পক্ষ থেকে আরো একটা মেসেজ আসলো। লেখা, ” গ্রামে যাচ্ছো, ভালো কথা। তাহ, আমাকে জানিয়েছো গ্রামে যাওয়ার কথা? ”
আভার বিরক্ত লাগলো। গ্রামে যাচ্ছে, জানানোর সময় থাকলে তো জানাবে। আহনাফের এই ছোট্ট বার্তায় রাগ স্পষ্ট। এই ছেলের নাকের ডগায় রাগ ঝুলে থাকে। যখন তখন যার তার উপরে রাগ ঝাড়া উনার প্রতিদিনকার রুটিন। আভা ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে কিবোর্ড চাপলো,” গ্রামে যাচ্ছি, এটা বলার কি আছে? আসলে হুট করে প্ল্যান হয়েছে। বলার সময় পাইনি। ”
আভা বার্তা পাঠিয়ে হেডফোনের আওয়াজ বাড়িয়ে দিলো। পূর্বে গানের আওয়াজ অর্ধেকে ছিলো। এখন সর্বোচ্চ আওয়াজে গান বাজছে। আবারো “টুং” করে শব্দ হলো হেডফোনে। আভা মেসেজ পড়লো,” আমি প্রায় এক ঘন্টা ধরে তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভেবেছিলাম বারান্দা দিয়ে একঝলক দেখে নিবো তোমায়। কতদিন তোমাকে দেখিনি তার খবর রাখো? না, তা রাখবে কেনো? তোমার খবর তো থাকে কোনসময় কোন লোকে আমাদের দেখে ফেললো, কোন পিলার আমাদের দেখে হাসলো, কোন বিলবোর্ড আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এসব।রিডিকিউলাস।”
পুরো মেসেজ পড়ে আভার এই মুহুর্তে দু রকম অনুভুতি হচ্ছে। প্রথমত, আহনাফের এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা। মানুষটা সারাদিন হসপিটাল করে বিকেলে তার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। নিশ্চয়ই পা ব্যাথা করছে।মানুষটা বড্ড উন্মাদ। আভা সেসব ভেবেই হেসে ফেললো। আভার হঠাৎ হেসে উঠার শব্দে আভার বাবা সামনের সিট থেকে পিছন ফিরে তাকালেন। ভ্রু জোড়া কুঁচকে আভার দিকে তাকালেন উনি। আভা এতে খানিক বিব্রত অনুভব করে চটপট মুখখানা মলিন করে ফেললো। দাদুমনি অসুস্থ বিধায় কারো মন মেজাজ এখন ভালো নেই। তাই এই মুহূর্তে হাসাটা হলো চূড়ান্ত অন্যায়। আভাকে নীরব থাকতে দেখে আভার বাবা পুনরায় সামনে মুখ ঘুরালেন।
বাবা মুখ ফিরাতেই আভা কোলের উপর থেকে ফোন হাতে নিলো। আহনাফের উদ্দেশ্যে পাল্টা মেসেজ করলো, “কতদিন মানে কি?আমাদের পরশু দেখা হয়েছে। ”
সঙ্গেসঙ্গে আহনাফ মেসেজ করলো, ” বাহ্! সেটার খবরও রাখো দেখছি। তোমার দিল এত পাষাণ কেনো? হ্যাঁ? পরশু দেখা হয়েছে, সেটা তোমার কাছে বড় কিছু হয়ে গেছে। এদিকে আমি প্রতিনিয়ত তোমাকে দেখার জন্যে ছটফট করছি,সেটা চোখে পড়ে না? হাও রুড!”
আভা মেসেজ দেখে দুমিনিট থম ধরে বসে রইলো। আসলে যখনই আহনাফ এমন আবেগপূর্ণ কোনো কথা বলে আভা তার উত্তরে কি বলবে খুঁজে পায়না। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সমস্ত কথা কণ্ঠনালীতে এসে আটকে গেছে। কন্ঠনালী ভেদ করে বেরুনোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। আভা যখন হরেক বাক্য সাজাতে ব্যস্ত তখন আহনাফ মেসেজ করলো, ” এই বউফ্রেন্ড, চলে এসো না আমার সম্রাজ্যে। চিরদিনের জন্যে। কথা দিচ্ছি,আমার রাজ্যে রানী করে রাখবো তোমায়। এই দূরত্ব আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আমার উপর দয়া করো এবার। তোমার নামের রোদ্দুরে পুড়ে খা খা হয়ে যাচ্ছি আমি। এবার তোমার হাতের একটু শীতল পরশ দরকার। খুব বেশিই দরকার, বউফ্রেন্ড। ”
আভার প্রাণটা ধক করে উঠলো। হঠাৎ করেই তার গলা শুকিয়ে এলো। তবে তৃষ্ণাটা যে পানির না সেটা স্পষ্ট। তবে কিসের তৃষ্ণা? অনুভূতির? আভা কাপা হাতে কিবোর্ড লিখলো, ” সময় আসলে এমনিই আপনার কাছে চলে আসবো। ততদিন নাহয় রোদ্দুরে পুড়তে থাকুন। ইদানিং খুব বেশি ফর্সা হয়ে যাচ্ছেন। কালো হওয়াটা দরকার। তাই আমার রোদে পুড়েই নাহয় কালো হয়ে যান। গ্রেট আইডিয়া, তাইনা?”
আভার ঠোঁটে হাসি। হাসিটা যেনো ঠোঁট থেকে সরছেই না। আচ্ছা, এই হাসির কারণটা তবে কে? আহনাফ?
মেসেজের টোনে আভার ধ্যান ভাঙলো। পড়লো সে বার্তাটা,
” দিস ইজ নট ফেয়ার, বউফ্রেন্ড। শাস্তি দিচ্ছ ? আমার শাস্তির ধরনটা সামনে এলে সামলাতে পারবে তো? ”
আভা নীরব হেসে সিটে গা হেলালো। চোখদুটো বুজে নিতেই দুচোখে ভর করলো রাজ্যের ঘুম। এই মুহূর্তে ঘুমটা খুব দরকার আভার জন্যে। কিছু তপ্ত অজানা অনুভূতি নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলার জন্যে ঘুমটা প্রয়োজন। অতঃপর আভা ঘুমিয়ে পড়লো।
______________________
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামতেই বাড়িতে হইচই শুরু হয়ে গেছে। আভাদের বাড়িয়ে আসার খবর শুনে দাদুমনি খুব অদ্ভুত ভাবেই অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছেন। হয়তো সুস্থ থাকার ভান করছেন। ছেলে উনার প্রচুর রেগে আছে। আজ হয়তো উনাকে বগলদাবা করে শহরে নিয়েই ছাড়বে। কিন্তু দাদুমনি সেটা চাইছেন না। তাই লেংড়া পা নিয়েই হেঁটে বেড়াচ্ছেন ঘরময়।
আভাদের খাতির যত্ন করতে কয়েকজন চাচী মিলে রাতের খাবার তৈরি করছেন। রান্নার ঘর থেকে মাটির চুলোর জ্বলন্ত ধোয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। আগুনের গন্ধ মুখ পেরিয়ে নাকে যেতেই বুকের ভিতরটা চঞ্চল হয়ে আসছে। চারদিক কেমন যেনো গ্রাম গ্রাম গন্ধ আসছে। গরুর গোবরের গন্ধ, শেয়ালের হাকডাক, গ্রামের হইচই সব মিলিয়ে হলুস্থুল কাণ্ড। আভা উঠানে দাঁড়িয়ে সমবয়সী মেয়ের সাথে গল্প করছেন। মাথার উপর সরু চাঁদ সসম্মানে আকাশের ঠিক মধ্যেখানটায় বসে আছে। চাঁদের চারপাশে লুটোপুটি খাচ্ছে শত তারা। আভা হাঁটতে হাঁটতে চাচাতো বোনদের সাথে কথা বলছে। চাচাতো বোনদের মধ্যে অন্যতম হলো, সাথী। যাকে আভা খোঁচা দিয়ে পদ্মা সেতু বলে ডাকে। সাথীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মিম, বর্ষা, বৃষ্টি আর তাহমিদা।
আচমকা সাথী বলে বসলো,
— ” এই আবা, তোর হবু বরের ফটো আছে? দেখা না। আমিও দেখি কত বদসুরত দেখতে। ”
আভা সাথীর মাথায় ঠাস করে এক চাটা মারলো। এতে সাথী ন্যাকামি করে মাথায় হাত ঘষে আভার দিকে তাকালো। আভা বললো,
— ” আমার নাম আভা। আবা না। একবার অন্তত আমার নামটা ঠিকমত উচ্চারণ কর। আমার এত সুন্দর নামের বারোটা বাজাই দিলি। ”
সাথী নাক মুখ কুঁচকে বললো,
— ” তোর শুদ্ধ ভাষা তোর কাছেই রাখ। আবা বললেই কি আর আভা বললেই বা কি। নাম ধরে ত ডাকছি। খচ্চর তো বলি নাই, শুকরিয়া আদায় কর। এবার তোর জামাইর পিক দেখা। ওতো লুকাইয়া লাভ নেই। আমরা তোর জামাইরে খেয়ে ফেলবো না। দেখা এখন। ”
আভা সাথীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। তবে এতে সাথীর মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেলো না। বড়ই অদ্ভুত! আভা ফুস করে এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— ” আমার কাছে তার কোনো পিক নেই। পারলে মোবাইল চেক করতে পারিস। ”
#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_১৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
আভা আর তার সঙ্গপাঙ্গ পুকুরপাড়ে এসে থামলো। বাড়ির পুকুরের পানি এই মুহুর্তে অনেকখানি স্বচ্ছ। কদিন আগেই পানি পরিষ্কার করা হয়েছে। পুকুরপাড়ের পাশ ঘিরে আছে লম্বা সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা দুটো বেঞ্চ। আভা আর বাকিসব একে একে বসে পড়লো বেঞ্চটায়।
সাথীর হাতে আভার ফোন। ইতিমধ্যে সেই ফোনের নাড়িভুঁড়ি সব বের করে ফেলেছে ও। তবুও একটা ছবিও পায়নি সাথী। সাথীকে ব্যর্থ হতে দেখে বাকি সবাই একে একে ফোন চেক করলো। তবে সবাই নিরাশ হলো। তাহমিদা আভার উদ্দেশ্যে বললো,
— ” আভাপু, দুলাভাইর একটাও ছবি নাই? এ কেমন কথা?”
তাহমিদার কণ্ঠে আশ্চর্যভাবের ছোঁয়া। তার আভাপু এতটা অকর্মা সেটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। আজকাল কোন মেয়ে নিজের হবু বরের ছবি মোবাইলে রাখে না? আভা নিজের ফোনটা বর্ষার হাত থেকে ছুঁ মেরে নিয়ে ফেললো। বেঞ্চে আরামকরে বসে রয়ে সয়ে বললো,
— ” ছবি তোলার সুযোগ থাকলে তো তুলবো। মহাশয়ের সাথে যখনই দেখা হয় সবসময় এমনভাবে আমার দিকে নজর রাখে, ফোন বের করে ছবি তোলা তখন জাস্ট ইম্পসিবল। যখন উনি কারো সাথে কথা বলেন তখনও কেমনে কেমনে যেনো আমি কিছু করলেই বুঝে ফেলে। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় উনার চোখ চার, পাঁচটা। একই সময়ে এত কিছু কেমনে লক্ষ্য করেন। স্ট্রেঞ্জ! ”
সবাই আভার দিকে হাঁ করে তাঁকিয়ে আছে। আভা এদের তাকানো দেখে ভ্রু কুঁচকিয়ে তাদের দিকে তাকালে বর্ষা বলে উঠে,
— ” আভা, এসব শুনে তোর বরকে এখন আরো বেশি দেখতে মন চাইছে। কেমন রে দেখতে?”
আভা হেসে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাত নেমেছে। রাতের বেলা চুল দেখাতে নেই। দাদুমনির কড়া নির্দেশ। তাই আভা ওড়নার অগ্রাংশ দিয়ে মাথা ঢেকে ফেললো। বলা যায়না কখন কোন ভূতে আছর করে। আভা ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
— ” অন্য একদিন দেখাবো নে। এখন চল। ভাত খাবো। মা ডাকছেন। ”
আভার পাশাপশি এসে দাঁড়ালো আরো চার মুখ। আভা ওদের সাথে হেসে হেসে ঘরের দিকে এগুলো। গ্রামের বাড়িতে আসলে ওদের সাথে কথা বললেই যেনো মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। শহরের এতদিনের গুমড়ে ভাব কমে আসে ক্ষণিকের মধ্যেই। সর্বোপরি ভালো লাগে। প্রচন্ড ভালো লাগে।
____________________
সকাল হয়ে এসেছে। জানালার ফাঁক থেকে এক টুকরো আলো এসে লুঁটোপুঁটি খাচ্ছে আভার সম্পূর্ণ মুখ জুড়ে। আভা আলো-আঁধারের এই খেলায় বিরক্ত হয়ে কোলবালিশ দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। গতকাল অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে ওরা। সারারাত জেগে সমবয়সীদের সাথে গল্পগুজব করায় আলাদা এক শান্তি আছে।
বেশ খানিক পরে আভার ঘুমের মধ্যেই খেয়াল করলো,তার চোঁখে আর আলো গড়াচ্ছে না। আর আভা এতে অবাক হলো। চোঁখ জোড়া কুঁচকে নিয়ে পাশ ফিরলো। তবে ঘুম ভাঙলো না। হঠাৎ আভার কানে একটা নরম পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে আসলো, ‘ বউফ্রেন্ড! ‘
আভা ঘুমের মধ্যেই চমকে উঠলো। আদুরে এই শব্দটা কর্ণগহ্বরে প্রবেশ করতেই মুখখানা ঘুমের মধ্যেই হেঁসে উঠলো ওর। আবারো সেই মিষ্টি স্বপ্ন। ইশ! আজ যেনো ঘুমটা আর না ভাঙ্গে। আভা এই স্বপ্ন দেখতে চায়। মন প্রাণ উজাড় করে দেখা স্বপ্নের মাঝে হারিয়ে যেতে চায়।
এখন কটা বাজে আভার জানা নেই। তবে এই মুহুর্তে ঘড়ি দেখাটা দরকার। তাই ভাবানুসারে, চোঁখ মেলে সামনে তাঁকালো আভা। দশটা পাঁচ। আভা ঘড়ি দেখেই চোঁখ কচলালো। দুই হাঁত উপরে তুলে শরীরকে মুঁচড়ে নিলো। আড়মোড়া ভাঙতেই পাশের ঘর থেকে শব্দ এলো,দাদুমনির। তবে দাদুমনির শব্দের সাথে সাথে আরো একটা ভরাট কণ্ঠস্বর কানে এলো আভার। কণ্ঠটা তার চেনা। আহনাফ! আভা ধড়ফড়িয়ে বসে গেলো। আহনাফ আসলেন কোথা থেকে? আভা জলদি ওড়না গায়ে দিয়ে পাশের রুমের দিকটায় হাঁটা ধরলো। তার সন্দেহ সঠিক হয় কি করে?
আভা পাশের রুমের দরজার আড়াল থেকে চোখ বুলালো। দাদুমনির পাশে হাস্যরত আহনাফকে দেখেই আভার চোঁখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। এ কি করে সম্ভব? আভা দুহাত দিয়ে চোঁখ পরিষ্কার করলো। তারপর আবারও সামনে তাঁকালো। না,আহনাফ-ই।
হঠাৎ আহনাফের চোঁখ পড়লো দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা লাল কামিজ পরিহিত আভার দিকে। সহসা আহনাফ আভার দিকে তাঁকিয়ে তার ডান চোঁখটা টিপে দিলো। ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে আভার দিকে তাঁকালো। এতে আভা চমকে তাড়াহুড়ো করে সরে যায় আড়াল থেকে। কি অসভ্য ছেলে! দেখেই ইভটিজিং করতে শুরু করে দিয়েছেন!
আহনাফ আভার ওমন লুকিয়ে পড়তে দেখে মুঁচকি হেসে আবারও দাদুমনির সাথে গল্প করতে লেগে পড়ে।
আভা গটগট পায়ে রান্নার ঘরের দিকে ছুঁটে। আহনাফের হঠাৎ আসার কারণ মা-ই ভালো বলতে পারবেন।
আভার মা রান্নাঘরে চুলোর কাছে বসে আছেন। চুলোয় পরোটা করা হচ্ছে। হয়তো আহনাফের জন্যে। আভা মায়ের পাশে এসে বসে পড়ে। আভার মা আভাকে দেখে বলে উঠলেন,
— ” আহনাফকে হাঁত ধুতে বল। নাস্তা রেডি হয়ে গেছে। আর শোন, বেসিন দেখিয়ে দিস ওকে। প্রথম এসেছে তো। কিছু চিনবে না। ”
আভা মায়ের আদেশ একপাশে ফেলে রেখে বললো,
— ” উনি কখন এলেন? রাতেও তো কিছু বলো নি আমাকে। আজ সকালে ধুম করে এসে হাজির। উনার আসার খবর তুমি জানতে? ”
আভার মা চুলোয় একটা লাকড়ি ঢুকিয়ে চুলোয় ফুঁ দিলেন। সঙ্গেসঙ্গে চুলোর আগুন দ্বিগুণ বেগে গর্জে উঠলো। বিষয়টা ভারী সুন্দর দেখালো তখন! আভার মা এবার বললেন,
— ” আহনাফের আসার খবর তোর বাবা তো জানতো। সেই তো রাজি করিয়েছে ওকে। তোর বাবার কথায় আর মানা করতে পারেনি। তাই সব কাজ একদিনের জন্যে ফেলে রেখে চলে এসেছে। কালকে ভোর সকালে চলে যাবে আবার। ”
আভা গালে হাঁত দিয়ে বসে রইলো মায়ের পাশে। আজ সকালে আহনাফ এসেছেন তার মানে প্রায় সারারাত ড্রাইভ করতে হয়েছে তাকে। আবার কাল ভোরে চলে যাবেন। তার মানে আবার কালকে লম্বা জার্নি। ওরে বাবারে! শুনেই তো আভার ভয় লাগছে। জার্নি ব্যাপারটা আভার ভালো লাগলেও টানা দুদিন লম্বা জার্নি করা আভার পক্ষে মোটেও সম্ভব না। প্রাণ বেরিয়ে যাবে মনে হয়। আর সেখানে? আহনাফ দুদিন টানা এতবড় জার্নি করবেন। বাপরে! এত ধৈর্য্য!
এসব আকাশ-কুসুম ভাবনার মাঝে আভার মা পুনরায় তাড়া দিলেন আভাকে। তাই আভা না চাইতেও তার ভাবনার সমাপ্তি টেনে এগিয়ে গেলো দাদুমনির ঘরের উদ্দেশ্যে।
দরজা খুলে গুটিগুটি পায়ে দাদুমনির সামনে এসে দাঁড়ালো ও। আভাকে দেখে দাদুমনি আর আহমাফ দুজনেই আভার দিকে চোঁখ তুলে তাকালেন।
আভা আহনাফের দিকে তাঁকিয়ে একদমে বলে ফেললো,
— ” নাস্তা রেডি। মা আপনাকে হাঁত ধুতে বলেছেন। ”
আহনাফ দাদুমনির দিকে একনজর তাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। গায়ে জড়িয়ে থাকা ধূসর রঙের টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করে আভার আগেই হাঁটা ধরলো। আভা আহনাফের পিছন পিছন আসতে লাগলো।
আভাদের বেসিন খাবার রুম সংলগ্ন। আভা আহনাফকে বেসিন দেখিয়ে দিলো। আহনাফ বেসিনে ভালো করে হাঁত ধুয়ে চট করে আভার লাল ওড়নায় ভেজা হাঁত মুছে ফেললো। আভা এতে খানিক চমকে উঠে চটজলদি ওড়না আহনাফের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। তবে আহনাফ ছেঁড়ে দিলো না। ধীরে সুস্থে নিজের কাজ শেষ করে তবেই ওড়না ছাড়লো।
আভা আহনাফকে থাকার জন্যে একটা রুম দেখিয়ে দিলো। আহনাফের সবকিছু গুছিয়ে রুম থেকে চলে যেতে উদ্যত হলে আহনাফ হঠাৎ আভার হাঁত খপ করে ধরে ফেলে। আভা এতে খানিক ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে,
— ” কি হলো?”
আহনাফ আভার হাঁত নিজের হাঁতের মুঠোয় পুড়ে আভার পাশে এসে দাঁড়ালো।আহনাফের ওমন কাছাকছি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আভার বুকের ভিতর চিরচেনা সেই ঢেউ খেলে গেলো। আহনাফের গায়ের কড়া পারফিউমের গন্ধ নাকে আসতেই এক ভয়ঙ্কর মাতাল রোগে গ্রাস করতে লাগলো আভার সম্পূর্ণ মন। আহনাফ আভার ওমন কাঁপাকাঁপি দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো। খুব আলতো হাতে আভার শরীরে দুপাশে ঝুঁলে থাকা লাল টকটকে ওড়নার একাংশ আভার মাথায় উঠিয়ে দিলো। সঙ্গেসঙ্গে ওড়নার লাল রঙে ঢেকে গেলো আভার সম্পূর্ণ মাথা। আহনাফ এবার আভার দিকে তাঁকিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,
— ” পারফেক্ট। এখন একদম ‘আমার বউ, আমার বউ’ লাগছে। ”
‘ আমার বউ’ শব্দটা কানে আসতেই এভাবে শিরদাঁড়া দিয়ে এক উত্তাল-পাত্থাল স্রোত বয়ে গেলো। কানের দুপাশের অংশ ঠান্ডায় হিম শীতল হয়ে গেলো। সম্পূর্ণ মুখে ছড়িয়ে গেলো এক মুঠো লাল আবির। লজ্জারা ঘিরে ধরলো তার সমস্ত ইন্দ্রিয়।
#চলবে