#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
ভাড়া বাসা দেখে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ৮ টা বেজে গেছে । জুঁইয়ের অন্য কোন চিন্তা নেই তার একটাই চিন্তা আর তা হচ্ছে ইফসি । এতটাইম সে তার মেয়েকে ছাড়া থাকে নি । রাজশাহীতে থাকা কালীন অবস্থায় জুঁই অফিসে ইফসিকে নিয়ে যেতো । জুঁইয়ের জীবনটাই সংগ্রামের জীবন । তার ছোট্ট মেয়েটা আজ কেঁদেছে হয়তো । এত টাইম মাকে ছেড়ে সেও কখনো থাকে নি । তার উপর আজকে আবার নতুন অফিস বলে মোবাইল ধরারও সুযোগ পায় নি সে । বাসার দরজার কাছে এসে কলিংবেল দেয় জুঁই । ফয়জুন্নেসা বেগম দরজা খুলে দেয় । মেয়েকে খুব ক্লান্ত লাগছিল তবুও মেয়ে তার সামনে মলিন হাসি দিয়ে সালাম দেয় । জুঁইয়ের বরাবরের অভ্যাস , বাসার বাহিরে যাওয়ার আগে একবার সালাম এবং বাসায় ফিরে দরজায় একবার সালাম দিবে ।
– আসসালামু আলাইকুম ,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম , আসলি তবে ?
– হু , ইফসি কই মা ?
– তোর ভাবীর কাছে ।
– বিরক্ত করেছে আজকে তাই না ?
– দুপুরের দিকে একটু কান্না করছিল পরে তোর ভাবী কোলে নিছে পরে চুপ হয়েছে ।
– ওহ , মা ব্যাগ টা রাখো । আমি ইফসির কাছে যাই ।
মায়ের কাছে ব্যাগ দিয়ে জুঁই তার ভাবীর রুমে পা বাড়ায় । রুমে ঢুকতে একটু সংকোচ করছিল তবুও মেয়েকে দেখবে বলে পা বাড়িয়ে রুমে প্রবেশ করে জুঁই ।
ভেতরে গিয়ে দেখে ইফসিকে নিজের পেটের উপর বসিয়ে খেলা করছিল জুঁইয়ের ভাবী ফারজানা । তার পাশেই জুঁইয়ের ৫ বছরের ভাইয়ের ছেলে যাওয়াদও ইফসির গালে ধরে আদর করছে । জুঁই তখন পেছন থেকে ইফসি বলে ডাক দেয় । মায়ের গলার স্বর শুনে ছোট্ট ইফসি পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় । ইফসিকে দেখে জুঁইয়ের দুচোখ জুড়িয়ে গেছে । ইফসির একবছর পর জুঁই আর ইফসিকে বেল্লু মাথা করে নি চুল বড় করে রেখেছে । সেই চুলের দুপাশে দুটো ঝুটি বাঁধা , চোখে হাল্কা করে কাজল দেয়া । ইফসি দেখতে অবিকল জুঁইয়ের মত । দুধে আলতা তার গায়ের রঙ ঠিক যেন তার মা জুঁই । ইফসিকে দেখলে যে কেউই আদর করবে । মাকে দেখে মামীর কোলে থেকেই দু’হাত বাড়িয়ে আধো আধো বুলিতে ” আম্মুন ” বলে হেসে দেয় । জুঁইকে দেখে ফারজানাও উঠে বসে বলতে শুরু করে ,
– ইফসি সোনার আম্মুন চলে আসছে ,
তা দেখে যাওয়াদও উঠে বসে বলতে শুরু করে ,
– বনুর মা আসছে , আমার ফুপিমা আসছে আসছে ।
যাওয়াদ মাশা-আল্লাহ অনেক লক্ষী একটা ছেলে । জুঁইয়ের যখন বিয়ে হয় যাওয়াদ তখন দুই বছরের । ফুপিমা ছাড়া সে কিচ্ছু বুঝতো না । আর জুঁইও যাওয়াদকে আগলে রাখতো । যাওয়াদ ইফসিকে বনু বলে ডাকে । খাটের কাছে এসে আগে যাওয়াদকে কোলে নেয় জুঁই ।
– আব্বাজান , আপনি কেমন আছেন ?
– আলহামদুলিল্লাহ ফুপিমা , বনু কান্না করছে । আম্মু চুপ করাইছে ।
– তাই ? বনু পঁচা , কেমন ?
– এহহহ আমার বনু ভালো ।
যাওয়াদকে চুমু দিয়ে খাটে রেখে নিজের মেয়েকে কোলে নেয় জুঁই । ফারজানাকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
– আজকে খুব জ্বালাইছে , তাই না ?
– নাহ তেমন না । একটু কান্না করছিল , পরে ঠিক হয়ে গেছে ।
– খেয়েছে আজকে ?
– হ্যাঁ , আমি ভাত খাইয়ে দিলাম ।
– ওহ ,
– ও-কে আমার কাছেই দেও । মামুনির কাছে থাকবে ইফসি । আম্মুন ফ্রেশ হবে এখন ।
মামীর কথায় মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ইফসি । তার ভেতরের মনোভাব হচ্ছে , সে মাকে ছাড়বে না । পরে ফারজানা খাট থেকে নেমে ইফসিকে কোলে নিয়ে নেয় ।
– তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে । যাও ফ্রেশ হয়ে নেও , ততক্ষনে ইফসি না হয় আমার কাছেই থাকুক ।
– আচ্ছা , আম্মুন মামুনিকে জ্বালিও না কেমন ? আম্মুন ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো ।
এই বলে জুঁই রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে যায় । শরীরটা বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগছে তার । অফিস শেষ করে পাক্কা দুই ঘন্টা যাবত অফিসের আশেপাশে বাসা খুঁজেছে জুঁই । অবশেষে একটা দুই রুমের ছোট বাসা পছন্দ হয়েছে তার । ছোট দুইটা রুম আর তার সাথে একটা টয়লেট আর একটা রান্নাঘর । ওদের মা মেয়ের দিন কেটে যাবে । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির পিন খুলতে খুলতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় জুঁই ।
এমন সময় ফরজুন্নেসা বেগম মেয়ের কাছে আসে । মেয়ের সাথে কিছু কথা আছে ওনার ।
– জুঁই,,,,,,,,,,,,,,?
– হেএ মা , কিছু বলবা ?
– আসা যাবত দেখছি কি জানি একটা ভেবে যাস তুই ।
– আল্লাহ পাক আমায় ভাবনার নসীব দিয়েছে মা , না ভেবে উপায় কি বলো ?
– সব কিছুকে ভাগ্য ভেবে ভুলে যা মা ।
– হাসালে মা , আমি কি সব ধরে রেখে দিয়েছি নাকি ।
– চাপা ব্যাথা রেখে দিয়েছিস তো ?
– এইসব কিছুই না মা ।
– ফ্রেশ হয়ে খেতে আয় ।
এই বলে ফয়জুন্নেসা বেগম পিছন ফিরে চলে যেতে নিলে জুঁইয়ের ডাকে আবারও মেয়ের দিকে ফিরে তাকান তিনি ।
– কিছু বলবি ?
– বাসা দেখে এসেছিলাম । পছন্দ হয়েছে আমার , আমার আর ইফসির জন্যে ঠিকাছে । এডভান্স করে আসছি , এই মাসেই উঠে যাবো ।
– সব ঠিক করে এলি তাহলে ?
– হ্যাঁ মা , এখানে থাকলে সম্পর্কগুলো তিক্ততায় পরিণত হবে । তাছাড়া যাওয়াদ বড় হচ্ছে ওর পড়াশোনাও শুরু হবে । বাড়তি ঝামেলা হয়ে যাবে ।
– আমি জানি ফারজানার কথায় তুই হয়তো কষ্ট পেয়েছিস ।
– নাহ তেমন কিছু না । ভাবী তো খারাপ কিছু বলে নি , শুধু খারাপ লাগলো আমায় বলতে পারতো ।
– আমি দেখি রাসেলের সাথে কথা বলবো
– নাহ মা , একদম না । মা দিন শেষে তোমাকে ওদের সাথেই থাকতে হবে । দয়া করে বাড়তি ঝামেলায় যেও না । তুমি বরং আমার কাছে গিয়ে কয়েক দিন থাকবে । আর মা ভাবীও পরের মেয়ে । সংসার করতে আসছে এখানে , অবিবাহিত ননদ থাকা এক আর বিবাহিত ননদ সাথে বাচ্চা নিয়ে থাকা আরেক । বাদ দাও , অশান্তি চাই না আমি ।
– আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে নে ।
– হু
রাতে ইফসিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজের রুমে শুইয়ে দেয় জুঁই । তারপর নিজে খেতে যায় । সেখানে তার বড় ভাই রাসেল ভাবী ফারজানা এবং মা ফরজুন্নেসা বেগম উপস্থিত ছিলেন । নিজের ভাইয়ের দিকে চোখ যায় জুঁইয়ের । জুঁইয়ের কাছে আজকাল আপন ভাইকে পরের মত লাগে । তার মনে হয়তো সংকা কাজ করছে দুর্মূল্যের বাজারে নিজেদের সংসারও ঠিক মত চালাতে বিপদে পড়তে হয় তার উপর তার বোন ভাগনি এসে জুটেছে । সব মিলিয়ে যে তার ভাইয়ের চিন্তাচেতনা তা বুঝতে বাকি নেই জুঁইয়ের । খাবার টেবিলে অনেকটাই নিরবতা । আগে খাবার টেবিলেই ওরা ৩ জন অনেক মজা করতো । এখন সব আনন্দ মিশে গেছে মাটিতে । চুপ করে থাকলে কথা রয়ে যাবে । সময় চলে গেলে সেই কথার দাম থাকে না । তাই নিরবতা ভেঙে জুঁই নিজেই তার ভাইকে বলে । কারণ জীবন যখন মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিয়েছে তখন বাকি রাস্তা তাকে একাই চলতে হবে
।
– বুঝলা ভাইয়া , অফিস থেকে আসার সময় একটা বাসা দেখে এলাম । আমার বেশ ভালো লাগলো । ভাবলাম এই মাসেই উঠে যাবো ।
জুঁইয়ের কথা শুনে একদম চুপচাপ হয়ে যায় তার ভাই ভাবী । তারাও ভাবে নি যে জুঁই একদিনে এতটা করে ফেলবে । তখন ফারজানা মানে জুঁইয়ের ভাবী বলে ,
– এত তাড়াতাড়ি এত সব করে নিয়েছো ?
– হ্যাঁ ভাবী , করতে যখন হবে তাহলে দেরি করে লাভ কি ?
– এখানেই থেকে যাইতা ।
ফারজানা যে মুখের কথাটুকু বলেছে এতেই জুঁই অনেক খুশি । মলিন মুখে হালকা হাসি দিয়ে জুঁই তার ভাবী ফারজানার দিকে তাকায় ।
– এখানে থেকে যেতে বলার আগে গতকালের কথা গুলো ভাবা উচিত নয় কি ভাবী ?
এইবার জুঁইয়ের কথায় ফারজানা একদম চুপ হয় যায় । রাসেলের মুখেও কথা নেই , রাসেল যেন বোবা হয়ে গেছে । মাঝে মাঝে রাসেলের এই বোবা হয়ে থাকাটাই ফয়জুন্নেসা বেগমকে সব থেকে বেশি কষ্ট দেয় । নিজের ছেলে যদি এইভাবে চুপ করে থাকে কোন মায়ের ভালো লাগে ।
– এখানে থাকলে সম্পর্কগুলো খারাপ হবে । এর থেকে ভালো আলাদা হয়ে যাই । মাঝে মাঝে তোমরা যাবে আমার বাসায় । আমি আসবো তোমাদের বাসায় । কি করবো বলো , এখন পরিস্থিতিটাই এমন । সব কিছু না চাইতেও করা লাগবে ।
– ইফসিকে সামলাতে পারবে ?
– এটা কি বলো ভাবী ? ৮ মাস বয়স থেকে এখন দেড় বছর তার । আমিই তো সামলে নিলাম । আমার হয়ে একটা মানুষতো দেখলাম না যে আমার বাচ্চাটাকে সামলেছে । ৮ মাস বয়স অবদিও আমিই দেখেছি । দাদা দাদী থেকেও ছিল না থাকার মত ।
– হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক ।
– সেই হিসাব করতে গেলে তুমি খুব ভাগ্যবতী , জাওয়াদ তার দাদুন এবং ফুপিমা দুজনেরই আদর ভালোবাসা পেয়েছে আর আমার ইফসি সব থাকতেও অনাথ ।
তখন রাসেল মুখ খুলে ,
– কেন তোর কি অজানা নাকি সব কিছু , তুই জানতিস না তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেমন ছিল ।
– এখন তো তাহলে বলতে হয় , বিয়েটাও তো তোমরাই দিয়েছিলে তাই না ভাইয়া ?
যাই হোক , আমার খাওয়া হয়ে গেছে আমি উঠি ।
এই বলে জুঁই উঠে যায় । রাসেলের মুখ জুঁইয়ের এক কথাতেই বন্ধ হয়ে যায় ।
রাতের মধ্যভাগ ,
আজকে চুলের মুঠি ধরে মেরেছে জুঁইকে তার স্বামী । জুঁই বার বার আকুতি মিনুতি করেও ছাড়া পাচ্ছে না । জুঁইয়ের মাথা ব্যাথা করে তাই তার মাথায় আঘাত করা যায় না । কিন্ত তিনি তা বুঝে না । জুঁইয়ের আজকের অপরাধ , সে আজকে রাতে জুঁইকে কাছে পেতে চেয়েছে কিন্তু জুঁই অসুস্থ । সিজারিয়ানের পর মাঝে মাঝে সেলাইয়ের জায়গায় টান লাগে জুঁইয়ের । যা জন্যে এই মুহূর্তে সঙ্গম তার পক্ষে সম্ভব নয় । সে বুঝবে কি সে তো বুঝার চেষ্টাও করে নি । লাষ্টবার যখন জুঁই না করে দিল তখনই সে জুঁইকে মারে । তার মা’র বলতে হাত মুচড়ে ধরা , চুলের মুঠি ধরা , গালে চড় দেয়া ইত্যাদি । তবে নরপিশাচের মত মারে না । চুলের ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে জুঁই তার স্বামীকে বলতে থাকে ,
– ফারুক লাগছে আমার , ছাড়ো আমায় , আমি ব্যাথা পাচ্ছি । ফারুক আমার শরীর ভালো না , ছাড়ো আমায় ।
জুঁই জোরে কথা বলতে পারে না কারণ ইফসি তখন ছয় মাসের । ঘুমাচ্ছিল সে তখন । হঠাৎ করেই ফারুক মানে জুঁইয়ের স্বামী জুঁইকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেয় ।
জুঁই তখন লাফ দিয়ে উঠে বসে যায় । পুরো শরীর তার কাঁপতে থাকে । বিছানা থেকে নেমে পানি খায় সে । আবার ইফসিকে দেখে , তার দেড় বছরের বাচ্চাটা তখন গভীর ঘুমে মগ্ন । গত এক বছরে এমন বহুবার হয়েছে যে হুটহাট করেই এইসব স্বপ্ন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার । অতীত কি শেষ হয়েও পিছন ছাড়ে নি তার । শরীরের কাঁপুনি কমিয়ে নিয়ে ডায়েরিটা নিয়ে বসে যায় জুঁই । কিছু একটা লিখে নিয়ে লাষ্ট দুটো লাইন লিখে ফেলে ,
” অতীত আমায় ছাড়ছে না পিছু
আমি তো আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার অনেক কিছু
কথা তো দিয়েছিলে ফিরবে ”
.
.
.
চলবে…………………….