কথা দিয়েছিলে ফিরবে পর্ব ৬

#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৬
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

নাস্তার টেবিলে বসে থাকা নাফিসের মন খাবারের দিকে নেই । টেবিলে ভরপুর খাবারে । তিন বছর আগে যেই খাবার যোগার করার অজুহাতে একটা মেয়ের বিশ্বাস ভরসা ভালোবাসা সব কিছুকে পায়ে ঠেলে মেয়েটাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল সে । আজ সেই খাবারের অভাব নেই তার ঘরে । শুধু অভাব তার সেই কাদম্বরীর । যাকে সেও চেয়েছিল এক সময়ে একান্ত আপন ভাবে । কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সব কিছুকে মাটি চাপা দিতে হয়েছিল তাকে । সামনে খাবার রাখা আছে কিন্তু আজ কেন জানি সেই খাবার গুলোও । কিছু কথা আপন মনে অন্তর বলে উঠে ,

– একদিন দায়িত্বের অজুহাত দেখিয়ে জুঁইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম । আর আজ সেই সব দায়িত্ব অনেকটাই সফল হয়ে গেছে শুধু সাথে নেই আমার ভালোবাসার সেই মানুষটা ।

এমন সময় একজন ভদ্রমহিলার ডাকে ধ্যান ভেঙে যায় ,

– নাফিস ,,,,,,?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– এই নাফিস ,,,,,,,,,,?
– হুউউউ ,
– কি ব্যাপার , খাচ্ছিস না যে ?
– খাচ্ছি না কোথায় ? খাচ্ছি তো
– কোথায় খাচ্ছিস তুই ?

ভদ্রমহিলা হলেন রেহানা পারভিন সম্পর্কে তিনি নাফিসের মা । তার কথায় নাফিস বিরক্তবোধ করে তবুও দাত মুখ খিটে রয় । এমন সময় একজন ভদ্রলোকও তার পাশে এসে বসে যায় ।

– কিরে বাবা , কি হয়েছে ?
– কোথায় কি হয়েছে ?
– মন খারাপ নাকি ?
– বাবা , আমার মন ভালো নাকি খারাপ সেটার খবর তো আগে কেউ নাও নি আজ কেন ?

ভদ্রলোক আনিস বেপারি সম্পর্কে নাফিসের বাবা তিনি । ছেলের কথায় অভিমানের ছাপ এটা তিনক বেশ বুঝে গেছেন । কিন্তু তিনিও আবদ্ধ তার স্ত্রী রেহানার কাছে । বলতে গেলে ভদ্রমহিলা সবার জীবনটাকে নষ্ট করে রেখে দিয়েছেন । এমন সময় রেহানা পারভিন বলে উঠেন ,

– কি হয়েছে তোর ? এমন করস কেন ?
– কিছুই হয় নি ।
– কিছু না হলেই ভালো । যাই হোক আজকে সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি আসিস । এক জায়গায় যাবো আমরা ।

মায়ের কথায় নাফিস বুঝে যায় যে কোথায় যাওয়ার কথা বলছে তার মা । তাই নাফিসও কড়া স্বরে জবাব দেয় ।

– নেক্সট টাইম এইসব কথা আমার সামনে বলবে না তুমি । এখন আর এইসবের টাইম নেই আমার কাছে ।
– নাফিস ,,,,,,,,?
– চিৎকার করো না , আজকে তোমার জন্যে আমার এই অবস্থা মা । নিজেরা ভালো থাকার জন্যে আমার ভালো থাকাটা কেড়ে নিয়েছো । এখন তো ভালো আছো তাহলে আমাকে আমার অবস্থাতে থাকতে দাও ।

এই বলে নাস্তা না খেয়েই বেরিয়ে যায় নাফিস । ভদ্রমহিলা রেহানা পারভিন আনিস বেপারিকে উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বলে ওঠে ,

– ও কি সেইখানেই এখনও আটকে আছে ? যা হবার তা তো হয়েই গেছে । এখন ও-কে বিয়ে করতে হবে ।
– সবটাই তো শেষ করে দিছো , এখন আর বিয়ে বিয়ে করছো কেন ? তখন তো বিয়ের নামেও তোমার আর তোমার মেয়েদের জ্বালা ধরে যেতো ।
– তুমি কথা কম বলো ,
– আমি তো কথা কম-ই বলি । তোমাদের সব অন্যায় দেখেও চুপ করেই আছি ।

আনিস বেপারির কথায় চুপ হয়ে যায় রেহানা পারভিন । মুখ বাকিয়ে উঠে চলে যান তিনি ।

অফিসে বসে এক মনে কাজ করে যাচ্ছে জুঁই । পাশে ইফসি বসা , সে খেলছে । এমন সময় তার টেবিলের ল্যান্ড লাইনে ফোন আসে । ফোন রিসিভ করতেই ভদ্রলোক মাহবুব হোসেন বলে উঠলেন ,

– নাদিরা একটু রুমে আসুন তো ,,,
– জ্বি স্যার আসছি ,,

মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ছোট্ট ইফসি মাকে ডেকে দেয় ,

– আম্মুন ,,,,,,,,

জুঁইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে ইফসি ইশারায় তার মাকে বুঝাচ্ছে তাকে কোলে তুলে নিতে । ছোট্ট ইফসির এই একটাই আবদার তার মায়ের কাছে । সে শুধু একটু কোলে উঠতে চায় । আর কিছুই আবদার করার নেই তার । জুঁই মেয়ের দিকে হাটু গেড়ে বসে মেয়ের গালে হাত রাখে ,

– আম্মুন , আমি একটু আসছি । যাবো আর আসবো । তুমি একটু থাকো আম্মুন

মায়ের কথায় চুপসে যায় ছোট্ট ইফসি । সে বুঝে যায় তার মায়ের কথা । তাই সে চুপ করে পুতুল গুলো দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে । ইফসিকে বসিয়ে রেখে জুঁই তার বসের রুমে যায় ।

– স্যার আসবো ?
– হ্যাঁ আসুন ,
– জ্বি স্যার বলুন ।
– বসুন ,

মাহবুব হোসেন এর কথায় সামনে থাকা চেয়ারে বসে যায় জুঁই । ভাবছে হঠাৎ এইভাবে ডেকে পাঠালো তাকে ,

– নাদিরা , কিছু কথা বলার আছে ?
– জ্বি স্যার বলুন ,
– নাদিরা গতকাল আমরা একজন নতুন employee নিয়েছি । তিনি এতদিন শাখা অফিসে ছিলেন , গতকালই মেইন অফিসে জয়েন হলেন । গতকাল আপনাকে আর বলা হয় নি তাই আজ বলে দিলাম । এখন থেকে মেইন ফাইল গুলো আগে আপনার কাছে যাবে তারপর তার কাছে সে ফাইল সাইন করে দিলেই তা আমার কাছে আসার এপ্রুভাল পাবে । আমি আশা রাখবো আপনি বুঝতে পেরেছেন ?
– জ্বি স্যার বুঝতে পেরেছি ।
– সো তিনিও আপনার সিনিয়র হিসেবে জয়েন দিয়েছেন এই অফিসে । আপনার কেবিনের ঠিক আগের কেবিনটাই তার । চাইলে দেখা করে আসতে পারেন আপনি ।
– জ্বি স্যার ।
– এইবার আপনি আসতে পারেন ।
– জ্বি স্যার ।

জুঁই কেবিন থেকে বের হয়ে নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়ায় । মনে মনে ভয় ঢুকে গেছে । সিনিয়র হিসেবে জয়েন করা ভদ্রলোক কেমন হবে কে জানে । তার উপর ফাইলে ত্রুটি ধরতে পারলেই বড় সড় ঝামেলা হয়ে যাবে । সব মিলিয়ে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ গুলো এলোপাথাড়ি ছুটাছুটি করছে তার ।

নিজ কেবিনে এসে আরও অবাক হয়ে যায় জুঁই । যেই চেয়ারে সে তার ছোট্ট ইফসিকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল সেই চেয়ারটা ফাঁকা । ফাঁকা চেয়ার দেখে জুঁইয়ের কলিজায় পাহাড় নেমে আসে । জুঁইয়ের চোখ থেকে অনায়াসেই পানি গুলো গড়িয়ে পড়ে যায় । সব দিকে শক্ত থাকলেও জুঁই তার ছোট্ট ইফসির জন্যে বড় বেশিই অসহায় । মেয়ের কিছু হলে সে পাগল হয়ে যায় । এইটুকুন একটা মেয়ে ভরা অফিস থেকে কোথায় উধাও হবে ? মুখে হাত দিয়ে চাপা স্বরে কেঁদে দেয় জুঁই । ওয়াসরুম সহ সবটা চেক করে সে এইখানে ইফসি কোথাও নেই । পাগল পাগল লাগছিল জুঁইয়ের নিজেকে । কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছে না জুঁই । কেবিনের বাহিরে গিয়ে মেইন কোরিডোরে মেয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকে সে । অফিসের বাকি স্টাফরাও জুঁইয়ের এমন ডাকাডাকিতে ইফসিকে খুজতে থাকে । কিন্তু ইফসি কোথাও নেই । দারোয়ানের কথা অনুযায়ী ইফসি অফিসের বাহিরেও যায় নি । তাহলে ইফসি কোথায় যাবে । জুঁই আর নিজেকে নিজের আয়ত্ত্বে রাখতে পারে নি । সবার সামনেই মেঝেতে বসে যায় ।

– আম্মুন কোথায় তুমি ? আম্মুন খুজছি তোমায় , চলে আসো আম্মুনের কাছে । ইফসি , আম্মুনের কাছে আসো ।

সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে যায় জুঁই । কয়েকজন ফিমেইল স্টাফ জুঁইকে রিলেক্স করায় । কিন্তু জুঁইকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না । তার মেয়েকে তার এক্ষুনি চাই । পাগল হয়ে মেয়েকে ডাকতে থাকে সে ।

– ইফসি , ইফসি , ইফসি আম্মুন কোথায় তুমি , ইফসি ।

.
.

চলবে…………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here