#কলঙ্ক
#৭ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
সাত-পাঁচ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করলাম বাড়ি থেকে।যাওয়ার সময় মা খুব কাঁদলেন।আমায় জড়িয়ে ধরে বুঝিয়ে সুজিয়ে বললেন,’তোরে অনেকেই অনেক কিছু বলবো।তুই চুপচাপ শুনবি কিন্তু কোন কথা বলবি না।মনে রাখিস যে সহ্য করে সেই বড়ো।যে বলে সে কখনো বড় হতে পারে না!’
আমি বললাম,’তুমি টেনশন করো না তো একদম মা। আমাকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না।আমি ঢাকায় যাচ্ছি এখন শুধুমাত্র একটা উদ্দেশ্যে। এখন থেকে একটাই কাজ আমার। পড়াশোনা করা। নিজের ক্যারিয়ার গড়া।লোকের মন্দ কথা শোনার সময় আছে নাকি আমার!’
বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন একটু তফাতে। আমার এই কথাটা শোনার পর তিনি এগিয়ে এলেন আমার কাছে। এসে আমার একটা হাত মুঠো করে ধরলেন। তারপর সেই হাত তার বুকের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন,’আমার মন বলছে মা তুই বড় হবি।প্রতিষ্ঠিত হবি। হয়তো তোর অনেক বাঁধা আসবে।ঝড় ঝাপটা পোহাতে হবে।এসবে দমে গেলে চলবে না।বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারলেই মানুষ সফল।উঠতে না পারলে ব্যর্থ।ব্যর্থদের কেউ কখনো মনে রাখে না।এমনকি নিজ পিতাও না।সফলদের সবাই মনে রাখে। তাদের গুণগান গায়।পিতাও পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। এখন গ্রামের সবার কাছে তোর পরিচয় ফরহাদ মাস্টারের মেয়ে।আমি চাই তুই এমন জায়গায় যা যেন মানুষ আমার পরিচয় বলতে গিয়ে বলে অমুকের বাবা!’
আমি ভেবেছিলাম আর কাঁদবো না।বাড়ি থেকে শুকনো চোখ নিয়ে যাবো।আমি ভেবেছিলাম সেদিন রাতের পর থেকে আমার চোখের সব জল আপনা আপনি শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। ফাগুনের আধো শীতল হাওয়ায় বাবার বুকে জলের মতো ঝাপটে পড়লাম আমি।বাবা আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন তার বুকের ভেতর। আমিও একটা ছোট্ট টুনটুনি পাখির ছানার মতো বাবার পেকে সাদা হওয়া লোমশ বুকের ভেতর লুকিয়ে যেতে লাগলাম।আর কাঁদতে কাঁদতে ভিজিয়ে দিতে লাগলাম বাবার বুকের সাদা সাদা লোমের ক্লান্ত শরীর।
বাবাও হয়তো কাঁদছেন। ভেতরে ভেতরে।পুরুষরা এমনই।ওরা কাঁদে। ভয়ংকর রকম কাঁদে। কিন্তু কেউ দেখতে পায় না।ওরা মেয়েদের মতো চোখ ভিজিয়ে কাঁদে না। টপটপ করে গাল বাইয়ে জল ফেলে না নিচে।ওরা শব্দ করে কাঁদতে পারে না।ওরা কাঁদে লুকিয়ে চুরিয়ে। ওদের কান্নার শুরু শেষ বুকের ভেতর।আমি শুনতে পাচ্ছি এখন। খুব স্পষ্ট করে শুনতে পাচ্ছি বাবা কাঁদছে। তার বুকের ভেতর কান্নার শব্দ হচ্ছে।জল গড়িয়ে পড়ছে মনের চোখ থেকে।টপটপ, টপটপ শব্দ হচ্ছে সেই জল গড়িয়ে পড়ার।বাবারা এমন কেন? সন্তানকে ভীষণ ভীষণ ভীষণ রকম ভালোবাসে।অথচ তার সন্তান কোনদিন তা বুঝতেই পারে না!
‘
ভাইয়া তাড়া দিলো। বললো,’তোমরা যা শুরু করছো ট্রেন তো মিস্ হবে!’
বাবা আমায় ছেড়ে দিলেন।হাতের পিঠে চুমু এঁকে দিয়ে বললেন,’যা মা যা।কাঁদিস না কেমন!মন খারাপ করিস না কখনো কোন কিছু নিয়ে।সব সময় ভাগ্যের উপর বিশ্বাস রাখিস। ঠিকমতো নামাজ আদায় করিস।কেউ কখনো কটুকথা বললে তুই উত্তর দিস না সাথে সাথে।তুই বরং এইসব কথা এসে তোর আল্লার কাছে বলিস।জায়ানামাজে বসে ইচ্ছামতো কাঁদিস। শোন মা, মানুষের দরবারে কেঁদে কেটে একসাগর জল ফেলার চেয়ে আল্লাহর দরবারে এক ফোটা জল ফেলা বেশি উত্তম।আমি চাই তুই উত্তম কাজটাই করবি।আর জ্ঞানীরা কখনো ভুল করে না।তুই জ্ঞানী মানুষ। দ্বিতীয় ভুল তোর মাধ্যমে কিছুতেই হতে পারে না!’
আমি বাবাকে কথা দিলাম। বাবার হাত ধরে বললাম,’আমি আর ভুল করবো না বাবা ইনশাআল্লাহ!’
‘
ঝকঝক করে ট্রেন ছুটছে।আমি জানলার পাশে বসেছি। ভাইয়া আমার ও পাশে। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’তূর্ণা তোকে অনেক সুন্দর লাগছে। কেমন সুখি সুখি দেখাচ্ছে। আচ্ছা তুই কী মনে মনে খুব আনন্দিত কোন একটা কারণ নিয়ে?’
আমি হেসে ফেললাম। বললাম,’অফকোর্স আনন্দিত।কারণ আমি তোর মতো এমন লক্ষ্মী একটা ভাই পেয়েছি এই জন্য।’
ভাইয়া বললো,’খুশি হলাম শুনে। আচ্ছা এখন শোন, ভাইয়ার জন্য তুই কী কী করতে পারিস বল তো?’
আমি আবার হাসলাম। এবার হাসলাম গাঢ় করে। কিন্তু শব্দহীন। তারপর বললাম,’সবকিছু করতে পারি।যা বলিস তাই করবো ইনশাআল্লাহ!’
ভাইয়া হাসলো। হেসে বললো,’যদি বলি ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে?’
আমি ঝটপট বলে দিলাম,’তাও পারবো।’
ভাইয়া এবার বললো,’উহু। এভাবে ঝটপট করে উত্তর দিলে তো হবে না।একটু ভেবে বলতে হবে। চিন্তা ভাবনা না করেই যে কথা বলে সে হলো গর্দভ।তুই জ্ঞানী মানুষ।জ্ঞানী মানুষ অনেক ভেবে চিন্তে কথা বলে।’
আমি এবার অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম। তারপর বললাম,’ভাইয়া,আমি জানি কারোর কথায় মরতে যাওয়া বোকামি। কিন্তু তোর প্রতি আমার যে ভালোবাসা আর সম্মান আছে তার জন্য আমি মরতেও কখনো দ্বিধা করবো না।’
ভাইয়া এবার আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর বললো,’তোর কোন পরিবর্তন হয়নি।তুই কী করবি জানিস?আমান ফিরে আসলে ওকে আবার একসেফ্ট করে বসবি!’
আমানের নামটা শুনে ঘেন্নায় আমার মুখে থুথু জমে উঠলো।জানলা দিয়ে সত্যি সত্যি আমি একদলা থুথু ফেললাম। তারপর বললাম,’ভাইয়া,এই কুকুরটার নাম আর কখনো আমার সামনে উচ্চারণ করিস না।আমি ওকে একটা কুকুরের চেয়েও বেশি ঘৃণা করি!’
ভাইয়া হাসলো। হেসে বললো,’কিন্তু ও যখন ফিরে আসবে।দশটা মিথ্যে বলে তোকে সাতপাঁচ বোঝাবে। তখন তো একেবারে গলে যাবি।দরদ উথলে উঠবে একেবারে?’
আমি প্রায় কান্না করে দিলাম।টুপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ার আগেই ভাইয়া হাতের তালু বাড়িয়ে দিলো। কুড়িয়ে নিলো আমার চোখের জল।যেন এটা সাধারণ কোন জল নয়।যেন অমূল্য কোন রত্ন। ভাইয়া বললো,’আর কাঁদিস না।আমি বলছি তুই সাকসেস হবি।হবেই হবি ইনশাআল্লাহ!’
আমি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া হাসছে।হাসলে ভাইয়াকে অনেক সুন্দর লাগে!
‘
হোস্টেলের বারান্দায় পা ফেলতেই আমার বুকটা কেমন ধ্বক করে উঠলো।বাড়ি থেকে গাড়ি থেকে নিয়ে আসা বাবা মা ভাইয়ার মোটিভেশন গুলো মুহূর্তে উবে গেল।ওই যে বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছে একটা মেয়ে। মেয়েটার সাথে কোনদিন আমার কথা হয়নি। তবে সে এই হোস্টেলেই থাকে। আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সম্ভবত আমার ব্যাচমেট। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি গুলোতে পরিচয় টরিচয়ের ব্যপারগুলো অত গুরুত্ব পূর্ণ নয়। মেয়েটা হেঁটে হেঁটে এদিকেই আসছে।যেন আমায় কিছু বলবে। আচ্ছা ও কী আমায় জিজ্ঞেস করবে বাচ্চাটার কী হলো? এমন ভাবে বলবে যে, এই, তোমার কী বেবি হয়েছিলো তূর্ণা? ছেলে না মেয়ে?
আমার কান্না এসে যাচ্ছে। ঠোঁট কেমন তিরতির করে কাঁপছে।নাকে সর্দি জমে উঠছে।আমি মাথায় ওড়নাটা ভালো করে টেনে দিয়ে মাথা নত করে হাঁটছি। আমার হাতে ব্যাগ।ব্যাগটাতে কয়েক সেট কাপড় ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। তবুও মনে হচ্ছে এই ব্যাগটার বিরাট ওজন। এই ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে আমার কষ্ট হচ্ছে।মেয়েটা আমার কাছে এসে গেছে। একেবারে কাছে এসে গেছে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এখন মুখ খুলবে। তারপর কথাটি বলবে।আমি কী ওর কথাটি সহজে নিতে পারবো?
‘
#চলবে