#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৬
কেটে গেল দুইদিন। এর মধ্যে আরোহীর সাথে বাচ্চা রুহানের প্রচুর ভাব জমে গেছে। এখন রুহান সারাক্ষন আরোহীর পেছনেই ঘুরঘুর করে। কী জানি রুহান আরোহীর কাছে মায়ের মতো ছোঁয়া পায় হয়ত। সেদিন আরোহীকে যখন আমেনা আহমেদ রুহানের মায়ের ছবি দেখালো তখন আরোহীরও ভীমরি খাওয়ার মতো অবস্থা। পুরোপুরি মিল না হলেও একটা বাইরের মেয়ে হিসেবে আরোহী আর রুহানের মায়ের মধ্যে বেশ মিল রয়েছে। আমেনা আহমেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, বাস্তবে দেখলে আরও মিল পেতো, আচরণও একটু একটু মিল। এজন্য হয়ত ছোট্ট রুহানের মনে আরোহীর প্রতি মায়ের টান অনুভব করেছে!
আরোহী আমেনা আহমেদের কাছ থেকে শুনেছে, রুহানের বাবা যতবারই কাজে বাইরে যায় ততবারই রুহানকে রাখা মুশকিল হয়ে পড়তো কিন্তু এইবার আর মুশকিল হয়নি। প্রথম একদিন কান্না করেছিল কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে আরোহীকে পেয়ে তার এখন বাবাকেও লাগে না। হয়ত তার ছোট মস্তিষ্কে ধারণা জন্মে গেছে যে মায়ের মতো হয়ত আরোহীও হারিয়ে যাবে। এখন তো সে আরোহীকে ছাড়া কিছু বুঝেই না। সারাক্ষন আরোহীর সাথে ঘুরঘুর করে। আর আরোহীও রুহানকে নিয়েই থাকে। রুহানকে কোলে নিলে তার নিজেরও মাতৃত্বের স্বাদের অভাব পূর্ণ হয় হয় মনে হয়।
পাশাপাশি আরোহী নিজের একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল কিন্তু আমেনা আহমেদের একটাই কথা উনি আরোহীকে চাকরি করতে দিবে না। তবুও অন্যের ঘরে আর কতদিন! এনারা নিজের মতো করে বললেও কোথাও যেন একটা বাধা কাজ করে। অনেক তো করেছেন এনারা। আর কষ্ট দিয়ে কী হবে!
তাই আজ আরোহী একপ্রকার জোর করে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে । চাকরি বলতে বেশি বড়ো নয়। আরোহীর নিজের যোগ্যতা অনুসারে স্বল্প বেতনের একটা চাকরি। আরোহীর বিশ্বাস, আজকে হয়ত চাকরিটা হয়েই যাবে। আর অন্যের বাড়িতে পড়ে থাকতে হবে না। মাঝে মাঝে রুহানকে এসে দেখে যাবে। অবশ্য এই দুইদিনে রুহানের প্রতি অনেক ভালোবাসা জন্মে গেছে। মনে হচ্ছে, রুহানের সাথে তার অনেক অনেক গভীর সম্পর্ক। প্রথম প্রথম ওকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে কিন্তু মানিয়ে নিতে হবে। চাকরিটা পেলেই আশ্রমে গিয়ে খালাকে একেবারে নিজের সাথে নিয়ে আসবে। এই জীবনে খালাও অনেক কষ্ট করেছে। বুঝ হওয়ার পর থেকে খালাকে আরোহী দেখে আসছে মাঝে মাঝে খালা ভীষণ মন-মরা হয়ে যেত। ছোট্ট ছিল বিধায় আরোহী বুঝতে পারতো না তবুও খালার ওই মলিন চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতো আর তখন খালা অদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে উঠতো,
‘জানিস আরু, আমার না মাঝে মাঝে কিচ্ছু ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে এসব কিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে অনেক দূরে হারিয়ে যায় কিন্তু পারি না তোদের জন্য। আর কারো কাছে দায়িত্বটা সপে দিতে পারলেই চলে যেতাম।’
আরোহী ছোট ছিল তখন কিছুই বুঝতে পারতো না সেটা খালা নিজেই জানতেন কিন্তু তিনি তবুও বলেই যেতেন কারণ ওই যে একটা কথা শোনার মানুষ দরকার ছিল!
আরোহী খালার এরূপ কথা-বার্তা তখন বুঝে উঠতে না পারলেও কিন্তু বড়ো হওয়ার সাথে সাথে সবকিছু আয়ত্তে আনতে পেরেছে। কিন্তু যে খালা যাদের ছেড়ে যেতে পারেনি যাদের জন্য থেকে গিয়েছিল কিন্তু তারা ঠিকই খালাকে ছেড়ে গিয়েছিল। যেমন আরোহী নিজেও সুখের সন্ধান পেয়ে খালাকে ভুলতে বসেছিল অথচ আরোহীর আশ্রমের আঠারোটা বছর খালা আগলে রেখেছিল! কিভাবে পারলো আরোহী সে খালার সাথে একটা বছর সম্পর্ক না রাখতে! আরোহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই চাকরিটা হয়ে যাক, খালার কাজটা অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিবে দরকার হলে এই চাকরির পাশাপাশি খালার কাজটা সে নিজেই নিবে এরপর খালাকে আপন করে নিয়ে আসবে নিজের কাছে। তারপর নিজে একটা ছোট্ট ঘর নিয়ে সেখানে খালা আর সে মিলেমিশে সুখে থাকবে। ‘সুখে থাকবে’ ভাবতেই তার ঠোঁটে তাচ্ছিল্য হাসির আবাস দেখা গেল। তার আবার সুখ! এতো ভালো থাকার অভিনয় করলেই কী ভালো থাকা যায়। রুহান আর এই পরিবারের সাথে মিলেমিশে থাকতে থাকতে হয়ত দিনটি পার হয়ে যায় কিন্তু রাত! রাতটা তো অনেক দীর্ঘ রাত মনে হয় তার। একেকটা রাত যে কত কষ্টে কত চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শেষ হয় সেটা কে জানে!
‘আরোহী মা!’
কারো কণ্ঠস্বর শুনেই আরোহীর ধ্যন ভাঙতেই দেখলো আমেনা আহমেদ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
‘জি, জি বলুন খালা।’
‘তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। রুহান তোমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তুমি বোধহয় খেয়াল করোনি।’
আমেনা আহমেদের কথা শুনে আরোহী নিচের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলো, রুহান তার শাড়ির আঁচল ধরে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। রুহানের সেই দৃষ্টি দেখে আরোহীর ভীষণ মায়া হলো। সে দ্রুত কোলে তুলে নিল রুহানকে। এই ছেলেটা দুইদিনে তার মনে সবার প্রথমেই জায়গা করে নিয়েছে। তার মা হওয়ার শখ কয়েকদিনের জন্য হলেও পূর্ণ করেছে এই ছেলেটা। চাকরিটা পেয়ে চলে গেলে সে কিভাবে থাকবে একে ছাড়া!
আরোহী আর কিছু না ভেবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমেনা আহমেদের দিকে দৃষ্টি দিল। উনি আরোহীর সামনে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে। তা দেখে আরোহী মুচকি হেসে বলে উঠল,
‘খালা, কিছু বলবেন!’
‘না, বলছি কী! তোমার চাকরিটা না করলে হয় না। আমাকে তো খালা ডাকো। মনে করো, আমি সত্যিই তোমার খালা। আর রুহানকে ছাড়া থাকতে পারবে তুমি! ছেলেটাও দুইদিনে তোমাকে পেয়ে আর কাউকে খুঁজছে না। নিহান তো বলেই দিয়েছিল যে তার ছেলের কী হলো হঠাৎ করে যে প্রানপ্রিয় বাবাকেও আর খুঁজছে না। হয়ত ছেলের জন্য বাকি সার্জারি অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসবে।’
আরোহী বিনিময়ে কোনো জবাব দিল না। খালাকে কোনোমতেই বুঝিয়ে ইন্টারভিউ এর জন্য পরিপাটি হয়ে বের হলো। তার মাথার উপর অনেক দায়িত্ব। সে দায়িত্বগুলো পালন করার জন্য হলেও তার চাকরি পেতে হবে। অনেক বড়ো হওয়ার বাকি আছে তার।
যথা স্থানে গিয়ে পৌঁছাতেই আরোহীর ডাক আসলো। সে উঠে অনুমতি নিয়ে ঢুকতেই একজন মধ্য বয়স্ক লোককে বসে থাকতে দেখল। আরোহী বুঝতে পারলো হয়ত উনারই অফিস এটা। সে উনার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিতেই উনি বসতে বলল।
উনি আরোহীর নেওয়া কাগজপত্র গুলো দেখে দূরে সরিয়ে রাখলো।
আরোহী ভেবেছিল উনি চাকরির যোগ্যতা নিয়ে কথা বলবেন কিন্তু না!
কাগজপত্র দেখেই উনি আরোহীর দিকে এক অন্য দৃষ্টিতে দেখল।
‘ডিভোর্সি!’
‘জি।’
‘চাকরি দরকার!’
আরোহী মাথা নাড়তেই লোকটি আবারও আগের ন্যায় দৃষ্টিতে আরোহীকে নিচ থেকে উপরে দেখে নিল।
‘চাকরি তো অনেক আছে কিন্তু তা তোমার যোগ্যতা অনুসারে নয়। কিন্তু আমি তবুও তোমাকে দিতে পারি। কোন চাকরি দরকার তোমার! টাকা চাই?’
লোকটির কথা বলা আর এমনভাবে তাকানোর অর্থ বুঝতে পেরে আরোহীর গা ঘৃণা’য় রি রি করে উঠল। সে আর চুপ না থেকে উঠে দাঁড়ালো।
‘তোদের মতো মুখোশ পড়া মানুষদের ধরে থা’প্রা’নো উচিত।’ বলতে গিয়েও আরোহী মুখ সামলে নিল। কারণ এটি লোকটির অফিস। কিছু হলেই আরোহীর বিপত্তি। সে লোকটির সামনে থেকে চৌ মেরে নিজের কাগজপত্র গুলো নিয়ে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
যত আশা নিয়ে বেরিয়েছিল ততটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাসায় ফিরেছিল। আরোহী ভেবেছিল আজ হয়ত চাকরিটা হয়েই যাবে। অন্তত সবচেয়ে নিম্ন পদের হলেও একটা চাকরি পাবে ভেবেছিল কিন্তু দুনিয়া যে বড়োই কঠিন। এখানে ভালো মানুষের আড়ালেই কিছু কুৎসিত মানুষের বাস। একটা বাপের বয়সী মানুষও ছাড় দিচ্ছে না। এই দুনিয়াতে একেক মানুষের একেক রূপ!
সবাই কী বাবার মতো ভালো হতে পারে না! সবার মন-মানসিকতার ভেতরে যদি রাখতো যে,’আমি আমার সন্তানদের জন্য যেমন আদর্শ তেমন অন্যদের জন্যও আদর্শ হবো।’
মন-মানসিকতা বদলালেই দুনিয়াটা সুন্দর হতো! আরোহী মলিন শ্বাস ফেলল। আজকের আশাটাও গেল কিন্তু সে হাল ছাড়বে না কিছুতেই। এসব ভাবতে ভাবতেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
———
আজ আরিয়ান ফিরবে। দুইদিনের সময়টা মনে হচ্ছে যেন অনেক দীর্ঘ। এই প্রথম আরোহীর সাথে এতদিন যোগাযোগ ছিল না। প্রতিবার এরকম কাজে বাইরে গেলেও আরোহীর সাথে দিন শেষে রাতে ঠিকই কথা হতো আর নয়তো আরোহী নিজেই দিনে কয়েকবার কল করে করে খেয়েছে কিনা! ফ্রেস হয়েছে কিনা! এসব বলে বলে আরিয়ানকে বিরক্ত বানিয়ে ফেলতো কিন্তু এইবার করেনি। উল্টো আরিয়ান রাতে কল করেই মোবাইল বন্ধ পেয়েছিল। টানা দুইদিন তার মোবাইলে সংযোগ পায়নি। স্নেহা আর মায়ের সাথে ঠিকই কথা হয়েছিল কিন্তু শুধু আরোহীর সাথেই হয়নি। তাই আরিয়ান এক রকম ফুরফুরে মেজাজে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(