কাঁচের সংসার পর্ব -০৫

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৫

আরোহী যখন চোখ খুলল তখন চারদিকে আলোর ছড়াছড়ি। দীর্ঘক্ষন চোখ বন্ধ ছিল বলে হঠাৎ আলো দেখে আরোহী আবারও চোখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেলল।

‘তুমি ঠিক আছো মা?’

কারো গম্ভীর মায়াভরা কণ্ঠস্বর শুনে আরোহী আর চোখ বন্ধ করে থাকতে পারলো না। সে দ্রুত চোখ খুলতেই একটু দুরুত্বে একটা মধ্যবয়স্ক নারীকে তারই দিকে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল।

‘জি কিন্তু আমি এখানে…!’

আরোহীর কথা শুনে মধ্যবয়স্ক নারীটি সামান্য হাসলো আর এতেই যেন তার সব সৌন্দর্য পুরো মুখে বিস্তীত লাভ করলো।

‘আমরা গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। মাঝরাস্তায় হঠাৎ তুমি এসে পড়েছিলে আর কোনোমতেই ব্রেক কষে তোমাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হই। তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি সেজন্য লাখো লাখো শুকরিয়া। জানো, ভোর থেকে এই পর্যন্ত সময়টা কত চিন্তায় ছিলাম!’

উনার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো।

আরোহী মনোযোগ দিয়ে শুনলো। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ল।

‘খালা, আমার হাতে সার্টিফিকেট ছিল সেগুলো কই!’

আমেনা আহমেদ আসনে বসা অবস্থায় ক্যাবিনের কর্নারে ইশারা করে বললো,
‘ঐতো আমি রেখেছি এগুলো। চিন্তা করো না।’

আর এতেই আরোহী নিশ্চিন্ত হলো কিন্তু তার টাকা! সেগুলো ছাড়া এখন কিভাবে চলবে! এখন তো কোনোমতেই সার্টিফিকেট আছে কিন্তু তাও এখন কার সময়ের জন্য অনেক নিম্নমানের। টাকা ছাড়া এই দুনিয়ায় কিচ্ছু হয় না। আরোহী ভেবেছিল, অন্তত বাসা থেকে বেরিয়ে হাতের টাকাগুলো দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে কোনো একটা ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে আর নিজেও চলতে পারবে কিন্তু এখন টাকাগুলোও হারালো। তার হঠাৎ করে ভীষণ রকম খারাপ লেগে উঠল। কী করবে সে এখন! ইনারা তো আরোহী জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিল। ওর জ্ঞান ফিরেছে হয়ত এখন ইনারাও চলে যাবে। আরোহী কোথায় যাবে, কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। হাতের মুঠোয় টাকার সাথে সাথে একটা কাগজে নাম্বার লিখে নিয়েছিল, যেটা আশ্রমের খালার নাম্বার। উনার নাম্বারটাও হারালো। ভেবেছিল, উনার সাথে দেখা করে কিছু একটার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে। অন্তত উনি আরোহীকে ফিরিয়ে দিবেন না কিন্তু এখন সেই পথটাও বন্ধ হয়ে গেল। তবে সেই আশ্রমে গিয়ে খোঁজ নেওয়া যায় কিন্তু অন্তত যেতে হলেও যে টাকাগুলো লাগবে সেই টাকার কানা-কড়িও তো আরোহীর নেই।

‘মা, তুমি কী কিছু নিয়ে চিন্তিত?’

পাশ থেকে ‘মা’ সম্বোধনে আরোহীর ধ্যন ভাঙলো। এই মানুষটির বারে বারে এমন মায়া-ভরা সম্বোধনে আরোহীর প্রাণ শীতলতায় ভরে যাচ্ছে। বুঝ হওয়ার পর থেকে কেউ তাকে এভাবে কোনোদিন বলেনি। স্কুল বা কলেজে যখন অন্য ছাত্রীদের এভাবে তাদের বাবা-মা সম্বোধন করতো তখন আরোহী চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে থাকতো। তারও ইচ্ছে ছিল তাকে কেউ এভাবে ডাকুক কিন্তু সেই ইচ্ছেটা কোনোদিন পূর্ণ হয়নি। ভেবেছিল, বিয়ের পর শাশুড়ির মন আদায় করে নিয়ে এভাবে ডাক শুনবে কিন্তু তা তো কোনোদিনই পূর্ণ হওয়ার নয়!

মাথায় হাতের ছোঁয়া পেতেই আরোহী তাকিয়ে দেখলো মহিলাটি এগিয়ে এসে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘বললে না তো! তুমি কী কিছু নিয়ে চিন্তিত। আমাকে নিশ্চিন্তে বলতে পারো।’

‘না না খালা। কিছু হয়নি।’ বলতে গিয়েও আরোহী থেমে গেল। সে এখন কিভাবে চলবে! সেটাই ভাবার বিষয়। উনারা তো চলে যাবে তাকে রেখে কিন্তু আরোহীর আশ্রমে যেতে যে টাকা লাগবে। একটু জিজ্ঞেস করে না হয় দেখায় যায়।

‘খালা,’ কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আরোহীর কণ্ঠস্বর অস্বস্তিতে পড়ে গেল। যদি উনারা মনে মনে ভাবে যে কয়েকটা টাকার জন্য এমন করছে! কিন্তু পরবর্তীতে নিজের চলার কথা মাথায় আসতেই লজ্জা-শরম ত্যাগ করে সে বলেই ফেলল।

‘খালা, আমাকে হাসপাতালে আনার সময় আমার হাতে কোনো টাকা বা কাগজ পেয়েছিলেন! সার্টিফিকেট এর সাথে সাথে ছিল!’

আরোহীর কথা শুনে খালা নিচের দিকে তাকিয়ে কী যেন মনে করার চেষ্টা করলো।
‘আমার তো ঠিক মনে পড়ছে না মা। আমার মাথায় তোমাকে হাসপাতালে আনার ভাবনা মাথায় আসছিলো। আর তোমার আঙ্কেলকে বলেছি দ্রুত যেন নিয়ে আসে। সার্টিফিকেটটা সাদা আর কোনো জরুরি ভেবে নিয়েছিলাম। টাকা হয়ত রাস্তায় পড়েছে কিন্তু নেয়ার কথা মাথায় ছিল না! কোনো জরুরি কিছু ছিল না-কি!’

‘ওহ। না খালা তেমন জরুরি নয়।’

আরোহীর এমন জবাবে আমেনা আহমেদ হয়ত কিছু বুঝে উঠতে পেরেছেন কিন্তু উনি মুখে তা প্রকাশ করলো না।
ঠিক সেসময় ক্যাবিনের দরজা খুলে এক মধ্যবয়স্ক লোক ঢুকলো।

‘এখন ঠিক আছো তুমি?’

‘জি আঙ্কেল।’
আরোহীর জবাব পেতেই লোকটি আরোহীর পাশে বসা আমেনা আহমেদকে কিছু একটা ইশারা করতেই আমেনা আহমেদ হাসি-মুখে বলে উঠল,

‘আর তোমার পরিবারের নাম্বার দিও, আমি নাহয় খবর দিচ্ছি যাতে উনারা এসে তোমাকে নিয়ে যায়। এতো ভোরে কেউ বাড়ি থেকে বের হয়! পরের বার থেকে হাজার রাগ থাকলেও এতো ভোরে বের হইয়ো না। আল্লাহ না করুক, যদি কোনো বড়ো বিপদ হয়ে যায়!’

পরিবারের কথা বলতেই আরোহীর চেহারা মুহূর্তের মধ্যে মলিন হয়ে গেল। সেটা আমেনা আহমেদও ধরতে পেরেছেন।
তিনি আরোহীর দিকে এগিয়ে এসে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিল।

তিনি আরোহীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
‘আমাকে বলতে পারো মা। নিজের মা মনে করে।’

এমন মায়াভরা কণ্ঠে আশ্বাস পেয়ে আরোহী আর কিছু লুকিয়ে রাখলো না। সে সবকিছু বলতেই উনারা একে-অপরের দিকে তাকালো।

‘খালা, আমার কিছু লাগবে না। এমনিও আপনারা অনেক কিছু করেছেন এই পর্যন্ত আমাকে আপনাদের মূল্যবান সময় দিয়েছেন। আমাকে একটা ছোট-খাটো চাকরি দিলেই হবে। আমার উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সার্টিফিকেট আছে। আমাকে সেই যোগ্যতা অনুযায়ী একটা চাকরি দিলেই হবে। ‘

আরোহীর কথা শুনে আমেনা বেগমের স্বামী এগিয়ে এলেন। উনিও এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আরোহী কোথাও যেন আপনজনের ছোঁয়া অনুভব করলো।

‘যদি কিছু মনে না করো একটা কথা বলি! তুমি আমাদের বাসায় থাকতে পারো। তোমার হয়ত প্রশ্নঃ জাগতে পারে যে এতো সহজে এসব কেন করছি! বাসায় গিয়ে সব জানতে পারবে!’

আরোহী ঝাপসা চোখে দুইজনের দিকে কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে তাকালো।

———–

‘দাদু উনি কে!’

বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই একটা পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা ছেলে এসেই আরোহীর দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। আরোহী বুঝতে পারলো এই বাচ্চা হয়ত এই ঘরের নাতি।

আমেনা আহমেদের স্বামী শফিয়ূল্লা চৌধুরী বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে আদর করে বলে উঠল,
‘উনি তোমার একটা আন্টি।’

বাচ্চাটি আরোহীর দিকে এগিয়ে আসলো।

‘তুমি আমার মায়ের মতো আন্টি। মাকে আমি ছবিতে দেখেছি, তোমারই মতো।’ বাচ্চাটি আরোহীর দিকে এগিয়ে এসে আদো আদো ভাঙা গলায় বলে উঠল।
আরোহীর কেন জানি মনে হলো বাচ্চাতি বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বুঝদার।

‘তাই! তোমার মা কই!’কথাটি বলতেই বাচ্চাটি চুপ হয়ে গেল।

আমেনা আহমেদ এগিয়ে এসে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে কেউ একজনকে ডাকতেই, একজন মহিলা দৌড়ে এসে বাচ্চাটিকে খেলতে নিয়ে যাবে বলে কোলে নিতে চাইলে বাচ্চাটি আরোহীর আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
আরোহী বুঝতে পারলো মহিলাটি হয়ত এই ঘরে কাজ করে।
আমেনা আহমেদ এক ফলক বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে আরোহীর দিকে তাকালো।

‘ওর মা বেঁচে নেই। ও আমার ছেলের বাচ্চা। ছেলেটা জন্ম দিতে গিয়ে সময় মতো র’ক্ত না পেয়ে মেয়েটা অকালে পরপারে পাড়ি জমিয়েছিল। ওর মাকে কখনো আমি ‘বৌমা’ এর চোখে দেখিনি, সবসময় আমাদের সম্পর্ক মা-মেয়ের মতো ছিল কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল। তোমাকে প্রথম দেখেই আমি কেঁদে উঠেছিলাম কারণ তুমি দেখতে কিছুটা আমার ওই মেয়েটার মতো। তাই তো তোমাকে আর ছাড়তে পারিনি।’

আরোহী ঝাপসা চোখে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন মানব-মানবীর দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরতেই বাচ্চাটি একেবারে তার সাথে মিশে গেল। আরোহীর কেন জানি মনে হলো বাচ্চাতি বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বুঝদার।
এইযে মা নেই সেটা এতটুকু একটা বাচ্চা কী নির্দ্বিধায় বলে ফেলল বুঝদারের মতো। আরোহী বাচ্চাটিকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। কেউ সবকিছু পেয়ে হারায় আবার কেউ না পেয়ে হারায়।

#চলবে ইন-শা-আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here