কাঁচের সংসার পর্ব -০৪

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৪

নিস্তব্ধ রাত। চারদিকে শান্ত, নির্জীব। দূরে কোথায় জানি কিছু সময় পর পর থেমে থেমে শেয়ালের হাক ভেসে আসছে। আরোহী রুমের জানালা খুলে গাঢ় আঁধারের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ পূর্ণিমা, চারদিকে চাঁদের কী সুন্দর আলো! একদম সব স্পষ্ট। দূরের গাছের ডালটা হঠাৎ করেই নড়ে উঠল। হয়ত কোনো রাতের পাখি উড়ে নিজের নীড়ে ফিরছে। আরোহী সেদিকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকালো। পাখিটারও হয়ত আরোহীর মতো মন খারাপ! তাই বোধহয় প্রিয়জনের কাছ থেকে এতক্ষন দূরে ছিল, শেষ পর্যন্ত আর না পারতে নীড়ে ফিরছে।
আরোহী নিজের ভাবনা দেখে হাসলো। তার মন খারাপ বলে আরেকটা প্রাণীরও মন খারাপ হবে না-কি! পাখির মন খারাপ হবে কেন! হয়ত সে খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিল, অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার ফলে রাত হয়ে গিয়েছে।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভোর হওয়ার অপেক্ষায় আছে । ভোর হলেই এই বাসা থেকে চিরতরে বেরিয়ে পড়বে। একা একটি মেয়ে মানুষ তাই এই গভীর রাতে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না। হাজার হলেও এই শহরে অনেক মুখোশ পরিহিত মানুষের ভিড়ে আরোহী কোনোদিনও নিজেকে সপে দিবে না।

আরোহী জানালা বন্ধ করে এগিয়ে এলো রুমের দিকে। টেবিলের উপর ডিভোর্সের কাগজটা জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে যেন সেটা আরোহীর দিকে তাকিয়ে আরোহীকেই উপহাস করে হাসছে।

আরোহী মেঝেতে বসে কাগজটা হাতে নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একটা সাইনের বিনিময়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক গঠন হয় তেমনি একটা সাইনের মাধ্যমেই একটা সম্পর্ক নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।

এই ডিভোর্সের কাগজটার ব্যাপারে হয়ত আরিয়ান জানে না। কাল সকালে আরিয়ান বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষন পর স্নেহা আর লুৎফা বেগম এই কাগজটা আরোহীর দিকে ছুঁড়ে মেরে বলেছিল যাতে সে খুব দ্রুতই সাইন করে আরিয়ান ফেরার আগেই এই বাড়ি থেকে বিদায় নেয়।
লুৎফা বেগম গত একমাস ধরে আরিয়ানের বিয়ে নিয়ে মেতে উঠেছিল। তিনি জানতেন, আরিয়ান হয়ত কোনোদিনও আরোহীকে ডিভোর্স দিবে না কারণ আরোহীর যাওয়ার স্থান নেই কিন্তু লুৎফা বেগম আর স্নেহার এতো কিছু দেখার সময় নেই । তারা আরিয়ান আসার আগেই এই বোঝাটাকে বিদায় করতে পারলেই হলো। হয়ত স্নেহা বিয়ের একমাস আগে থেকে লুৎফা বেগমকে কান-পড়া দিয়েছিলো যে আরোহী থাকলে তারা সুখে সংসার করতে পারবে না আর আরিয়ান হয়ত আরোহীর অসহায়ত্ব দেখে ভুলেও ডিভোর্স দিতে চাইবে না। তাই দুইজনে লুকিয়ে ডিভোর্স পেপার বানিয়েছে আর তা সফল হতে যাচ্ছেও।

আরোহী আর কিছু না ভেবে খুব দ্রুতই সাইন করে দিল। একটা পেপারওয়েট এর সাহায্যে ডিভোর্স পেপারটা টেবিলে চাপা দিয়ে রাখলো। যাতে দরজা খুলতেই সবার আগে ডিভোর্স পেপারটা চোখে পড়ে।

আরোহী উঠে দাঁড়ালো। সময় হয়েছে তার হারিয়ে যাওয়ার। সবাই যে যার রুমে শান্তির ঘুম দিচ্ছে, শুধু আরোহীরই চোখে ঘুম নেই।
আরোহী এসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লো ভোর ফোটার অপেক্ষায়। হাঁটুমুড়ে মাথা গুঁজে অনেকটা সময় বসেছিল। চারদিকে থেকে পাখির কিচির-মিচির ডাক ভেসে আসতেই সে উঠে পড়লো।

আলমারি খুলে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিল। সাথে আর কিছুই নিল না। কী নিবে! এই সংসারের কিছুই তো তার নয়। সবকিছুই তো আরিয়ান বিয়ের পর একটার পর একটা কিনে দিয়েছিল। শুধু পরনের শাড়িটা আর আশ্রমে যতটুক পড়েছিল উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত সার্টিফিকেটগুলো বাদে সে আর কিছুই নিল না। হাতে কিছু টাকা ছিল সেগুলোই নিল। এগুলো বিয়ের পর পর আরোহী আরিয়ানের কাছ থেকে কিছু কিনে দেওয়ার বায়না ধরলে তখন আরিয়ান কিছু টাকা গুঁজে দিতো যে আরোহী যেন নিজে কিনে নিয়ে আসে। জিনিস কেনার পর যেগুলো ফেরত পেতো সেসব আর আরিয়ান নিতো না। তখন আরোহী বলতো,
‘আরে!আমি টাকা দিয়ে কী করবো! আমার সবকিছুই তো তুমি আনো বা দেখা-শোনা করো! আমার স্বামী আছে না!’

তখন আরিয়ান হাসি-মুখে এগিয়ে এসে আরোহীর মুখ তার দুইহাতে আবদ্ধ করে বলতো,

‘কেউ একজন জানি একটা কথা বলেছিলেন যে ‘অতি সুন্দরীরা বোকা হয়’। আমিও প্রমান পেলাম তোমাকে।’
তখন আরোহী মুখ ফুলিয়ে রাখতো। আর আরিয়ান হেসে বলতো,
‘প্রত্যেক মেয়েদের উচিত দিন শেষে স্বামীর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে অন্তত সবচেয়ে ছোট এমাউন্ট হলেও জমিয়ে রাখা। আর স্বামী না দিলেও নিজে আদায় করা। এগুলোই পরে বিপদের সময় কাজে আসে। স্ত্রী জাতিরাই টাকা বেঁধে রাখতে পারে কিন্তু তোমার অন্যদের মতো অতো বুদ্ধি-সুদ্দি নাই। তুমি টাকা হাতের লাগালে পেয়েও কাজে লাগাতে জানছ না। সাধে কী আর বোকা বলি!’

সেদিনের দৃশ্যটা চোখের উপর ভাসতেই আরোহী ঝাপসা চোখে হেসে দিল। সেদিন আরিয়ানের কথাগুলি আরোহীর মনে গেঁথে গিয়েছিল। সে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিল আরিয়ানের ভাবনা দেখে। এরপরও অবশ্য আরোহীর টাকা খুঁজতে হতো না। দিন শেষে আরিয়ান অফিস করে ফিরতেই কিছু টাকা আরোহীর হাতে গুঁজে দিলে আরোহী বলতো,’মাত্র এই টাকা দিয়ে কী করা যাবে!’
তখন আরিয়ান মুচকি হেসে বলতো,’বিপদের সময় দেখো এই টাকাগুলোই জমে বৃহৎ আঁকার ধারণ করে কিভাবে আমাদের সাহায্য করবে! বিপদ তো আর বলে-কয়ে আসে না।’

আরিয়ানের কথায় ঠিক হলো। এখন এসবই আরোহীর মুল সম্পদ। কিন্তু এই বিপদ শুধুমাত্র আরোহীর একার। আরোহী দরজার দিকে এগিয়ে থেমে গেল। শেষবারের মতো তার নিজ হাতে সাজিয়ে তোলা সংসারটা দেখে নিচ্ছে। তার নিজের রুমটা একটু দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু স্নেহা দরজা আটকে দিয়েছে। সে অপলক দৃষ্টিতে রুমের দরজাটার দিকে তাকিয়ে মনের আশা পূর্ণ করে নিল। আরোহী চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করলো। এই বাড়ির দিকে সে আর তাকাবে না। যতই তাকাবে ততই মায়া বাড়বে। মায়া জিনিসটা বড়োই খারাপ। আরোহী আর কিছু না ভেবে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। দরজা পেরিয়ে পা অগ্রসর হতেই না চাইতেও বিয়ের প্রথম সে আর আরিয়ান ঢোকার মুহূর্তটা মনে পড়ে গেল। সেদিন আরোহী ভয়ে ভয়ে পা ঢোকাতে না চাইলে আরিয়ান তার ডান হাত মুঠো পুরে নিয়ে আশ্বাস দিয়েছিল কিন্তু এক বছরের ব্যাবধানে সব শেষ।

আরোহী ঝাপসা দৃষ্টিতে বাড়িটির দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। আর দেখবে না এই বাড়ির দিকে। যতবারই দেখবে ততবারই কোনো না কোনো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠবে। সে চোখ মুছে মেইন রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। জিদের বশে তো বেরিয়ে গিয়েছে, এখন কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছে না। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কাল সারাদিন পেটে কোনো কিছুই পড়েনি যার ফলে মাথাটা তীব্র ব্যথা করছে, খিদের চোটে হাঁটতেও পারছে না। সে খাইনি তা না, খাবার দেয়নি। লুৎফা বেগম আর স্নেহা মনে করেছিল, আরিয়ান থাকতে বলেছে বিধায় আরোহী থেকে যাবে তাই তো তিনি আরোহীকে সারাদিন গাধার মতো খাঁটিয়েও কোনো খাবার দেয়নি যাতে আরোহী শেষমেষ এই বাড়ি থেকে বিদায় নেয়।
আরোহী মনে মনে হাসলো। সে তো লুৎফা বেগমকে শাশুড়ির চোখে না তাকিয়ে মায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কিন্তু উনি কেন বউ না ভেবে মেয়ে ভাবতে পারলো না!

মেইন রাস্তায় উঠতেই আরোহীর মাথা গুলাতে শুরু করলো। পেট গুলিয়ে বমি পাচ্ছে। ক্ষিদেয় পেট চৌ চৌ করছে। এখন মনে হচ্ছে এতো ভালো সেজে লাভ ছিল না, অন্তত বেরিয়ে আসার সময় হলেও রান্নাঘর থেকে কিছু খেয়ে নেওয়া উচিত ছিল। তখন তো লুৎফা বেগম আর স্নেহা ঘুমে ছিল যার ফলে ধরা খাওয়ার উপায় ছিল না।
পরে আরোহী নিজেকে নিজেই উপহাস করে হাসলো। ক্ষিদের চোটে চুরি করে খাওয়ার কথা মাথায় আসতে দুই দন্ড সময় লাগছে না।
আরোহী আরেকটু এগিয়ে গেল। দূরে একটা মুদির দোকান খুলেছে। আরোহী আশার আলো খুঁজে পেলো ভেবে অদূরের দোকানটির দিকে পা বাড়ালো।
রাস্তার মাঝে উঠতেই পেট গুলিয়ে বমি পেয়ে গেল। মাথা অসম্ভব ঘুরছে। হয়ত ক্ষিদের যন্ত্রনা আর সহ্য করতে পারছে না। ছোট বেলা থেকেই সে ক্ষিদের যন্ত্রনা সহ্য করতে পারতো না, মাথা ঘুরাতো। আজও ব্যতিক্রম হলো না। আরোহী এইতো কাছে ভেবে পা চালাতে নিতেই দূরে গাড়ির আলো এগিয়ে আসতে দেখা গেল। সে তার শক্তিতে সরে যাওয়ার অবকাশ আর পেল না। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পেল গাড়িটা তারই দিকে দানবের মতো এগিয়ে আসছে।

#চলবে ইন-শা-আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here