#কাঞ্জি
#পর্ব-২
#সাদিয়া_খান( সুবাসিনী)
কান্নার সাথে খাবারগুলো গিলে ফেলল আবৃতি।বাড়ি ফেরার পর এক দফা রত্না বেগমের রাগের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে।অদিতির প্রিয় শেড লাভিং গাছটায় রোদ পড়েছিল। কেমন নির্জীব হয়ে গেছে গাছটা।যদিও অদিতির ঘরের দিকে তার যাওয়ার অনুমতি নেই তবুও দোষটা তার ঘাড়েই এসে পড়লো। আজমীর, অদিতি এবং আবৃতি হচ্ছে রত্না বেগমের তিন সন্তান।আজমীর বাবার ব্যবসাটা দেখছে। বড় রকমের নার্সারী এবং বৈধ ভাবে পাখির বিজনেস রয়েছে তাদের।বিদেশি পাখিদের ব্রিডিং করানো, একুরিয়ামের জন্য রাখা নানান প্রজাতির মাছ কিংবা সকল প্রকার দেশি বিদেশি গাছের সমারোহ। আবৃতির নামে এই বিজনেসটা চলছে। খায়রুল সাহেব এই নামেই ব্যবসা শুরু করেছিলেন।দেশি বিদেশি যে কোনো প্রকার মাছ, গাছ বা ফুলের জন্য শহরের অধিকাংশ মানুষ আবৃতিদের জানে।
আবৃতি নিজেও আজমীরের ন্যাওটা।বাবা মারা যাওয়ার পর এই ভাইয়ের জন্যই বেঁচে আছে পৃথিবীতে। না হলে রত্না বেগম যেভাবে তাকে ছোটো বেলায় মারধর করতো। কবে যেন দম আটকে মরে যেত সে। এই তো প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়ের কথা। বিজ্ঞান পরীক্ষার আগের রাতে রত্না বেগম পড়াতে এসেছিলেন। পড়া না পারার কারণে আবৃতির পিঠের উপর দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।কিংবা একদিন বই হারানোর দোষে ঘাড়ে পা দিয়ে লাথি মেরেছিলেন।সেই সময় আজমীর তাকে বার বার বাঁচিয়েছে।আজমীর জানে তার মায়ের রাগের কারণ।বাবার অন্যায়গুলো সেও তো মেনে নিতে পারেনি।তাই বলে বাবার সন্তান হওয়াটা তো আবৃতির দোষের নয়। সন্তান তো মা বাবা সিলেক্ট করে পৃথিবীতে আসে না।যার ঘরে সৃষ্টিকর্তা যাকে পাঠায়। আজকের দিনটা আবৃতির ভীষণ ভীষণ খারাপ গেল।
টবটা তার উদ্দেশ্যে ছুড়ে মারার কারণে সেটা পা বরাবর এসে ভেঙ্গেছে। আদিতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মায়ের পাশে।সে কি বলতে পারলো না টবটা সে রোদে রাখেনি। মাটিগুলো পরিষ্কার করে নিজের ঘরে ফিরে এলো আবৃতি। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।মুখে ওড়না গুঁজে গোঙানির শব্দে বলতে লাগলো
“কেন এমন করলে তোমরা? তোমাদের আমি কি ক্ষতি করেছিলাম?কেন আমায় এভাবে ভাসিয়ে তোমরা সুখে আছো।মৃত্যুর পর কি কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে না তোমার বাবা?এই যে তোমার মেয়েটা কেবল অবহেলা পেয়ে যাচ্ছে।তুমি কি এই অবহেলা চেয়েছিলে নিজের সন্তানের জন্য?না চাইলে কেন এমন করলে?”
খাবার টেবিলে বসে রত্না বেগম মুরগীর রানটা অদিতির প্লেটে তুলে দিলেন।আবৃতির পাতে পড়লো গলার হাড়, মাথা এবং গিলার সাথে দুই পিস আলু। প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে রত্না বেগম বলল,
“বাপের ঘরেই সব সুখ। শ্বশুর বাড়িতে এটুকও পাবে না। হয়তো এক পিস আলুও না কপালে জুটতে পারে।আর এই যে দুই দিন পর পর চুলে শ্যাম্পু লাগাও।এটাও কমাও।জীবন কখনো একরকম চলে না।কখন বিপদ আসে বলা যায় না।”
আবৃতির দলা পাকানো কান্না এবং কষ্ট ভাতের সাথে গিলে ফেলল।সেই মুহূর্তে দরজায় কারোর শব্দ হলো।বাসাটা পাঁচতলা। নিচ তলায় বাড়ির কাজের লোক,দারোয়াম এবং ড্রাইভার স্ব পরিবারে থাকে।দোতলায় থাকে সুফিয়া খাতুন এবং তার স্বামী ফয়সাল আহমেদ।তিনতলায় রত্না বেগম তার সন্তান নিয়ে।চারতলায় শাহরিয়ারদের পরিবার এবং পাঁচ তলায় সুফিয়া খাতুনের ছোটো ছেলে বাবুল আহমেদ এবং তার পরিবার। শাহরিয়ারের বাবা শফিক সাহেব যার কার পার্সের বিজনেস রয়েছে। স্ত্রী আসমা, ছেলে শাহরিয়ার এবং মেয়ে শাহানারা নিয়ে তাদের সংসার।অপর দিকে বাবুল সাহেবের এক ছেলে বর্ণ এবং স্ত্রী নাজিয়ার সাথে থাকেন। যখন সুফিয়া খাতুনের মেয়েরা আসেন তখন তারা মা-বাবার সাথেই থাকেন।সবার হাড়ি আলাদা হলেও এই বাড়ির বাচ্চাদের জন্মদিনে রান্না করেন সুফিয়া খাতুন।প্রত্যেকেই তার জন্য কলিজার অংশ।দরজা খুলে তাকে দেখে কিছুটা নরম হলেন রত্না বেগম।আবৃতি কিছু বলবে না এটা তার বিশ্বাস আছে কিন্তু সুফিয়া খাতুন কি করে যেন সব বুঝে যায়।
চেয়ার টেনে বসতে বসতে সুফিয়া খাতুন বললেন,
“আমি তোমাদের কারোর সাথেই খাই না।তোমাদের টাকাতেও চলি না।আমি এখনো আমার স্বামীর ইনকামে চলি।”
“জানি। এ কথা কেন বলতেছেন?”
“একটা গাছ মরছে আজমীররে বললে দশটা আইনা দিবো।এই গাছের জন্যে তুমি জন্মবারে মেয়েটারে বকছো কোন সাহসে?”
“কথা গাছের নয়।দায়িত্বের।আম্মা আবৃতি বাকীদের মতো হতে পারবে না।ওকে সব বুঝতে হবে।ও শাহানারা বা অদিতি না।ও আবৃতি।”
“আমার কাছে সবাই সমান।তুমিও সমান আমার খায়রুল ও সমান।আজ রাতে রানবা না। আমার বাসায় সবাই খাবা।আর আবৃতি তুই আয় আমার সাথে।”
“দাদু খাচ্ছিলাম।”
“প্লেট নিয়েই আয়। তোর দাদা বসে আছে এক সাথে খাবে বলে।”
আবৃতি কথা না বাড়িয়ে দাদীর পিছন পিছন চলে এলো।খাবার টেবিলে বসতে বসতে দাদার সাথে নানান কথা হলো।দাদী আবৃতির ভাতের প্লেটের খাবার পলিথিনে ভরে তার সামনে প্লেট দিয়ে বললেন,
“ফেলবো না।কুকুরকে দিয়ে দিবোনি। তুই আজকে আমার রান্না খেয়ে দেক।”
প্রতিদিন ফিরে শাহরিয়ার দাদীর সাথে দেখা করে যায়।আজকে আসতেই তার দাদী আবৃতির পাশে তাকে বসিয়ে দিয়ে খাবার বেড়ে দিলেন।লাল নীল লজ্জা আর স্যাইয়া ডাকটার কথা মনে পড়ে খাবার নামছিল না আবৃতির।নিজের প্লেটের মাছের মাথাটা শাহরিয়ার আবৃতির প্লেটে তুলে দিয়ে বলল,
“খেয়ে খেয়ে শক্তি বানাও।যা খাও সব তো চুলেই চলে যায়।”
“স্যা…”
টেবিলের নিচে খপ করে শাহরিয়ার হাত রাখে আবৃতির উরুতে।ফিসফিস করে বলল
“আবার স্যাইয়া বলে ডাকলে সত্যি সত্যি মাথায় তুলে আছাড় মারবো।”
“আমার কি দোষ? আপনার আফটার শেভ কিংবা ম্যানলি পারফিউমের গন্ধে আমার মাথাটা টাথা নষ্ট হলেও সেটা আমার দোষ না কি?একে তো পিচ্চি পিচ্চি মাথার মাথাটা নষ্ট করে ফেলেন আবার হুমকি দিচ্ছেন?”
আবৃতির হাত থেকে ভাতগুলো ঝরঝর করে প্লেটে পড়ে গেল।নিজের কথার কারণে আবারো লজ্জায় মিশে যেতে মন চাইলো।শাহরিয়ার হাত সরিয়ে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো।দাদা-দাদী কিছু নিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত।নিচের ঠোঁট কামড়ে লজ্জায় কান্না আটকানোর চেষ্টা বৃথা হলো আবৃতির।শাহরিয়ার বোধ হয় বুঝলো।আলগোছে উঠে যেতে যেতে বলল,
“দাদী আমি পরে খাবো।এখন আর ইচ্ছে নেই।”
(৪)
সন্ধ্যে বেলা আবৃতিকে একটা মিষ্টি রঙের শাড়ি দিয়েছে ফয়সাল সাহেব।সেটা পরতে সাহায্য করলো শাহানারা এবং বর্ণের মা। শফিক সাহেব ভাতিজির জন্য কেক নিয়ে এসেছেন।বেশ আনন্দের সাথে কেক কাটলো আবৃতি।
সবাই যখন কেক খাওয়ায় ব্যস্ত শাহরিয়ার আবৃতির ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। খুব সাবধানী হাতে একটা চেইন বের করলো পকেট থেকে।কোথাও একটু শব্দ হলো।হৈহৈ করতে থাকা কাজিনের দলে কেকের ক্রিম লাগানোর হুড়োহুড়ির মাঝে আবৃতির শাড়ির আঁচল গলিয়ে হাত প্রবেশ করালো সে।না আবৃতি নিজেও বুঝেনি।বুঝবে কি করে?শাহরিয়ার কি তাকে স্পর্শ করেছে?একটুও নয়। কেবল একটা সরু কোমরের বিছা পরিয়ে দিয়েছিল কোমরে।যতক্ষণে শীতল কিছুর অনুভব হলো কোমরে তখন শাহরিয়ার সরে এসেছে অনেকটা দূরে।কোমর হাতড়ে আবৃতি দেখতে পেল রূপোর সরু একটা বিছা।একদম সরু তবে যেখানে হুকটা লাগানো হবে সেখানে ঝুলছে একটা চাঁদ।আর চাঁদকে আষ্টেপৃষ্টে আলিঙ্গন করে আছে একটা ইংরেজি অক্ষর।
তিরতির করে কেঁপে উঠলো সে।তার মনে কেবল অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তাভাবনা ডানা মেলছে।এই যে এখন তার ইচ্ছে হচ্ছে দিন কাল সব ভুলে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে। কারণ এটা যে বিগত পনেরো বছরে তার একমাত্র উপহার।কেউ এভাবেও উপহার দেয় বুঝি? চকিতে শাহরিয়ারের দিকে তাকালো সে।তার দিকে হাসি মুখে এগিয়ে এসে শাহরিয়ার এক কাজ করে বসলো।পকেট থেকে একটা ডিম বের করে আবৃতির মাথায় ঠাস করে ফাঁটিয়ে দিয়ে বলল,
“শুভ জন্মদিন।”
চলবে (এডিট ছাড়া।যারা পড়বেন রেসপন্স এবং কমেন্ট করবেন।এক লাইন হলেও। এতে আমি বুঝতে পারবো গল্পটা কেমন হচ্ছে।)
#ছবিয়ালঃইন্সটাগ্রাম