#কাঠপুতুল
#লেখনীতে-তানভীন শিলা
#পর্ব-৯
.
একসপ্তাহ্ থেকে মৃদু নিজের রুম থেকে বের হয়না। পরী মৃদুর জন্য খাবার কুড়িয়ার করে।
“পরী, পরশ তো সকালে বের হয়ে যায় কখন আসে দেখায় যায়না। মৃদুকে নিয়ে আয় যা, মেয়েটা সারাদিন রুমে থাকে। হয়তো ওর ভালোলাগেনা একা একা।”
পরী শকড্ রুশানা বেগমের কথায়। মৃদুকে ৩টা বছর যেমন ট্রিট করেছে সেটা হয়তো কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের দ্বারা সম্ভব না, কিন্তু সে সব জেনে বুঝে করেছে। আর আজ প্রথমবার তিনি মৃদুর জন্য্ একটু হলেও সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন।
“মা তোমায় তো আর বলা যাবেনা যে মৃদু রুমে একা থাকেনা। তোমার কলিজার টুকরা ছেলেটাও যে আছে ঐ রুমে। এই সপ্তাহ থেকে ওরা একসাথেই আছে। আমি একজনের জন্য না দুইজনের জন্য খাবার নিয়ে যাই। পাক না মৃদু ওর ভাগের ভালোবাসাগুলো, ক্ষতি কি তাতে??”(মনে মনে বলে পরী)”
“মা মৃদু ভালো আছে আর ওর নিজেরই নাকি বাহিরে আসতে ভালোলাগেনা।”
“এভাবে থাকলে আরো বেশি খারাপ হবে ওর জন্য।আমিই ডেকে আনি।”
পরী দৌড় লাগায় রুশানা বেগমের পিছনে। নক করার আগেই গেটের সামনে দাড়ায় পরী।
“মৃদু ঘুমিয়ে আছে মা। ও একটু দূর্বল তাই ঘুমিয়ে আছে।”
“তাই নাকি? কখন দেখলি?? নাস্তার সময় তো হয়নাই, তুই তো ওর রুমেই যাসনি।”
“মৃদুই বলেছে মা। ওর নাকি ঘুম থেকে উঠতে ১০টা-১১টা বেজে যায়।”
“ওহ্ আচ্ছা ঠিক আছে।”
রুশানা বেগম যেতেই পরী মনে মনে বলে-
“বাঁচা গেলো।।”
.
.
.
পরশকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে দেখে অবাক হয় রুশানা বেগম।
“তুই কখন আসিস বাড়িতে? তোকে তো আসতে দেখাই যায়না না। আর এভাবে গায়েব হয়ে যাস কেন? আমাদের সাথে থাকতে বুঝি তোর ভালোলাগেনা?”
“উফ্ মা এতো বেশি কেন বুঝো বলোতো?”
ছেলের বিরক্তিমাখা উত্তরে অবাক হয় রুশানা বেগম। এতো বছর পর এলো অথচ বাড়িতে তাকে পাওয়াই যায়না, তাই অভিমানি সূরে বলেন তিনি-
“তুই তো আমাদেরকে সময়-ই দিচ্ছিস না। সবসময় বাহিরেই থাকিস, এই এক সপ্তাহ্ তোর রুমে যতবার-ই গেছি একবারো পাইনি।”
“ট্যুর প্ল্যান করেতেছি মা পুরোনো বন্ধুরা মিলে। ওদের সাথেই থাকি। ১মাসের জন্য ঘুরতে যাবো আমরা ।(সব তোমার ছেলের বউ-এর দোষ। তোমার ছেলেকে ছাড়তেই চায়না তো আমি কি করবো?-মনে মনে বলে মনেই হাসে পরশ)”
“১মাস!!!! তুই তো এসেছিস-ই ৩মাসের জন্য আর তার মধ্যে ১সপ্তাহ্ চলেই গেছে আবার ট্যুরে যাবি ১মাসের জন্য। আমরা কি তোর কেউ না? আমাদের জন্য সময় কই?”
“মা ট্যুর থেকে আসার পর কোথাও যাবোনা, সারাদিন রাত বাড়িতেই পরে থাকবো ওকে? এখন আসি বাই।”
“নাস্তা তো করে যা।”
“না মা বাহিরে করে নিবো।”
.
পরশ বের হয়ে যেতেই পরী মৃদুলার রুমে নাস্তা নিয়ে ঢুকে।
“তো ভাবিমনি ভালো আছো তো?”
পরী দড়জায় দাড়িয়ে দুষ্টুমির হাসি ঝুলায় ঠোঁটে। মৃদু পরীকে বলে-
“তোমার ভাই থাকতে খারাপ থাকার প্রশ্নই উঠেনা।”
পরী গেট লাগিয়ে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মৃদুকে। পরীর খুশি উপলব্ধি করতে পারে মৃদু। পরী নিজের ভাইকেও ততটা ভালোবাসেনা যতটা মৃদুকে ভালোবাসে।
“আমি তোর জন্য অনেক খুশি রে মৃদুপাখি। প্রথমে তো ভেবেছিলাম ভাইয়া তোকে সত্যিই সত্যিই ডিভোর্স দিবে কিন্তু ভাইয়া তো আমাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে দিলো আর সাথে এত্তোগুলাআআআআআ ভালোবাসাও দিচ্ছে তোকে।”
“হুম তবে কেমন যেনো অদ্ভুত আচরণ করে মাঝে মাঝে। হয়তো কিছু লুকোচ্ছে আমার থেকে যেটা আমার জানা প্রয়োজন কিন্তু পরশ আমায় জানাচ্ছেনা।”
“ধুর বাদ দে তো। তুই ভালো আছিস এটাই আমার কাছে অনেক।”
“পরী একটা প্রশ্ন করি?”
“হুম কর।”
“জুনায়েদকে একটা চান্স দেয়া যায়না? মানছি একটা ভুল করেছে, সেটা নিজেই স্বীকারও করেছে সে। ও এখনো তোকে ভালোবাসে পরী, ওর চোখে মিথ্যা বলার আফসোস আর ভালোবাসা হারানোর ভয় দুটোই দেখেছিলাম আমি।”
পরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তখনি পিছনের দড়জা দিয়ে পরশ রুমে প্রবেশ করে। পরশ ভিতরে ঢুকলে পরী রুম থকে বের হয়ে যায়।
(মৃদু যেই রুমটায় আছে সেটা ষ্টোর রুম ছিলো। ষ্টোর রুমে দুটো দড়জা, পরশ বাগানের দিকের দড়জা দিয়ে এই ১সপ্তাহ মৃদুর রুমে এসেছে। পরশ যাওয়ার সময় গেট বাহির দিয়ে তালা লাগিয়ে দেয় আর চাবি নিজের কাছে রাখে।)
“মৃদুপাখি তাড়াতারি করে খাইয়ে দাওতো। আমি একটু বাহিরে যাবো কাজ আছে কিছু। তোমার কারণে বন্ধুদের সাথে দেখা কিংবা ভালোভাবে কথাও বলা হয়নি এখনো, আবার মাকে মিথ্যাও বলে আসলাম যে বন্ধুদের সাথে ছিলাম তাই ওদের সাথে দেখা করে সব ঠিক করেই চলে আসবো।”
“আমার কারণে? আমি বলেছিলাম বুঝি তোমায়, আমার কাছে পরে থাকতে? আজকেই শেষ দিন, তুমি আর আমার রুমে আসতে পারবেনা?”
“রাগ করোনা মৃদুপাখি প্লিজ। মাকে যেটা বলেছি সেটা সত্যি করে আসি আগে। ফোনে বলেছি তাই সব একটু দেখে আসতে হবে তো।”
“আমি যাবোনা তোমার সাথে। তুমি বাকীদের নিয়ে যাবে।”
“তুমিই তো সব মৃদুপাখি। তোমার জন্য কিছু না বলা সত্য অপেক্ষা করতেছে যেটা আমি এই ভ্রমণে জানাবো তোমায়।”
“এভাবে কেনো বলতেছো? আমার খুব ভয় করতেছে পরশ প্লিজ আমি যাবোনা।
“প্লিজ এটা নিয়ে আর কথা বলবে না তো। আমরা সবাই যাবো।”
“ওকে।”
পরশ নাস্তা করে বের হয়ে যায়। মৃদু পরশের দেয়া কাপড় পরে নিজের মতো করে হাত-পা ও বাকী অংশগুলোতেও মালিশ করে। মৃদু ঔষধ না খেয়েই শুয়ে পরে সাথে ঘুমিয়েও যায়। ইদানিং ঘুম যেনো চোখে জেঁকে বসেছে মৃদুর। পরশ প্রায় ৩ঘন্টা পরে আসে দেখে মৃদু ঘুমিয়ে আছে। ঔষধের পাতা চেক করে দেখে ঔষধ খায়নি মৃদু। অনেক বেশিই কেয়ারলেস মেয়েটা।
“মৃদু!!! মৃদু গেট আপ। তুমি খুব পঁচা মৃদু। আমার কথা শুনোনা। উফ্ উঠো তো।”
“আর ৫মিনিট প্লিজ।”
“তোমার কাকিমা তোমাকে ডাকতেছে উঠো।”
‘কাকিমা’ শুনেই লাফিয়ে উঠে মৃদু। পরশ তো হাসতে হাসতে শহীদ হয়ে যাবে অবস্থা।
“এতো ভয় পাও তুমি মাকে?”
মৃদু মাথা নিচু করে রাখে। পরশ মৃদুর দুই গালে হাত দিয়ে বলে-
“সব রেডি মৃদুপাখি। আমি বিকেলে মা-বাবাকে জানিয়ে দিবো যে আমরা ট্যুরে কালকেই যাবো।”
“কালকে।?”
“হুম কালকে। আন্বিষ আর আশনি জানে, পরীকে আর সুমেন ভাইকে ব্যাগ প্যাক করতে বলতে হবে। তুমিও করে নিও। মৃদুপাখি…..”
“হুম।”
“ভালোবাসি।”
মৃদু কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে থাকে। পরশ মৃদুর কপালে অধর ছুঁইয়ে বের হয়ে যায়।
.
.
“তোরা যাবি যা আমি মানা করবোনা কিন্তু মৃদুলা এ বাড়ির বাহিরে পা রাখবেনা। তোদের ডিভোর্সের পরে সুমুকে বিয়ে করে ওর যেখানে খুশি যেতে পারবে তার আগে না।”
“তুমি কি মৃদুর সাথে সুমেনের বিয়ের কথা বলছো? ওদের বিয়ে দিবে তুমি?”
“হ্যাঁ কেনো নয়? আর সুমেন মানে কি? ওর তোর বড়, খালাতো আবার চাচাতো ভাই ও।”
“মা….. আমি তোমাকে আমার ডিসিশন জানিয়েছি। তোমার কাছে কিন্তু আমি অনুমতি নিতে আসিনি আর সুমেন ভাই ও যাবে আমাদের সাথে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে যাস নিয়ে।”
.
.
সকাল ৭টা বাজে।
৬টার সময় পরশ মৃদুর রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে গিয়েছিলো।
সবাই বের হবে তাই গাড়ির পাশে দাড়িয়ে আছে মৃদুর জন্য। মৃদু এখনো বের হয়নি, আর না গেট খুলেছে। পরশের মেজাজে দুই কেজি ঝাল মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে মৃদু। সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১০মিনিট পর বের হয় মৃদু। মৃদুকে দেখে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম পরশের। চেহারায় পরিবর্তন হয়েছে সে জানে কিন্তু নীল শাড়িতে অপরুপা লাগছে তার মৃদুকে। আন্বিষ তো মৃদুকে কীভাবে পটাবে সেটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণায় লেগে গেছে। আশনির মুখে রহস্যের হাসি। অনুভূতিহীন দুজনও মৃদুকে দেখে অনেক খুশি আর তারা হলো সুমেন আর পরী। পরী মৃদুর বলা কথাগুলো নিয়ে ব্যস্ত। জুনায়েদকে দেয়া যায় কি একটা চান্স? অনেক অপমানিত হওয়ার পরেও বেহায়ার মতো শুধুমাত্র সরি বলতে শতবার চেষ্টা করেছে সে। আর সুমেন তার প্রিয়তমাকে ভুলতে না পারার কষ্ট নিয়ে হাসি মুখে সবার সামনে নাটক করতে ব্যস্ত। নিজের কষ্ট অন্যকেউ কে দেখালে সে সুযোগ নিতে পারে, তাই সে কখনো কোন বন্ধুর সাথে নিজের কষ্ট বিনিময় করেনি, মৃদু কিছুটা জানলেও পুরোটা জানায়নি সুমু।
এই ট্রিপ সবার জীবনে অনেক বড় পরিবর্তন আনবে যেটা সম্পর্কে কেউ-ই অবগত নয়। কেউ নিজের অতীত ফিরে পাবে তো কেউ হয়তো নিজের বর্তমানটা হারাবে।
.
বাসের সামনে দাড়িয়ে আছে মৃদু। ওরা ৬জনসহ আরো ২১জন যাবে তাই বাস নিয়েছে যেনো সবাই ভ্রমণ উপভোগ করতে পারে। গন্তব্য সিলেট।
.
সবাই নিজেদের আসন গ্রহন করে। পরী জানে তার ভাই মৃদুকে ছাড়বেনা তাই একা বসে পরে। ওর পাশে কেউ এসে বসলে চোখ তুলে তাকাতেই ঝাটকা খায়।
“জুনায়েদ”(চোখ বড় করে তাকায় পরী)”।
.
সুমুর মন ভালো নেই। পাশে কে বসেছে তাকে দেখার তো বিন্দুমাত্র ইচ্ছার ই ও নেই। কারো কথার আওয়াজে বিদ্যুৎ গতিতে চমকায় সুমু।
“কুহেলী?”(সুমুর বিশ্বাস যেনো মুহুর্তেই জানালা দিয়ে পালাতে চায়। এটা কি সত্যিই সম্ভব?)
.
.
“মৃদু!!”
“হুম”
“সরি”
“কেন?”
“তোমায় ভুল বোঝার জন্য।”
“কি ভুল বুঝেছিলে?”
“আমি দেড়বছর এটাই জানতাম যে তুমি সুমেন ভাইকে ভালোবাসো।”
“মানে?”(চোখ বড় তাকায় মৃদু)।
.
চলবে-