কান্তা মনি পর্ব -০৪

#কান্তা_মনি
#পর্ব_৪
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

কান্তা মনি ছলছল চোখে একবার নিয়াজের দিকে তাকিয়ে পালঙ্ক থেকে উঠে যেতে নিতেই নিয়াজ ঘপ করে কান্তার হাত এক টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।
-এই মনে শুধু মাত্র আমার কান্তামনির বসবাস বুঝেছো তুমি? (গম্ভীর মুখ করে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)

হাল্কা কেঁপে ওঠে কান্তা মনি। অভিমান ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে নিয়াজের দিকে।
-তা বেগম সাহেবা আপনি মেহরিনকে কিভাবে চিনলেন? আর সে যে কেমন সুন্দর তাও বা কিভাবে জানলেন? তাকে তো আপনি দেখেননি কখনো। (হালকা হেসে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
-আজকে সে এ বাড়িতে এসেছিল। (মুখে বিষন্নতা ফুটে ওঠে কান্তা মনির)
ভ্রু কুচকায় নিয়াজ মির্জা।
-কিছু বলেছে কি তোমাকে? মুখটা এভাবে আচমকা ভার করে ফেললে কেন কান্তা মনি? (নিয়াজ মির্জা)
ছলছল চোখে দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ সূচক ইঙ্গিত দেয় কান্তা।
-তবে চোখে অশ্রু টলমল করছে কেন প্রিয়তমা? কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো। (দুহাতের মাঝে কান্তা মনির মুখ নিয়ে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
-বাবার কথা মনে পড়ছে। বাড়ির কথা মনে পড়ছে । সখীদের কথা মনে পড়ছে ।(থেমে থেমে বলে ওঠে কান্তা মনি)
নিয়াজ মির্জা মুচকি হেসে বলে ওঠে,
-বোকা মেয়ে একটা। কাল তো এমনিই তোমাদের বাড়িতে যাব। তখন সবার সাথে দেখা করে নিয়ো। তোমার যখন যা মন চায় করো দ্বিধাবোধ করার দরকার নেই ।
-আচ্ছা। আম্মা আপনার সাথে কথা বলেছে? (কান্তা মনি)
-হ্যা সন্ধ্যা বেলা আম্মার কক্ষে গিয়েছিলাম। কথা হয়েছে। (নিয়াজ)
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কান্তা।

-রাত বেশ হয়েছে কান্তা মনি ঘুমিয়ে পড়। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া ভালো। আমি হারিকেনের আলো নিভিয়ে আসি। (নিয়াজ মির্জা)
কান্তা সুরসুর করে পালঙ্কের ওপরে গিয়ে দু বালিশের মাঝে কোলবালিশ রেখে প্রাচীর তৈরি করে শুয়ে পড়ে। যুবক তা দেখে দুষ্টু হেসে মাথা ঝুলাতে ঝুলাতে আলো নিভিয়ে পালঙ্কের দিকে অগ্রসর হয়।

পরদিন সকলকে বিদায় জানিয়ে কান্তা মনিকে নিয়ে নিয়াজ মির্জা রওনা হয় কান্তা মনির বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। পালকি রমিজ হাওলাদারের ভিটের সামনে এসে থামতেই এক মুহূর্ত দে্রি না করে পালকি থেকে নেমে পড়ে কান্তা মনি।

প্রাণ প্রিয় মেয়েকে দেখে চোখের পানি সামলে রাখতে পারেন না রমিজ হাওলাদার। বুকে আগলে নেন মেয়েকে যেন কত বছর পর মেয়ের দেখা পেয়েছেন তিনি।
-মারে কেমন আছিস মা? (রমিজ হাওলাদার)
-এইতো আব্বা এখন অনেক ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? (কান্তা মনি)
-তোরে ছাড়া কেমন থাকতে পারি আমি বল ? (রমিজ মিয়া)
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে কান্তা মনি।
-মারে আমার ওপর রাগ কইরা থাকিস না। আমি তোর মতের বিরুদ্ধে যাইয়া তোর বিয়া দিছি। কি করব বল? তোর প্রতি করা অত অন্যায় তো আমি ঠেকাতে পারতাছিলাম না। আমি তো তোর ব্যর্থ বাপ। তুই যাতে ভালো থাকিস তাই জমিদার পুত্র বিয়ার প্রস্তাব দিতেই আর না ভাইবা হ্যা বইলা দেই। (রমিজ হাওলাদার)
-না আব্বা আমি একটুও রাগ করে নেই। ওনার মতো মানুষ হয় না আব্বা। (চোখের পানি মুছে বলে ওঠে কান্তা মনি)

-এইযে আমিও কি একটু জায়গা পাবো? নিয়াজ মির্জা)
বাবা-মেয়ে দুজনেই হেসে ওঠে।
কক্ষ হতে রাহেলা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন।
-আরে বাবু মশাই আপনারা এসে পড়েছেন! ও রজনীরে তাড়াতাড়ি চুলোয় জ্বাল ধরা। (রাহেলা)
রাহেলা বেগম কান্তার দিকে অগ্রসর হয়ে তাকে বাহুডোরে আগলে নেয়।
-কেমন আছিস মা? (রাহেলা)
কান্তা মনি অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করছে। ে সে কার রূপ দেখছে। আগেতো রাহেলা বেগমের এমন রূপ কখনো দেখেনি কান্তা।
-ভালো। (আমতা আমতা করে জবাব দেয় কান্তা)
ভেতর থেকে রজনী দৌড়ে এসে কান্তাকে জড়িয়ে ধরে। একের পর এক চমক যেন রমিজ হাওলাদার এবং কান্তা মনিকে অবাক করে তুলছে। কান্তা মনি বিস্ময়ে কিংকররব্যবিমূঢ়।
-তোরে অনেক মনে পড়তাছিলরে কান্তা। (রজনী)
জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে কান্তা বলে ওঠে,
-আমারও অনেক মনে পড়ছিল।

যুবক কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। সে যে রাহেলা আর রজনীর উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে।

-আব্বা বলেছিল একবার গ্রাম দর্শনে যেতে। আমি একটু বের হচ্ছি। (নিয়াজ মির্জা)
-সে কি এখনই বের হয়ে যাবে? আগে একটু বিশ্রাম করুন ,কিছু খেয়ে নিন বাবু মশাই। (রমিজ হাওলাদার)
-আমাকে বাবু মশাই ডাকবেন না। আমিতো আপনাদের পুত্রের মতোই তাইনা? ঘন্টা দুই/তিনেক পর এসে বিশ্রাম নেব। তারপর সবাই একসাথে খানাপিনা করব গল্পের আসর বসাবো। এখন আসি।(নিয়াজ মির্জা)
স্থান ত্যাগ করে নিয়াজ মির্জা।

-হ্যারে কান্তা তুইতো দেখি এক/দুদিনের মধ্যেই কত সুন্দর কইরা কথা বলা রপ্ত কইরা ফেলছিসরে। (রজনী)
স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ায় কান্তা।
-ঢং! (রাহেলা মুখ ভেঙ্গচি কাটেন)

রমিজ হাওলাদার স্ত্রীর এমন কান্ড দেখে বেজায় দুঃখ পান। রাহেলার দিকে গরম চোখে চেয়ে থাকেন। রাহেলা তা লক্ষ্য করে আস্তে একটা ঢোক গেলে।

-আরে সরদার বাড়িতে কার পা পড়ল! ভেতরে আসো নিয়াজ, বসো একটু। (মেহরিন)
-আমিতো বসতে আসিনি মেহরিন। আগে বলো তুমি কেন গতকাল জমিদার বাড়িতে গিয়েছিলে? (নিয়াজ মির্জা)
-আমিতো নূর জাহান খালার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম নিয়াজ। (মেহরিন)
-তুমি কি বলেছো কান্তা মনিকে? আমাকে একজন দাসী বলল, তুমি নাকি তাকে অপমান করেছ? (নিয়াজ)
-কান্তা মনি কে? ওহ তোমার বেগম! হাহা বেশ করেছি অপমান করেছি। কি যোগ্যতা আছে ওর তোমার বেগম হবার? তোমার যোগ্য একমাত্র আমি, এই মেহরিন। (মেহরিন)
-মুখে লাগাম দাও মেহরিন। সতর্ক করে যাচ্ছি তোমাকে। তোমাকে যেন আর জমিদার বাড়িতে না দেখি। বিশেষ করে আমার বেগমের আশেপাশে ঘেষার চেষ্টাও করবে না তুমি। ভালো করে তোমার মাথায় ঢুকিয়ে রেখো। (নিয়াজ মির্জা)
-কি ব্যাপার নিয়াজ তুমি মেহরিনকে এভাবে কথা শোনাচ্ছো কেন? (মারজান সরদার)
-তা আপনার আদরের কন্যাকেই জিজ্ঞাসা করুন। আসছি। (নিয়াজ মির্জা)
নিয়াজ সরদার বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেই মেহরিন ক্রধান্বিত হয়ে পাশে থাকা ফুলদানীটা মেঝেতে ছুড়ে মারে।

-গলার হারডা তো সোনার তাইনা কান্তা? (রাহেলা)
-হ্যা মা। (কান্তা মনি)
-সবই তো তোর কপালরে। বলছি কি রজনীর তো কয়দিন পর বিয়া দিমু। তোর এই হারটা তো রজনীরে দিতে পারিস। সৎ হোক তবুও তো তোর বোন হয় তাইনা? তুই তো এরকম হার অহরহ থাকব। জমিদার পুত্রের বেগম বইলা কথা! (রাহেলা)
কান্তা মনি এক পলক তার গলায় পরিহিত সোনার হারের দিকে তাকিয়ে তাতে হাত বুলায়। এটা যে তার স্বামীর দেওয়া প্রথম হাদিয়া। এটা সে কিভাবে অন্য কাউকে দেবে?
-এই হার তো কান্তা মনির। এই হার রজনীকে কেন দিতে হবে। রজনীর বিয়ের সময় আমি তাকে ভারী গহনা গড়িয়ে দেবো। এই হার নিতে হবেনা। (নিয়াজ মির্জা)
খুশির ঝলকানি ফুটে ওঠে রাহেলার সারা মুখে।
-আচ্ছা বাবা।
-আপনাদের যখন যা দরকার হবে আমার কাছে খবর পাঠাবেন। কখনো দ্বিধাবোধ করবেনা না। (নিয়াজ মির্জা)
-আচ্ছা বাবা আচ্ছা। (রাহেলা)
কান্তা বিরক্তি নিয়ে রাহেলার দিকে তাকায়।

জ্যোস্না রাত। আকাশে একফালি চাঁদের চারিপাশে হাজার হাজার তারকা মিটমিট করে জ্বলছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে কান্তা-নিয়াজ সম্পতি। দুজনের মাঝে একহাত দূরত্ব। শান্ত মৃদু বাতাসের সাথে নদীর জলের কলকল ধ্বনি পরিবেশকে অসম্ভব সুন্দর একটা রূপ দিয়েছে। এ রূপ যে চোখে দেখা যায় না, এ রূপ যে অনুভব করে উপলব্ধি করতে হয়।

কান্তা মনি আড়চোখে নিয়াজের দিকে তাকায়। এ সুদর্শন সাহসী পুরুষ তার স্বামী! তার যে নিছক স্বপ্ন মনে হয়। একটা মানুষ এতটা ভালো কিভাবে হতে পারে? এই যুবক যে তাকে ধীরে ধীরে মুগ্ধ করে তুলছে। তবেকি সে বন্দি হয়ে হতে চলেছে এই যুবকের ভালোবাসার বন্ধনে? তাও এত দ্রুত!

হঠাত দুজনেই উপস্থিতি উপলব্ধি করতেই একসাথে পেছনে ফিরে তাকায়। দ্রুত একটা ছায়া সরে যেতে দেখেই নিয়াজ কোমরে গুজে রাখা ছোট ছুরিখানা বের করে। নিয়াজের হাতে ছুড়ি দেখে আতকে ওঠে কান্তা। ভয়ে কিছুটা দূরে সরে যায় ।
-ভয় পেয়ো না। দ্রুত চলো এখানে আর এক মুহূর্ত ও থাকা চলবেনা। (নিয়াজ শক্তপোক্ত করে কান্তার হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে নিয়ে স্থান ত্যাগ করতে পা বাড়ায়)

হঠাত কাটাগাছের সাথে শাড়ির আচল বিধে যায় কান্তার। কিছুটা নুয়ে শাড়ির আচলটা ছাড়িয়ে নেয় কান্তা। নিয়াজ মির্জা কান্তার হাত টেনে নিয়ে আসেপাশে সাবধানতার সাথে চোখ বুলাতে বুলাতে স্থান ত্যাগ করে।

নদীর পাশে থাকা জঙ্গলের একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কেউ একজন ক্রধান্বিত হয়ে স্বজোড়ে হাতে থাকা তরোয়াল পাশের গাছের দিকে ছুড়ে মারে।

পরদিন সকাল সকালই কান্তা মনি পালকি চোড়ে পুনরায় নিজের নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ক্ষানিক বাদে বাদে ডুকরে ডুকরে কেদে উঠছে কান্তা মনি। মেয়েদের জীবন কতটা কষ্টের। জন্মের পর বাবার বাড়িকে নিজের বাড়ি হিসেবে চিনে বড় হতে থাকে, বিয়ের পর নতুন ঠিকানায় স্থানান্তর হওয়ার পর সে উপলব্ধি করে আসলে মেয়েদের নিজের কোনো বাড়ি নেই। জন্ম হয় বাবার বাড়িতে আর মৃত্যু হয় শশুড়বাড়িতে। কথাগুলো ভাবতেই আবারও ডুকরে কেদে ওঠে কান্তা মনি। বাবা-মা, আদরের ভাই-বোন কে ছেড়ে আসতে যে কতটা কষ্ট হয় তা একমাত্র মেয়েরাই জানে।

চলবে…

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here