কান্তা মনি পর্ব -২৩ ও শেষ পর্ব

#কান্তা_মনি
#পর্ব_২৩ (সমাপ্তি পর্ব)
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

-কান্তা…
মেহরিনকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ছুরি দিয়ে বারবার তার শরীরে আঘাত করতে থাকে কান্তা মনি।

-তোদের একটাকেও ছাড়ব না। (কান্তা মনি)

কক্ষে এসেই ধপ করে পালঙ্কের ওপর বসে পড়ে কান্তা মনি। হঠাত দ্বার খুলে কক্ষে প্রবেশ করে মুর্শিদা।

-কান্তা মনি ভাবিজান তু্মি এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলে? আমিতো একটু আগে কক্ষে এসে তোমাকে খুজে না পেয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। (মুর্শিদা)
-এখন আমার কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করবেনা মুর্শিদা ভাবিজান। সময় হলেই নিজেই সব কিছু বুঝতে পারবে। শুধু বলব তোমার এই বোনটার জন্য একটু দোয়া রেখো যেন সে তার উদ্দেশ্যে সফল হয়। (কান্তা মনি)

মুর্শিদা কান্তা মনির কথার আগামাথা না বুঝে বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
-আচ্ছা ঘুমানোর আগে এই দুধটুকু খেয়ে নাও তো। এই সময়ে নিজের অনেক খেয়াল রাখতে হবে। একদম বেখেয়ালিপনা করা যাবেনা। (মুর্শিদা)
-আচ্ছা। (কান্তা মনি)

মুর্শিদা একবার সারা কক্ষে চোখ বুলিয়ে বড় একটা নিশ্বাস টেনে কক্ষ ত্যাগ করে।

কান্তা মনি কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরের দিক তাকিয়ে থেকে হঠাত কান্না করতে করতে মেঝেতে বসে পড়ে। তার নিজেকে যে বড্ড শূণ্য শূণ্য মনে হচ্ছে।

ফজরের নামাজ পড়ে বাগানের দিকে হাটতে বের হয় কান্তা মনি। হঠাত ডালপালা বিশিষ্ট মোটা একটা গাছের দিকে তাকিয়ে চিতকার করে উঠে ছিটকে মাটিতে পড়ে যায় কান্তা মনি।

বাগানের দিক থেকে কারো বিকট চিতকার শুনে একজন দাসী দৌড়ে বাগানে ছুটে আসে। কান্তা মনিকে মাটিতে বসে থাকতে দেখে তার কাছে ছুটে যায় দাসী।

-বেগম আপনার কি হয়েছে? চিতকার করলেন কেন? আর এখানে এভাবে বসে আছেন কেন? (দাসী)
কান্তা মনি কিছু না বলেই টলমল চোখে হাতের আঙ্গুল দিয়ে গাছটির দিকে ইশারা করে তাকানোর জন্য।গাছের সাথে গলায় ফাঁস দেওয়ায় অবস্থায় বেগম নূর জাহানকে ঝুলে থাকতে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে যায় দাসীর।

চোখ খোলা। নিষ্প্রাণ ফ্যাকাসে মুখ। বেগম নূর জাহানের খোলা ওই স্থির চোখ জোড়া যেন কত কিছু বলতে চায়।

একের পর এক হত্যা,আত্মহত্যা গ্রামে একপ্রকার ঝড় তুলে দিয়েছে প্রজাদের মাঝে। তাদের মাঝেও আতংক ছড়িয়ে গেছে। ভোরে একদল পথিক গ্রামের বড় গাছের কাছ থেকে যাওয়ার সময় মেহরিনের লাশ খুজে পায়। মেহরিনের মৃত্যুতে গ্রামবাসীর মনে যতটা না ভয় জমেছে তার থেকেও বহুগুণ ভয়ে জমে আছে আর আতংকিত হতে আছে শাহ,সুলতান মির্জা, নওশাদ, আহসান মির্জা।

বেগম নূর জাহানের লাশের পাশে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছে কান্তা মনি। বেগম নূর জাহানের মতো এমন গম্ভির আর বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বের মানুষ করবে আত্মহত্যা! তাকে যে হত্যা করা হয়েছে তা কান্তা মনির অজানা নয়। আর কারা করেছে তাও জানে কান্তা মনি। নিশ্চয়ই বেগম নূর জাহান এমন কিছু জেনে গিয়েছিল যে তাকে সরিয়ে দিয়েছে ওই পশুগুলো। বেগম নূর জাহানের মতো একজন বিচক্ষণ মানুষ কোনো সূত্র রেখে যান নি? কান্তা মনির মন খচখচ করছে ব্যাপারটা নিয়ে। বুকটা খা খা করছে কান্তা মনির। মানুষটা তাকে একদম নিজের মেয়ের মতো ভালো বেসেছে। কত খেয়াল রেখেছে তার। কিন্তু শেষে এসে সে পারল না বেগম নূর জাহানকে বাচাতে? মেহরিন তাহলে এইজন্যই অত রাতে জমিদার বাড়ি ছেড়েছিল! এবার যেন কান্তা মনির কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার।কান্তা মনি পাশে ফিরে তাকায়। হেতিজা মেহেরুন্নেছাকে জড়িয়ে ধরে করুণ সুরে কান্না করছে। বড্ড মায়া হচ্ছে মেয়েটার জন্য। ভাইয়ের মৃত্যু,মায়ের মৃত্যু। কিভাবে সে নিজেকে সামলাবে? কান্তা মনির নিজেরই তো নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু এবার সে একে একে শেষটা দেখেই ছাড়বে। কান্তা মনি হেতিজার হাত টেনে নিয়ে তার সম্মুখে বসায়। থুতনি ধরে হেতিজার চোখের দিকে তাকায় কান্তা মনি।

-এই মেয়ে আমার দিকে ফেরো। (কান্তা মনি)
ভেজা চোখে কান্তা মনির দিকে তাকায় হেতিজা।
-সারাজীবনের জন্য কষ্টের উদ্দেশ্য করা কান্নাকে থামিয়ে দাও। এখন থেকে কান্না করবে কিন্তু সেটা হবে সুখের কান্না বুঝেছো?(কান্তা মনি)

কান্তা মনি হেতিজাকে জড়িয়ে ধরে তার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
-এটা আত্মহত্যা না হেতিজা বুবু। আমাদের বিচক্ষণ আম্মজান কিছুতেই আত্মহত্যা করতে পারেনা। তোমার ভাইজানের মতো আর আমার আব্বাজানের মতো আমাদের আম্মাজানকেও হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা এর শেষ দেখেই ছাড়ব। চোখের পানি মুছে নাও।

হেতিজা এক পলক তার আম্মাজানের দিকে তাকিয়ে সন্তপর্ণে চোখের পানি মুছে নেয়।

কক্ষের মধ্যে এ মাথা হতে ও মাথা হাটা-চলা করছে কান্তা মনি। হঠাত দ্বার খুলে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করে শাহ আহসান মির্জা। আচমকা কক্ষে আহসান মির্জার প্রবেশ দেখে বেশ চমকে যায় কান্তা মনি।

-আপনি এখানে? (কান্তা মনি)

আহসান মির্জা তেড়ে এসে আচমকা কান্তা মনির গলা চেপে ধরে।
-তুই মেহরিনকে মেরেছিস তাইতো? ওহ “তাইতো” বলছি কেন? তুই ই তো মেরেছিস। তাহলে তো তুই সবই জানিস দেখছি। (আহসান মির্জা)

বেশ জোরেই গলা চেপে ধরায় গলা বিষ ব্যথা হয়ে আসছে কান্তা মনির।
-তোদের মতো নরপশুদের বেচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। তোরা সবাই বিশ্বাসঘাতক। একে একে সবার অবস্থা ঠিক মেহরিনের মতো হবে। আম্মাকেও তোরা মেরেছিস তাইনা?(তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে কান্তা মনি)

-হুম। বেটির বহুত তেজ যে! এখন তোর পালা। (বলেই মাজার কাছ থেকে একটা ছুরি বের করে কান্তা মনির দিকে তাক করে শাহ আহসান মির্জা)

হঠাত বিকট শব্দে আর্তনাদ করে ওঠে শাহ আহসান মির্জা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে মাথার পেছনে হাত রেখে ধীরে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আহসান মির্জা।

এহেন মুহূর্তে কান্তা মনি অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে। কান্তা মনি সামনে তাকাতেই থমকে যায়। রেহানা হাতে রক্তে মাখা দা নিয়ে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।

-ভাবিজান! (অবাক কন্ঠে বলে ওঠে কান্তা মনি)

রেহানার হাত থেকে দা টা পড়ে যায় মেঝেতে। ঠোট কামড়ে কান্না চাপিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করে মেঝেতে হাটু ভেঙ্গে বসে পড়ে রেহানা।

কান্তা মনি ছুটে গিয়ে রেহানার পাশে বসে পড়ে তাকে জাপটে ধরে।
-ভাবিজান তুমি এটা কিভাবে করলে? (কান্তা মনি)
-কি ভেবেছো আমি কিছুই জানিনা? আজ কত বছর ধরে এদের এই হিংস্রতা দেখে আসছি। এই নরপশুর সাথে সংসার করতে করতে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কতো অন্যায় করেছি এই নরপশুদের পাল্লায় পড়ে। এদের বাচার কোনো দরকার নেই কান্তা মনি। এদের এত অন্যায় দেখতে দেখতে আজ পারিনি চুপ করে থাকতে। একদম সারাজীবনের জন্য হিংস্রতা নিভিয়ে দিয়েছি এর। (চোখের পানি মুছে নেয় রেহানা) কান্তা মনি তুমি বাইরে গিয়ে আসেপাশে থাকা রক্ষিদের একটু কোনো কাজে পাঠিয়ে দাও। আমি এদিকে লাশ সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করি। কান্তা মনি মাথা নাড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে গিয়ে কক্ষের বাইরে চলে যায়।

পরের দিন নদীর কিনারায় শাহ আহসান মির্জার লাশ পাওয়া যায়। এবার আহসানের মৃত্যু যেন একেকটা বিশ্বাসঘাতকদের হাটু কাপিয়ে দিয়েছে।
নির্বাক হয়ে লাশের দিকে তাকিয়ে আছে রেহানা। ছোট রোদেলা ফ্যালফ্যাল করে আর আব্বার ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এত বছর সংসার করার পরেও রেহানার যেন ঘৃণা ছাড়া একবিন্দু পরিমাণও মায়া আসছে না ভেতর থেকে।

বেগম নূর জাহানের কক্ষের আলমারি খুলে তাকের ওপর একটা ভাজ করা কাগজ পেয়ে তা হাতে নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করে কান্তা মনি। বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে সকল কথাই যে চিঠিতে লিখে গেছেন বেগম নূর জাহান। অতিবিশ্বাসী মানুষদের থেকেও দূরে থাকতে বলেছেন বেগম নূর জাহান। চিঠিতে বারবার একজন মহিলার কথা উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু তার নামটা উল্লেখ করেননি। কান্তা মনির ভ্রু কুচকে আসে। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে বসে কার কতটুকু আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে? হয়ত সে জন্যই নামটা উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন বেগম নূর জাহান। কিন্তু কান্তা মনি এটুকু বুঝে গেছে এই সকল ষড়যন্ত্রের মূলে ওই ষষ্ঠ ব্যক্তি। বেগম নূর জাহানকে যে বিষ দেওয়া হয়েছিল এ কথাটা মস্তিষ্কে গিয়ে পৌছাতেই রাগে চোখ বন্ধ করে নেয় কান্তা মনি। চিঠিতে একটা পাতালঘরের উল্লেখ আছে। কিন্তু সে তো কখনো এই পাতালঘরের কথা শোনেনি! চিঠিটা শাড়ির আচলের মাঝে লুকিয়ে নিয়ে কক্ষ হতে বের হতে নিতেই নওশাদ আর শাহ সুলতান মির্জা হাজির হয়। ঠাস করে কান্তা মনির গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় নওশাদ।

-এত বড় সাহস তোর! সাহস তো বেশ বেড়ে গেছে দেখছি। দুই দুইটা হত্যা করে ফেলেছিস! তোকে শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি বাচতে চাইলে চুপ করে থাক। নাহলে কি হতে পারে বুঝতে পারছিস নিশ্চয়ই? (তেড়ে এসে বলে ওঠে নওশাদ)

-নওশাদ তুই একে ছেড়ে দিচ্ছিস কেন? ও আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। ওকে তো আমি ছাড়ব না। (ক্ষেপে যান শাহ সুলতান মির্জা)
-মামা ওখানেই থেমে যাও। ব্যাপারটা আমি বুঝব। তুমি যাও ঘুমাও কক্ষে গিয়ে। (নওশাদ)

সুলতান শাহ স্থান ত্যাগ করতেই নওশাদ কান্তা মনির মুখের ওপর ঝুকে বলে ওঠে,
-এখনো বলছি থেমে যাও। আমি কিন্তু তোমাকে বাচিয়ে রেখেছি। সব যদি মেনে নাও তাহলে তোমারই লাভ। এই নওশাদ তোমাকে দিলের রাণী করে রাখবে। এই প্রথম নওশাদ কোনো রমনীর রূপে মোহিত হয়ে তাকে সুযোগ দিলো শত অপরাধ থাকার পরেও।

কান্তা মনি ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে “ছিহ” বলে ওঠে। নওশাদকে ধাক্কা দিয়ে কক্ষ হতে বের হয়ে যায় কান্তা মনি।

কক্ষে এসে এ মাথা হতে ও মাথা পায়চারী করতে থাকে কান্তা মনি। পাতালঘরে কি এমন লুকিয়ে আছে? পাতালঘরের সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই তাকে শাহ সুলতান মির্জা আর নওশাদের ওপর নজর রাখতে হবে। কিন্তু এই ষষ্ঠ মানুষটা কে হতে পারে?

-কান্তা মনি আমাকে মেরো না। তোমার পায়ে পড়ি মেরো না আমাকে। ওগো শুনছো মেহরিনের মা! আমাকে বাচাও। তুমি ওভাবে দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এই মেয়ে আমাকে মেরে ফেলবে। আমার বাধন খুলে দাও। (মারজান সরদার)

স্বামীর নিষ্ঠুরতার কাহিনী শুনে পাথরের ন্যায় জমে দাঁড়িয়ে আছে মারজান সরদারের বেগম।

-ছিহ! আপনি মানুষ নাকি পশু। এত ক্ষমতার লোভ? বিশ্বাসঘাতক আপনি। আমাদের মেয়েটাকে বিগড়ে ফেলেছিলেন আপনি। ওর মৃত্যুর জন্যও আপনি দায়ী। ওমন মেয়ে আর আর আপনার মতো মানুষকে মরে যাওয়াই উচিত। তাতে পৃথিবীতে পাশবিকতা কমে যাবে। মেরে ফেলো একে কান্তা মনি। (বলেই কান্না করতে করতে কক্ষের দ্বার বন্ধ করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দাড়ান মারজান সরদারের বেগম)

কান্তা মনি পুনরায় মারজান সরদারের মুখ বেধে দেয়।

কিছুক্ষণ আগে…
ঘুম থেকে উঠেই হাত-পা-মুখ বাধা দেখে চমকে যায় মারজান সরদার। সামনে তাকাতেই কান্তা মনিকে দেখে ভয়ে কুকড়ে ওঠে মারজান সরদার। তলোয়ারের ধারালো অংশ মেঝেতে ভর করে তার ওপর থুতনি ঠেকিয়ে শক্ত চোখে মারজান সরদারের দিকে তাকিয়ে আছে কান্তা মনি। তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার বেগম।

বর্তমানে…

-চিতকার কর। সবাইকে ডাক। বল তুই কি করেছিস যার জন্য কান্তা মনি তোকে হত্যা করতে এসেছে। কি পারছিস না তো চিতকার করতে? তা কই গেল তোর সেই গর্জে ওঠার ক্ষমতা? কই গেল সেই পাশবিকতা? সব হারিয়েছিস এখন? (কান্তা মনি)

বাচার জন্য ছটফট শুরু করে দেয় মারজান সরদার। কান্তা মনি তা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তলোয়ার কায়দা করে ধরে নিয়ে মারজান সরদারের দিকে অগ্রসর হয়। তলোয়ারটা মারজান সরদারের গলা বরাবর বসিয়ে দেয় কান্তা মনি।

-আলবিদাহ। (বলেই হনহন করে কক্ষ হতে বেরিয়ে যায় কান্তা মনি)

কান্তা মনিকে বেরিয়ে যেতে দেখে কিছুক্ষণ পরে মারজান সরদারের স্ত্রী ধীর পায়ে হেটে গিয়ে কক্ষে প্রবেশ করেন। স্বামীর নিথর দেহ পালঙ্কের ওপর পড়ে থাকতে দেখে মেঝেতে হাটু ভেঙ্গে বসে ডুকরে কেদে ওঠেন তিনি। নারীকে যে পরিস্থিতি মোতাবেক চলতে হয়। কখনো কোমল হতে হয় তো কখনো তাকে কঠোর রূপ ধারণ করতে হয়।

দুদিন ধরে নিখোজ শাহ সুলতান মির্জা। জমিদার বাড়ির হাল যেন বেশ করুণ। শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা যে সে কবেই বিছানায় পড়েছেন। জমিদার বাড়ির হাল ধরার মতো যে তেমন কেউই নেই। না পেরে শাহ মহাশিন মির্জাকেই হাল ধরতে হয়েছে জমিদার বাড়ির।

সময়টা বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব। এই সময়ে বাড়িতে কোনো পুরুষই থাকেনা। এই সুযোগেই কান্তা মনি রেহানা আর হেতিজাকে দিয়ে কিছু দরকারি জিনিস সংগ্রহ করে নিয়ে একটা ব্যাগে ভরে নেয়। উদ্দেশ্য পাতালবাড়ির সন্ধান করা। জমিদার বাড়ির প্রতিটা ঘর তন্নতন্ন করে খুজেছেচ কান্তা মনি,হেতিজা,রেহানা আর মুর্শিদা। কিন্তু না কোথাও কোনো গুপ্ত রাস্তা পায়নি তারা।

জমিদার বাড়ির পেছনের বাগানের দিকে অগ্রসর হয় কান্তা মনি। বাগানের প্রায় শেষ প্রান্তের দিকে যেতে থাকে কান্তা মনি। এদিকটায় একটু জঙ্গল জঙ্গল ভাব থাকায় কখনো আসেনি সে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে অন্ধকার নেমে আসছে। থেমে গিয়ে ব্যাগের ভেতর থেকে হারিকেনটা বের করে জ্বালিয়ে নিয়ে আবার হাটা শুরু করে কান্তা মনি। বেশ উচু থেকে বড় বড় লতা মাটিতে এসে ঠেকে ঠেকে পুরো একটা প্রাচীরের মতো তৈরি করে নিয়েছে। এ যেন এক লতায় ঘেরা প্রাচীর। কাপা কাপা হাতে লতাগুলো দু দিকে ঠেলে দিয়ে বেশ অবাক ভঙ্গিতেই সামনে অগ্রসর হয় কান্তা মনি। সে তো কখনো কল্পনাই করেনি এদিকে এমন কিছু আছে। হাটার মাঝেই পায়ের নিচে শক্ত কিছু অনুভব করে কান্তা মনি। কিছুটা সরে দাঁড়িয়ে ওই স্থানে জমে থাকা লতাপাতা সরাতেই ভ্রু কুচকে আসে কান্তা মনির। একটা লোহার তৈরি ছোট দরজার মতো কিছু একটা। কান্তা মনি ভাবতে থাকে এটাই সেই পাতালঘরে প্রবেশের পথ নয়ত? দরজাটায় কোনো তালা দেওয়া নেই। হয়ত কেউ আছে ভেতরে। বুকটা কেমন যেন ধুকপুক ধুকপক করছে কান্তা মনির। মনে এক রাশ সাহস জমিয়ে নিয়ে পেটে একবার হাত বুলিয়ে দরজা খুলে সিড়ি বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে কান্তা মনি।

শাহ সুলতান মির্জার গলায় তলোয়ার চালানোর পর মুহূর্তেই কান্তা মনি সিড়ি বেয়ে পাতালঘরে প্রবেশ করে।

-ফুফুমনি! (কান্তা মনি)
পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠ পেয়ে হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দিয়ে পেছনে ঘুরে তাকায় মেহেরুন্নেছা।
-কান্তা মনি তুমি এখানে? (অবাক চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে মেহেরুন্নেছা)
-তাহলে সেই ষষ্ঠ ব্যক্তি আর কেউই না আপনি ফুফুমনি? (কান্তা মনি)
-জেনেইতো গেছো তাহলে জিজ্ঞাসা করছো কেন? (তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে মেহেরুন্নেছা)
-ছিহ ফুফুমনি এমনটা কিভাবে করতে পারলেন আপনি? (কান্তা মনি)

-যেমনটা ভাবে আমার জীবনটা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল এই মানুষগুলো। বিয়ে দিয়েছিল এমন একজনের সাথে যে কিনা ঘরে বউ রেখে তার বিয়ের আগের ভালোবাসার কাছে ছুটে যায়। আর সেই মেয়েটা যখন আমার ভাবিজান তা জানার পরে আমার ঠিক কেমন লাগে বোঝো? পরে ষড়যন্ত্র করে মুঞ্জিলা আর নুরুলকে ফাসিয়ে দেই। নুরুল খুন হয় আর মুঞ্জিলা পাগল হয়ে যায়। কিন্তু এই ঘটনা জানতে পেরে যায় ওই বুড়ি নূর নাহার। বাধ্য হই ওই বুড়িকে তিলে তিলে শেষ করতে কারণ সব সময় নূর নাহার আমাকে খোটাতো। কবিরাজের থেকে একটা বিষাক্ত পদার্থ নিয়ে আসি, যা নূর নাহারের খাবারের সাথে মিশিয়ে খাইয়ে খাইয়ে ওর বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতাটুকু কেড়ে নেই। এত বছর ভোগাতে ভোগাতে ভাবলাম আর কত কষ্ট দেব? এবার নাহয় চিরতরে কষ্টটা কমিয়ে দেই। জানতে পারি এই জমিদার বাড়ির যে সদস্য জমিদারী দায়িত্ব পায় তাকে নাকি একটা মূল্যবান হীরা সংরক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়। যেটার ব্যাপারে একমাত্র এপর্যন্ত যারা জমিদারী দায়িত্ব পায় তারাই জানে। এই বাড়ির আর কেউ এখন পর্যন্ত এই হীরার সম্পর্কে জানেনা। জাহাঙ্গীর ভাইজানকে যখন আব্বা ওই হীরার ব্যাপারে সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলো তখন আমি শুনেই নেই। ভেতরে ভেতরে ভিষণ লোভ জাগে। কিন্তু অনেক খোজার পরেও কখনো পাইনি। এই এদেরকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করি জমিদারী হাতানোর নাম করে। কিন্তু আমার আসল উদ্দেশ্য ওই হীরা। ভেবেছিলাম উদ্দেশ্য পর্যন্ত পৌছানোর পরেই এদের সরিয়ে দেব আমি আর নওশাদ মিলে। কিন্তু আমার কাজটা তো তুমি সহজ করে দিলে কান্তা মনি। বাকি ছিল এই সুলতান মির্জা। দিলাম এটাকে সরিয়ে। এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছি। নূর জাহান ভাবিজান সব জেনে যাওয়ায় তাকে সরাতে বাধ্য ছিলাম। খাবারে বিষ মিশিয়ে দেই। মরার পরেই লাশ টেনে নিয়ে আমি আর মেহরিন ওই গাছে ঝলিয়ে দেই। ভাইজানকে আর কি মারব? সে তো গেল গেল বলে। কিন্তু কথা হচ্ছে আমার ভাইপোটা বড্ড বেশি ঘাড় ত্যাড়া। বললই না হীরা কোথায়। এই একটা কথা শোনার জন্যই তো তাকে বাচিয়ে রেখেছি। সবার কাছে মিথ্যা নাটক সাজিয়েছি যে নিয়াজ মারা গেছে। এমন কি শাহ সুলতান মির্জাও জানতো না সেদিন নিয়াজকে না মেরে এখানে এনে রাখা হয়েছিল। এহ যাহ! সবই তো বলে দিলাম আমি। (মাথায় হাত রেখে জিহ্বা কামড়ে ধরে মেহেরুন্নেছা)

-আহা আম্মা! বলে দিলে সব? মজাটাই শেষ করে দিলে। (নওশাদ)

নিয়াজ বেচে আছে শুনে যেন বুকের মাঝের ধুকপুকানিটা বহু গুণ বেড়ে গেল কান্তা মনির। চোখ ছলছল করে উঠল। এতক্ষণ সে আসেপাশে তাকায়নি। পাশ ফিরে তাকাতেই চমকে যায় সে। এককোণে হাত-পা বাধা অবস্থাতে মেঝেতে পড়ে আছে নিয়াজ। মুখখানা একদম ফ্যাকাসে হয়ে আছে। পরিহিত পোশাকে যেন পাহাড় সমান ময়লার স্তূপ জমে গেছে।

-ছিহ! ফুফুমনি ছিহ!আপনি এতোটা স্বার্থপর! আপনাকে শাস্তি পেতেই হবে। (কান্তা মনি)

-নওশাদ আব্বা দুঃখিত। আমি এই প্রথমবার তোর বায়না করা কোনো জিনিস তোর হাতে তুলে দিতে পারব না। কান্তা মনিকে যে এখন আমাদের মেরেই ফেলতে হবে। নয়ত আমাদের দুজনের বাচা মুশকিল হয়ে যাবে। (আফসোসের সুরে বলে মেহেরুন্নেছা)

-আম্মা! (আহ্লাদের দূরে বলে নওশাদ)
-না আব্বা হবেনা। (বলেই মেহেরুন্নেছা মেঝে থেকে তলোয়ার বের উঠিয়ে নিয়ে কান্তা মনির দিকে তেড়ে আসে)

মেহেরুন্নেছাকে ছুটে আসতে দেখে কান্তা মনি কাধে ঝুলে থাকা ব্যাগ থেকে বিষাক্ত পদার্থের শিশিটা বের করে যেটা কবিরাজের থেকে আগেই সংগ্রহ করেছিল। মেহেরুন্নেছা কান্তা মনির সামনা সামনি হতেই কান্তা মনি শিশিটার মুখ খুলে মেহেরুন্নেছার নাকের সামনে ধরে। মুহূর্তের মাঝে মেহেরুন্নেছা মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। সাথে সাথে কান্তা মনি মেঝে থেকে তলোয়াড় উঠিয়ে নিয়ে তার বিপরীত পাশ দিয়ে ছুটে আসা নওশাদের মাথায় আঘাত করে।

ভোরের আলো ফুটে গেছে।
কান্তা মনি ঠিক সেই বড় গাছটার সামনে চেয়ার পেতে বসে আছে যেখানে বেগম নূর জাহানকে গলায় রশি বেধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গাছটার নিচেই অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে নওশাদ আর মেহেরুন্নেছা। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে নিয়াজ, রেহানা,হেতিজা,মুর্শিদা,মহাশিন আর যোহরা।

কিছুক্ষণ বাদেই মেহেরুন্নেছার জ্ঞান ফেরে। চোখ খুলে টের পায় হাত-পা বাধা। পাশেই পরে আছে আর পুত্র। ছটফট শুরু করে দেয় মেহেরুন্নেছা। কান্তা মনি ইশারা দিতেই হেতিজা বালতিতে করে পানি নিয়ে এসে নওশাদের মুখের ওপর ঢেলে দেয়। কিছুক্ষণ বাদেই জ্ঞান ফেরে নওশাদের। ছটফট আর আকুতিমিনতি শুরু হয়ে যায় দুজনের। বাচার জন্য ছটফট শুরু করে দেয় দুজনে। কি এক মর্মান্তিক দৃশ্য তাই নাহ! চোখের সামনে আপন মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছেনা।

কান্তা মনি চেয়ার হতে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে অগ্রসর হয় বড় গাছটার নিকট। পর পর দুটো রশির এক প্রান্ত ধরে টান দিতেই উপর থেকে নেমে আসা মেহেরুন্নেছা আর নওশাদের গলায় বেধে রাখা রশির আরেক প্রান্ত ওপরের দিকে উঠতে থাকে। ছটফটানি শুরু হয়ে যায় দুজনের। শত আকুতিমিনতিতেও মন গলে না কারো। নিয়াজ এসে রশি দুটো আরেকটি গাছের সাথে বেধে দেয়। কান্তা মনি পুনরায় গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। মেহেরুন্নেছা আর নওশাদের ছটফটানি দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে কান্তা মনি। হাসির মাঝেই হঠাত কান্না করে ওঠে। এমন পরিস্থিতি দেখে কেউ আর অবাক হয় না।

পাঁচ বছর বয়সের নির্জনের হাত ধরে কান্তা মনি রমিজ হাওলাদারের কবর যিয়ারত করে বেরিয়ে আসে কবরস্থান হতে। বাইরে এসে প্রিয় স্বামীকে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কান্তা মনিও মৃদু হেসে ফেলে। নির্জন দৌড়ে গিয়ে তার আব্বাজানের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে।
-আপনি কিভাবে জানলেন জনাব যে আমরা এখানে আছি?
-কল্পনা শক্তি প্রয়োগ করে। (নিয়াজ)
-ধুর মজা করে শুধু। (কান্তা মনি)
-আরে আমার বেগম রাগ করে কেন? রেহানা ভাবিজানের কাছে শুনেই চলে এলাম। ভাবলাম একসাথে আজকে সারা গ্রাম ঘুরব। তুমি তো ভালো গাছে উঠতে পারো। ওইদিকটায় পাকা পাকা পেয়ারা গাছে ঝুলতে দেখে এসেছি। চলো আজকে পেয়ারা চুরি করি। (কান্তা মনির হাত ধরে নিয়ে সামনে এগোতে এগোতে দুষ্টু হেসে বলে ওঠে জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-যাহ ফাজিল ব্যাটা। ভুলে গেছেন আপনি একটা ছেলের বাপ হয়ে গেছেন? বুড়ো হয়ে গেছেন আপনি। (কান্তা মনি)
-ধ্যাত কিযে বলো। আমার বয়স তো সবে ঊনিশ পেরিয়ে কুড়ি। (নিয়াজ)
-তাই না? (হেসে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-জ্বি আমার বেগম। আর তুমি ভিতু বলেই গাছে উঠে পেয়ারা চুরি করতে চাইছোনা তাই বল। কথা ঘুরাও কেন? (নিয়াজ)
-কি আমি ভিতু! (মাজায় হাত বেধে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-এই এই রেগোনা। তুমি রেগে গেলে আমি শেষ। তুমিতো আমার সাহসী বাঘিনী। (নিয়াজ)
-না। (কান্তা মনি)
-কি না? (ভ্রু কুচকে বলে ওঠে নিয়াজ)
-আমি কোনো সাহসী বাঘিনী না।
-তবে কি?(নিয়াজ মির্জা)
-আমি আপনার #কান্তা_মনি । (কান্তা মনি)

মুচকি হাসে নিয়াজ। এক হাতে কান্তা মনিকে আগলে নিয়ে বলে ওঠে,
-হ্যা তুমি আমার #কান্তা_মনি।

~সমাপ্ত

(এতদিন যারা পাশে ছিলেন তাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আর প্রাণঢালা ভালোবাসা। #কান্তা_মনি গল্পটিকে আপনারা এতোটা ভালোবাসা দিয়েছেন যে আমি সত্যিই বিমোহিত। শুরু থেকে যারা সাথেই ছিলেন তাদেরকে আবারো অনেক অনেক ধন্যবাদ। গল্পটি কেমন লেগেছে অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্য করে জানাবেন। ইন শা আল্লাহ নতুন কোনো গল্প নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here