#কার_হাতে_যে_ধরা_দেব_হায় (পর্ব-২)
লেখনীতে— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
আমার বাবা আমাকে বোঝাতে চাইছেন বারবার বিয়েটা করলে আমার জন্যই ভালো। একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ, ভালো স্বামী, ভালো বাড়ি সবই পাওয়া হবে। পড়ালেখার ব্যাপারে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। শৌর্যের পরিবার উল্টো আমাকে জোর করেই পড়াবে। ওদের পরিবারে অন্তত পক্ষে অনার্স কমপ্লিট করতে হয় সবাইকে। বাড়ির বউরা সবাই চাকরি করছে যার যার পছন্দ মতো। কোনো বাধ্য বাধকতা নেই। সব শুনেও আমার মন গলেনি। আমার সমস্যা তো আসলে পড়ালেখা কিংবা শ্বশুর বাড়ি নিয়ে নয়। আমার সমস্যা স্বয়ং শৌর্য ভাইয়াকে নিয়ে। বাবার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে তিনি নিজ হাতে মেয়েকে একটা ছোট খাটো যু’দ্ধে ঠেলে দিচ্ছেন। বাবার আর আমার কথাগুলো ছন্দ করে আমি মনে মনে কাঁদি।
যেমন একটা ছড়া ছিল,
“টুনটুনি গো পাখি,
নাঁচো তো দেখি!
না বাবা নাঁচবো না,
পড়ে গেলে বাঁ’চবো না!”
আর আমি সেটা ঘুরিয়ে বানালাম,
“টিয়া গো পাখি,
বিয়ে করো তো দেখি!
না বাবা করব না,
বিয়ে করলে বাঁ’চবো না”
বিকেলে শৌর্য ভাইয়া আমাদের বাসায় এসে হাজির। সাথে অবশ্য আমার রোহান ভাইয়া আর নাফিস ভাইয়াও ছিল। তাদের দেখে তো আমি হতবাক। নাফিস ভাই মশকরা করে বললেন,
-‘দেখলি টিয়া, তোর উড বি তো তোর জ্বরের কথা শুনে একেবারে পা’গ’ল হয়ে গেছে। এখনিই এত দেওয়ানা হয়ে গেছে বিয়ে করলে না জানি কি হবে!’
শৌর্য ভাইয়া তাকে ধ’ম’ক দিলেন। সেই ধ’ম’কে আমিও কেঁ’পে উঠলাম। রোহান ভাই নাফিস ভাইকে টেনে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন,
-‘নে তোরা দু’জনাতে কথা বল। আমরা কোনো কাবাবের হাড্ডি হতে চাইনা।’
ওরা দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিতেই আমি আচানক ভ’য়ে জমে গেলাম। শৌর্য ভাইয়া আমার হাতের কাছে চেয়ার টেনে বসলেন। আমার জ্বর এখন ১০০তে এসে ঠেকেছে। শরীর দুর্বল তাই শুয়েই আছি। শৌর্য ভাইয়ার উপস্থিতি মোটেও ভালো লাগছে না। কিন্তু কিছু করারও নেই। শৌর্য ভাইয়া আমার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলেন। আমার ইচ্ছা করছিল আঙুল দিয়ে গুতা মেরে চোখ গেলে দিতে তার। বললাম,
-‘আপনি এখানে কেন এসেছেন?’
তিনি একটু নড়ে চড়ে বুকের মধ্যে দুই হাত ভাজ করে একটু হেলে বসে বললেন,
-‘দেখতে এলাম, কত বড় ইডিয়টকে বিয়ে করতে যাচ্ছি! যার কিনা বিয়ের কথা শুনেই সোজা জ্বর চলে এসেছে! নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এসে এখন এসব জ্বরের নাটক করলে তো চলবেনা টিয়া পাখি! অলরেডি আমার আত্মীয়-স্বজনকে বিয়ের দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে। এখন তো তোমাকে বিয়ে করতেই হবে। আমার একটা প্রেস্টিজ আছে তো সমাজে!’
আমি চোখ গরম করে তাকালাম। বললাম,
-‘আপনাকে বিয়ে করতে হবে এর মতো এত বড় একটা দুঃ সংবাদ শুনলে জ্বর কি মৃ’ত্যুই ঘটে যাওয়ার কথা। তাও ভালো আমার কেবলই জ্বর হয়েছে। অন্তত বেঁ’চে আছি এই ঢের। আর বিয়ে? সেটা তো মজার ছলে বলেছি। আপনি একটা বেকুব, না না শুধু বেকুব না বড় মাপের গাঁধা। মজাও বোঝেননি। বিয়ে তো আমি আপনাকে করব না। আমার কল্পনাতেও না।’
শৌর্য ভাইয়া ভীষণ রে’গে গেলেন। কিন্তু রা’গটা সেভাবে ঝারলেন না। বললেন,
-‘কল্পনাতে বিয়ে করতে তো আমিও বলিনি। যা হওয়ার সবই বাস্তবেই হবে। বি রেডি! বিয়ে তো আমি তোমাকেই করব। একটা পুরোনো হিসেব নিকেশ বাকি আছে। তুমি তো ভালোই জানো আমি কিসের কথা বলছি।’
আমি তব্দা খেয়ে গেলাম। ব্যাটা ব’দ তবে আসলেই শ’য়’তা’নি বুদ্ধি নিয়ে ঘুরছে। আমাকে আরো সচেতন হতে হবে। বিয়েটা ভাঙার উপায়ও পাচ্ছি না বিশেষ।
তাই সারাজীবনের জন্য পরাজিত না হওয়ার চেয়ে এখন কিছু সময়ের জন্য পরাজয় স্বীকার করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ভেবে নিলাম। কোনো রকমে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। গাল বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-‘নিন এবার আপনি একটা থা’প্প’ড় মা’রেন। জোরসে মা’রেন। কোনো সমস্যা নেই। তাতেও শখ না মিটলে আরেকটা দিবেন। হিসেব বরাবর। শুধু শুধু আর বিয়ে করে টাকা খরচ করা লাগবেনা।’
কথাগুলো বলেই চোখ খিঁ’চে বন্ধ করে ফেললাম। যদিও বলে ফেলেছি। কিন্তু আদৌতে একটা থা’প্প’ড় খাই আমি সেটাও চাই না। এই পরিশ্রমী শক্ত পোক্ত হাতের একটা থা’প্প’ড় খেলে যে আমার মাড়ি ভেঙে পড়বে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?
আমি ভ’য়ে কাতর হয়ে যা ভাবলাম আর যার অপেক্ষায় ছিলাম তার কিছুই হলো না। বরং একটা নরম স্পর্শ আমার গালে অনুভব করলাম। চোখ তুলে তাকাতেই অবাকের চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না শৌর্য ভাই মাত্র আমাকে কিস করলেন! আমি বললাম,
-‘আপনি এটা কি করলেন!’
-‘ওহ! আরেকটা দেওয়া হয়নি। দুইটা চেয়েছিলে তো!’
বলেই আমার গালে আবারও চুমু খায়। আমি তাকে ধা’ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে একটু পিছিয়ে গিয়ে বললাম,
-‘আপনি এত বড় অ’সভ্য! ছিঃ শৌর্য ভাইয়া। আপনাকে আমি লু’ই’চ্চা ভাবিনি কখনো।’
-‘কেন? আমি লু’ই’চ্চা হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে নাকি?’
-‘মহাভারতের কথা জানিনা। তবে আমি অশুদ্ধ হয়ে গেছি। আপনি আর আমার সামনেই আসবেন না। আমি সবাইকে বলব আপনার ক্যারেক্টার কেমন!’
-‘কেমন?’
-‘এই যে এমন!’
-‘এই যে কেমন সেটাই তো জানতে চাইছি।’
-‘ন’ষ্ট।’
-‘ভালোই তো। পুরুষ মানুষ একটু ন’ষ্ট না হলে হয় না। যাই হোক! যা বলার বলে দাও। কেউ আমাকে কিছুই বলবে না। এমনিতেও দুইদিন পরে তোমার সাথে সবচেয়ে বেশি লু’ই’চ্চামি করার সুযোগ তোমার বাবা, ভাই আমাকে কাগজে কলমে লিখিত ভাবেই দিয়ে দিবে। তখন কি করবে? তার থেকে ভালো হয় না আগে থেকেই একটু প্র্যাক্টিস করলে!’
আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই নাফিস ভাইয়া এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সে যেতেই আমার নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছিল। কি হচ্ছে এসব! এত বোকা কেন আমি? একটু জ্ঞান, বুদ্ধি হলে কি এমন ক্ষ’তি হয়ে যেতো? রা’গে, দুঃখে আমার চোখ ভিজে উঠল।
রাতেই ব্যাগ পত্র গুছিয়ে আমার জ্বর বাবাজি বিদায় নিলেন। এদিকে বাসায় আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। বিয়ে না করে আমার আর উপায় রইল না কোনো। অবশেষে শুক্রবারে তার সাথে আমার ঘটা করে বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়ের পর তাদের বাড়িতে আসতে চাইছিলাম না। কান্নাকাটি করলাম প্রচুর। শৌর্য ভাইয়া ওহ এখন তো আর ভাইয়া বলা যায় না। শৌর্য এসে বললেন,
-‘শোনো টিয়া! তুমি ওই বাড়িতে না গেলে কিন্তু আমি এই বাড়িতে থেকে যাবো। তখন কিন্তু হিসেব বেশি করে তুলব। বুঝতে পারছ তো কি বলছি!’
আমি আর পারলাম না! তার বাড়িতেই উঠতে হলো। আমার জা আর ননদরা মিলে আমার ভারি সাজ-পোশাক বদলে নতুন করে হালকা কিন্তু সুন্দর ভাবে সাজিয়ে একটা লাল রঙের কাতান শাড়ি পরিয়ে দিল।
তারা চলে যাওয়ার পর আমি বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। শৌর্য নামক প্রাণীর দেখা না পেয়ে শান্তিতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দরজার নব খুলে শৌর্য ভেতরে প্রবেশ করল। আমি তাকে দেখে একটু অবাক হলাম। বাসায় পরা টি-শার্ট আর প্যান্ট তার পরণে। অর্থাৎ এতক্ষণ অন্য কোনো রুমে ছিল। ফ্রেশ হয়েই এসেছেন। আমি ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে রইলাম। শৌর্য কিছুক্ষণ ডাকলেন,
-‘টিয়া! এই টিয়া? ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?’
আমি সাড়া দিলাম না। চুপ করে রইলাম। নড়লামও না একটুও। লাইটের সুইচ বন্ধ করার শব্দ আমার কানে আসে। আমি শুনি আর একটু কুকড়ে যাই। অভিনয় চালিয়ে যেতে যেতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারিনি। শেষ রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি হলো। ঠান্ডায় আমার শরীর কাঁপতে থাকে। আমি ঘুমঘুম চোখ মেলে দেখি শৌর্য ঠিকই একটা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি ওত কিছু না ভেবে কাঁথা টেনে তার গা ঘেষে শুয়ে পড়লাম। তার কিছুক্ষণ পরেই! একটা সবল হাত আমার কোমড় আকড়ে ধরল। আমি চোখ খুলতেই দেখলাম শৌর্য আমার দিকে ঝুকে আছে। আমাকে চোখ মেলতে দেখেই মুঁচকি হেসে বললেন,
-‘খুব শীত করছে টিয়া?’
আমি স্বাভাবিকভাবেই মাথা নাড়লাম। তিনি আমার আরেকটু ঘনিষ্ট হয়ে এলেন। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
-‘তাহলে আমি শীত তাড়িয়ে দেই?’
আমি চোখ বড়বড় করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ততক্ষণে সেই মানুষটা আরো অনেক গভীর ভাবে আমাকে আকড়ে ধরল। চোখ বুজে পড়ে থাকার চেয়ে আমার আর কিছুই করার রইল না। মনে মনে বৃষ্টিকে বললাম,
-‘বৃষ্টি তুই আজ থেকে আমার পছন্দের তালিকা হতে বাদ। তোর জন্যই আমি আজ একজনের কাছে হে’রে গেলাম। একেবারে যাকে বলে গো হারান হারা!’
#চলবে।