#কালো_রাত্রির_খামে (০৮)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________
পড়াতে বসার একুশ মিনিট পর আদিল এলো। এতক্ষণ সম্ভবত ঘুমাচ্ছিল সে। তার হাতে চিপসের উন্মুক্ত প্যাকেট। সে চিপস খাচ্ছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো এবং উশকোখুশকো। রাত্রি তাকে আড়চোখে দেখলো। তবে সে এমন একটা ভাব করে রইল যেন সে আদিলকে দেখতে পায়নি। আদিল সোজা তার দিকেই এগিয়ে এলো। বললো,
“চিপস খাবেন ম্যাডাম?”
রাত্রি তাকালো। এমনভাবে যেন আদিল কথা না বললে সে আদিলকে খেয়ালই করতো না। সে না বোধক মাথা নেড়ে বললো,
“না ভাইয়া।”
আদিল তার ‘না’ শব্দটিকে গ্রাহ্যই করলো না। বললো,
“হাঁ করুন।”
“আমি খাবো না।”
আদিলের শান্ত মুখশ্রীতে সামান্য রাগের প্রলেপ ফুটলো। কঠিন গলায় বললো,
“আপনাকে হাঁ করতে বলেছি।”
এমন কঠিন স্বরের হুকুম রাত্রির ভালো লাগলো না। সে বিরক্তি গোপন না করেই বলে উঠলো,
“বললাম তো আমি…”
রাত্রি কথা শেষ করতে পারে না। আদিল একটা চিপসের টুকরো সুযোগ বুঝে তার মুখে পুরে দিয়েছে।
ঠোঁটে মৃদু হাসি রেখে আদিল এক পিস চিপস নিজের মুখে পুরে খেয়ে বললো,
“আদিলকে না বলা এত সহজ নয়।”
রাত্রি স্তব্ধ। আদিল এমন করবে সে ভাবতে পারেনি।
মালিহার ইচ্ছা করছে চিপস খেতে। সে ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললো,
“আমাকে দেবে না?”
রাত্রি আদিলের দেওয়া চিপস খেলো না। চিপস পিস মুখ থেকে সরিয়ে গ্লাসে থাকা পানি পান করলো সে।
অন্যদিকে আদিল মালিহার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে বললো,
“তোকে কেন দেবো? এখন তোর পড়া দেওয়া-নেওয়ার সময়। এখন তুই শুধু পড়া নিবি, চিপস কেন নিবি?”
রাত্রির দিকে ফিরে বললো,
“রাত্রি, ওকে ভালো করে পড়ান। অঙ্কে মাত্র পঁয়ত্রিশ পায়, এটা মানার মতো? আমি কখনও এত খারাপ স্টুডেন্ট ছিলাম না। আর তুই আমার বোন হয়ে…”
লজ্জায় যেন আদিলের মস্তক নত হয়ে আসে। সে বিছানায় বসলো। বসে রইল যতক্ষণ না পড়ানো শেষ হলো। এই এতক্ষণ সময়টাতে সে রাত্রির থেকে একবারও চোখ সরিয়েছিল কি না সন্দেহ। রাত্রির ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। কেউ এমনভাবে তাকিয়ে থাকা আসলেই বিব্রতকর ব্যাপার। রাত্রি মালিহার রুম থেকে বের হলে আদিলও প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই বের হলো। ডাকলো পিছন থেকে। রাত্রি দাঁড়ালোও। আদিল তার সম্মুখে এসে বললো,
“শুধু ছাতা ফেরত দিলেন। আপনার কি মনে হয় না আপনি আরও কিছু দিতে ভুলে গেছেন?”
আদিলের মাঝে আবারও সেদিনকার মতো স্বাভাবিক এবং শান্ত ভাবটা লক্ষ করছে রাত্রি। সে হয়তো বুঝতে পারছে আদিল ‘আরও কিছু’ বলতে কী বুঝিয়েছে। কিন্তু সে বললো,
“আপনি তো আর কিছু আমাকে দেননি, যা দিয়েছেন ফেরত দিয়েছি।”
আদিল তার কথায় হাসলো। পর মুহূর্তেই চেহারা অন্ধকার হলো তার। কেমন গভীর গলায় বললো,
“কিন্তু আপনি সেটা দেননি, যেটা আমি চাই।”
আদিলের সাথে আর কথা বাড়ানো উচিত নয় বুঝতে পেরেই রাত্রি বললো,
“আমি যাচ্ছি।”
রাত্রি চলে আসতে আসতে ফের আদিলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল,
“মিসিং হওয়া ওই চারটা অক্ষর আপনার কাছে আছে রাত্রি। ওই চারটা অক্ষর আমার। আমাকে ওগুলো ফেরত দিন।”
আদিলের কথাগুলো বড্ড অসহনীয় ঠ্যাকে রাত্রির কাছে। ভবিষ্যতে আদিল ঠিকই সুস্থ হয়ে যাবে, তখন সে এই ঘটনাগুলোও দিব্যি ভুলে যাবে। অথচ অযথাই সে এই বর্তমান সময়টাকে বিদঘুটে করে তুলছে।
__________________
শ্রাবণীর একটিমাত্র ভালো জামা। এটা ছাড়া আর কোনো জামা নেই যেটা পরে সে সহপাঠীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতে পারে। কিন্তু এই একই জামা পরে সে প্রায় কয়েকবার অন্য সহপাঠীদের জন্মদিনের আয়োজনে অংশগ্রহণ করেছে। এবারও এটাই পরতে হবে দেখে তার মন খারাপ হচ্ছে। তার একই পোশাক বার বার পরে যাওয়ার ব্যাপারটা কিছু সহপাঠীরা ভালো চোখে দেখে না। শ্রাবণী জামাটা বের করে ফ্যাকাশে মুখে বসে রয় বিছানায়।
রাত্রি বাসায় ফিরেছে। রুমে প্রবেশ করে সে ফ্যানের গতি বাড়িয়ে বিছানায় বসলো। আজ প্রচণ্ড গরম পড়েছে। বিকেলকে মনে হচ্ছে উত্তপ্ত দুপুর। সে প্রথমে শ্রাবণীকে লক্ষ করলো না। হঠাৎ যখন শ্রাবণীকে লক্ষ করলো এক প্রকার অবাকই হলো। মেয়েটা জামা নিয়ে এমন মন মরা মুখে বসে আছে কেন?
“কী হয়েছে?” জানতে চাইলো রাত্রি।
শ্রাবণী না তাকিয়ে জবাব দিলো,
“আজ মধুমিতার জন্মদিন।”
“তো?”
“আমাকে ওর জন্মদিনের পার্টিতে ইনভাইট করেছে। ক্লাসের সবাইকেই করেছে।”
“তুমি যাবে?”
শ্রাবণী এবার তাকালো। বললো,
“তো যাব না? আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠান তো হয়ই না, এখন অন্যদের অনুষ্ঠানেও না যাই সেটা চাও? তাছাড়া মধুমিতা ভালো মেয়ে। ওকে আমার ভালো লাগে।”
“তাহলে কী নিয়ে এত ভাবছো? গিফটের ব্যাপার?”
“না, একটা গিফট সব ক্লাসমেটরা একসাথে মিলে দেবে। ওখানে টাকা দিয়েছি। বাবার কাছ থেকে নিয়েছিলাম।”
“তাহলে কী নিয়ে ভাবছো?”
“কী পরে যাব? আমার তো কোনো পোশাক নেই।”
“এটা কী বলছো? পোশাক নেই মানে? পোশাক নিয়েই তো তুমি বসে আছো।”
শ্রাবণী জামাটা উঁচিয়ে ধরে বললো,
“এটা পরে যাব আমি? এটা পরে এর আগেও আমি ক্লাসমেটদের বার্থ ডে পার্টিতে অ্যাটেন্ড করেছি।”
“তাহলে কালোটা পরে যাও।”
“ওটা পুরোনো হয়ে গেছে। তাছাড়া ওটা ইঁদুরে কেটেছিল, মনে নেই তোমার?”
“সেটা তো খুবই অল্প পরিমাণ। আমি তো সেলাই করে দিয়েছি, বোঝার উপায় নেই।”
“আমি ওটা পরে যাব না।”
রাত্রির বলতে ইচ্ছা হলো, ‘তোমার যাওয়ারই দরকার নেই।’ কিন্তু সে বললো,
“ঠিক আছে, আমার একটা থ্রি-পিস পরে যাও তাহলে।”
শ্রাবণী রাত্রির একটা থ্রি-পিস পরে দেখলো। না রাত্রির থ্রি-পিস সে পরতে পারবে না। খুব লম্বা আর ঢিলেঢালা। শ্রাবণী কোনো উপায় না দেখে বললো,
“ঠিক আছে, আমার লাল ড্রেসটাই পরে যাব।”
শ্রাবণীকে সহপাঠীর বাসায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব অর্পিত হলো অয়নের উপর। শ্রাবণীকে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে হবে শুনে অয়ন বললো,
“কোথায় নিয়ে যেতে হবে? এসব চিন্তাভাবনা ছাড়। কোথাও যেতে হবে না। ভাত খেয়ে ঘুমা।”
শ্রাবণী গাল ফুলিয়ে বললো,
“তুমি এরকম করছো কেন? আপু তো যেতে নিষেধ করেনি।”
“আমার তো সেখানেই প্রশ্ন, কেন আপু কিছু বলেনি?”
অয়ন রুমের দিকে অগ্রসর হলো,
“আপু।”
এসে বললো,
“তুমি ওকে এত স্বাধীনতা দিচ্ছ কেন বলো তো? ও যেখানে যেতে চাইবে সেখানেই কি ওকে যেতে দিতে হবে?”
“ওর বয়সটাই এখন এমন। দুরন্ত। ও এখনও আমাদের মতো নিজেকে মানিয়ে নিতে শেখেনি। ওর মনে অনেক ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। ওর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখো। তোমাকে যদি যেতে বাধা দেওয়া হতো তোমার ভালো লাগতো?”
“অভাবীদের ভালো, খারাপ লাগার মূল্য নেই। এ ঘরটায়ও তেমনি এসবের মূল্য দেওয়া উচিত না। ও আজই শেষবার কারো জন্মদিনে যাবে। ওর এসব শখ আহ্লাদ কমানো উচিত।”
অয়ন বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। শ্রাবণী বসার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। অয়ন ওকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বললো,
“মাথায় ওড়না দে।”
“কেন?”
“কেন মানে? মাথায় ওড়না দে।” ধমকে উঠলো অয়ন।
শ্রাবণী ভয় পেয়ে মাথায় ওড়না দিলো। অয়ন বললো,
“এত লিপস্টিক দিয়েছিস কেন? লিপস্টিক মোছ।”
“কোথায় এত লিপস্টিক দিয়েছি?”
“তুই মুছবি।”
শ্রাবণী অয়নকে রাগাতে চাইলো না। বেশি রেগে গেলে হয়তো যেতেই দেবে না।
শ্রাবণী রুমে এসে একটা ওড়নায় লিপস্টিক মুছলো। তবে পুরোটা মুছলো না। হালকা লিপস্টিকের আবরণ তার ঠোঁটে রয়ে গেল।
অয়ন বাসা থেকে বের হতে হতে বললো,
“ছেলেরাও আসবে?”
“ছেলেরা কোত্থেকে আসবে? ভাইয়া, আমি গার্লস স্কুলে পড়ি।”
“ওহ।” মনে পড়ার ভঙ্গি করলো অয়ন।
শ্রাবণীকে যথা স্থানে পৌঁছে দিয়ে অয়ন চলে গেল। শ্রাবণী তাকে নির্দিষ্ট একটা সময় পর এসে নিয়ে যেতে বলেছে।
ভিতরে প্রবেশ করে প্রথমেই শ্রাবণী সেই মেয়েগুলোর সম্মুখীন হলো, যারা তার ব্যাগে ময়লা ঢুকিয়ে রেখেছিল। ওরা শ্রাবণীকে দেখে হাসলো। ফিসফিস করে নিজেদের মাঝে কিছু বললোও। শ্রাবণী দেখেও না দেখার ভাণ করলো। স্কুলে শ্রাবণীর ঘনিষ্ঠ কোনো বান্ধবী নেই। তবে কয়েকজন আছে যাদের সাথে সে মোটামুটি মিলেছে। তারা শ্রাবণীকে দেখা মাত্র ডাকলো। শ্রাবণী তাদের সঙ্গে কথা বললো কিছুক্ষণ। এরই মধ্যে মধুমিতার জন্মদিনের কেক এসে গেল। গান বাজছে। গান গাচ্ছে মধুমিতার মামা। তিনি ভালো গান করেন। শ্রাবণী মুগ্ধ হয়েই শুনছিল তার গান। রুমি নামের মেয়েটা কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শ্রাবণী লক্ষ করেনি। রুমি তার ব্যাগে ময়লা ঢুকিয়ে রাখা মেয়েগুলোর মধ্যে একজন। রুমি ব্যঙ্গ করে হেসে বললো,
“তোমার কি এই একটাই ড্রেস শ্রাবণী?”
রুমির ঠোঁটের দুষ্টু, শয়তানি হাসিটা দেখে শ্রাবণীর গা জ্বলে যাচ্ছে। সে যত চায় মেয়েগুলোকে এড়িয়ে চলতে মেয়েগুলো তত তার সামনে চলে আসে। শ্রাবণী কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না।
রুমি বললো,
“তুমি সব সময় একটা ড্রেস পরেই কেন চলাফেরা করো? তোমার বাবার কি টাকা নেই তোমাকে নতুন ড্রেস কিনে দেওয়ার? তোমরা কি প্রচুর গরিব?”
রুমির কটু কথাগুলো শুনতে শ্রাবণীর ভীষণ কষ্ট হয়। সে তার চোখ সংযত রাখতে চায়। সে চায় না এই বাজে মেয়েটার সামনে তার চোখে জল জমুক এবং ঝরুক। এমনকি এই বাজে মেয়েটার সঙ্গে সে তর্কও করতে চায় না এই স্থানে। শ্রাবণী বললো,
“তোমার সাথে আমার বিন্দুমাত্র কথা বলার আগ্রহ নেই।”
শ্রাবণী অন্যদিকে সরে যেতে চাইলেই রুমি তার হাত ধরে আটকালো। শ্রাবণী ফিরে তাকালো রুমির দিকে। রুমির চোখে-মুখে এখনও শয়তানি ভাবটা বিদ্যমান। সে বললো,
“তুমিই বলো শ্রাবণী, এমন একটা পরিবেশে তোমার এই পোশাক কি মানানসই? আমার জন্মদিনে প্লিজ এই ড্রেসটা পরে যেয়ো না। এটা ভীষণ নোংরা হয়ে গেছে। টাকার দরকার হলে বলো, আমি তোমাকে একটা ড্রেস কেনার টাকা দেবো। দান করার জন্য আমাদের ভালোই টাকাপয়সা রয়েছে।”
এই তিক্ত কথায় শ্রাবণীর কোমল মনে এবার ভীষণ আ’ঘাত লাগলো। গাল বেয়ে নেমে গেল তার চোখের জল। রুমি বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে বললো,
“কী ন্যাকা তুমি!”
রুমি ঘৃণিত কিছু ধরে আছে এমনভাবে শ্রাবণীর হাত ছেড়ে দিলো। যেন এটা হাত নয়, পচে যাওয়া কোনো বস্তু। শ্রাবণীর মনে হলো বড্ড ভুল করে ফেলেছে সে এখানে এসে। এই আয়োজন তাদের মতো মানুষদের জন্য নয়। এটা সামর্থ্যবান মানুষদের। যাদের ভালো ভালো পোশাক রয়েছে। যারা প্রতিবেলা আমিষ খায়। শ্রাবণী প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল মধুমিতাদের বাড়ি থেকে। সে সময় সকলের দৃষ্টি শ্রাবণীর দিকেই ছিল। মধুমিতা ডেকে উঠলো তাকে, শ্রাবণী শুনেও শুনলো না।
রাগ, দুঃখ আর অভিমানে শ্রাবণী এতটাই সাহসী হয়ে উঠলো যে মধুমিতার বাড়ি থেকে একাই ফিরলো। আসতে অবশ্য তার সমস্যা হয়নি। সে অধৈর্য হয়ে দরজা ধাক্কালো। মিথিলা দরজা খুলে দিতেই শ্রাবণী কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা রুমের দিকে হেঁটে গেল। রুমে ঢুকে দরজা ভিজিয়ে ঘরের পোশাক পরে নিলো সে। তার একমাত্র ভালো জামাটাকে টেনে-হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। তার চোখ বেয়ে যন্ত্রণার ভারী অশ্রুপাত হচ্ছে। যখন টেনে হিঁচড়ে ছেড়া গেল না তখন সে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারির ড্রয়ার থেকে একটা ছোটো কাঁচি বের করে ফিরে এলো জামার কাছে। জামাটাকে কে’টে টুকরো টুকরো করে ফেলবে সে। দরকার নেই এই জামার। এটা নোংরা! এটা ভীষণ নোংরা!
মিথিলা রান্নাঘরে গিয়ে জানালো শ্রাবণীর কিছু হয়েছে। রুম থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। এ কথা শুনে রাত্রি রান্নার কাজ ফেলে দৌড়ে এলো। ভেজানো দরজাটা খুলে দেখতে পেল শ্রাবণী সুন্দর জামাটাকে কাঁচি দিয়ে কা’টছে। রাত্রি ছুটে এসে জামাটা কেড়ে নিলো। চিৎকার করে উঠলো,
“এটা কী করছো তুমি? পাগল হয়ে গেছো?”
শ্রাবণীও চিৎকার করে উঠলো,
“হ্যাঁ, পাগল হয়ে গেছি, একদম পাগল হয়ে গেছি। আমার আর ভালো লাগে না। এ ঘরে থাকার চেয়ে পাগল হয়ে রাস্তায় ঘোরাও অনেক ভালো। আমরা ভিখারি। আমাদের রাস্তায় থাকা উচিত। এ ঘরে জন্ম নিয়ে অন্যায় করে ফেলেছি।”
রাত্রি ভীষণ জোরে একটা থা’প্পড় মা’রলো শ্রাবণীর গালে। শ্রাবণী এতে আরও জোরে চিৎকার শুরু করলো,
“মা’রছো কেন আমায়? কেন মা’রছো? সব জায়গায় আমাকে ছোটো হতে হয়। মানুষজন ইচ্ছা মতো কথা শোনায়। তোমরা কী বুঝবে কেউ কথা শোনালে কেমন লাগে? এরকম একটা-দুটো থা’প্পড় মা’রার চেয়ে গলা কে’টে মে’রে ফেলো আমায়।”
শ্রাবণী রুম থেকে বেরিয়ে গেল এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে। তার শরীর অস্বাভাবিক রকম কাঁপছিল।
প্রিয়ারা রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আর মিথিলা তার থেকে কিছুটা ভিতরে। রাত্রির চোখ থেকেও টপটপিয়ে জল নামছে। সে এখনও জানে না কী হয়েছে, তবে কিছু একটা হয়েছে, আর যা হয়েছে ভালো কিছু হয়নি। কেউ কি আবার তাদের দরিদ্র্যতাকে কটাক্ষ করেছে? বুকের ভিতর কষ্টে ভীষণ তোলপাড় হয় রাত্রির। সে বসে পড়ে বিছানায়। এ কষ্ট যে তারও!
শ্রাবণী দরজা খুললেই নিচ তলার দুজন ভাড়াটিয়াকে দেখতে পায়। তারা মূলত তাদের ঘরের চিৎকার-চ্যাঁচামেচির শব্দ শুনে এসেছে। শ্রাবণী তাদের গ্রাহ্য করলো না, সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
___________________
মিশাতের শেষ সম্বল ছিল একশত দশ টাকা। তবে অতি দুঃখের বিষয় সে তার শেষ সম্বলটুকু হারিয়েছে। তার কাছে এখন আর কোনো অর্থ নেই। এবার কি তাকে না খেয়ে মরতে হবে?
সে জানে না কেন তার জীবনে একটার পর একটা অঘটন ঘটছে। বাবার জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে সে অতি আশার সঙ্গে ব্যবসায় শুরু করতে চেয়েছিল। একা একা নয়, দুইজনের অংশীদারি ব্যবসায়। চুক্তিবদ্ধও হয়েছিল, কিন্তু অপর অংশীদারকে টাকাটা হস্তান্তর করতেই ও ব্যাটা টাকা নিয়ে ফেরারি হলো। বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন, রাগান্বিত হলেন, বাড়ি থেকেই বের করে দিলেন স্বীয় পুত্রকে। বের করে দিয়েছে অর্থহীন, তাও ভাগ্যিস সে আসার আগে দেড় হাজার টাকা চুরি করে এনেছিল। না হলে মাথার উপর এই যে ছাদটা দেখা যাচ্ছে এটা থাকতো না, সে থাকতো এখন রাস্তায়, মাথার উপর থাকতো খোলা আকাশ।
তবে তার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে যাওয়াতে সে খুব ভেঙে পড়েছে। পকেটমারটার কী দরকার ছিল তার পকেট থেকে ওই একশত দশ টাকা পূর্ণ মানিব্যাগটা ছিনতাই করার?
সে এখন পুরো অসহায়। এই শহরে তার মতো এত অসহায় কেউ নেই বলেই মিশাতের বিশ্বাস। সে কাঁদছে। যতটা নিঃশব্দে কাঁদা যায়। পুরুষ মানুষের কান্না কেউ শুনে ফেললেও এটা সেই পুরুষের জন্য লজ্জা। তাও যদি হয় শেষ সম্বল মাত্র একশত দশ টাকা হারানোর কান্না সে লজ্জা হজম করারও কোনো পথ থাকবে না।
মিশাতের কান হঠাৎ সজাগ হয়ে ওঠে। একজনের কান্নার শব্দ কি ভেসে আসছে না? হ্যাঁ, ওই তো শোনা যাচ্ছে কে যেন কাঁদছে। তবে কান্নারত মানুষটি বেশ জোরে-শোরেই কাঁদছে। তার কান্নার ধরাবাঁধা নেই। ওই কান্নার শব্দে মিশাতের কান্নাও ভারী হয়ে ওঠে। তার মনে হয় কান্নারত মানুষটি হয়তো তার পরম বন্ধু। সে পরম বন্ধুটিকে দেখার জন্য ঘর থেকে বের হলো। ফুরফুরা হাওয়ার পাল তাকে ছুঁয়ে দিয়ে ছুটে গেল আরও দূরে। দূর দূরান্ত থেকে আসা কৃত্রিম আলোয় একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি কেন কাঁদছে?
(চলবে)