কালো রাত্রির খামে পর্ব -০৭

#কালো_রাত্রির_খামে (০৭)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________

রোশনি অয়নের দিকে তাকাচ্ছে আর মনে মনে রাগান্বিত হচ্ছে। একটা ছেলে কীভাবে এরকম হতে পারে? আশ্চর্য! সে ভেবেছিল কিছুই বলবে না। কিন্তু সে চুপও থাকতে পারলো না। বলে ফেললো,
“আপনি কেমন মানুষ? আপনি ছেলেগুলোকে কিছু বললেন না কেন?”

অয়ন না তাকিয়ে হাঁটার গতি অব্যাহত রেখে বললো,
“তারা আমাকে তো কিছু বলেনি, আমি কেন শুধু শুধু তাদের কিছু বলতে যাব?”

রোশনি দাঁড়িয়ে গেল।
“এটা আপনি কী বললেন?”

তবে অয়নের মাঝে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ নেই। সে হাঁটছেই। সে আর দাঁড়াবে না বুঝতে পেরে রোশনি দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। পূর্বে বলা কথাটা আবার বললো সে,
“এটা আপনি কী বললেন? আপনাকে কিছু বলতে হবে কেন? আমি আপনার সাথে ছিলাম। ছেলেগুলো আমাকে টিজ করছিল। আপনার কি উচিত ছিল না এর প্রতিবাদ করার? আপনাকে শুধু বেয়াদবই ভেবেছিলাম, এখন দেখছি আপনি বেয়াদবের পাশাপাশি খুব বেশি দায়িত্বজ্ঞানহীনও।”

অয়নের কণ্ঠে এবার রাগ ঝরলো,
“আপনার কণ্ঠকে সংযত রাখুন। খুব বেশিই বেয়াদব শব্দটি উচ্চারণ করে ফেলছেন। আমি বাকি সবার মতো নই। আমি শুধু সেটাই করি যেটা আমার উপকারে আসবে। আমি যা করার শুধু নিজের জন্য এবং নিজের পরিবারের জন্য করতে পারি। পর মানুষের জন্য কিছু করার দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়নি।”

“ভুল, সম্পূর্ণ ভুল আপনি। মানুষের প্রতিও মানুষের কিছু দায়িত্ব থাকে। আর আমি তো আপনার প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর প্রতি আপনার কোনো দায়িত্ব নেই?”

“নেই। রাস্তাঘাটে আর কখনও আমার সঙ্গ নেবেন না।”

অয়ন হাঁটতে শুরু করলো আবার। রোশনি পিছনে আসতে আসতে বললো,
“কেন নেবো না? আমি কি আপনার মতো বেয়াদব? যে বিল্ডিংয়ে আমি একাউন্টিং পড়ি ঠিক একই বিল্ডিংয়ে আপনি একই সময় স্টুডেন্ট পড়ান। দেখা হয়ে গেলে কি আমি কথা বলবো না? বেয়াদব আপনি হতে পারেন, প্রতিবেশীর প্রতি সামান্য সৌজন্যমূলক আচরণ দেখানোর শিক্ষা আমার মাঝে আছে।”

অয়ন পিছন ফিরে তাকালো। রোশনিকেও দাঁড়িয়ে যেতে হলো। অয়নের দৃষ্টিতে রাগ। বললো,
“আপনাকে না বলেছি নিজের কণ্ঠ সংযত রাখতে?”

রোশনিও কণ্ঠে রাগ ফোটানোর চেষ্টা করে বললো,
“আপনার সাথে কথা বলাই ভুল। আপনি পিছন পিছন আসবেন আমি আগে আগে যাব। কখনও আর একসঙ্গে হাঁটবো না।”

রোশনির কথা শেষ হওয়া মাত্রই অয়ন লম্বা পা ফেলে হেঁটে চলে গেল। অথচ রোশনি চেয়েছিল সে আগে যাবে। রোশনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। ছেলেটার মাঝে মানুষের প্রতি কোনো যত্ন বোধ নেই। ছেলেটা কি পাথর হৃদয়ের? তবে রোশনি একটা বিষয় উপলব্ধি করছে, ছেলেটার কোনো একটা বিষয় সে পছন্দ করে। হয়তো সেটা ছেলেটার বেয়াদবিই।

____________________

যার পকেটে টাকার অভাব তার সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা খুব বিলাসিতাপূর্ণ ঘটনা ছাড়া আর কী? মিশাত সিগারেটটা জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে ফেললো। সিগারেট খাওয়া বড্ড বিলাসিতা হয়ে যেত। কারণ সে সকাল থেকে এখন অবধি কোনো দানাপানি মুখে তুলেনি। অথচ সিগারেট খেতে নিয়েছিল। সিগারেট অবশ্য তার নিজ টাকায় কেনা না। একটা খাবারের দোকানে আজ সে কাজ করেছিল সকাল থেকে। যে ছেলেটা দোকানে কাজ করে সে ছেলেটা অসুস্থ বিধায় সে কাজটা করার সুযোগ পায়। দোকানের মালিক খুশি হয়ে টাকার পাশাপাশি এই সিগারেটটাও দিয়েছে।
মিশাত সিগারেটটা একটা বক্সে রাখলো। এমনভাবে রাখলো যেন ওটা কোনো স্বর্ণদ্রব্য। এই স্বর্ণদ্রব্য না দিয়ে দোকানের মালিক তাকে খাবার দিলে সে ভীষণ খুশি হতো।
মিশাত বের হলো চিলেকোঠার ক্ষুদ্র রুমটি হতে। চিলেকোঠার এই ছোট্ট রুমটি সে বাড়ির মালিককে অনেক বলে কয়ে তারপর ভাড়া নিয়েছে। প্রতি মাসের ভাড়া পাঁচশত টাকা। তিন মাসের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করার ফলে তার কাছে তেমন কোনো টাকাই আর অবশিষ্ট নেই। অগ্রিম ভাড়া পরিশোধের পর ছিল ত্রিশ টাকা। আর আজ কাজ করে কামাইকৃত টাকা হচ্ছে একশত টাকা। দুই মিলে একশত ত্রিশ টাকা। এখন এ থেকে বিশ টাকার মধ্যে তার খাওয়ার কাজটা সারতে হবে। মিশাত দরজা টেনে বন্ধ করলো। লক করার প্রয়োজন নেই, কারণ তার ঘরে মূল্যবান কোনো বস্তু নেই। চোর চুরি করতে এলে নিজেও লজ্জা পাবে তার জিনিসপত্র দেখে।
এখন বিকেল সাড়ে চারটা। কতক্ষণ ধরে সে অভুক্ত! গতরাতে মাত্র দশ টাকা দামের একটা বিস্কুট আর পানি খেয়েছিল। পেটে সেসবের কিছুই অবশিষ্ট নেই। ছাদের ভেজানো দরজা খুলে নামা দিলেই আচমকা তাকে থমকাতে হলো। কারণ, একজন ভাড়াটিয়াও ঠিক ছাদের দরজা খুলবে বলে হাত বাড়িয়েছিল, এর মধ্যেই সে খুলে ফেলেছে। এখন সেই ভাড়াটিয়া ঠিক তার সম্মুখে অবস্থান করছে। ভাড়াটিয়া মেয়ে। সুন্দর। চেহারায় ভদ্র ভদ্রও একটা ভাব আছে। মনে হলো মেয়েটা তার সামনে পড়ে অপ্রস্তুত বোধ করছে। তার অপ্রস্তুত ভাব কাটাতে মিশাত বললো,
“কোনো ব্যাপার না আপু, আপনার যখন খুশি তখন ছাদে আসবেন। আমি খুব একটা ঘরে থাকি না। আপনারাই তো বিল্ডিংয়ের মাথা, আমি তো উড়ো মানুষ বলা যায়। আচ্ছা, এখানে রোদে দেওয়া কাপড়গুলো কি আপনাদের? একটা ওড়না পড়ে গিয়েছিল, আমি উঠিয়ে রেখেছি।”

রাত্রি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার কথায় সে ক্ষণিকের জন্য হতবিহ্বল রয়ে বললো,
“জি না, আমাদের নয়। আমরা শুধু শার্ট শুকাতে দিয়েছি।”

“ওহ, আপনার স্বামীর?”

“জি না, ছোটো ভাইয়ের।”

“ওহ দুঃখিত! মাফ করবেন। ঠিক আছে আপনি থাকুন, আমি যাই।”

রাত্রি সরে দাঁড়ালে মিশাত নেমে গেল। গুনগুন করে কিছু একটা গাইতে গাইতে নামলো, রাত্রি ঠিক বুঝতে পারলো না। তবে ছেলেটাকে তার সহজ-সরল প্রকৃতির মনে হলো।

উঠোনে এসে আরেকজন ভাড়াটিয়াকে দেখতে পেল মিশাত। এ ভাড়াটিয়াও একজন মেয়ে। তবে বয়সে ছোটো। একটা বিড়াল ছানাকে আদর করছে। মেয়েটাকে একটু দেখার পর মনে পড়লো এই মেয়েটাই তাকে প্রথমদিন ধা’ক্কা দিয়েছিল এবং নিজে ধা’ক্কা দিয়ে দোষ তার উপরই চাপিয়ে দিয়েছিল। সেদিন সে কিছু বলেনি, কারণ তার মন ভালো ছিল না। তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থাকা উচিত। তাই সে সেদিনের অন্যায়ের প্রতিবাদ আজ করতে গিয়ে বললো,
“এই মেয়ে শোনো।” শ্রাবণী ডাক শুনে ফিরে তাকালো, “সেদিন তুমি আমাকে ধাক্কা মে’রেছিলে, আমি না।”

শ্রাবণী ভ্রু কুঁচকে ফেললো। সে এমনভাবে মিশাতকে দেখছে যেন কোনো কিম্ভূতকিমাকার প্রাণী তার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে কিছু না বলেই দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলো বিড়াল ছানার উপর।
মিশাতও আর দাঁড়িয়ে রইল না। এমনিতেই অনেকক্ষণ ধরে অভুক্ত সে। এবার তার খেতে যাওয়াই উচিত। শুধু শুধু ফাও প্যাঁচাল পেরে তো লাভ নেই।

_____________________

বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর রাত্রির কেবল মনে হচ্ছে কোথাও না কোথাও তার তানবীনের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। হয়তো তানবীন তার আশেপাশেই আছে। নজর রাখছে। এমন মনে হওয়ার দরুন রাত্রি চলতে চলতে বার বার আশেপাশে তাকাচ্ছে। আর এদিক-ওদিক তাকাতে গিয়ে সে প্রথমে খেয়ালই করলো না একটা বাইক যে তার সামনে থেমেছে। আচমকা দেখে ভয় পেল, চমকালো।

আজ তানবীন হেলমেট পরা। চোখের সম্মুখের কাচ সরিয়ে বললো,
“কাউকে খুঁজছেন?”

রাত্রি না বোধক মাথা নেড়ে বললো,
“না খুঁজছি না কাউকে।”

“কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে আপনি কাউকে খুঁজছিলেন? আর কেনই বা মনে হচ্ছে যাকে খুঁজছেন সেটা আসলে আমিই?”

“আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি কীভাবে জানবো? তবে আমি আপনাকে খুঁজছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে ফলো করছে।”

“তাই?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে, বাইকে উঠুন। আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”

রাত্রি মনে মনে পণ করেছে সে কিছুতেই আর তানবীনের বাইকে উঠবে না। একটা অপরিচিত মানুষের বাইকে কেন যাতায়াত করতে হবে তাকে? হোক গিয়ে সে স’ন্ত্রাসী কিংবা অন্য কিছু। রাত্রি বললো,
“দেখুন, আমি আপনার বাইকে আর কখনও উঠবো না। আপনাকে আমি চিনি না। একজন অপরিচিত মানুষের বাইকে আমি কেন উঠতে যাব?”

“কেন উঠবেন না? ব্যাপারটা কি এমন হতে পারে না যে, আমি বাইক চালক আর আপনি প্যাসেঞ্জার? না কি ভাবছেন আমাদের মাঝে ব্যাপারটা অন্য রকম?”

“আমি কিছুই ভাবছি না। আপনি আর কখনও আমার সামনে আসবেন না প্লিজ।”

“আমি অবশ্যই আপনার সামনে আসবো, আর আমি যতবার আসবো আপনি ততবার আমাকে দেখবেন। এমন একটা সময় আসবে যখন আপনি আমাকে না দেখতে পেয়ে মন খারাপ করবেন।”

তানবীন বাইক স্টার্ট করে ঘুরে চলে গেল।
রাত্রির দু চোখে আকাশ স্পর্শী বিস্ময়। শেষে এটা কী বলে গেল তানবীন?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here