#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ২৬।
হৃদ গলা ঝেড়ে বললো
” রিধিশা একটু নিউজ চ্যানেলে দাও না! তুমি পড়ে কার্টুন দেখে নিও।” রিধিশা ঠাণ্ডা গলায় বললো
” তুমি পড়ে কার্টুন দেখে নিও। আমার বাসায় টিভি নেজ অনেক দিন ধরে কার্টুন দেখিনি।” হৃদ ভোতা মুখ করে বললো
” ১০ মিনিটের জন্য প্লিজ!” রিধিশা মুখ ফুলিয়ে বললো
” বোনের জন্য একটা নিউজ মিস করতে পারবে না?”
হৃদ অবাক হয়ে যায় রিধিশার কথায়।
রিধিশা এতো সহজে মেনে নিয়েছে তাকে? হৃদ অবাক স্বরে বললো
” তুমি কি আমাকে তোমার ভাই হিসেবে মেনে নিয়েছো?” রিধিশা টিভির দিকে তাকিয়ে বললো
” না মানার কি আছে? একই বাবার ছেলে মেয়ে আমরা।” হৃদ আলতো হেসে বললো
” গিফট বক্সটা খুলে দেখেছিলে?” রিধিশা জিভ কেটে বললো
” ভুলেই গিয়েছিলাম গিফটের কথা। আচ্ছা পড়ে দেখে নেবো।”
লিমা বেগম দুজনকে খাওয়ার জন্য টেবিলে বসতে বলে। রিধিশা আর হৃদ এসে টেবিলে বসে পড়ে। সাদিয়া বেগম আর লিমা বেগম ব্রেকফাস্ট আনতে আনতে শফিক উদ্দিনও এসে বসে। রিধিশা আর হৃদ তার দিকে না তাকিয়ে খাওয়া শুরু করে। সাদিয়া বেগম আর লিমা বেগম মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। দুজন অসহায়ের মতো তিনজনের মাঝে ফেঁসে রয়েছে। কারোর ঠাণ্ডা ব্যাবহারই তারা হজম করতে পারছে না।
নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে শফিক উদ্দিন রিধিশার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
” রিধিশা কতোদিন থাকবে বাড়িতে?” খেতে খেতে রিধিশা তাচ্ছিল্য হেসে বাবার কথার পিঠে বললো
” কেনো আবার কোনো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন নাকি?” শফিক উদ্দিন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। হৃদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসতে থাকে। শফিক উদ্দিন বললো
” দেখো তোমরা আমাকে বারবার ভুল বুঝছো। প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দেওয়া হয় তাতেই ভালো। কিন্তু তুমি বারবার নিজের বিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছো। আমি তোমার ভালোর দেখেই বিয়ে ঠিক করছি। তোমাদের দুজনের কাউকেই আমি কম ভালোবাসি না।”
শফিক উদ্দিনের কথায় রিধিশা শব্দ করে হেসে উঠে। যেনো কোনো মজার কথা শুনেছে। রিধিশা হাসতে হাসতে বললো
” প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের যতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেন ততো ভালো এসব কবে থেকে মানছো আব্বু? তুমি যখন লুকিয়ে বিয়ে করেছিলে তখন তোমার ভালো মন্দের বিচার কোথায় ছিলো? তারপরও মানলাম সন্তানের জন্য লুকিয়ে বিয়ে করেছো। কিন্তু পড়ে তো আমাদের জানাতে পারতে। এতোবড় কথাটা লুকিয়ে রাখার মধ্যে কি মজা পেলে তুমি? ঠিকাছে তুমি বিয়ে করেছো তোমার ইচ্ছে। এসব নিয়েও কথা বলতে চাই না।
ছোট থেকেই দেখেছি আমাকে কতো ভালোবাসো
তুমি। আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি কিন্তু তুমি ছোট একটা বিয়ের বিষয় নিয়ে আমাদের বাবা আর মেয়ের সম্পর্ক কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছো সেটা একবারও ভেবেছো? ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখিয়েছো যেভাবেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে আমাকে। আর সময়ের সাথে সাথে সব ভুলে গিয়েছো তাই না? তুমি সেসব কথা হয়তো মজার ছলে বলেছিলে কিন্তু আমি মজার ছলে নেইনি। আমি সত্যি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।
আমি বারবার বলছি আমি এখন বিয়ে করতে চাই না তাও বারবার এসব নিয়ে আমাদের মাঝে ঝামেলা তৈরি করছো। আমি দূরে থেকেও শান্তি পাচ্ছি না। তোমাদের এই বিয়ে কথা শুনে শুনে কান পচে গিয়েছে বিশ্বাস করো। আজকে শেষবার জানিয়ে দিচ্ছি আমি আমার বিয়ের কথা আর শুনতে চাই না। আর এসব নিয়ে আর একবার কথা উঠলে আর কোনোদিন বাড়িতে আসবো না আমি। আমার বিয়ে কারোর কোনো দুশ্চিন্তার প্রয়োজনও নেই। আমার ইচ্ছে হলে আমি নিজেই মানুষ খুঁজে আমার বিয়ের কাজ মিটিয়ে নেবো। বিয়ে হলেই তো খুশি তুমি আর কিছু চাইলে বলো চেষ্টা করবো দেওয়ার।”
রিধিশা উঠে হনহন পায়ে রুমে চলে গেলো।
মেয়ের কথা শুনে শফিক উদ্দিনের মন ভার হয়ে উঠে। সত্যি সম্পর্কটার মধ্যে একটা ভাঙ্গন ধরে গিয়েছে ছোট একটা বিয়ের কথা নিয়ে।
শফিক উদ্দিন উঠে নিজের রুমে চলে গেলো।
হৃদ উঠে রিধিশার রুমে চলে যায়। লিমা বেগম শফিক উদ্দিনের রুমে যেতে নিলে সাদিয়া বেগম তাকে আটকে বললো
” আপা একা থাকতে দিন কিছুক্ষণ উনাকে। তাহলে যদি একটু বুঝতে পারে মেয়ের সাথে কি করছে।” লিমা বেগম সায় জানায়।
হৃদ রিধিশার রুমে ঢুকে দেখে রিধিধা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হৃদ গিয়ে রিধিশার মাথায় হাত বুলায়। রিধিশা চোখ মুছতে থাকে বারবার কিন্তু কান্না থামাতে পারে না।
” কান্না থামাও রিধি। ছোট বিষয়ে কাঁদলে জীবনে চলবে কি করে? জীবনের পথ চলায় মানুষ কতো শতো হোচট খায় আর তোমার জীবনের পথ চলা শুরু হয়েছে মাত্র। বিয়ের কথা ঝেড়ে ফেলো মাথা থেকে।” রিধিশা কাঁদতে কাঁদতে বললো
” আমি বিয়ের কথা ভাবছি না। আব্বু আর আমার সম্পর্কের কথা ভাবছি। আগে আর এখনের কতো পার্থক্য।” হৃদ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো
” ছাড় এসব। সম্পর্ক ঠিক হওয়ার হলে এমনি ঠিক হবে। যাও হাত মুখ ধুয়ে এসো আমরা বাইরে যাই। গ্রাম দেখে আসি। এখানে তো প্রথম এসেছি আমি। কয়েকদিন হয়েছে তবে চিনি না কিছু তাই বাইরে যাওয়া হয়নি।”
রিধিশা নাক টেনে মাথা নেড়ে ঠিকাছে বলে ওয়াসরুমে
যায়। হৃদ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠতেই রিধিশার ফোন বেজে উঠে। হৃদ ফোন হাতে নিয়ে নাম্বারটা দেখতে পায়। কোনো নাম দিয়ে সেভ করা নেই। হৃদ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রিধিশা কিছুক্ষণ পর ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে তৈরি হয়ে মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
হৃদের সাথে বেরিয়ে গেলো হৃদকে গ্রাম দেখাবে বলে।
.
নিশাদ চোয়াল শক্ত করে বসে আছে। রাগ তরতর করে বাড়ছে আর কমছে। নিশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” রিধিশা আমার একটা কথা যদি শুনতো আমি ধন্য হয়ে যেতাম। বদ মেয়ে কলটা ধরলো না।” নিশাদ রেগে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মৃণাল সাহেব বাজারে গিয়েছে ছেলের জন্য নিজে বাজার করে আনবেন বলে। নিশাদ তখন ঘুমিয়ে থাকায় তার আর যাওয়া হয়নি।
রুম থেকে বের হতেই উমা’কে দেখতে পায়। রহিম চাচাকে কিসব বলে উমা রান্না ঘরে চলে যায়।
রহিম চাচা রাগ দেখাচ্ছে দেখে নিশাদ এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো
” কি হয়েছে চাচা। চেঁচাচ্ছ কোন কারণে?” রহিম চাচা চোখ পাকিয়ে বললো
” কোন কারণে জিজ্ঞেস করতাছো বাজান? মৃণালের ছোট ছেলেটা যেই শয়তান। আমারে দেখলেই মাথায় চইরা বসে। হোস্টেল থাইকা আসতাছে এখন আমি নাকি আগাইয়া নিয়া আসতাম। আর কোনো মানুষ পায় না নাকি এই কাজের লেইগা?”
উমা রান্না ঘর থেকে চেঁচিয়ে বললো
” ভাই নিয়ে আসেন না! আপনার সামনেই তো শাসন করি আমি। আজকেও করবো।” রহিম চাচা মাথা নাড়িয়ে বললো
” তোমার ওই শাসনে কুনু কাজের না। তোমার ছেলে তোমার সামনে শয়তানি না করলেও আমার ধারে আইসা জ্বালায়।” নিশাদ হেসে বললো
” আচ্ছা তোমার যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি।”
রহিম চাচা বাধা দিয়ে বললো
” তুমি তো চিনোই না আনবা কি কইরা?”
” আরে চিনি না চিনে নেবো। তুমি যাও তোমার অন্য কাজ থাকলে সেটা করো।”
নিশাদ বাড়ির সামনের বড় রাস্তায় হাটছে আর পা দিয়ে ইট উড়িয়ে ফেলছে। দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই কিন্তু উমা’র ছেলেকে বড় হওয়ার পর কখনো দেখেনি তাই ভাবছে অন্য ছেলেকে না ধরে বাসায় নিয়ে যায়। গাড়ির শব্দ শুনে নিশা ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকায়। গাড়ি থেকে একটা ছেলে ব্যাগ টানতে টানতে নেমে আসে। ভাড়ি ব্যাগও টানতে পারছে না। নিশাদ এগিয়ে গিয়ে ব্যাগ তুলে নেয়। ছেলেটা হা করে তাকায় নিশাদের দিকে। নিশাদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাকে। মৃণাল সাহেবের চেহারার সাথে অনেকটাই মিল রয়েছে। ছেলেটা বিস্ময়ের স্বরে বললো
” তুমি আমার নিশাদ ভাইয়া না?” নিশাদ রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে বললো
” হুম। তুমি চেনো আমাকে?”
ছেলেটা নেচে নেচে হাটছে দেখে নিশাদ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা হাসতে হাসতে বললো
” আরে চিনবো না তোমাকে? আম্মু, আব্বু কতো কথা বলে তোমাকে নিয়ে আর তোমার ছবিও দেখিছি কতো। আজকে রহিম চাচা আসেনি কেনো? চাচ্র জন্য একটা প্লাস্টিকের ব্যাঙ এনেছিলাম।” নিশাদ মিহি হাসি দিয়ে বললো
” নাম কি তোমার?” ছেলেটা চমকে ঠাস করে দাঁড়িয়ে
পড়লো নাচ থামিয়ে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
” আমার নাম জানো না তুমি?”
নিশাদ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে প্রশ্ন শুনে।
” ছোট বেলায় নাম জানতাম এরপর তো আর আসিনি আর তোমার নাম শুনিনি তাই জানি না।”
ছেলেটা আবার নাচা শুরু করে।
“It’s okey. Myself Nihan Shah.”
নিশাদ ঠোঁট উল্টে বললো
” মনে পড়েছে। কোন ক্লাসে পড়ো?”
” তুমি দেখি কিছুই জানো না আমার ব্যাপারে। আমি ষষ্ঠ শেণিতে পড়ি। আম্মু এবার ইংলিশ মিডিয়ামে জোড় করে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে আবার হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছে বলো তো কি অত্যাচারটাই না করে আমার উপর! ইংলিশ পড়তে ভালো লাগে না কিন্তু আম্মুর ভয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে ইংলিশও বলি যদি পারি আর কি।”
নিশাদ হাসতে থাকে নিহানের কথা শুনে।
” রাস্তা দিয়ে হাটার সময় সোজা হয়ে হাটতে হয় এভাবে নাচলে উল্টে পড়ে ব্যাথা পাবে।” নিহান স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে নিশাদের দিকে তাকায়। চোখ বড় বড় করে বললো
” ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছো। আম্মু যদি দেখে আমি হাটার সময় নেচেছি। বাসায় ঢুকতেই কয়েকটা বকা দিবে।” নিশাদ হাসতে হাসতে বাড়িতে ঢোকে নিহানের সাথে।
বাড়িতে ঢুকেই ভদ্র হয়ে গেলো নিহান। উমা ছেলের কাছে আসে। নিশাদের হাতে ব্যাগ দেখে বললো
” তুমি আনতে গিয়েছিলে?” নিশাদ ব্যাগ নিচ রেখে বললো
” হুম।” নিশাদ টেবিল থেকে পানি থেকে থাকে। উমা শান্ত চোখে নিশাদের দিকে তাকিয়ে আবার নিহানের দিকে তাকায়। নিশাদ নিহানকে দেখে যাচ্ছে। উমা কিছু জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত একটাও কথা বলছে না। নিশাদ মনে মনে হাসলো খুব করে। মায়ের সামনে দুধে তুলসি পাতা আর বাইরে বাদর।
চলবে…..#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ২৭।
হৃদকে গ্রাম দেখিয়ে নিয়ে আসতে আসতে নিশাদ দুইবার কল দিয়েছে। রিধিশা হৃদের সামনে রিসিভ করেনি সাইলেন্ট করে রখে দিয়েছিলো। রিধিশা বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বসতেই নিশাদের ফোন আসে। রিধিশা রিসিভ করতেই নিশাদ চেঁচিয়ে উঠে
” এতোবার কল করলাম আর এখন রিসিভ করলে? তোমাকে সামনে পেলে জাস্ট খেয়ে ফেলবো। অসভ্য মেয়ে একটা।”
রিধিশা বিরক্ত গলায় বললো
” উফফ বেশি বুঝেন আপনি। আমি ভাইয়ার সাথে বাইরে গিয়েছিলাম তাই রিসিভ করতে পারিনি।”
নিশাদ শান্ত হয়ে যায়। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বললো
” ঢাকা যাবে কবে?” রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” গতকালই তো আসলাম। ঈদের এসেছি ঈদ’ই তো পালন করলাম না।”
” হু, হু ভালো করে ঈদ পালন করে নাও এরপর দেখা হলে তো আর ছাড় পাবে না আমার কাছ থেকে।”
রিধিশা মুখ বাঁকায় নিশাদের কথায়। দুজন আবার ঝগড়া করতে থাকে।
.
ঈদের দিন সকাল হতেই ছেলেরা তৈরি হয়ে মসজিদে নামাজের জন্য চলে যায়।
রিধিশা সকালেই শাওয়ার নিয়ে নতুন জামা পড়ে বসে রয়েছে। রিধিশা সাদিয়া বেগম আর লিমা বেগমেত কাছে গিয়ে বললো
” আম্মু, মনি আমার সালামি দাও!” লিমা বেগম হাতে পায়ের বাটি দিয়ে বললো
” নে,তোর সালামি।” সাদিয়া বেগম হেসে দেয়। রিধিশা মুখ লটকিয়ে বললো
” আরে পায়েস কি সালামি হয় নাকি? আমাকে সালামি দাও আম্মু।” লিমা বেগম চুলার তরকারি নাড়তে নাড়তে উত্তর দেয়
” কোনো সালামি দিচ্ছি না এবার। না খেয়ে শরীরের কি হাল বানিয়েছে। এবার খেয়ে দেয়ে মোটা হয়ে যাবে এটাই তোমার সালামি।” রিধিশা মুখ ফুলিয়ে রাখে।
সাদিয়া বেগম রিধিশাকে ৫ হাজার টাকা সালামি দেয়। রিধিশা চোখ বড় বড় করে বললো
” এতো কেনো ছোট মনি?” সাদিয়া বেগম হেসে বললো
” তোমাকে প্রথম সালামি দিচ্ছি এইটুকু তো কমই।”
রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” তাহলে সব সময় দিতে হবে এখন।” সাদিয়া বেগম হেসে সায় দেয়।
নামাজ শেষ করে হৃদ আর শফিক উদ্দিন বাড়িতে ফিরলে সবাইকে টেবিলে বসতে বলে। রিধিশা আগে থেকেই টেবিলে বসে পায়েস খাচ্ছিলো। হৃদ রিধিশাকে জিজ্ঞেস করলো
” রিধি আমাকে সালাম করলি না যে?” রিধিশা খেতে খেতে বললো
” সালাম করে কি করবো? তোমাকে তো দিতেই হবে আমাকে সালামি।” হৃদ মুখ বাঁকিয়ে বললো
” ইশ! কে বললো তোকে? সালাম না করলে আমি তো দেই না।”
” আচ্ছা অপেক্ষা করো। খেয়ে বিচুটি পাতা নিয়ে আসছি আমি।” হৃদ চোখ বড় বড় করে তাকায়।
.
নামাজ শেষ করে বাবা আর ছোট ভাইয়ের সাথে বাড়িতে ফিরে নিশাদ। উমা সবাইকে পায়েস, সেমাই দিয়ে যায়। নিহান পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে নিশাদের পাশে বসে। নিশাদের পায়ের উপর হাত রেখে খেতে খেতে বললো
” একবার ঈদে কি হয়েছিলো বলো তো! ঈদের দুইদিন আগের ভাত ফ্রিজে ছিলো পানি দেওয়া। ঈদের দিন পায়েস রান্না হয়েছে ভেবে আমি পুরো রান্নাঘর খুঁজেছি কিন্তু পাইনি পড়ে ফিজে ওই পানি ভাত দেখে আমি পায়েস ভেবে খাচ্ছিলাম। গন্ধটা কি বাজে ছিলো কি বলবো। একটু পর আম্মু এসে জিজ্ঞেস করে কি খাচ্ছিস? আমি বললাম পায়েস। আম্মু বললো পায়েস কোথায় পেলি? আজকে তো পায়েস রাধিনি এখনও দুপুরে রাঁধবো। তারপর আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাহলে ফ্রিজে কি ছিলো। আম্মু বকা দিতে দিতে বললো অন্ধ নাকি তুই? নষ্ট ভাত আর পায়েসের পার্থক্য বুঝিস না তুই? তারপর আমি বমি করে দিয়েছে।”
নিশাদ মুখ চেপে রেখেও হাসি কন্ট্রোল করতে পারেনি। মুখের পায়েসটা কোনো রকম গিলে শব্দ করে হেসে উঠে। নিহানও তাল মিলিয়ে হাসতে থাকে। মৃণাল সাহেব হাসতে হাসতে বললো
“কি ব্যাপার দুই ভাই এতো হাসছো কি নিয়ে?” নিহান দাঁত কেলিয়ে বললো
” কিছু না গল্প করছি।” উমা’কে রান্নাঘর থেকে আসতে দেখে নিহান কেশে নড়েচড়ে বসে। নিশাদও হাসি লুকিয়ে মাথা নিচু করে মুখ টিপে হাসতে থাকে।
মায়ের সামনে নিহান বোবা হয়ে থাকলেও মায়ের আড়ালে এক দণ্ড কথা না বলে থাকে না। নিশাদকে প্রচুর হাসিয়েছে দুইদিনে।
.
হাসি মজা করে পুরো দিন কাটিয়ে দেয়। রিধিশা ব্যালকনিতে বসে রয়েছে। সকাল থেকে গ্রামের প্রতিবেশীর অনেক ছেলে মেয়ে এসেছিলো রিধিশাকে দেখে। সবার সাথে সময় কাটিয়ে ভাইয়ের সাথে দুষ্টুমি করে কেটে গেলো।
” এখানে এসে মনে হচ্ছে আগের মতো বাচ্চা হয়ে গিয়েছি। ঢাকা ফিরেই তো আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বো।
নিশাদ কি করছে? রাতে শেষ কথা বলেছিলো আজকে আর কল দিলো না একটাও। সব সময় আমাকেই বকে শুধু। এখন তো নিজেই আমাকে ভুলে বসে আছে।” নিশাদ মন খারাপ করে রুমে এসে পড়ে।
রিধিশা বিছানায় বসতেই দরজার দিকে চোখ পড়ে।
শফিক উদ্দিন দাঁড়িয়ে আছে। আসবে কি আসবে না সেই দ্বিধাতে ভুগছে। রিধিশা এগিয়ে বললো
” ভেতরে এসো আব্বু।”
শফিক উদ্দিন নিশ্বাস ফেলে ভেতরে ঢোকে। রিধিশা বসতে বললে তাকে। শফিক উদ্দিন চুপচাপ বসে পড়লো। রিধিশা শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে বললো
” কিছু বলবে?” শফিক উদ্দিন চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে নিচু গলায় বললো
” আমাকে মাফ করে দিস মা আমার ভুলের জন্য। আর কখনো তোদের আমি কষ্ট দেবো না। তুই যতোক্ষণ না পর্যন্ত সম্মতি জানাবি আর কখনো বিয়ের কথাও তুলবো না। তুই আমার কাছে ফিরে আয়। আমার মেয়ে আর ছেলে আমার কাছে থাকলেই আমি এখন খুশি আর কিছু চাই না সত্যি। তুই আমার সাথে কতোদিন হলো ভালো করে কথা বলিস না। আমার কি কষ্ট হয় না? ছেলে মেয়েদের থেকে দূরে থাকতে কি আমার ভালো লাগছে নাকি?” রিধিশা হেসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
” আর কষ্ট পেতে হবে না। এখন আমরা সবাই তোমার কাছে।” শফিক উদ্দিন রিধিশার কথায় খুশি হয়ে যায়।
_________
রিধিশা আজকে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে তাই ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে তখন হৃদ রুমে আসে। রিধিশা হৃদকে দেখে ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দিলো। হৃদ হেসে দেয় রিধিশার কান্না দেখে। হৃদ এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
” আরে পাগলি ঢাকা’ই যাচ্ছিস। বিদেশে যাচ্ছিস না। আর কয়েকদিন পর তো আমাকেও ঢাকা যেতে হবে তখন তোর সাথে দেখা করবো।” রিধিশা চোখ মুছে বললো
” কেনো? তোমরা এখন থেকে এখানেই তো থাকবে ঢাকা কেনো যাবে?”
” আরে আমার নতুন ব্যাবসা না! মাও এখানে থাকবে আমি শুধু ঢাকা যাবো আর কি মাঝে মাঝে।”
হৃদের টেবিলে থাকা গিফট বক্সের দিকে চোখ যায়। গিফট বক্সটা হাতে নিয়ে বললো
” এখনও খুলিসনি এটা?” রিধিশা জিভ কেটে বললো
” আমি ভুলেই যাই বারবার, এখনই খুলছি।”
রিধিশা র্যাপিং পেপার খুলে একটা বক্স পায়। সেটা খুলতেই রিধিশা চমকে যায়। একটা গোল্ডের ব্রেসলেট। হৃদের দিকে তাকাতেই হৃদ মুচকি হেসে ব্রেসলেট টা নিয়ে রিধিশা হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে বললো
” আমার ছোট বোনের খুব শখ ছিলো। ছোট বেলায় বাবা ফোনে তোর ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে বলতো এটা আমার ছোট বোন। তখন থেকেই আমার সেই না চেনা বোনের প্রতি টান বাড়তে থাকে। ছোট বেলা থেকে আমি টাকা জমাতাম ছোট বোনটার জন্য অনেক বড় চকলেট কিনে তার কাছে যাবো। ছোট বেলার সেই চকলেট কেনার টাকা জমিয়ে জমিয়ে যখন অনেক টাকা হলো তখন তো বড় হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা আর আমাকে সেই বোনের ছবি দেখাতো না। তাও টাকা রেখে দিয়েছিলাম একদিন যদি একটা বোন হয় তাকে গিফট দেবো। তারপর সত্যি জানতে পারলাম আমার বোন আছে। সেইদিন বাড়িতে আসার আগে আমার সেই ছোট বেলার জমানো টাকা দিয়ে এটা কিনেছি। বোনের প্রতি আবেগ আর ভালোবাসা একটু বেশিই আমার।”
রিধিশা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। হৃদের কথা শুনে কেঁদে দেয় শেষ পর্যন্ত। হৃদ রিধিশার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো
” আমার ছোট্ট বোন, কাঁদে না। যেদিন আমার আছে জানতে পেরেছিলাম তখন কি খুশি হয়েছিলাম কি বলবো! আর ভেবেছিলাম আমার চকলেট কেনার জন্য জমানো টাকা গুলো দিয়ে এবার সত্যি কিছু কেনা হবে।” রিধিশা হেসে দেয়। ব্রেসলেট টা দেখতে থাকে।
হৃদ বিছানায় বসে বললো
” আচ্ছা এবার আসল কথা বলি। বলছিলাম এখন তো সব ঠিকই হয়ে গিয়েছে। তুই তোর টিউশনিগুলো নাহয় ছেড়ে দে। তোর তো কষ্ট হয় পড়াশোনার সাথে টিউশনি গুলো কান্টিনিউ করতে।”
রিধিশা শান্ত গলায় বললো
” নাহ আমি টিউশনি ছাড়তে চাই না এখন। এতোদিনে সব অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। এখন নিজে পরিশ্রম করে উপার্জন করা টাকা গুলো দেখলেও শান্তি পাই। টিউশনিও ছাড়তে চাই না।” হৃদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” ভাই আর বাবার টাকা নিতে আপত্তি তোর? আত্মনির্ভরশীল হওয়া খুব ভালো কিন্তু এভাবে তো কষ্ট হয়ে যায় তাই না? তুই আগে পড়াশোনা শেষ কর ভালো করে তারপর যা ইচ্ছে করবি।”
” প্লিজ ভাইয়া আমাকে বাধা দিও না। এসবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি এখন তো আপাতত ছাড়ছি না। তবে আমার যখন মনে হবে আমার কষ্ট হচ্ছে তখন আমি টিউশনি ছেড়ে দেবো, ঠিকাছে!” হৃদ রেগে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো
” যা ইচ্ছে কর। আমি কে? তোকে বলার মতো।”
রিধিশা ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে।
.
মৃণাল সাহেব ছেলের উদ্দেশ্যে বললো
” পরের ঈদেও কিন্তু আসবি! আবার দশ বছর পর আসার চিন্তা করে রাখিস না।” নিশাদ হেসে বললো
” আরে বাবা এখন সময় পেলেই চলে আসবো তাই না নিহান?” নিহান মাথা নেড়ে বললো
” হ্যা, ভাইয়া বলেছে এরপর এসে আমাকেও নিয়ে যাবে ভাইয়ার সাথে তারপর আমরা অনেক ঘুরবো।”
উমা উপর থেকে নামতে নামতে বললো
” আর তোমার পড়াশোনা আমি শেষ করবো তাই না?”
নিহান বিরবির করে বললো
” করলে তো খুব ভালো হতো কিন্তু তুমি তো আমাকে দিয়েই পড়াও সব।” উমা গম্ভীর গলায় বললো
” বিরবির করে কি বলছো তুমি?” নিহান এক গাল হেসে বলে
” বলেছি পড়াশোনা শেষ করেই যাবো আম্মু।” নিশাদ মুখ টিপে হাসে। উমা এগিয়ে এসে নিশাদের হাতে একটা শপিং ব্যাগ দিয়ে বললো
” এটা তোমার জন্য কিনেছিলাম। দেওয়া হয়নি আগে, সাবধানে যেও।” নিশাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে সায় জানায়।
যাওয়ার পথে নিশাদ তাদের পারিবারিক কবর স্থানে আসে। এখানেই তার মা’কে কবর দেওয়া হয়েছিল। আসার পর থেকে প্রতিদিন একবার করে এসে এখানে জিয়ারত করে আর কবর পরিষ্কার করে যেতো। নিশা ব্যাগ একপাশে রেখে বসে
” মা চলে যাচ্ছি আমি এখন। তোমার কবরটা আর পরিষ্কার করতে পারবো না।” নিশাদ মায়ের সাথে কথা বলতে থাকে। কিছুক্ষণ কাঁদলো তারপর জিয়ারত করে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।
.
বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে হৃদের সাথে চলে আসে রিধিশা। হৃদ রিধিশাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসে। ট্রেন ছাড়ার পর হৃদ বাড়ির পথে রওনা দেয়।
রিধিশা পাশের সিট খালি দেখে নিশ্চিন্তে বসে থাকে। কয়েক ঘন্টা পর ট্রেন আরেকটা স্টেশনের সামনে থামায়। মানুষজন উঠতে থাকে ট্রেনে। রিধিশা তখন ঘুমে ঢুলু ঢুলু করছে। গাড়িতে উঠলেই তার চোখ যেনো বন্ধ হয়ে থাকতে চায় সব সময়।
নিশাদ ট্রেনে উঠে নিজের সিট খুঁজে বের করে। এক সিট খালি আর আরেক সিটে মেয়ে দেখে। মাস্ক পড়া আর বাইরের দিকে মুখ করে থাকায় ভালো করে দেখতেও পারছে না। নিশাদ ঢোক গিলে বললো
” Excuse me!”
রিধিশা বিরক্তিকর ভাবে পাশে তাকায়। ভালো ভাবে দেখতেই বিস্ময়ে চোখ দুটো মারবেলের মতো হয়ে গেলো। রিধিশা দাঁড়িয়ে অবাক গলায় বলে উঠলো
” আপনি এখানে?”
নিশাদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই থাকে। কি বলবে সে গলা দিয়েই তো কথা বের হচ্ছে না খুশিতে। নিশাদ ঢোক গিলে দ্রুত ব্যাগটা রেখে পাশে বসে বললো
” তুমি এখানে কি করছো? সত্যি আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমি এখানে। তারমানে তোমার সাথে যাবো পুরোটা রাস্তা!” রিধিশা ঠাস করে বসে মাস্ক খুলে বললো
” আমি বসে আছি তাহলে তো আমার সাথেই যাবেন। আর কোনো জায়গা ছিলো না নাকি? আপনাকে আমার সাথেই বসতে হলো!”
নিশাদ দাঁত কেলিয়ে বললো
” কি আর করবে বলো ভাগ্য চায় আমরা একসাথে থাকি আর ঝগড়া করি।” রিধিশা হতাশার নিশ্বাস ফেলে সিটে হেলায় দিয়ে বসে। নিশাদ নিজের মাস্ক পড়ে বললো
” মাস্ক পড়ে নাও। বাইরে কতো ধুলোবালি থাকে!”
” ট্রেনে তো আর থাকে না।”
” থাকে তো কি হয়েছে? নিজেকে সব সময় প্রটেক্ট রাখতে হয়।” রিধিশা মাস্ক পড়তে পড়তে বললো
” এতোক্ষণ তো মাস্ক পড়েননি তখন প্রটেক্ট রাখার কথা মনে ছিলো না?” নিশাদ বিরক্ত গলায় বললো
” তুমি আসলেই একটা কথাকে দশটা কথায় ট্রান্সলেট করে সেটা নিয়ে ঝগড়া করো। একটু আগে পানি খেতে গিয়ে ভিজে গিয়েছিলো তখন মাস্ক ফেলে দিয়েছিলাম।” রিধিশা মুখ ভেঙ্গিয়ে হাই তুললো।
চলবে……