#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩৫।
নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” কি বলতে চাইছো তুমি?”
” বলেছি আমাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। যার জন্য আমার এড়িয়ে চলায় আপনি কষ্ট পাচ্ছেন।” নিশাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” এতোদিন তোমার এই প্রশ্ন কোথায় ছিলো?”
রিধিশা আমতা আমতা করে বললো
” এতোদিন এই প্রশ্ন মনে হয়নি কখনো তাই কখনো ভাবিনি এসব।”
নিশাদ ঠান্ডা গলায় বললো
” তাহলে এখনও ভেবো না ভুলে যাও। এসব সম্পর্কের প্রশ্ন টেনে আমাদের মাঝে দেয়াল খাড়া করবে না। তুমি, আমি যেমন আছি তেমনই এর বেশি কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই।” রিধিশা রাগি গলায় বললো
” প্রয়োজন নেই মানে কি? প্রত্যেক সম্পর্কের একটা নাম থাকে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্কও নেই আর সম্পর্কের নামও নেই। তাই বলছি আমার থেকে দূড়ে থাকবেন।”
নিশাদ রেগে কিছু বলার আগেই রিধিশা ফাইল রেখেই বেরিয়ে যায় স্টোর রুম থেকে। নিশাদ অতিরিক্ত রাগের মাথায় ফাইলের তাকে জোড়ে ঘুষি মেরে বসে। ব্যাথা পেয়ে মুখ কুঁচকে নেয়। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ফাইল নিয়ে বেরিয়ে পরে আর কোনো ফাইলেরই দরকার নেই তার।
চেয়ার টেনে বসে ঠাস করে ফাইলটা রাখে টেবিলের উপর। রিধিশা একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। নিশাদ কম্পিউটারে টাইপিং করতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর বিজয় স্যার এসে নিশাদকে বললো
” নিশাদ ফাইল গুলো কিছুক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাবেন। সব কিছু চেক করতে হবে আগামীকালকের মিটিং এর আগে।” নিশাদ একটা ফাইল এগিয়ে দিতে দিতে বললো
” বাকিগুলো কিছুক্ষণের মধ্যে দিচ্ছি স্যার।” বিজয় স্যার নিশাদের হাত দেখে চোখ কপালে তুলে বললো
” আপনার হাত এভাবে কাটলো কি করে? রক্তে হাত মেখে রয়েছে আর আপনি চুপ করে আছেন!”
রিধিশা তাৎক্ষণিক নিশাদের দিকে তাকায়। নিশাদের রক্ত মাখা হাত দেখে বুকের ভেতর লাফিয়ে উঠে।
নিশাদ শক্ত গলায় বললো
” আমার হাত ঠিকাছে কিছু হয়নি।” বিজয় রিধিশাকে উদ্দেশ্য করে বললো
” রিধিশা আমার কেবিনে গিয়ে দেখুন ফার্স্টএইড বক্স রয়েছে নিয়ে এসে নিশাদের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিন।”
রিধিশা দ্রুত গতিতে উঠে চলে গেলো। বিজয় স্যারও চলে গেলো।
রিধিশা চেয়ার টেনে বসে নিশাদের হাত টেনে চিন্তিত গলায় বললো
” মিনিটের মধ্যেই হাত’টার কি অবস্থা করেছেন? ইশশ! আবার বোবা হয়ে বসে ছিলো।”
নিশাদ নিজের দিকে হাত টেনে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললো
” কারো চিন্তা করতে হবে না। আমার থেকে দূড়ে থাকলেই তার ভালো।” রিধিশা মাথা নিচু করে আবার হাত টেনে ধরে।
নিশাদ আবার ছাড়িয়ে নিতে চাইলে রিধিশা শক্ত করে চেপে ধরে। নিশাদ ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠতেই রিধিশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” আরেকবার হাত সরলে এখন হাতের ২৪টা বাজিয়ে দেবো।” নিশা হাত টানতে টানতে বললো
” হ্যা, তুমি তো তাই পারো। সব সময় মানুষকে ব্যাথায় দেয় কখনো ব্যাথা সারায় না। সাধে তো আর বেয়াদব বলি না।”
রিধিশা হাত ছেড়ে রাগি গলায় বললো
” চুপচাপ হাতটা ব্যান্ডেজ করতে দেবেন নাকি এখন স্যাভলন ঢেলে দেবো?”
” দেবো তবে শর্ত আছে।” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” এখন থেকে আবার আমার সাথে বাইকে যেতে আর আসতে হবে।” রিধিশা নিশাদ হাত টেনে তুলো দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে বললো
” আপনার সাথে দূরত্ব বাড়াতে চাইছি আর আপনি দূরত্ব ঘোচাতে চাইছেন, কেনো?”
নিশাদ রিধিশার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো
” জানি না তবে তোমার সাথে কথা না বলে এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। আমার হাত ব্যান্ডেজ করছো মানে আমার সাথে যেতে হবে তোমাকে।”
রিধিশা কথা উত্তর দিলো না। যত্ন সহকারে নিশাদের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে থাকে। নিশাদের চোখের আড়ালে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখে পানি মুছে নিলো। আড়াল করতে চাইলেও তো আর পারে না। নিশাদ ঠিকই দেখে বুঝেছে।
রিধিশা ব্যান্ডেজ করে আবার কাজে মন দেয়।
বিজয় স্যার নিশাদকে কাজ করতে না করে দেয়। রিধিশা নিশাদের কাজ গুলো কমপ্লিট করতে থাকে। নিশাদ বসে বসে রিধিশার ওড়না নিয়ে দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আবার মোবাইলে বসে গেইম খেলছে।
রিধিশা নিশাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিশাদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রিধিশা থতমত খেয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। নিশাদ ঠোঁট চেপে হাসলো।
অফিসের কাজ শেষ করে দুজন বেরিয়ে পড়ে। নিশাদ বাইক নিয়ে আসলে রিধিশা চুপচাপ বসে পরে।
চলন্ত বাইকে নিশাদ বারবার রিধিশার দিকে তাকায় কিন্তু রিধিশার দৃষ্টি একদিকেই বরাদ্দ। নিশাদ একটা চায়ের টং দেখে বাইক থামায়। রিধিশা আশেপাশে পরখ করে বললো
” এখানে কেনো থামিয়েছেন?” নিশাদ বাইক থেকে নেমে বললো
” চা খাবো ওয়েট করো আসছি।”
রিধিশা বাইকের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। দুপুরে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় পানি জমেছে। আকাশে মেঘ না থাকলেও বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব’টা রয়েছে। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় গায়ে লোম কাটা দিয়ে উঠছে।
মুখের সামনে গরম চা ধরে নিশাদ। রিধিশা চমকে তাকায়। মাটির মগের গরম চা হাতে নিয়ে ফু দিতে থাকে। রিধিশা নিশাদের দিকে তাকিয়ে বললো
” আপনি টং এর চা খান?” নিশাদ হতাশার স্বরে বললো
” কোনোদিন তো খাইনি কিন্তু আজকে না খেলেই নয়। আফসোসের ব্যাপার হলো মাহিন এর সাথে কতো বাত কফি শপে গিয়ে কফি খেলে, ডেট করলে অথচ আজ পর্যন্ত কখনো আমার সাথে এক কাপ কফি খেলে না তুমি। টং টা দেখে মনে হলো যদি একটু টং এর চা খাওয়ার সুযোগই পাই তাহলে মন্দ কি!”
রিধিশা হেসে নিশাদের দিকে তাকালো। চায়ে চুমুক দিয়ে বললো
” আপনি সব সময় অন্যের সাথে নিজের কম্পেয়ার করেন কেনো বুঝি না। সবার প্রতি সবার অনুভূতি যেমন এক না তেমনই সবার সাথে সব কিছু করা হয় না। আপনার সাথে কফি খাইনি কিন্তু বৃষ্টির দিনে টং এর চা ঠিকই খেয়েছি। বন্ধ কফিশপে কফি খাওয়ার থেকে খোলা আকাশের নিচে টং চা খাওয়াটা বেশি আনন্দের নয় কি?”
নিশাদ মাথা নেড়ে বললো
” হুম! একটা কথা বলো মাঝে মাঝে তুমি এতো যুক্তিসংগত কথা বলো কি করে? আমি তো জানতাম না বেয়াদব মেয়েরা শুধু ঝগড়া করতেই জানে।”
রিধিশা চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই নিশাদ নিঃশব্দে হাসলো। চা খাওয়া শেষে দুজন বাড়ির দিকে পথ দেয়।
নিশাদ রিধিশাকে বাসার সামনে নামিয়ে বললো
” এখন সব ঠিক হয়েছে আবার কোনো গণ্ডগোল করলে সত্যি সত্যি পানিতে ফেলে দেবো এবার মাথায় রেখো।” রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” আপনাকে ভয় পাই নাকি আমি? হুহ! উহহ, আপনার হাত’টা দেখিয়ে নেবেন ফার্মেসীতে গিয়ে।” নিশাদ চলে যেতে রিধিশা উপরে চলে আসে।
দরজার খুলতে খুলতে দেখলো হেনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। রিধিশাও হেসে বললো
” এতো হাসছো কেনো ভাবি?”
হেনা হেসে বললো
” নাহ এমনি, আজকেও অফিস ছিলো নাকি তোমার।?”
” হ্যা, ভাবি। পার্ট টাইম জব তো তাই সপ্তায় ৭দিনই অফিস। তবে শুক্রবার একটু কম সময় অফিস।”
“ওওওও তা কার সাথে এসেছো গো!” রিধিশা হেনার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে। হেনা হেসে বললো
” আরে ভয় পাচ্ছো কেনো? চলো তোমার রুমে চলো।”
রিধিশা দরজা খুলে হেনা’কে নিয়ে ভেতরে ঢোকে। ব্যাগ রাখতেই হেনা রিধিশাকে টেনে বসিয়ে বললো
” নিশাদ’কে আমরা চিনি বুঝলে? ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তো বিয়ের পর থেকেই ওকে দেখছি। নিশাদ অনেক বছর ধরে এখানে থাকছে। নিশাদের সাথে তো আমাদেরও ভালো সম্পর্ক তবে নিশাদ এখন আর আসেনা বেশি। আরে আমাদেরও প্রেমের বিয়ে বুঝেছো! তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
রিধিশা হেনা’কে থামিয়ে বললো
” না ভাবি তেমন কিছুই না। আমরা একই ভার্সিটিতে পড়ি আবার একই অফিসে চাকরি হয়েছে তাই আর কি নিশাদের সাথে মাঝে মাঝে আসা হয়।”
হেনা মিটমিট হেসে বললো
” সমস্যা নেই তেমন কিছু না থাকলেও ধীরেধীরে হয়ে যাবে অনেক কিছু। আমি তো কালই নিশাদকে দাওয়াত দিয়ে আসবো আমাদের বাড়িতে আসার জন্য।” রিধিশা মাথা চুলকাতে থাকে। হেনা কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায়।
.
টিউশনি পড়িয়ে রিধিশা ভার্সিটিতে এসে পড়েছে। ক্লাসে বসে আছে। স্যার এসে ক্লাস করাতে থাকে কিন্তু জোতির দেখা নেই। রিধিশা বসে বসে বিরক্ত হয়ে উঠে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে নিশাদ, রেহান, সূর্য, সাদি বাইক নিয়ে ঢুকেছে। বাইক পার্ক করেই উল্টোপাল্টা দৌঁড় দেয় নিজেদের ক্লাসে। রিধিশা ফিকফিক করে হেসে দেয়।
ক্লাসের স্যার হাসির উৎস খুঁজে গম্ভীর গলায় রিধিশাকে ডাকে।
রিধিশা চমকে দাঁড়িয়ে পরে। স্যার গম্ভীর গলায় বললো
” হাসাহাসি করার হলে বাইরে গিয়ে করবে আমার ক্লাসে নয়। আমার ক্লাসে ডিস্টার্ব পছন্দ করি না আমি ভালো করেই জানো।” রিধিশা মাথা নিচু করে বললো
” সরি, স্যার।” স্যার আবারও ক্লাস করাতে থাকে। রিধিশা মুখ ফুলিয়ে রাখে।
দ্বিতীয় ক্লাসের সময় জোতি ক্লাস আসে। রিধিশা জিজ্ঞেস করলো
” এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন ম্যাডাম? এখন তোর আসার সময় হয়েছে?” জোতি হাপানো রোগীর মতো জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে বললো
” তুই জানিস না কিভাবে দৌঁড়ে এসেছি আমি। ভাইয়া এসেছে, ভাইয়ার সাথেই ছিলাম। ব্রেক টাইমে আবার আসবে তবে তোর সাথে কি কথা বলতে চেয়েছে।”
রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” আমার সাথে কিসের কথা?” জোতি ঠোঁট উল্টে বললো
” আমি কি জানি! আমাকে বললে তো বলেই দিতাম। কিন্তু প্লিজ, রিধি! আমার রিলেশনের কথা বলিস না প্লিজ!”
” ধুর চুপ থাক। তোর রিলেশন নিয়ে জিজ্ঞেস করার হলে ফোনেই জিজ্ঞেস করতো।”
” তাও ঠিক তবে এসব নিয়ে কিছু বললে তুই কিন্তু একদম মুখ খুলবি না।” রিধিশা বিরক্তিকর চাহনি দেয়।
চলবে…….#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩৬।
ব্রেকের সময় হতেই রিধিশা বেরিয়ে যায় ক্লাস থেকে। যাওয়ার পথে নিশাদের গলা শুনে দেখে সামনে নিশাদ একা একা বিড়বিড় করতে করতে যাচ্ছে। রিধিশা একটু এগিয়েও নিশাদের কথা শুনতে পেলো না স্পষ্টভাবে। হাটার মাঝে নিশাদ দাঁড়িয়ে যায় আর রিধিশা সেটা বুঝতে না পেরে নিশাদের পিঠের সাথে ধাক্কা খায়। নিশাদ চট করে পেছনে ঘুরে। রিধিশা মুখে হাত দিয়ে সরে দাঁড়ায়। নিশাদ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে
” কি? আমার পেছনে কি করছিলে?”
রিধিশা কেশে বললো
” আমি আপনার পেছনে কি করবো? আমি তো যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে আপনি দাঁড়িয়ে গেলেন তাই আপনার সাথে ধাক্কা খেয়েছি।” নিশাদ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। রিধিশা মুখ লটকিয়ে বললো
” কি এভাবে তাকান কেনো? চুরি করছি নাকি? সরুন।”
নিশাদ রিধিশার আরো সামনে গিয়ে বললো
” সরবো না কি করবে? যাওয়ার জন্য পথ কি কম আছে এখানে?” রিধিশা মুখ কুঁচকে বললো
” ঝগড়া করা রক্তে মিশে গেছে নাকি?”
নিশাদ হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললো
” উফফ, মনে হয়।” নিশাদ কথায় রিধিশা মিটমিট করে হাসে। রিধিশা আশেপাশে তাকিয়ে বললো
” ঠিকাছে অন্যকাউকে খুঁজে ঝগড়া করুন আমি এখন ব্যস্ত।” নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” কিসের এতো ব্যস্ততা তোমার?”
” আপনাকে বলবো কেনো শুনি?” রিধিশা চলে যায়। নিশাদ মুখ বাঁকায় রিধিশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।
“কালকে ঘুরে ফিরে রাতে ফিরেছি বাসায় তারজন্য একে তো স্যারের ক্লাস লেট করেছি আবার বকাও খেয়েছি। ধুর আজকের দিনটাই খারাপ। আজকে না আসলেই ভালো হতো।” নিশাদ বিড়বিড় করতে করতে আসলো।
ক্লাসে দুই মিনিট বসতেই সূর্য আর সাদি আসে। সূর্য নিশাদকে বললো
” এখানে কি মরার মতো বসে আছিস? ক্যান্টিনে চল খিধে পেয়েছে। সকালে তো খেতেও পারলাম না দৌঁড়ে চলে এসেছি।” নিশাদ জ্যাকেট টেনে বললো
” রেহান কোথায়?”
” ও তো সবার আগেই ক্যান্টিনে গিয়ে খাচ্ছে।” নিশাদরা ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে চলে গেলো।
.
রিধিশা জোয়ানের অপেক্ষায় বসে ছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে জোয়ান আসে। রিধিশা বললো
” তুমি হুট করে আসলে যে ভাইয়া? অফিসের কাজে এসেছো নাকি?” জোয়ান হেসে বললো
” হ্যা। অফিসের কাজে তো এখন মাঝে মাঝেই আসি তবে কম সময় হওয়ায় দেখা করতে পারি না তাই ভাবলাম এবার দেখা করেই যাই দুজনের সাথে।”
রিধিশা আলতো হেসে বললো
” ভালো করেছো। জোতি বললো আমার সাথে কি কথা বলবে তুমি?” জোয়ান গলা ঝেড়ে নেয়। নিচু স্বরে বললো
” বলতে পারিস কথাটা বলার জন্যই আসা তোর কাছে। অনেক সময় হয়েছে তাই এবার আর না বলে থাকা’টা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।”
রিধিশা অবাক হয়ে বললো
” এমন কি কথা?”
” বলছি আগে বল আমাকে ভুল বুঝবি না।” রিধিশা কিছুক্ষণ চুপ সায় জানায় মাথা নেড়ে। জোয়ান রিধিশার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো
” আমি ভালোবাসি তোকে। কোনো মেয়ের প্রতি এতো মায়া, ভালোবাসা আগে কখনো অনুভব করিনি। রাতে ঘুমানোর আগে তোর কথা ভাবি ঘুম থেকে উঠার পরও তোর কথা ভাবিই। দিনে ২৪ ঘণ্টা তোর চিন্তায় বিভোর থাকি। তোর প্রতি ভালোবাসা’টা রোগের মতো দেখা দিচ্ছে। প্রথম প্রথম তোর প্রতি আমার একটা টান অনুভব হতো সেটা সাধারণ ভাবেই নিতাম কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেটা ভালোবাসার মতো রোগে পরিণত হবে ভাবিনি।
তাও ধরে নিয়েছিলাম এসব কিছুই না দুদিন পর ভুলে যাবো। কিন্তু ভুলতে পারছি না কোনোভাবেই। প্রতিদিন দ্বিধায় ভুগেছি যে, আমি বলবো কিভাবে এসব কথা? আমি ভালো করেই জানি তুই আমাকে বড় ভাইয়ের চোখেই দেখিস তাই আমি নিজেকে আর নিজের অনুভূতি গুলো’কে বাধা দিয়ে এসেছি এতোদিন। এসব কথাও কখনো বলবো আমি ভাবিনি কিন্তু আমি নিরূপায় হয়ে গিয়েছি ভালোবাসার কাছে।
ভালোবাসা এভাবেও হয়ে যায় সেটা ভালো না বাসা পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। আমি এই দ্বিধার সমাপ্তি করতেই তোর কাছে এসেছি। তোকে ভালোবাসি আমি আর বিয়ে করতে চাই।”
রিধিশা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জোয়ানের কাছে এসব কথা শুননে কখনো ভাবেনি। জোয়ান চুপচাপ রিধিশার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে অপরাধীর মতো মনে হচ্ছে রিধিশার চাহনি দেখে। দুই হাতে শক্ত ভাবে কফির মগ চেপে ধরে মাথা নিচু করে থাকে জোয়ান। রিধিশাকে স্তব্ধ ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জোয়ান তাকে ডাকলো
” রিধি! কিছু বল প্লিজ!” রিধিশা ধ্যান ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো
” আমি কি বলবো? বলার মতো কিছু রেখেছো?”
জোয়ান অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।
” এতোবড় ভুল কি করে করলে ভাইয়া? আমি সব সময় তোমাকে বড় ভাই এর মতো ভেবে এসেছি। আমার থেকে কি এক্সপেক্ট করছো তুমি?”
জোয়ান বলল
” ভালোবাসার মাঝে অনেক এক্সপেক্টেশন থাকে। আর আমার মনে হয় না আমার কোনো কমতি রয়েছে। তোকে যথেষ্ট সুখ দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার রয়েছে।”
রিধিশা নিশ্বাস ফেলে বললো
” এখানে কথা ক্ষমতা অক্ষমতার ব্যাপারে না।
তোমার মতো ছেলে চাইলেই পাওয়া যায় না। যে পাবে সেই ভাগ্যবতী। আমাকে ভালোবাসতে পারো মানছি। কিন্তু আমি তোমাকে ভাইয়ের চোখে দেখি। আমি কখনো এই সম্পর্ক নিয়ে ভাববো না। আমি তোমাকে বিয়েও করতে পারবো না।”
জোয়ান মলিন হেসে বললো
” জানতাম তুই বিয়ে করতে চাইবি না আমাকে। কিন্তু শেষ চেষ্টার জন্য মন ছটফট করছিলো রে।”
রিধিশা জোয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো
” আমাকে ভুলে যাও ভাইয়া। আমার থেকে ভালো কাউকে পাবে তুমি।” জোয়ান হেসে জড়ানো গলায় বললো
” শান্তনা দিচ্ছিস?” রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” নাহ, দেখবে সত্যি আমার থেকে ভালো কাউকে পাবে তুমি তারপর আর আমাকে মনেই থাকবে না তোমার।” জোয়ান তাচ্ছিল্য হাসে।
রিধিশা করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। জোয়ান কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ কুঁচকে বললো
” ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। চল জোতির সাথে দেখা করে চলে যাবো।” রিধিশা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়। জোয়ান রিধিশার সাথে বেরিয়ে যায়।
.
ঘাড় ঘুরিয়ে নিশাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রিধিশা আর জোয়ানের দিকে তাকায়। রিধিশার পেছনের টেবিলে বসে যে তাদের দুজনের কথোপকথন সব শুনেছে সেই ব্যাপারে সন্দেহ ণেই। সূর্য, সাদি, রেহান তিনজন নিশাদের পানে তাকিয়ে আছে। তিনজন খাওয়ায় এতো বিভোর ছিলো যে কি হয়েছে না হয়েছে সেদিকে খেয়াল নেই। সূর্য নিশাদকে উদ্দেশ্য করে বললো
” কিরে তুই খাচ্ছিস না কেনো? ঠান্ডা বরফ হয়ে গিয়েচ্ছে মনে হয়।”
নিশাদ বাঁকা হেসে টেবিলের উপর রাখা খাবারটা তুলে খেতে থাকে। সাদি ভ্রু কুঁচকে বললো
” হাসিস কেনো?” নিশাদ হাসতে হাসতে বললো
” সময় হলেই বলবো। তোরা তৈরি থাকিস।”
রেহান খেতে খেতে অস্পষ্ট ভাবে বললো
” কিসের জন্য তৈরি হবো? তোর বিয়ে জন্য নাকি?”
রেহানের কথা বুঝে উঠতে তিনজনের কিছুটা সময়।লেগে যায়। নিশাদ বোঝার পর উত্তরে হেসে বললো
” হয়তো! কখন কি হয় তার কি ঠিক আছে?”
তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবারও নিশাদের দিকে তাকালো। নিশাদ কি ভাবতে ভাবতে খেয়ে যাচ্ছে।
.
জোয়ান রিধিশার উদ্দেশ্যে বললো
” জোতি’কে এসব কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই।” রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” জানাবো না কখনো।” জোয়ান মলিন হেসে বললো
” আজকের জন্য কিন্তু আমাকে ভুল বুঝে আবার ভুলে জাস না।”
” চাইলেও সবাইকে ভুলা যায় না। আর তোমাকে ভুলবো কেনো? তুমি তো আমার কাছে ভাইয়ের মতোই থাকবে।” জোয়ান আলতো হাসলো। জোতি আসতেই জোয়ান দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
জোতি আগ্রহ হয়ে জিজ্ঞেস করলো
” ভাইয়া কি কথা বলেছে’রে তোকে? আমার কথা কিছু বলিসনি তো!” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” তোর আমার প্রতি একটুও বিশ্বাস নেই না?” জোতি ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বললো
” আছে তো!” রিধিশা রাগি দৃষ্টিতে তাকায়।
________________
রিধিশা ভার্সিটি শেষ করে বাসায় ফিরে আসে। ১টা বাজে অফিসে যাবে। তালা খুলতে খুলতেই হেনা ডাকলো তাকে। রিধিশা জিজ্ঞেস করে
” কি হয়েছে ভাবি?” হেনা মিটমিট হেসে বললো
” আরে তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। এসো বাসায় এসো।” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। তার জন্য আবার কি সারপ্রাইজ? হেনা রিধিশাকে তাদের ড্রইংরুমে নিয়ে আসে। নিশাদকে সোফায় বসে থাকতে দেখে রিধিশা চোখ কপালে তুলে ফেলে। রিধিশা ছুটে চলে যেতে চাইলে হেনা তাকে চেপে ধরে যেতে নিষেধ করলো।
নিশাদ কথা বলতে বলতে রিধিশার দিকে চোখ পড়তেই হেসে বললো
” আরে তুমি এখানে?” সাজেদা বেগম জিজ্ঞেস করলো
” রিধিশাকে চেনো নাকি নিশাদ?” নিশাদ হেসে বললো
” হ্যা, আন্টি খুব ভালো করে। ভার্সিটিতেও পড়ি আবার একই অফিসেও জব করি।”
” বাহ তাহলে তো আরো ভালো। রিধিশা এসে বসো। নিশাদ বাবা কতো দিন পর আসলো বাড়িতে।”
হেনা মিটমিট করে হেসে রিধিশার কাধে হালকা ধাক্কা দেয়। রিধিশা তাড়া দেখিয়ে বললো
” না আন্টি। ফ্রেশ হবো আবার অফিসে যেতে হবে। আমি যাই বরং।”
নিশাদ ঘড়ি দেখে বললো
” আরে আরো দেড় অনেক সময় বাকি। দুই মিনিট বসো! গুরুজনের কথা ফেলতে নেই।” রিধিশা দাঁতে দাঁত চেপে তাকায়। সাজেদা বেগম রিধিশাকে টেনে বসিয়ে দিলো। সাজেদা বেগম হেনা’কে বললো
” হেনা তুমি কথা বলো আমি আসছি এখনই।”
হেনা রিধিশার পাশে বসে নিশাদকে বললো
” তা নিশাদ ভাই দিনকাল কেমন চলছে?”
নিশাদ রিধিশার দিকে তাকিয়ে বললো
” হ্যা অনেক ভালো চলছে।”
হেনা আড়চোখে রিধিশার দিকে তাকিয়ে বললো
” তাই নাকি? তা এতোদিন খোঁজ খবরও তো নিলে না আমাদের। তোমার ভাই না বললে তো আজকেও আসতে না।” নিশাদ হেসে বললো
” কি যে বলো ভাবি। ব্যস্ত থাকায় আসিনি আজকে একবার বলতেই কিন্তু এসে পড়েছি। তাও যদি আফসোস না মিটে তাহলে একটু অপেক্ষা করো। দুইদিন পর বউ নিয়ে তোমার বাসায় দাওয়াত খেয়ে যাবো আর তোমাদেরও বউ এর রান্না খাওয়াবো।”
” বাব্বাহ! দুদিনে বিয়েও করে ফেলবে? বেশি ফাস্ট তাই না রিধিশা!” রিধিশা হেনার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। হেনা পাত্তা দিলো না।
” এখন এতো এতো বিয়ে দেখছি যে, ভয় পাচ্ছি যাকে বিয়ে করবো তার না আবার বিয়ে হয়ে যায়। তাই আমি তো দুদিনেই বিয়ে করছি ডিসিশন ফাইনাল।”
রিধিশার চোখে দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় নিশাদের দিকে।
” তাহলে নিশাদ কি বিয়ে করলে মিলি’কে বিয়ে করবে?” রিধিশা ভাবতে ভাবতে শুকনো ঢোক গিললো। হেনা’কে কাজের কথা বলে নিজের বাসায় চলে আসলো।
চলবে……..