কুঁড়েঘর ২ পর্ব – ১৮+১৯

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩৩ ।

নিশাদ কাজ করতে করতে রিধিশার দিকে তাকাচ্ছে বারবার। রিধিশাও আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কাজের মধ্যেই দুজন আজকের অফিস টাইম শেষ করে নেয়। অফিস ছুটি হতেই দুজন বেরিয়ে যায়। নিশাদ বাইক স্টার্ট দিতে দিতে রিধিশার দিকে তাকায়।
রিধিশা রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু খালি রিকশা রিধিশার চোখেই পরছে না। নিশাদ বাইক নিয়ে রিধিশার সামনে যায়। রিধিশা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নিশাদ চোখে ইশারায় পেছন দেখিয়ে বলে উঠলো
” পেছনে বসো। এক জায়গায়ই তো যাবো চলো আমার সাথে। রিকশার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকবে নাকি?”

রিধিশা শক্ত গলায় বললো
” থাকবো আপনার কি? আপনি আপনার মতো যান আমি আমার মতো যাবো। আপনার সাথে যাওয়া কোনো interest নেই আমার।”
নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” তোমার সাথে যাওয়ার জন্য যেনো মরে যাচ্ছি আমি? এক জায়গায় যাচ্ছি তাই বলেছি নাহলে আমারও যার তার সাথে যাওয়ার কোনো Interest নেই, ওকে? এখন চুপচাপ উঠবে নাকি দুপুরের কাজটা আরেকবার রিপিট করত্র হবে?”

রিধিশা শুকনো ঢোক গিলে রাগি গলায় বললো
” ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে আপনি?” নিশাদ হেসে বললো
” না একদমই না। সাবধান করছি সব দিক থেকে। রিকশা না পেয়ে গেলে বাসায় যাওয়ার পথে আবার কোনো বাজে ছেলের খপ্পরে পড়লে বুঝবে তোমার এতো জেদ ধরার মজা।”
রিধিশা চোখ মুখ কালো করে ফেলে। নিশাদ স্টার্ট দিতে দিতে আবারও বললো
” লাস্ট বার বলছি উঠবে নাকি চলে যাবো?”

রিধিশা নিশাদের বাইকে উঠে বসে। নিশাদ বাইক রাইড করতে করতে রিধিশাকে বললো
” ভালো করে ধরো আমাকে নাহলে রাস্তায় পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত।” রিধিশা নিশাদকে না ধরে তার পেছনে বাইকের উঁচু জায়গাটা শক্তভাবে আকড়ে ধরে।
উঁচু নিচু রাস্তায় আসতেই রিধিশার পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। রিধিশা শক্ত করে বসে থাকতে চাইলেও পারছে না। ঢোক গিলে নিশাদের কাধ শক্ত করে ধরে
বসে। রিধিশা মনে মনে সরকারকে গালমন্দ করলো। রাস্তায় বেহাল দশা করে রেখেছে। কখন এক্সিডেন্ট হয়ে যায় ঠিক নেই।

বাসার সামনে বাইক থামাতেই নামতে নামতে দম ছেড়ে রিধিশা বললো
” আল্লাহ! এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন কি করে আসবো?”
” আজকে যেভাবে আসলে সেভাবেই আসতে হবে ম্যাডাম। সকালে রান্না করে দিতে হবে মনে রেখো কিন্তু!” রিধিশা থমথমে চেহারা বানিয়ে বললো
” পারবো না। রান্না করে দেওয়ার সময় নেই। ভার্সিটি আছে জানেন না?”

নিশাদ চোখ মুখ শক্ত করে বললো
” একদিন ভার্সিটিতে দেড়ি হলে কেউ খেয়ে ফেলবে না তোমাকে। তোমার ওই না হওয়া জামাইয়ের সঙ্গে যখম ভার্সিটি বন্ধ করে দেখা করতে চলে যেতে তখন ভার্সিটির চিন্তা কোথায় থাকতো? আমার সাথে চালাকি করতে আসবে না। যা বলছি তাই শুনবে।”
শব্দ করে বাইক চালিয়ে নিজেদের বিল্ডিং এ চলে যায় নিশাদ। রিধিশা হা করে তাকিয়ে বললো
” রাগার মতো কি বললাম আমি? উদ্ভট বজ্জাত ছেলে।” রিধিশা মুখ ফুলিয়ে বাসায় চলে আসে।

.
রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোতে রিধিশার আজকে অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। এখনও আযান পড়েনি ফযরের তাই রিধিশা চা নাস্তা করে নেয়। আযানের জন্য কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আযান পড়লেই নামায শেষ করে নেয়। তারপর স্নেহার বাসায় চলে আসে। স্নেহার বাসায় নক করতেই স্নেহার আম্মু দরজা খুলে দেয়। রিধিশা সালাম দিয়ে ভেতরর ঢুকতে নিলেই স্নেহার আম্মু বললো
” আরে রিধিশা স্নেহা তো নিশাদের বাসায়। তুমি নাকি নিশাদের থেকে কিসের নোটস কালেক্ট করবে! তাই স্নেহাকে নিয়ে গিয়েছে। স্নেহাকে পড়াতে পড়াতে তোমার কাজ সেরে নাও।”

রিধিশা জোড়পূর্বক হেসে বললো
” ওহহ ভুলেই গিয়েছিলাম আমি নোটস এর কথা। আচ্ছা আন্টি আমি যাচ্ছি।” স্নেহার আম্মু হেসে মাথা নাড়ায়। রিধিশা নিশাদের ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজায়। মুহূর্তেই দরজা খুলে দেয় নিশাদ। রিধিশা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিশাদের উপর। নিশাদ হেসে বললো
” আরে আসো আসো রিধিশা। তোমার জন্যই আমরা বসে ছিলাম।” রিধিশা ঠাস করে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

দাঁত কিড়মিড় করে বললো
” আপনি জানেন আপনি কতো খারাপ? এসব করার মানে কি?” নিশাদ চোখ রাঙ্গিয়ে বললো
” একদম রাগ দেখাবে না কালকের কথা ভুলে গেলে এখনি? আমি ভালো করেই জানি তুমি অজুহাত দেবে তাই সেই উপায় রাখছি না আমি। চলো ভেতরে চলো।” রিধিশা নাক ফুলিয়ে নিশাদের সাথে যায়।
গিয়ে দেখে স্নেহা সোফায় বসে আছে তার বই নিয়ে। রিধিশাকে দেখে এক গাল হেসে বললো
” ম্যাডাম তোমার জন্য কখন থেকে বসে আছি। এতো দেড়ি করো কেনো?” রিধিশা হেসে বললো
” সরি, আর দেড়ি করবো না।” রিধিশা স্নেহাকে পড়া দিয়ে রান্না ঘরে চলে যায়।

প্রথমে নাস্তা তৈরি করে দেয় নিশাদকে তারপর দুপুরের জন্য রান্না করতে থাকে। নিশাদ কফি খেতে খেতে পকেটে এক হাত গুঁজে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিধিশার কাজ দেখছে। রিধিশা এক মনে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে। দেড় ঘন্টার মধ্যে কয়েক পদ রেঁধে রান্নার কাজ শেষ করে। নিশাদের কাছে গিয়ে বললো
” সব রান্না শেষ করে দিয়েছি। এবার আমি যাচ্ছি আমার লেট হয়ে যাচ্ছে।”
” এক মিনিট দাঁড়াও।” নিশাদ নিজের রুমে চলে যায়। রিধিশা স্নেহার বই গুছিয়ে দেয়। এর মধ্যে নিশাদ এসে রিধিশার হাতে একটা গিফট দিয়ে চোখ মেরে বললো
” ধরো এটা তোমার জন্য। তোমার নো….টস”

রিধিশা ভ্রু কুঁচকে নিশাদের দেওয়া গিফটের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে দিয়ে বললো
” কিসের গিফট এটা? আমি নেবো না।” নিশাদ শান্ত গলায় বললো
” না নিলে আমার খারাপ লাগবে। তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার।” রিধিশা অস্বস্তি নিয়ে গিফটা নিলো। স্নেহাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নিশাদ ডেকে বললো
” অফিসে একসাথে যাবো আগে যাবে না কিন্তু!”
রিধিশা উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে পরে। স্নেহা তার ফ্ল্যাটে চলে যায়। নিশাদের দেওয়া গিফট’টা ব্যাগে রেখে দেয় রাতে দেখবে এখন সময় নেই আরেকটা টিউশনিতে যাবে।

.
অফিস শেষে রিধিশাকে নিশাদের সাথেই ফিরতে হয়। রিধিশা ফ্রেশ হয়ে রান্না বসায়। নিশাদের গিফটের কথা হঠাৎ মনে পড়তেই রিধিশা ব্যাগ থেকে বের করে। র‍্যাপিং পেপার খুলে দেখে একটা উপন্যাস বই। রিধিশা মুচকি হাসলো বইটা দেখে। বইটা খুলতেই প্রথমে কালো কাগজে হোয়াইট পেন দিয়ে লিখা ছোট একটা চিরকুট দেখতে পায় রিধিশা।

” নিশাদ শাহ’কে খুশি করা কিন্তু এতো সহজ না। বুঝলে? আজকে রান্না করে আমার খুশি করেছো তারজন্য ওই ছোট একটা গিফট। তোমার রান্নায় আমার মায়ের রান্নার স্বাদ পাই তাই কয়েকবার তোমাকে রান্না করে দিতে বলেছি।
আমাকে না করার সাধ্য কারো নেই তাই জোড় করে হলেও তোমাকে দিয়ে রাধাবো।”
রিধিশা মনে মনে চিরকুট’টা পোরে হাসলো।

__________

নিশাদ অফিসে আসার পর থেকে রিধিশার সাথে এখনও তার ঝগড়া বা কোনো কথা হয়নি তাই নিশাদ ভাবছে কি করে কথা বলা যায়। রিধিশা কম্পিউটারে মনোযোগ সহকারে কাজ করছে। নিশাদ রিধিশার টেবিল থেকে আইডি কার্ড সরিয়ে ফেললো কিন্তু রিধিশার খেয়াল নেই। নিশাদ রিধিশার ওড়না টেনে ওড়নার পমপম গুলো দেখতে থাকে। রিধিশার কাধে হালকা টান লাগতেই রিধিশা সেদিকে নজর দেয়।
নিশাদকে ওড়না নিয়ে খেলতে দেখে রিধিশা টান দিয়ে ওড়নার অংশ কোলে রেখে ভ্রু কুঁচকে বললো
” কাজ করতে এসেছেন নাকি খেলতে এসেছেন? স্যার দেখলে আপনার চাকরি না খেয়ে নেয়!”

নিশাদ ঘাড় বাকিয়ে ভ্রু নাঁচিয়ে বললো
” বাব্বাহ! আমার চাকরি নিয়ে তোমার এতো চিন্তা? নাকি আমাকে নিয়ে চিন্তা?” রিধিশা আমতা আমতা করে বললো
” আমার কেনো চিন্তা হবে? আমি তো বলছিলাম মনোযোগী হয়ে কাজ করুন।” নিশাদ হেসে বললো
” আমার কাজ শেষ ওকে? এখন নতুন কাজ আনবো।”

রিধিশা অবাক হয়ে বললো
” এতো দ্রুত আপনার কাজ শেষ? আপনি একাই করেন নাকি পিএ আছে?” নিশাদ কোণা চোখে তাকায়
” এসব কিছু নেই ঠিকাছে?” রিধিশা ঠোঁট উল্টে কপাল কুঁচকায়।
এর মাঝে রিধিশার বস আব্দুল্লাহ স্যার এর ডাক পড়ে। তিনি ডাকছে রিধিশাকে। নিশাদ উঠে বিজয় স্যারের রুমে চলে যায় ফাইল নিয়ে।

রিধিশা শক্ত হয়ে বসে আছে যেনো আব্দুল্লাহ স্যারের ডেকেছে শুনেইনি। হাত চালিয়ে কাজ করে যাচ্ছে শুধু।
নিশাদ আবারও কয়েকটা ফাইল নিয়ে বসে মুখ ফুলিয়ে বললো
” ভাবলাম কাজ শেষ করলে ছুটি দেবে কিন্তু আরো কাজ দিয়ে দিলো।” রিধিশা ঠোঁট চেপে হাসে।
আব্দুল্লাহ স্যারের রুম থেকে আবারও রিধিশার ডাক পড়ে। নিশাদ রিধিশাকে বললো
” যাচ্ছো না কেনো? স্যার পড়ে রেগে যাবে।”

রিধিশা কাজ বন্ধ করে অস্বস্তি নিয়ে দুটো ফাইল তুলে কেবিনে গেলো। রিধিশার চেহারা দেখে নিশাদ কপাল কুঁচকে যায় আপনা আপনি। রিধিশা কাজ শেষ করতে পারেনি তাই ভয় পাচ্ছে চাবে নিশাদ আবার ভাবলো অন্যকিছুও হতে পারে। নিশাদ উঠে আব্দুল্লাহ স্যার এর কেবিনে গেলো।

রিধিশা ফাইল দিতেই আব্দুল্লাহ স্যার তার দিকে কেমন করে তাকালো। রিধিশা চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। আব্দুল্লাহ স্যার আরো দুটো ফাইল দিলে রিধিশা সেগুলো নেওয়ার সময় সে কথা বলতে বলতে রিধিশার হাত ছুঁয়ে দেয়। রিধিশা অস্বস্তি আর রাগে চোয়াল শক্ত করে হাত ছাড়িয়ে ফাইল নিয়ে বেরিয়ে আসে।
সব কিছু দেখে নিশাদের চোখ জোড়া লাল হয়ে যায়।
নিশাদ রাগে হাত মুঠো করে একবার স্যারের দিকে তাকিয়ে আবার রিধিশার দিকে তাকায়।

নিশাদ হনহন পায়ে রিধিশার কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে রিধিশার দিকে ঝুঁকে যায়। রিধিশা চমকে নিশাদকে বললো
” কি হয়েছে?” নিশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” এতো রাগ তোমার মধ্যে তাহলে ভেতরে চুপ করে ছিলে কেনো? তখন রাগ হয়নি তোমার? বোবার মতো চুপ করে আছো কেনো এখনও? নাকি আমাকেই শুধু রাগ দেখানোর সাহস রাখো আর বাইরের দুনিয়ায় সেই রাগ দেখানোর কোনো সাহস নেই তোমার।”
রিধিশা মাথা নিচু করে নেয়। নিশাদ রিধিশার চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে শক্ত গলায় বললো
” আমি ব্যবস্থা করছি।”

নিশাদ হনহন করে বিজিয় স্যারের কেবিনে ঢুকে গেলো। বিজয় স্যার নিশাদকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো
” নিশাদ একটু আগেও নক করে এসেছিলেন আর এখনই হুট করে ঢুকে পড়লেন?” নিশাদ শান্ত গলায় বললো
” সরি, স্যার। ইম্পরট্যান্ট কথা বলার বলবো আপনি অনুমতি দিলে।” বিজয় স্যার ইশারায় বলতে বললো।
নিশাদ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বললো
” স্যার আমি চাইছি মিস. রিধিশা আমার আন্ডারে কাজ করুক।”

বিজয় স্যার ভ্রু কুঁচকে বললো
” নিশাদ কি বলতে চাইছেন? আপনার ইচ্ছে মতো তো হবে না এসব।”
নিশাদ শক্ত গলায় বললো
” সরি, স্যার আমি চাই না রিধিশা আব্দুল্লাহ স্যারের আন্ডারে কাজ করুক। কিছু মানুষ রয়েছে যারা কিছু কাপুরুষদের নজরে নিরাপদ নয়। এখানে রিধিশা আমার সব চেয়ে আপন মানুষ। তাহলে নিশ্চই আমি সব কিছুর আগে তার নিরাপদ চাইবো। তাই আমি চাই রিধিশা আমার সাথে বা আমার আন্ডারে কাজ করবে।”

বিয়জ স্যারের তীক্ষ্ম বুদ্ধির মাথা নিশাদের কথার ভাজে থাকা কথাগুলোও নিমিষেই বুঝে নিলো। বিজয় স্যার রিধিশাকে ডেকে পাঠায় আর নিশাদকে বললো
” বসুন আপনি আমি দেখছি।” নিশাদ শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত উঠিয়ে চেয়ারে টেনে বসে পড়লো। রাগে মাথা ভনভন করছে নিশাদের। কিছুক্ষণের মধ্যে রিধিশা নক করতেই বিজয় স্যার ভেতরে আসতে বসে। রিধিশা ঢোক গিলে একবার নিশাদের দিকে তাকিয়ে আবার স্যারের দিকে তাকায়।
নিশাদকে দেখেই গায়ে কাটা দিচ্ছে রিধিশার।

বিজয় স্যার রিধিশাকে বসতে বলে। রিধিশা বসতেই জিজ্ঞেস করে
” এখন থেকে তুমি নিশাদের আন্ডারে কাজ করবে। আব্দুল্লাহ স্যারের সাথে তোমার আর কোনো কাজের লেনাদেনা নেই। তোমার কাজ এখন নিশাদের আন্ডারেই চলবে। তোমার সমস্যা নেই তো!”
রিধিশা ফ্যালফ্যাল করে বসে থাকে। নিশাদ হমকি শরূপ ঠাণ্ডা গলায় বললো
” উত্তর দিচ্ছো না কেনো?”

নিশাদের হার কাঁপানো গলা শুনে বললো
” ন…না স্যার। কোনো সমস্যা নেই আমার।” বিজয় স্যার আলত হেসে বললো
” ঠিকাছে কাজ করতে থাকো।” রিধিশার সাথে নিশাদ চলে যেতেই বিজয় ডেকে বললো
” শার্টের হাতা নামিয়ে সুন্দর এমপ্লয়ির মতো থাকুন এখন আপনার ‘সব চেয়ে আপন মানুষটা’ সুরক্ষিত।”
বিজয়ের টানা সুরের কথা শুনে নিশাদ শার্টের হাতা নামাতে নামাতে লজ্জা পেয়ে বেরিয়ে আসে।

চলবে……..#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩৪ ।

নিশাদ কেবিনে আসলে রিধিশা ইতস্তত বোধ করে তার সামনে গিয়ে ধন্যবাদ বলে। নিশাদ এমনভাবে তাকায় যেনো খেয়ে ফেলবে তাকে। রিধিশা ভয় পেয়ে নিজের চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে কাজ করতে থাকে।
অফিস ছুটি হতেই রিধিশা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। নিশাদ বাইক নিয়ে এসে ধমকে উঠে। রিধিশা রেগে যায়। নিশাদ রেগে বললো
” তোমাকে বলেছি না আমার সাথে যাবে প্রতিদিন? এখনই নামো রিকশা থেকে।” রিধিশা রেগেই ধুপধাপ করে নেমে গেলো।

রিকশাওয়ালা রিধিশাকে বললো
” কি আপা উঠবেন না তো আমরার সময় করেন কেন আপনারা? জামাই বউ ঝগড়া করবো আর সময় নষ্ট করবো আমার।” রিধিশা আর নিশাদ থমথমে চেহারায় একে অপরের দিকে তাকায়। রিধিশা কথার প্রতিবাদ করার আগেই রিকশা নিয়ে চলে গেলো।
নিশাদ শক্ত গলায় বললো
” উঠবে নাকি চলে যাবো আমি?” রিধিশা ছোট নিশ্বাস ফেলে উঠে বসে বাইকে। আজকে নিশাদ হাজারটা কথা শোনালেও রিধিশার মুখ থেকে শব্দ বের হবে না কারণ নিশাদের রাগের কারণটা একেবারে সঠিক।

কিছুক্ষণের পথে দুজন পুরোটাই চুপচাপ ছিলো। রিধিশা পেছন থেকে বাইকের মিররে নিশাদকে কতোবার দেখেছে কিন্তু নিশাদ সোজাই তাকিয়ে ছিলো। রিধিশার বাসার সামনে বাইক থামাতেই রিধিশা নেমে বলে উঠে
” আমি অনেকবার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কোনোভাবেই আমি পারিনি। পরে যদি কোনো ক্ষতি করে সেই ভয়ে আর লোক লজ্জার কারণে কিছু করতে পারিনি।”

নিশাদ শান্ত গলায় বললো
” লোক লজ্জার ভয়ে মিইয়ে থাকলে এভাবেই কাপুরুষদের কারণে মাটিতে মিশে যাবে একদিন। সমাজ তোমাকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচায় না তাই সমাজের লোক লজ্জার কারণে নিজেকে বিষর্রন দেওয়া বর্তমান নারীদের কাজ নয়। সামবে বিপদ হবে ভেবে ভয়ে গুটিয়ে না থেকে নারীবাদী হয় সেই বিপদের সাথে লড়াই করতে পারলেই পূর্ণ নারী হতে পারবে। বাসায় যাও।” নিশাদ কথা শেষ করেই টান দিয়ে বাইক নিয়ে চলে গেলো।
রিধিশা মিহি হেসে উপরে উঠে আসে।

____________

সময়ের পাল্লা বারতে থাকে। দিন পেড়িয়ে একেকটা রাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের প্রত্যেকের জীবন থেকে একটা করে দিন শুষে নিচ্ছে। আমাদের জীবনের সময় গুলোও কমে আসছে।
এক মাস ব্যস্ততায় পার করে দিয়েছে প্রত্যেকে।
শুক্রবার বন্ধের দিন। আজকের আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে। আকাশে গুড়ি গুড়ি মেঘ জমেছে। সকালের সূর্যের আলো’টা আজকে ক্ষণিক্ষণের জন্যই উঠেছিলো। কেউ দেখা পেয়েছে আবার কেউ পায়নি।

রিধিশা ছাদের এক কোণায় মলিন দৃষ্টিতে দূড় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ রিধিশার চোখ জোড়া দেখলে এখন অজান্তেই আবেগে অভিভূত হয়ে পড়বে। রিধিশার চিন্তার মাত্রা যেনো ছাড়িয়ে পড়েছে। গত এক মাসে ঝগড়া হাসি মজায় ভালোই কেটেছে সময় রিধিশা আর নিশাদের।
গত কয়েকদিন আগেই অফিসের একজন মেয়ে কলিগ রিধিশার সাথে কথা বলতে বলতে জিজ্ঞেস করেছিলো
” তোমার আর নিষাদের সম্পর্ক কেমন? মানে তুমি নিশাদের কে হও?” অনেক ভেবে উত্তরে রিধিশা উত্তর দিয়েছিলো
” বন্ধু।”

কিন্তু সেইদিন বাসায় আসার পর থেকে ভাবনার পর ভাবনাতেই ছিলো। রিধিশার মনে প্রশ্ন জাগে, আসলেই তো তার সাথে আমার সম্পর্ক কিসের?
রিধিশার নিজের মনেও আগে দু একবার প্রশ্নটা আসলেও সেইদিনের মতো সিরিয়াস হয়ে ভাবেনি।
রিধিশার মনে হলো দুজনের মাঝে কিছুটা দূরত্ব আনা প্রয়োজন তাহলেই হয়তো তাদের সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ খুঁজে পেতো আর আসল সম্পর্কটা কি বুঝতে পারতো।

কয়েকদিনে রিধিশা নিশাদকে avoid করার চেষ্টা করেছে অনেক। নিশাদকে কথা বলার জন্য তীব্র ছটফট করতে দেখেছে। নিশাদ সুযোগ খুঁজেছে শুধু রিধিশার সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু রিধিশা কয়েকদিনে নিশাদকে এড়িয়েই চলেছে কথা বলার কোনো সুযোগ দেয়নি।
নিশাদকে যেমন ছটফট করতে দেখেছে তেমনই নিজের অনুভূতিগুলোর সাথে সম্মুখীন হয়েছে। নিশাদের সাথে নিজেকে কতোটা গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলেছে সেটা প্রতিটা পদক্ষেপে বুঝতে পারছে এখন।

নিশাদকে এড়িয়ে নিজেও শান্তি পাচ্ছে না। গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করে অশান্তির মাঝে ভুগছে।
নিশাদকে ছাড়া কতোটা নিসঙ্গ সে সেটাও বুঝতে পারছে। বারবার মনে হচ্ছে নিশাদকে ভালবেসে ফেলেছে কিন্তু রিধিশা সেটা মেনে নিতে পারছে না।
নিশাদকে সে ভালোবেসে বিশ্বাসই করতে পারছে না।
রিধিশা দ্বিধায় ভুগছে। কি করা উচিত তার বুঝতে পারছে না। এভাবে বেশিদিন নিশাদকে এড়িয়ে চলা সম্ভব না ভালো করেই জানে।

বৃষ্টির ছোট ছোটি ফোটা মুখের উপর পড়তেই রিধিশা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। বৃষ্টি ভালো ভাবে শুরু হওয়ার আগেই রিধিশা ছাদ থেকে নেমে গেলো। শুক্রবার হলেও আজকে অফিসে যেতে হবে। পার্ট টাইম জব তাই শুক্রবারও অফিস রয়েছে যদিও প্রতিদিনের তুলনায় দুই ঘন্টা কম।

.
সূর্য, রেহান, সাদি ঘুরঘুরে নিশাদকে দেখছে। নিশাদের দৃষ্টি টিভিতে। সাদি ফিসফিস করে বললো
” নিশাদের কি হয়েছে জানিস রেহান? ওর ভাবসাব বোঝা মুশকিল এখন।” রেহান বিরক্ত গুলায় বললো
” জানলে কি তোদের সাথে দাঁড়িয়ে আমিও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি নাকি?” সূর্য বললো
” আমার কি মনে হয় বলতো! রিধিশার সাথে নিশ্চই কোনো ঝামেলা হয়েছে তাই কয়েকদিন ধরে চুপচাপ হয়ে আছে।”

সাদি বললো
” এখন তো ঝগড়া হয়েছে বুঝলাম। কিন্তু আমার মতো তো মনে রিধিশা নিশাদের জীবনের এন্ট্রি নেওয়ার পর থেকেই নিশাদ বদলে গিয়েছে। মাঝে মাঝে আমাদের বাসার খাবারের টেস্টও আলাদা হয়ে যায়। আমার তো মনে হয় অন্যকেউ রেঁধে দেয়। বুয়া এতো মজা করে রান্না করে কখনো।”
রেহান সাদির মাথায় গাট্টা মেরে বললো
” তোর মাথাটা কি মিষ্টি দিয়ে ঠেসে রাখিস? এতোদিন হয়েছে এখনও বলছিস মনে হয়! রিধিশাই তো মাঝে মাঝে রেধে দিয়ে যায়। নিশাদ তো অফিসে যাওয়ার সময় রিধিশাকে সাথে করেও নিয়ে যেতো আমি দেখেছি। কিন্তু কয়েকদিন ধরে একাই যাচ্ছে।”

সূর্য নিশাদের দিকে তাকিয়ে বললো
” রিধিশার সাথে সেটিং হয়ে গেলে ভালোই হবে। নিশাদ তো মনে হয় রিধিশাকে ভালোওবাসে। যাই হোক দুজনের ভালো হলেই হয়।” রেহান আর সাদি সায় জানায়। রেহান চিন্তিত হয়ে বললো
” কিন্তু ব্রো! আমার আগে যদি নিশাদের বিয়ে হয়ে যায় থাহলে কিন্তু আমি মানতে পারবো না। আমি নিশাদের আগে থেকে প্রেম করছিলাম।”
” শোন যার ভাগ্যে বিয়ে লেখা থাকবে তারই তো হবে নাকি?”

সূর্য নিশাদের কাছে এসে বসে বললো
” কিরে নিশাদ অফিসে যাবি না!” নিশাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো
” হ্যা যাবো, কেনো?” সূর্য গলা ঝেড়ে বললো
” একটা কথা ছিলো আর কি।” নিশাদ টিভি অফ করে বললো
” হ্যা বল।”
” কালকে ঘুরতে যাবি? না কালকে তো অফিস আরো দেড়িতে ছুটি হবে আজকেই যাবি ঘুরতে? অনেকদিন ধরে তো চারজন ঘুরতে যাই না।”
নিশাদ মাথা নেড়ে বললো
” ঠিকাছে। অফিস থেকে এসে রাতে নাহয় যাবো।”
সূর্যরা খুশি হয়ে যায়।

.
রিধিশা তার কাজ করছে ঠিকই কিন্তু তার মন পুরোপুরি কাজের মধ্যে নেই। নিশাদ এখনও আসেনি তাই বারবার সেদিকে তাকাচ্ছে। রিধিশা চিন্তায় পড়ে যায়। নিশাদ দেড়ি করেনা কখনো।
কিছুক্ষণ পর নিশাদ আসলো অর্ধেক ভেজা অবস্থায়। রিধিশা তাকে দেখে হাফ ছাড়ে।
চেয়ারে বসতে বসতে প্রথমে রিধিশার দিকে তাকায় নিশাদ। নিশাদকে দেখে হাতের স্প্রিড বাড়িয়ে কম্পিউটারে কাজ করছে রিধিশা।

নিশাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রিধিশার এড়িয়ে চলার বিষয়টা বুকে ব্যাথা ধরিয়ে দিয়েছে তার। রিধিশাকে হাজার বার জিজ্ঞেস করেছে এড়িয়ে চলার কারণটা কিন্তু উত্তরেও এড়িয়ে চলেছে রিধিশা। আজকে তো একটা শলাপরামর্শ করেই ছাড়বে এটার আজকে ভেবেই এসেছে বাসা থেকে।
নিশাদ একটা ফাইল দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো
” বিজয় স্যার বলেছে এটার আরেকটা ফাইলে কিছু ডিটেইলস রয়েছে যেটা স্টোর রুমে পাওয়া যাবে। স্টোর রুম থেকে নিয়ে এসো।”
রিধিশা কথা না বলে ফাইল নিয়ে উঠে গেলো।
দারোয়ানকে স্টোর রুম কোথায় জিজ্ঞেস করে সেদিকে গেলো।

.
রিধিশা স্টোর রুমে ঢুকে দেখে লাইব্রেরীর মতো একেবারে তাকে তাকে অনেক ফাইল রাখা। রিধিশা ফাইল খুঁজতে খুঁজতে ভ্রু কুঁচকে বললো
” এটা নাকি অফিসের নতুন শাখা! নতুন অফিসের স্টোর রুমের কি দশা বানিয়ে রেখেছে এরা! সব গুলো কাজচোর। এখানে এতো ফাইল রেখে দিয়েছে বারবার আসতে হবে সবাইকে। স্টোর রুমটা পরিষ্কার করতে পারে না একটু! আমাকে না পাঠিয়ে বিজয় নিজেই আসতো তাহলে এসব দেখে সবাইকে কয়েকটা লেকচার শুনিয়ে দিতো।”

রিধিশা খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে যায়। এতো ফাইলের মাঝে খুঁজে বের করতে অনেক সময় লাগবে। রিধিশা হতাশার নিশ্বাস ফেলে ঘুরতেই নিশাদকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে চিৎকার করতে চায় কিন্তু তার আগেই নিশাদের এক হাত রিধিশার মুখ চেপে ধরে। রিধিশা চোখ বড় বড় করে তাকায়। ভয়ে তার বুক ধড়ফড় করছে এখনও।

রিধিশা নিশাদের হাত সরিয়ে রেগে বললো
” এভাবে ভুতের মতো কেউ আসে? আরেকটু হলে মরে যেতাম।” নিশাদ শান্ত চাহনি দিয়ে তাকায়। রিধিশা নিশাদকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই নিশাদ রিধিশার হাত টেনে ফাইলের তাকের সাথে চেপে ধরে। রিধিশা চোয়াল শক্ত করে বললো
” ছাড়ুন আমাকে নিশাদ! এসব কি ধরনের অসভ্যতাম?” নিশাদ শক্ত গলায় বললো
” আজকে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোথাও যাবে না। তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছো কেনো বলো!”

রিধিশা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নিশাদ রিধিশার বাহু চেপে বললো
” রিধিশা একদম চুপ করে থাকবে না। তোমার সাথে কথা বলার জন্য কতো চেষ্টা করছি চোখে পড়ে না তোমার এসব? সব দেখেও তুমি এড়িয়ে চলছো আমাকে! এসব কেনো করছো বুঝতে পারছি না আমি। আমি তো কোনো ভুলও করিনি তাহলে এভাবে শাস্তি দিচ্ছো কেনো?”

রিধিশা নিচু গলায় বললো
” শাস্তি দেওয়ার তো কিছু দেখছি না। আমাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক নেই যার জন্য আমার এড়িয়ে চলাটা আপনার উপর ইফেক্ট করবে।”

চলবে……..

[আর কয়েকটা পর্ব বাকি তারপর গল্পটা শেষ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here