#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৭
“কৃষ্ণময়ী তোমার মেঘবরণ কেশের মাতাল করা গন্ধে মাতোয়ারা হতে চাই বারংবার। ।”
সকাল ছয়টার সময় এরকম একটা মেসেজ দেখে আপনাআপনি দু তিনটে ভাজ পরে গেল তপার কপালে। ডিলিট করতে গিয়ে নজরে এলো অনেক দিন আগের একটি মেসেজ।
” আমার কৃষ্ণময়ী। মেয়েদের নাকি লম্বা চুলে সুন্দর দেখতে লাগে। আজ আমি নিশ্চিত।”
তপা গুনে গুনে দেখল দুই মাস আটাশ দিন আগের মেসেজ। আনমনে ভাবতে লাগল, কে লোকটা? আমি কি চিনি? আমার নাম্বারই বা কোথায় পেল। আর সকাল সকালই কেন মেসেজ এলো? লোকটা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে?
নাম্বার আর দেখতে পাওয়ার কথা মনে হতেই তাজমহলের কথা মনে হলো। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল লোকটা তো কিছুদিন আগে কেক অর্ডার দিয়েছিল। সে কেন হবে? কিন্তু কে সে?
এমন হাজারো ভাবনা ঠেলে ফেলে দিয়ে মন দিল নিজের কাজে। ডিমের ফোম তৈরি করে তাতে ময়দা মিশিয়ে নিল। ব্যাটার প্রস্তুত করে মোল্ডে ঢেলে ওভেনে দিয়ে বই নিয়ে বসল। আজ ছয়টা কেকের অর্ডার রয়েছে। এছাড়াও দুটো সুপার শপে দিতে হবে কিছু। ব্যস্ত তপার সময় কোথায় এসব নিয়ে ভাবার।
জীবনটা এখন নতুন লাগে তপার কাছে। এইতো সেদিনও হাহুতাশ করে মরছিল। কিভাবে খেয়ে পড়ে বাঁচবে সে? কিভাবেই বা লেখাপড়ার খরচ চালাবে? কিন্তু আল্লাহ তো আছেন। তিনিই একটা পথ দেখিয়েছেন। পৃথার উছিলায় তার কর্মসংস্থানের একটা সুযোগ করে দিয়েছেন। এখন আগের মত ভাবতে হয় না। চিন্তা করতে হয় না রাত পোহালে সকালে কি খাব? আদৌ খাবার পাব তো?
একটা ক্লাস শেষে বেরিয়ে এলো তপা। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে তার। লাইব্রেরীতে গিয়ে একটু বসবে সে। মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে সামনে কতগুলো পা দেখে থেমে গেল। মাথা উঁচু করে দেখল রাত্রি দাঁড়িয়ে। সাথে আরও পাঁচ ছয় জন। তপা বিরক্তি ভঙ্গিতে তাকাল। রাত্রি তপার পা থেকে মাথা অবধি একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
“দেখতে তো হাভাতে, হাবাগোবাই মনে হয়। তলে তলে এতকিছু করছিস কিভাবে তুই?”
তপা বিক্ষিপ্ত নয়নে তাকিয়ে বলল,
“কি করেছি আমি?”
রাত্রি অট্টহাসি দিয়ে পাশের জনের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“এই দেখ এমন ভাব করছে যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। তলে তলে যে আস্ত পুকুরটাই খেয়ে নিচ্ছে। বেয়াদব মেয়ে কোথাকার।”
তপা নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,
“মুখ সামলে কথা বলুন। কি বলছিলেন পুকুর খেয়ে নিচ্ছি? খেলে পুরো সমুদ্রটাই গিলে ফেলব, পুকুর ছুঁয়ে হাত নোংরা করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। এখন ঝেড়ে কাশুন তো দেখি ঝটপট। নয়তো বিদেয় হন চোখের সামনে থেকে।”
রাত্রি নিজের দু’হাত মুঠো করে ফেলল। কাটকাট গলায় বলল,
“পলক কে কি দেখিয়ে পাগল করেছিস তুই? এই শরীর? বিছানায় গিয়েছিস ওর সাথে? যে পলক আমার দিকে ফিরেও তাকায় না সে তোর মত কালির সাথে কিভাবে থাকে? বল এই শরীরটা দিয়েই পাগল করেছিস ওকে তাই না?”
তপার মাথা জলন্ত আগ্নেয়গিরির মত টগবগ করছে। চোখ কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। কানের ভেতরে মনে হচ্ছে ফুটন্ত সীসা ঢেলে দিয়েছে।
নিজের রাগটা সংবরণ করার চেষ্টা করে বলল,
“আপনার দিকে ফিরে তাকায় না কেন আপনার পেয়ারী পলক তাজওয়ার? আপনি শরীর দেখাতে পারেন না? দেখতে তো ভালোই মনে হচ্ছে। তাহলে তাকে দেখাতে কি সমস্যা? বিছানায় যেতেও নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? আপনার সো কল্ড পলক তাজওয়ার এত সুন্দর ফিগার দেখে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে না আপনাকে। তাহলে যাচ্ছেন না কেন? নাকি আপনার মধ্যেই কোনো ঘাপলা আছে। আছে নাকি? এরকম কিছু থাকলে আপনি আমাকে নিঃসংকোচে বলতে পারেন। আমার এক পরিচিত ডাক্তার আছে। তাকে বলে এই সমস্যা বিশেষজ্ঞ কোনো ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট নিতে বলবো। যাবেন তো মিস রাত্রি?”
রাত্রি সবটা শুনে তেড়ে এসে তপার গালে চড় মারতে উদ্যত হয়। তপা হাত মুচড়ে ধরে পিঠে ঠেকিয়ে বলল,
“আমাকে অবলা ভেবে ভুল করবেন না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সবাই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আর চড় আমিও মারতে পারি। কিন্তু আমার পরিবার আমাকে সেই শিক্ষা দেয় নি। কিন্তু আর একবার যদি এই হাত আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে তবে হাত আর হাতের জায়গায় থাকবে না। মাইন্ড ইট।”
রাত্রি আবারও হেসে উঠল।
“পরিবারের বড়াই করছিস? তা তোর পরিবার তোকে কি শিক্ষা দিয়েছে? লাইব্রেরীতে লটরপটর করতে? লিফটে গিয়ে জড়াজড়ি করতে? নাকি ছেলেদের সাথে চিপকে থাকতে? আরও তো ছেলে আছে কিন্তু পলকই কেন? পলক হ্যান্ডসাম বলে নাকি ওর টাকা আছে বলে? প্রস্টিটিউটের মত ওর থেকে টাকা নিয়ে নিজের পরিবার চালাচ্ছিস? লজ্জা করে না। শালী প্রস্টিটিউট কোথাকার। আবার পরিবারের ডায়লগ শোনাতে আসে।”
তপার চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করল। বা হাতে চোখ মুছে কিছু বলার আগেই সশব্দে রাত্রির গালে ছুঁয়ে দিল একটি ফর্সা ইস্পাত কঠিন হাত। রাত্রি হঠাৎ আক্রমণ সামলাতে না পেরে দুপা পিছিয়ে গেল। তপা অবাক হয়ে চেয়ে রইল সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে।
পলক রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তপার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আল্লাহ মুখ দেয় নি সাথে? পটরপটর কি কেবল আমার সাথেই করতে পারো?আমার একটা কথাও তো মাটিতে পড়তে দাও না তুমি। তাহলে ওর বেলায় মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছো কেন? দু ঘা লাগিয়ে দিতে পারো নি?”
তপা ঈষৎ রেগে বলল,
“সবকিছু আপনার জন্য হয়েছে। না আপনার সাথে দেখা হতো আর না রাত্রির সাথে কোনো ঝামেলা হতো। সেই প্রথম দিন থেকে আপনি আমার মাথায় উঠে নেচে যাচ্ছেন। আমি বলেছিলাম লাইব্রেরীতে আসতে? আমি বলেছিলাম লিফটে আমার সাথে যেতে? না তো? তাহলে নোংরা কথাগুলো আমাকেই কেন শুনতে হবে? আমি মেয়ে বলে? নাকি আমি অসহায় বলে? কোনটা মিস্টার পলক তাজওয়ার? ঝামেলা আপনার আর আপনার রাত্রির। কিন্তু এর মাঝে আমি কেন? কেন আপনারা আমাকেই পেলেন আপনাদের দাবার গুটি বানানোর জন্য? আর আপনার রাত্রি? সে যদি আপনাকে এতই চায় তবে কেন সেদিন আমাকে পাঠালো ওই চিরকুট দিয়ে। নিজেই যেতে পারতো। আর যখন আমাকে পাঠালোই আপনি কেন এসে ওর সাথে ঝামেলা করলেন? করবেনই তো। সমস্যা তো আপনার হচ্ছে না। ঝামেলা তো আমাকেই পোহাতে হচ্ছে। অসহায় তো আমি। আপনি নন।”
রাত্রির দিকে তাকিয়ে আঙুল তুলে বলল,
“মিস রাত্রি। লাস্ট একটা সুযোগ দিচ্ছি। এরপর আমার পেছনে লাগতে আসলে আমার মুখ নয় হাত চলবে। এটা শুধু কথার কথা নয়। সময় আসলে বাস্তবে রূপ নেবে। আর হ্যা আমি কালো। এটা একান্তই আমার গায়ের রঙ। না আমি আপনার গায়ের সাথে ঢলাঢলি করে আপনার ফর্সা রঙকে কালো বানিয়ে দিচ্ছি আর না আপনার ভাইয়ের বউ হচ্ছি। তাই আমার গায়ের রঙ নিয়ে আপনার সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এটা একান্তই আমার। আর আমি এতেই সুখী। আমার তো বাইরেটা কালো। কিন্তু আপনার তো অন্তর পর্যন্ত কালো। নোংরা। জঘন্য। দুর্গন্ধযুক্ত।”
বলে আর একমুহূর্তও দেরি না করে পলকের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে হনহন করে লাইব্রেরীর দিকে চলে গেল।
রাত্রি ক্রোধে ফেটে পড়লেও পলক অপলক তাকিয়ে রইল তপার পশ্চাৎগমনের দিকে।
লাইব্রেরীতে গিয়ে নীরব অশ্রু বিসর্জন দিল অনেকটা সময় নিয়ে। নিজের ভাগ্যের উপর ভীষণ রাগ হয় তপার। কি হতো যদি একটুখানি সুখ লেখা হতো সেখানে? কি হতো যদি একান্তই আপন বলে কেউ থাকতো তার? কি হতো যদি ছোট বেলাটা ভয়ংকর না হয়ে একটুখানি মধুর হতো? কি হতো যদি ওই নোংরা হাতটা ছুঁয়ে না দিত ওর ছোট্ট কোমলমতি শরীরটা?
আর নিতে পারছে না তপা। ছোট্ট জীবনটা ভীষণ ভারী লাগছে নিজের কাছে। না পারছে নিজের মৃত্যু কামনা করতে আর না পারছে সহ্য করতে।
পলক ঘন্টা খানেক সময় ধরে অপেক্ষা করছে তপার বের হওয়ার। কিন্তু সে তো বের হওয়ার নামই নিচ্ছে না। লাইব্রেরীর কোন কোণায় ঘাপটি মেরে আছে কে জানে? এই মেয়ে যে এত লাইব্রেরীতে কি করে ভেবে পায় না পলক। সময় পেলেই ছুট লাগায় লাইব্রেরীতে।
দীর্ঘ সময় পর ধীর পায়ে বের হলো তপা। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল পলকের দিকে। তপাকে আসতে দেখে পলক নড়েচড়ে দাঁড়ালো। কিন্তু তপা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল গেটের দিকে। পলকের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। দ্রুত গতিতে হেঁটে এসে তপার সাথে পা মিলিয়ে বলল,
“তিয়াশা কথা শোনা আমার। রাত্রির ব্যবহারের পেছনে আমার কোনো হাত নেই। আমাকে ভুল বুঝো না তুমি।”
আরও কিছু বলার আগেই তপা পলকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“থামুন আপনি। আমি কিছু শুনতে চেয়েছি আপনার কাছে? চাইনি তো? তাহলে? ভার্সিটিতে এত স্টুডেন্ট সবার সাথেই কি একই ব্যবহার করেন? না তো? তবে আমার বেলায় কেন? আমি চাই না তো আপনার এত মনোযোগ। সত্যিই চাই না। আমি হাত জোর করছি, প্লিজ আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন। আমি সাধারণ। সাধারণ হয়েই বাঁচতে দিন। দয়া করে আমার সামনে আর এভাবে আসবেন না। অন্য দশটা স্টুডেন্টের মতই ব্যবহার করুন আমার সাথে। দয়া করুন আমাকে। দোহাই লাগে।”
পলক অবাক হয়ে চেয়ে দেখল তপার নিঃসংকোচ আবদার। একবারও বুক কাঁপলো না এভাবে বলতে। একবারও ভাবল না পলক থাকবে কি করে তার কৃষ্ণময়ীকে না দেখে।
#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৮
“পলক তুমি কি ভেবেই নিয়েছো এভাবে ভবঘুরে হয়ে জীবন কাটিয়ে দেবে?”
পলক মায়ের কথা শুনে খাওয়া থামিয়ে দিল। মৃদু স্বরে বলল,
“কি হয়েছে মা? এভাবে বলছো কেন?”
পায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“তুমি এখন যোগ্য হয়েছো পলক। তোমার কি মনে হচ্ছে না তোমার এখন অফিস জয়েন করা উচিৎ? তোমার বাবার বয়স হচ্ছে। এখনো এত প্রেসার নিতে পারে লোকটা? তুমি হয়তো এটাও জানো না কাল বুকের ব্যথার জন্য হসপিটালে যেতে হয়েছিল তাকে। তুমি তো ঠিকমতো বাসায়ও আসো না। জানবে কি করে? ভার্সিটি লাইফ শেষ হয়েছে দুবছর আগে। এখনো কেন আঁকড়ে আছো সেখানে? রাজনীতি? কি দেবে তোমাকে ওই রাজনীতি? হ্যা তুমি মানুষের সাহায্য করতে চাও তো করো। তোমার বাবার যথেষ্ট আছে পলক। সেখান থেকে সাধ্যমত সাহায্য করো তুমি। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমাদের একটাই সন্তান তুমি। তোমাকে নিয়ে আমাদের চিন্তা হয় পলক। ওই অনিশ্চিত জীবনের দিকে আমরা তোমাকে যেতে দিতে চাই না। চাই না তোমার চিন্তায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে। আমরা চাই তুমি তোমার বাবার ব্যবসার হাল ধরো। নাকি তোমার ক্ষমতা চাই পলক?”
পলক মাথা নিচু করে বলল,
“ক্ষমতার লোভ আমার কোনো কালেই ছিল না মা। ঠিক আছে আমি অফিস জয়েন করবো। বাবা আমি আগামী কালই যাব অফিসে। তুমি ব্যবস্থা করো।”
পায়েল খুশি হলেও ছেলের মুখটা দেখে খুশির মাত্রাটা কমে গেল।
“তোর কি কিছু হয়েছে পলক?”
রায়হান তাজওয়ার মৃদু স্বরে বললেন। পলক বাবার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,
“বিরহ চলছে বাবা। তবে সেটা একতরফা বিরহ।”
রায়হান তাজওয়ার কিছু বুঝতে না পেরে স্ত্রী পায়েলের দিকে তাকালেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। পায়েল স্বামীর দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝালেন সে কিছু জানে না এ ব্যাপারে।
একদিন দুইদিন করে পনেরোটি দিন পার হয়ে গেছে। তপা পলকের দেখা পায় নি। প্রথম দিকে ব্যাপারটা আমলে না নিলেও দিন গড়াতে থাকলে তপা চিন্তিত হয়ে পড়ল। কেন আসছে না লোকটা?প্রান্তকে ফোন করে কিছু জানতে চাওয়ারও সাহস হচ্ছে না তার। পাছে প্রান্ত কি না কি ভেবে বসে। অগ্যতা দিন গুনতে থাকল পলকের ফিরে আসার।
পলক অফিসে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। বাবার সাথে নিয়মিত অফিস করছে সে। সেদিনের পর থেকে আর ভার্সিটি মুখো হয় নি। তবে তপাকে না দেখেও থাকে নি। তিনদিন যেতেই মারাত্মক হাসফাস লাগতে শুরু করে। আর থাকতে না পেরে টুক করে রাস্তা থেকে দেখে চলে এসেছে। দেখেছে কৃষ্ণময়ীর মায়াময়ী রূপ। সেটাও পৃথার সাহায্যে। প্রান্তর থেকে পৃথার নাম্বার নিয়ে পৃথা কে বলেছিল তপা কে নিয়ে বাইরে বের হতে। তাছাড়া তো তপার দেখা পাওয়া ভার। ক্লাস আর জরুরি দরকার ছাড়া সে বারমুখো হয় না।
পনেরো দিন পর আবার পলকের ফোন পেয়ে পৃথা মুচকি হাসল। আবার বোধহয় তৃষ্ণা পেয়েছে পলকের সেটা ভেবে ফোন ধরেই বলল,
“ভাইয়া আবার তৃষ্ণা পেয়েছে?”
পলক পৃথার মুখে এহেন কথা শুনে কেশে উঠল। লাজুক হেসে বলল,
“তা তো পেয়েছেই বটে।”
“আমি কিন্তু আর বাইরে নিয়ে যেতে পারব না। ওর শরীরটা ভালো নয় তেমন। কাল হালকা জ্বরও এসছিল।”
পলক উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“সে কি। ঠিক আছে এখন? হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে?”
পৃথা হাসল। ভাল লাগার হাসি। তৃপ্তির হাসি।
“না ভাইয়া। হসপিটালে নেয়ার মত বাড়াবাড়ি হয় নি। ঠিক আছে মোটামুটি। ক্লাসেও গিয়েছিল আজ। বেশি সমস্যা হলে তো যেত না। যাই হোক আপনি হঠাৎ কল দিলেন?”
পলক আমতা আমতা করে বলল,
” দেখতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু.. ”
পৃথা হাসি লুকিয়ে বলল,
” ছবিতে মন ভরবে?”
অগ্যতা রাজি হলো পলক। নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো। সামনে থেকে না দেখতে পারলেও ছবি দেখেই মন ভরিয়ে নেয়ার আশায় বুক বাঁধলো।
ঘন্টা খানেক যেতেই মেসেজের টুংটাং শব্দে পলক হুরমুরিয়ে পড়ল ফোনের উপর। মোবাইল স্কিনে স্পর্শ করতেই ভেসে উঠল তপার মোহময়ী মুখখানা। তিনটে ছবি দেখার পর সামনে এলো তিন মিনিট দশ সেকেন্ডের একটা ভিডিও। যেখানে তপা বিছানায় বসে চুলে তেল দিচ্ছে। লম্বা ঘনকালো চুলগুলো গাত্র পেরিয়ে বিছানায় লুটোপুটি খাচ্ছে। মাঝে মাঝে তপা বিরক্তিকর শব্দ করছে মুখ দিয়ে । মনে হচ্ছে চুলগুলোর উপর ভীষণ বিরক্ত সে। পলক আয়েসি ভঙ্গিতে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে তার কৃষ্ণময়ীর কেশরাশি। তেল দেয়া শেষ করে চিরুনী করতে শুরু করল। এর মাঝে একবার সোজা তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“হয়েছে তো ভিডিও করা এবার রেখে দে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।”
“আর একটু। তুই চিরুনী কর না। চুল বাঁধা ভিডিও করবো তো।”
পৃথার কণ্ঠস্বর ভেসে আসল।কিন্তু তাকে দেখতে পেল না পলক। হয়তো ফোনটা ধরে ছিল সে।
চিরুনী করা শেষে হাঁটু অবধি লম্বা চুলগুলো বিনুনি করে নিল। ব্যস এতটুকুই। এতটুকুতেই মনের কোণে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। পলক আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। জীবন টা নতুন লাগছে তার। সবকিছু কেমন অন্য রকম। সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে যেন সুখের অসুখ হয়েছে।
দীর্ঘ বাইশ দিন পর কাঙ্খিত মুখটা দেখতে পেল তপা। পার্কিং জোনে বাইকের উপর বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে গেইটের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তপা ধীর পায়ে পলক কে অতিক্রম করে চলে গেল। কাছাকাছি এসে আর তাকাল না একটা বারের জন্যও। তাকালেই দেখতে পেত একজন মানুষ কতটা ব্যাকুল হয়ে অবলোকন করছে তাকে। কতটা মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু আফসোস সে একবারের জন্যও বুঝলো না পলকের আকুলতা।
কিছুক্ষণ পর তপা তার ভার্সিটির এক বান্ধবী লুবনাকে নিয়ে হাজির হলো পলকের আস্তানায়। পেছনে দাঁড়িয়ে মিহি স্বরে শুধালো,
“এক্সকিউজ মি ভাইয়া।”
পলকের কপালের রগগুলো দপদপ করে উঠল। এতদিন পরে এসে কি মধুর বুলি শোনাচ্ছে। ভাইয়া। হাহ্। শুনেও না শোনার ভান করে নিজের কথা চালিয়ে গেল সামনের গোটাকতক মানুষের দিকে তাকিয়ে।
তপা গলার জোর আরেকটুখানি বাড়িয়ে বলল,
“শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো?”
পলক তখনও পেছন ফিরে তাকিয়ে রইল।
তপা এবার বেশ জোরেশোরেই বলল,
“মিস্টার তাজওয়ার। আমি কিছু বলতে চাচ্ছি তো।”
পলক মুচকি হাসল। কিন্তু তপার দিকে তাকানোর আগে মুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে গমগমে গলায় বলল,
“জ্বি বলুন।”
তপা আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে কয়েকদিন যাবত ক্যাম্পাসের বাইরে কিছু বখাটে হ্যারাস করছে সব মেয়েদের। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে এসেও হানা দিচ্ছে।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“সো আমি কি করতে পারি? সবার প্রবলেম সলভ করার দায়িত্ব নিশ্চয়ই একা আমার নয়? আপনি বরং দায়িত্ব নিয়ে নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করুন।”
তপা আশাক্ষুন্ন হলো। পলক এভাবে বলবে ও ভাবতেই পারে নি। মন খারাপ করে বলল,
“আমি আমার জন্য বলছি না। আমাকে কে কি বলবে? আমি তো সবার মত রূপবতী, রূপসী নই। কিন্তু বাকি মেয়েগুলো ক্যাম্পাসে আসতে ভয় পাচ্ছে। কাল একজনের ওড়না টেনে নিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে মেয়েগুলো ক্লাস করবে কি করে?”
পলক ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
“মিস তিয়াশা আপনি নিজের চরকায় তেল দিন। অন্যের টা না ভাবলেও চলবে।”
তপা মাথা নিচু করে ফেলল। চোখের কার্নিশে বিন্দু বিন্দু জল জমতে শুরু করেছে। যে কোনো সময় গড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু ও চায় না এই নাক উঁচু লোকটার সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে। তাই লুবনার হাত ধরে বলল,
“ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। চল।”
লুবনা হাতটা ছাড়িয়ে পলকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া ওরা অসভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কাল একজনের ওড়না টেনে নিয়েছিল। তপা প্রতিবাদ করায় ওর হাত ধরে অশ্লীল কথা শুনিয়েছে। আজেবাজে ইঙ্গিত দিয়েছে। আপনি প্লিজ কিছু একটা করুন। আমরা অন্য কাউকে ভরসা করতে পারছি না। আপনি এতদিন ভার্সিটিতে আসেন নি। আমরা কতটা অসহায় ছিলাম বলে বোঝাতে পারব না। আপনি ওদের একটা ব্যবস্থা করুন দয়া করে।”
পলক গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে বলল,
“ক্লাসে যাও।”
তিনশত আট নাম্বার রুম। বিশালাকার এই রুমটিই হলরুম। হলরুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কানে এক মাদকতাময় সুর ভেসে এলো। থমকে দাঁড়ালো তপা। পা দু’টো হটাৎই তপার সাথে বিদ্রোহ করে নিজেদের চলার গতি থামিয়ে দিল। দরজাটা একটু ঠেলে ভেতরে উঁকি দিল তপা। অদূরেই চেয়ারে বসে গিটারে টুংটাং শব্দ তুলে চোখ বন্ধ করে সুরের ঝংকার তুলছে পলক। তপা নিস্প্রভ চাহনিতে চেয়ে রইল কেবল শুভ্র মুখখানিতে। কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে হৃদয় কাঁপানো সুর।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে, ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কি না চেয়ে আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
বুকের ভেতরটায় প্রবল বেগে ঝড় বইছে। শান্ত হতে না পেরে দরজা থেকে পিছিয়ে গেল তপা। এক ছুটে লাইব্রেরীতে গিয়ে বইয়ের তাকের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।
গান শেষ করে দরজার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল পলক। একবারের জন্য সে দেখেছিল তার কৃষ্ণময়ীর মুগ্ধ চাহনি। দেখেছিল হরিণী চোখের কার্নিশে চিকচিক করা নোনাজলটুকু। ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসল পলক। তবে কি কৃষ্ণময়ীও মাতোয়ারা হচ্ছে তার মতো?
মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তপার। কেন গাইলো সে এই গান? এত মোহনীয় কণ্ঠে কেন গাইতে হবে? তপা যে বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। সে কি বুঝতে পারছে না? নাকি ইচ্ছে করেই করছে এমন? কিন্তু তপার যে বেসামাল হলে চলবে না। সে তো চাঁদের দিকে হাত বাড়াতে পারবে না। চাঁদ কেবল দূর থেকে দেখাটাই শোভা পায়। হাতে পাওয়াটা তো কল্পনা মাত্র।
পরের দিন ক্যাম্পাসে প্রবেশ পথে কোনো আপত্তিকর ঘটনার সম্মুখীন হলো না তপা। কিন্তু বিষয়টা আমলে নিল না। ভাবল ভেতরে গিয়ে হয়তো তাদের দেখা মিলবে। কিছুদিন ধরে তো এটাই রুটিনমাফিক চলে আসছে। হয় বাইরে হ্যারাস করবে নয়তো ভেতরে।
কিন্তু আজ ক্যাম্পাসে ঢুকতেই তপার চক্ষু চড়কগাছ। তপার হাত ধরে বাজে কথা বলা ছেলেটার হাত গলার সাথে ঝুলছে। ভাঙা হাতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। বাকি সাগরেদের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। তপা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। এদের এই হাল কে করলো? ভাবতে ভাবতে ছেলেটা এগিয়ে এসে মাফ চাইল তপার কাছে। তপা চোখ বড় বড় করে সবটা বোঝার চেষ্টা করছে। একে একে কালকের ঘটনাগুলো মনে করতেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। যা এড়ালো না অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা পলক তাজওয়ারের জহুরি দৃষ্টির। নিজেও এক চুটকি হেসে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। আপাতত তার কাজ খতম।
“কৃষ্ণময়ী। আমার ঘুম কেঁড়ে নিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছো? ঘুমিয়ে নাও যত ইচ্ছে। একবার কাছে পাই তারপর তোমার শাস্তি হবে। কঠিন শাস্তি।”
তপা মেসেজ দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বিরবির করে বলল,
“ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? মিস্টার কুলক তাজওয়ার কে বলতে হবে এর হাতটাও গলায় ঝুলিয়ে দিতে। যাতে আর মেসেজ টাইপ করতে না পারে।”
চলবে…
(আজ কি লিখেছি নিজেও জানি না। নিজের কাছেই কেমন অগোছালো লাগছে।)
চলবে…