কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব -১৩+১৪

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্ব১৩

সাদা পর্দা ঘেরা বিলাসবহুল কেবিন। সাদা সোফায় বসে আছে তপা। পাশেই চেয়ারে বসে ডাক্তারের সাথে জরুরী বৈঠক করছে পলক। তপা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে। কারণ ডাক্তার হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে। পলকের মুখটা দেখতে পাচ্ছে না তপা। তার শরীরের থেকে থেকে কেঁপে ওঠা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে সেও হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে বোধহয় ঠোঁটের কোণে, চোখে মুখে । তপার বোধগম্য হচ্ছে না এত হাসির কারন। এবার তপার সন্দেহ হচ্ছে, তারা হসপিটালই এসেছে তো? নাকি কোনো সার্কাস দেখতে এসেছে? এত হাসি কেন? আশ্চর্য! তপা পলকের কথা শুনতে না পারায় রাগ হচ্ছে কেবিন এত বড় হওয়ার জন্য। ডাক্তারের কেবিন হবে কবুতরের বাসার মত। ছোট্ট, খুপরি, ঝুপড়ি মতো।এত বড় বিলাসবহুল হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ডাক্তার হবে বয়স্ক, চশমা পরা কোনো লোক। এত কিউট একটা মেয়ের ডাক্তার হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল? না তো।
কিয়ৎক্ষণ পরে তপা নিজের উপরই রেগে গেল। সে হিংসাত্মক আচরণ করছে। তাও কিনা সুশ্রী ডাক্তার কে। সেটাও আবার মিস্টার তাজওয়ারের জন্য। ভাবতেই নিজেকে কয়েক দফা মনে মনে ঝাড়ল সে।

তপার ভাবনায় ভাটা পড়ল পলকের হাতের স্পর্শ মাথায় পড়তেই। পলক তপার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলল,
“ভয় করছে?”
তপার এক মূহুর্তের জন্য কি হলো জানে না। চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। পলকের চোখে পড়তেই হন্তদন্ত হয়ে পাশে বসে বলল,
“তিয়াশা। কি হয়েছে? বলো আমাকে। মাথা যন্ত্রণা করছে? পা ব্যথা করছে?”
তপা মাথা নাড়ালো। পলক আবারও বলল,
“তাহলে কি ভয় করছে? ডক্টর ব্যথা দেবে সেজন্য ভয় পাচ্ছো? ব্যথা দেবে না তো। যদি ব্যথা পাও তবে আমাকে বলবে। আমি ডক্টরের লাইসেন্স খেয়ে দিব।”
তপা পলকের পাগলামি দেখে হেসে ফেলল। পলক অবাক হয়ে বলল,
“তুমি হাসছো? আমি টেনশনে মরছি কি হলো ভেবে। আর তুমি মজা নিচ্ছো?”
তপা হাসি থামিয়ে মলিন গলায় বলল,
“আসলে এভাবে ভরসার হাত মাথায় রাখার মতো মানুষ তো আমার জীবনে খুবই নগন্য। তাই চোখে জল চলে এসেছে।”
পলক কিছু বলতে চেয়েও গিলে ফেলল কথাগুলো । তপার দিকে তাকিয়ে মোলায়েম গলায় বলল,
“ব্যান্ডেজ খুলতে হবে তো এখন।”
তপা মুচকি হেসে বলল,
“আমি রেডি।”
পলকও বিনিময়ে একটুখানি হেসে কোলে তুলে নিল। চেয়ারে বসিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এখানেই চলবে তো? নাকি তোর কোনো অসুবিধা হবে।”
ডাক্তার মুচকি হেসে বলল,
“আমার আবার কি হবে? আমি ডাক্তার। আমার রোগী আর মেডিসিন থাকলেই হয়। রাস্তাঘাটেও চিকিৎসা করতে পারি। এটাতো স্বয়ং আমার কেবিনের চেয়ার।”
পলক মাথা নেড়ে হেসে বলল,
“তুই আর পাল্টালি না।”
ডাক্তারও বিনিময়ে মৃদু হাসল। তপার দিকে তাকিয়ে মসৃণ কণ্ঠে শুধালো,
“আপুনি ভয় পেও না। আমি চেষ্টা করছি ব্যথা না দিতে।তুমি চোখ বন্ধ করে পাঁচ মিনিট স্বপ্ন দেখ। আমি আমার কাজ ফিনিশ করে ফেলি এর মধ্যে।”
তপা পুলকিত হলো ডাক্তারের ব্যবহারে। অথচ সে হাসাহাসি দেখে আনমনে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিয়েছে। হোক না সেটা মনে মনে।
তপা সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে ফেলল। মিনিট খানেক পেরোতেই চোখ খুলে বড় বড় করে তাকাল পলকের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর আবারও চোখ বন্ধ করে পুনরায় চোখ বড় বড় করে তাকাল। এভাবে চলল তিন চার বার। পলক ভ্রু কুঁচকে তপার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে একটুখানি ঝুকে তপার মুখোমুখি হয়ে নিচু গলায় বলল,
“কি হয়েছে তিয়াশা? এরকম করছো কেন? একবার চোখ খুলছো আবার বন্ধ করছো। কোনো সমস্যা হচ্ছে?
তপা চোখ পিটপিট করে বলল,
” আমার বোধহয় চোখে সমস্যা হয়েছে মিস্টার তাজওয়ার।”
পলক অবাক হয়ে বলল,
“চোখে সমস্যা? কখন থেকে হলো? আর তুমিই বা বুঝলে কি করে?”
তপা ঠোঁট উল্টে বলল,
“এক্ষুনি হলো সমস্যা। চোখ বন্ধ করেও যা দেখি চোখ খুললেও তাই দেখছি।”
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। মৃদু স্বরে বলল,
“চোখ বন্ধ করে কি দেখতে পাচ্ছো? চোখ খুলেই বা কি দেখতে পাচ্ছো?
তপা বিরবির করে বলল,
” এই কুলক তাজওয়ার আমাকে পাগল করে ফেলবে মনে হচ্ছে। ব্যাটা সাংঘাতিক লোক। একে বলা যাবে না তপা। এ যদি একবার জেনে যায় চোখ বন্ধ করলেও আমি তাকেই দেখছি। তাহলে এর যন্ত্রণায় নির্ঘাত আমার পাবনার বাসিন্দা হতে হবে। কথাগুলো হজম করে ফেল তাড়াতাড়ি তপা। প্রয়োজনে দু’টো হজম ক্যান্ডি খা।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি বিরবির করছো? স্পষ্ট করে বলো।”
তপা জোর করে একটু হেসে বলল,
“কিছু না তো। আপনার কাছে হজম ক্যান্ডি হবে?”
পলক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। তপা এই সুযোগে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

ব্যান্ডেজ খোলা থেকে শুরু করে ড্রেসিং করা অবধি পুরোটা সময় পলক তপার পাশে দাঁড়িয়ে একহাত আঁকড়ে ধরেছিল। তপা ভরসার হাত পেয়ে নির্ভয়ে বসেছিল অনেকটা সময়। ড্রেসিং করা শেষে পলকের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বলল,
“হয়ে গেছে। এখন বল তো এত আঘাত কি করে পেল? মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিস। পা ভেঙে দিয়েছিস। ব্যাপারটা কি? তুই কি টর্চার করিস ওর ওপর?”
পলক ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তপা শব্দ করে হেসে উঠল। পলক অবাক হয়ে তপার দিকে অপলক চেয়ে রইল। তার কৃষ্ণময়ী এভাবে হাসতে পারে জানা ছিল না তো। একদম হৃদয় কাঁপানো হাসি। দম বন্ধ করা হাসি।অনূভুতি গুলো গলা অবধি এসে যেন আস্টেপিস্টে জড়িয়ে রয়েছে কণ্ঠনালি কে।
পলক গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আমি টর্চার করি নি। বেচারি ভার্সিটির সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে গেছে।”
“তোর বউ ভার্সিটির স্টুডেন্ট। খুব তো বলতিস ছোট মেয়ে বিয়ে করবি না। সেম এজ বা দু এক বছরের ছোট কাউকে বিয়ে করবি। এখন কি হলো?”
তপা হা করে চেয়ে রইল। বলছে কি ডক্টর? বউ! এই কুলক তাজওয়ার তাকে বউ বলে পরিচয় দিয়েছে। কি সাংঘাতিক।
তপার চাহনি দেখে পলক মৃদু হেসে বলল,
“তোমার সাথে তো পরিচয় করিয়ে দেই নি তাই না? ও হচ্ছে মিথিলা। আমার স্কুল এন্ড কলেজ ফ্রেন্ড। ভার্সিটিতে গিয়ে আলাদা হয়ে গেছি। আমি ইউনিভার্সিটি ও মেডিকেলে।”
তপা মুচকি হাসল কেবল। তার এই কথার প্রেক্ষিতে কি বলা উচিৎ বুঝতে পারল না। তবে মিথিলা থেমে থাকল না। অনর্গল কথা বলে যেতে থাকল। থেকে থেকে আবার হাসির ফোয়ারাও বয়ে গেল। তপা দর্শক মাত্র। তার ভূমিকা কেবল শোনা, দেখা এবং মাঝেমধ্যে মুচকি হাসি বিনিময় করা।

কেবিন থেকে বেরিয়ে যেই না নিচে নামার জন্য সিঁড়িতে পা রাখবে তখন তপা চকিতে তাকাল। পলকের বুকে হালকা থাপ্পড় দিয়ে বলল,
“থামুন থামুন। একটু দাঁড়ান।”
সহসা এহেন আচরণে পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছে? ওয়াশরুম যাবে?”
তপা পলকের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
“ওই দিকে দেখুন। ওটা রাত্রি না?”
পলক চমকাল। তপার ইশারা করা জায়গায় দ্রুত তাকিয়ে দেখল রাত্রি হুইল চেয়ারে বসে আছে। ওর দৃষ্টি রেলিং বেদ করে বাইরে বিচরণ করছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। পলক অবাক চোখে দেখল রাত্রির পানে। মুখটা শুকিয়ে গেছে। মাথায় তপার মতই ব্যান্ডেজ। পায়েও একই অবস্থা।
কারো উপস্থিতি টের পেয়ে রাত্রি চোখ তুলে তাকাল। সামনে পলক ও তার কোলে তপা কে দেখে মাথা নিচু করে ফেলল। পলক তপা কে পাশেই একটা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়ল। তপা অবাক হয়ে দেখছে রাত্রি কে। কৌতূহল দমাতে না পেরে বলেই ফেলল,
“আপু, আপনার এই অবস্থা কি করে হলো?”
রাত্রি মলিন হাসল। বাইরের দিকে তাকিয়েই বলল,
“নিয়তি। পরের জন্য কুয়ো খুঁড়লে সে কুয়োয় নিজেকেই পড়তে হয় জানো তো।”
তপা কিছু বুঝতে না পেরে চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইল। পরক্ষণেই মনে পড়ল সেদিনের বলা কথাগুলো। সিসিটিভি ফুটেজ, ভার্সিটির বখাটে ছেলেটার ভাঙা হাত মনে পড়তেই তপা পলকের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“এসবের পেছনে আপনার হাত নেই তো?”
সোজাসাপটা প্রশ্নে পলক থতমত খেয়ে কেশে উঠল। আমতা আমতা করল।
“আমি কেন করবো? আমি কিছু করিনি। তাই না বল।” রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলল পলক। রাত্রি মলিন হাসল।
“তপা ওদের দোষ নেই। আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে ফেলে দিয়েছিলাম তার শাস্তি আল্লাহ আমাকে সাথে সাথেই দিয়ে দিয়েছে। ওরা কিছু না করলেও রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলেও তো একটা ব্যাপার আছে তাই না?”
তপা ঈষৎ অবাক হলো। ও জানতো না রাত্রি ওকে ফেলে দিয়েছিল। সিসিটিভি ফুটেজে কি ছিল তা আর জানা হয় নি তার। কিয়দংশ সময় পর তপা মৃদু স্বরে বলল,
“ওরা মানে কে কে আপু? কাদের দোষ নেই?”
পলক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তপার দিকে। এ মেয়ে রীতিমতো গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিয়েছে।
“তুমি অসুস্থ তিয়াশা। চলো এখান থেকে। রাত্রিও তো অসুস্থ। ওর ও নিশ্চয়ই কথা বলতে ভাল লাগছে না। চলো এখান থেকে।”
তপা মৃদু আওয়াজে বলল,
“এত ভয় কিসের মিস্টার তাজওয়ার?”
“ভয়? আমি? আমি কেন ভয় পাব? আশ্চর্য। তোমার শরীর ভালো না তাই বললাম চলে যেতে।”
তপা মুচকি হেসে বলল,
“আমি আপনাকে হারে হারে চিনি। আপনি না করতে পারবেন যে কলেজের বখাটে ছেলেটার হাত আপনি ভেঙে দেন নি। পারবেন?”
পলক অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কিছু বলছে না দেখে তপা আবারও বলল,
“আপুর মাথা আর পায়ের এই অবস্থা কি করে হলো? ভালভাবে বলুন। নয়তো আপনার মুখটাও আমি আর দেখব না। তপার কথা কিন্তু শুধুমাত্র কথা নয়, অলিখিত দলিল।”
পলক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাকে জব্দ করার জন্য এই একরত্তি মেয়েই যথেষ্ট। কথার কি তেজ।
“আমি কিছু করিনি। যা করার প্রান্ত করেছে।”
তপা চমকে উঠল। শেষে কিনা তার ভাই।
“আপনি কোথায় ছিলেন?”
“আমি চলে এসেছিলাম। আমি সত্যি কিছু করিনি।”
“ভাইয়া আপুকে পেল কোথায়?”
পলক আমতা আমতা করে বলল,
“আমি ভার্সিটির সামনে থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
তপা দু’হাত শক্ত করে মুঠোবন্দি করে ফেলল। তার কপালের রগগুলো দপদপ করছে।
শক্ত গলায় বলল,
“আমি ফোন ফেলে এসেছি বাসায়। ফোন দেন আপনার বন্ধুকে। এখানে ক্রাইম করে লেজ গুটিয়ে চট্টগ্রাম গিয়ে বসে আছে। ওর লেজ আমি দ্বিখন্ডিত করব আজ।”

পলক পকেট হাতড়ে ফোন বের করল। রাত্রি অবাক চোখে তপাকে দেখছে। যাকে ও ইচ্ছে করে আহত করেছে এত জঘন্য ভাবে। সে তাকে আঘাত করার জন্য নিজের লোকের উপর কতটা ক্ষেপে গেছে। রাত্রি ব্যাথিত হলো নিজের কৃতকর্মের জন্য।
“পলক, প্রান্ত কিছু করেনি তপা। ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। আমি আমার বাসার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। ওদের সত্যিই দোষ নেই।”
পলক চমকাল। প্রান্ত সত্যি সত্যি রাত্রিকে ছেড়ে দিয়েছিল? কিন্তু কেন? কই তাকে তো বলে নি। কি চলছে প্রান্তের মনে? কেন বলল না। পলক নিজ মনে আকাশকুসুম চিন্তায় মগ্ন হলো।
রাত্রি মাথা নিচু করে মলিন কণ্ঠে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দিও তপা। আমি প্রথম দিন থেকে তোমার সাথে একের পর এক অন্যায় করে গেছি। অথচ তুমি আমাকে আঘাত করার অপরাধে নিজের লোককে কাঠ গড়ায় দাঁড় করাচ্ছো।কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমাকে এতটা আঘাত করতে চাই নি। ভেবেছিলাম একটু আধটু লাগবে। তুমি ভয় পাবে। ভয় পেয়ে পলকের জীবন থেকে চলে যাবে। কিন্তু আমি এখন বলছি তুমি যেও না পলক কে ছেড়ে। ও তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসে তপা। এমন ভালবাসা হেলায় হারিও না। আমাকে দেখো চেয়েও পাচ্ছি না। এক টুকরো ভালবাসার জন্য কতটা বেহায়া হয়ে গেছি তবুও ধরা দিচ্ছে না আমার ঝুলিতে। তুমি ভাগ্যবতী। তাই না চাইতেও পেয়ে গেছো। হারিয়ে ফেল না। নয়তো পস্তাবে। মারাত্মক ভাবে পস্তাবে।”

চলবে…#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৪

প্রায় ত্রিশ মিনিট সময় ধরে পলকের ফ্ল্যাটে ঘাপটি মেরে বসে আছে তপা। শুধু বসেই নেই। কাঁদছে সে। নীরব অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে ক্রমাগত। যাকে বলে অঝোর ধারায় বর্ষণ। ছুটির দিন হওয়ার দরুন পলক ফ্ল্যাটে বসে অলস সময় কাটাচ্ছিল। ভেবেছিল বাড়ি গিয়ে একবার ঘুরে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। চটপট রেডি হতে শুরু করে। কিন্তু এহেন সময় দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়ে বিরক্ত হয়। দরজার দিকে এগুতে এগুতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এত টাকা খরচ করে কলিং বেল কি রূপ দেখানোর জন্য লাগিয়েছি নাকি? শক্তির অপচয় দরজার উপর না করে এক আঙুলে বেল টা প্রেস করলে কি তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে? আশ্চর্য।”
দরজা খুলেও অপর প্রান্তের মানুষটিকে কিছুটা ঝাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু সে কি জানতো দরজার বাইরের মানুষটার তার কলিজায় বসবাস।
তপার মুখ দেখে বেমালুম পুরুষ সিংহের ন্যায় তর্জন গর্জন থেমে গেল। প্রথমে তপাকে দেখে মনটা সুপ্রসন্ন হলেও চোখের পানি লক্ষ করতেই হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তিয়াশা কি হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি?”
তপা কিছু না বলে পলক কে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল। কান্না লুকোতে চেষ্টা করেও ডুকরে ডুকরে উঠলো।
“আমি কি কিছুক্ষণ এখানে থাকতে পারবো?”
তপার হিচকি তুলে তুলে বলা কথায় পলক খানিকটা অবাক হলো। যে নিজেই পালাতে চায় সে কেন নিজে থেকে থাকতে চাইছে? আনমনেই বলল,
“সে তুমি যতক্ষণ ইচ্ছে থাকো।কিন্তু কি হয়েছে সেটা তো বলো। আমার টেনশন হচ্ছে। পৃথা কোথায়?”
তপা মৃদু স্বরে বলল,
“ভাইয়া। ভাইয়ার সাথে কথা বলবো।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“প্রান্ত?”
তপা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
প্রান্ত ফোন ধরেই বলল,
” তোর জন্য কি ছুটির দিন গুলোতেও শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারবো না?”
তপা ঝরঝর করে কেঁদে বলল,
“ভাইয়া।”
প্রান্ত শোয়া থেকে এক ঝটকায় উঠে বসল। আতংক গ্রস্ত গলায় শুধালো,
“কি হয়েছে বোন আমার? কাঁদছিস কেন? পলক কিছু করেছে?”
তপা তখন হেঁচকি তুলে কাঁদছে। পলক ফোন প্রায় কেঁড়ে নেওয়ার মত ছো মেরে নিয়ে নিল।
“তোর বোন সেই কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। থামাথামির কোনো লক্ষণ নেই। কিছু বলছেও না। কি করব আমি?”
পলক কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“তুমি আমার *** এর প্রেমিক হয়েছো? প্রেমিকার কান্না থামাতে পারছো না। দুই মিনিটের মধ্যে যদি ওর কান্না না থামে তবে আমি নিজে তোর লাভ স্টোরির ভিলেন হবো খোদার কসম।”
পলক ভ্রু কুঁচকালো। এখন যত দোষ নন্দ ঘোষ।
“আমি কি ওকে জড়িয়ে ধরবো?”
প্রান্ত চমকাল। তার বন্ধু এমন নাদান বাচ্চা কবে হলো বুঝতে পারল না। পুরুষ সিংহ প্রেমের ছোঁয়া পেয়ে বিড়াল ছানায় রূপান্তরিত হয়েছে ভেবে মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল প্রান্ত। আর যাই হোক প্রেমে সে পড়বে না। কস্মিনকালেও না। এ যেন আজন্ম শপথ।
পলক আবারও বলল,
“কি হলো ধরবো?”
প্রান্ত প্রায় ধমকের সুরে বলল,
” প্রেমে পড়ার আগে আমার অনুমতি নিয়েছিলি?এই যে আমি থাকতেও আমার সামনে আমার বোনকে কোলে নিয়ে ঘুরিস তখন আমার পারমিশন নিস? কত বড় বেয়াদব ভাইয়ের কাছে জানতে চাইছে তার বোনকে জড়িয়ে ধরবে কিনা। আমি লাইনে আছি। আগে কান্না থামা তারপর ওর কাছে ফোন দে।”
পলক তপার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“কান্না অনেকক্ষণ আগেই থেমে গেছে। নে কথা বল।”

পলকের জড়িয়ে কথা শুনেই তপার কান্না থেমে মুখে শোভা পেয়েছে অবাক হওয়ার রেশ। কি অনায়াসে প্রশ্ন করল ‘আমি কি ওকে জড়িয়ে ধরবো?’ যেন প্রান্ত বললেই বুকে জড়িয়ে নিত। তপার মনের ভেতরে সুপ্ত অনূভুতিরা ডানা ঝাপটাতে শুরু করল।

পলক ফোন বাড়িয়ে দিতেই তপা মৃদু স্বরে বলল,
“ভাইয়া।”
বলতে বলতে আবারও চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। পলক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তপার দিকে। কি এমন হয়েছে মেয়েটার। এত শক্ত মনের মেয়েটা কেন এত দুর্বল আজ? কেন তার মনের এত শোচনীয় অবস্থা?
প্রান্ত শান্ত কণ্ঠে বলল,
“কি হয়েছে আপু? ভাইয়া কে বল।”
তপা হেচকি তুলে বলল,
“মামা এসেছে ভাইয়া।”
প্রান্ত অবাক হয়ে বলল,
“আংকেল এসেছে ভালো কথা। কিন্তু তুই এভাবে কাঁদছিস কেন? আংকেল এলে তো তোর খুশি হওয়ার কথা।”
তপা মলিন কণ্ঠে বলল,
“মামা একা আসেনি। সাথে ও এসেছে।”
প্রান্ত নিশ্বাস আঁটকে রেখে বলল,
“ও মানে কে এসেছে?”
“ভাই।”
“সিজান?”
তপা মৃদু আওয়াজে শুধু সম্মতি সূচক বলল,
“হুম।”
প্রান্ত দু’হাত মুঠো করে বসে রইল। ইচ্ছে করছে এক উড়ালে তপার কাছে চলে যেতে। বোনটা নিশ্চয়ই খুব অসহায় বোধ করছে।বোনের পাশে কাউকে তো চাই এখন। শক্ত করে হাতটা ধরে রাখার জন্য হলেও চাই। টাল সামলাতে না পেরে পা দু’টো টলে গেলে শক্ত হাতে তাকে আঁকড়ে রাখার জন্য হলেও আপন একজন মানুষ চাই।

প্রান্ত কিছু বলার আগেই তপা ফোনটা পলকের হাতে দিয়ে খোড়াতে খোড়াতে অন্য রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু সে জানে চিৎকার করে কাঁদলে পলক তাকে দুমিনিট ও থাকতে দেবে না এখানে। টেনে হিঁচড়ে বের করে কান্নার কারন জানার জন্য পাগল করে ফেলবে।তার চোখের জল পলক কে উতলা করে সেটা সে জানে। তাই শত ব্যথা সহ্য করেও চুপচাপ বসে রইল। পলক দরজা ঠেলে ভেতরে আসার চেষ্টা করলে তপা কান্নারত কণ্ঠে বলল,
“আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই প্লিজ। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দেব। প্লিজ আমাকে একটু বাঁচতে দিন।”

পৃথা চুলায় রান্না বসিয়ে ব্যস্ত হাতে কাজ শেষ করছে। তপার মামা বিছানার এক কোণে চুপচাপ বসে আছে নিচের দিকে তাকিয়ে। মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছে নিজের উপর। কেন আজই সিজান কে নিয়ে আসতে হলো তার। মেয়েটাকে অমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে দেখে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। তাই তো বুকে শত আঘাত লুকিয়ে থাকলেও পাথরের মত চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও গড়ায় নি।

সিজান ছাঁদ থেকে দ্রুতপদে রুমে ঢুকে পৃথার খোঁজ করল।পৃথা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো হাঁকডাক শুনে। তপার মামা মোর্শেদুল হক ও চোখ তুলে তাকালেন ছেলের দিকে। কিন্তু তিনি আজ নির্বিকার। ছেলের দিকটাও তিনি বুঝতে পারেন। আবার মেয়েটার অভিমানও ফেলনা নয়। তিনি যাবেন কোন পথে? দু’দিকেই তার আপনজন দাঁড়িয়ে। একদিকে গেলে অন্যদিক অন্ধকার।
সিজান পৃথার সামনে গিয়ে থমথমে গলায় বলল,
” তপা কোথায় গেল পৃথা? তাজমহল লেখা ফ্ল্যাটে কারা থাকে? তপা কেন সেখানে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল?”
তপা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“ওই ফ্ল্যাটে কারা নয় বলুন কে থাকে?”
“কে থাকে?”
সিজানের প্রশ্নে পৃথা এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে গড়গড় করে বলল,
” ওই ফ্ল্যাটে ভাইয়ার বন্ধু থাকে। পলক তাজওয়ার। তপার এ জগতে আমাদের পর বিশ্বাসের জায়গায় সেই আছে। তাই হয়তো নিজের তিক্ত অতীত সামনে আসায় সহ্য করতে না পেরে সেখানে চলে গেছে। ভালোই করেছে। মাঝখান থেকে আমাকে শুধু নোংরা মুখটা দেখার জন্য রেখে গেল। আর হ্যা সে কিন্তু একা থাকে। এখন কি তার সাথে জড়িয়েও তপার চরিত্রে কালি লেপ্টে দিবেন? আগেই জানিয়ে রাখি পলক তাজওয়ার কিন্তু প্রান্ত শাহরিয়ার নয়। তপার চোখের এক এক ফোঁটা পানির জন্য সে আপনার এক একটা হাড়গোড় ভাঙতে পারে।তাই যা বলার সাবধানে বলবেন।”
সিজান চমকাল। মোর্শেদুল হক ও বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালেন পৃথার দিকে।
“উনি কি তপার কিছু হয়? আমি বলতে চাচ্ছি তপা কি তাকে ভালবাসে?”
পৃথা মুচকি হাসল।
“তপা ভালবাসে কিনা সঠিক বলতে পারছি না।হয়তো বাসে। তবে বিশ্বাস করে। নিজের থেকেও বেশি। কিন্তু পলক ভাইয়া ভালবাসে। মারাত্মক ভাবে ভালবাসে। সে যদি একবার জানে আপনি তপাকে কাঁদিয়েছেন। আপনার জন্য তপা কষ্ট পাচ্ছে। তাহলে আপনার অবস্থা সে টাইট করে ফেলবে। নিজের ছোট বেলার বান্ধবীর মাথা ফাটাতে চাওয়ার আগেও সে দুবার ভাবে নি। আপনি তো চুনোপুটি। সো সময় থাকতে লেজ গুটিয়ে পালান।”
সিজান আহত চোখে তাকাল। তবে এটা ভেবে ভাল লাগলো তার ছোট্ট অভাগী বোন টাকে কেউ ভালবাসে। তার বোনের কথা ভাবার জন্যও কেউ আছে। প্রচন্ড কষ্টের সময় আগলে রাখার জন্য কেউ একজন বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে। অপেক্ষা করবে কখন তাতে একরাশ কষ্ট নিয়ে সে ঝাপিয়ে পড়বে।মোর্শেদুল হকের মনটা পলক কে একবার দেখার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। কার ভরসার মেয়ে তার এভাবে চলে গেল সেটা তো তার জানতে হবে, দেখতে হবে। কিন্তু মেয়ে তার যথেষ্ট বিচক্ষণ সেটা সে জানে। কিন্তু অভিমানের পাল্লা যে তার বড্ড বেশি ভারী।

“পৃথা? কোথায় তুমি? আমি ভেতরে আসবো?” পলকের কণ্ঠ শুনে পৃথা প্রায় দৌড়ে এলো রান্নাঘর থেকে। সিজান, মোর্শেদুল হকও নড়েচড়ে বসলেন।
“ভাইয়া আসুন। তপা আসে নি?”
“নাহ। তিয়াশা দরজা বন্ধ করে বসে আছে। দরজা খুলছেই না। আমার ঘরে আমাকেই ঢুকতে দিচ্ছে না।?”

বলতে বলতে বিছানায় চোখ পড়তেই দু’জোড়া উৎসুক চোখের উপর দৃষ্টি পড়ল তার। পৃথা পলকের দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলল,
“ইনি তপার মামা আর ইনি মামার ছেলে।”
পলক সালাম দিল। মোর্শেদুল হক সালাম বিনিময় করে টুকটাক কথা বললেন। কিন্তু সিজান নির্বিকার।হয়ে কেবল চেয়ে রইল।
পলক সিজানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি ব্যাপার ভাই আমার চেহারা কি খুব খারাপ? দেখতে ভয়ংকর লাগছে? কথা কেন বলছেন না?”
সিজান মুখ খুলে প্রথম কথাটা বলল,
“আমার বোন টাকে ভাল রাখতে পারবেন?”
পলক চমকাল। কি দিন আসল পলক তাজওয়ার শুধু চমকাচ্ছেই। ক্যারেক্টার কেমন উল্টো লাগছে তার। যে কিনা সবাইকে চমকে দিত। আজকাল তা তো হচ্ছেই না বরং ক্ষণে ক্ষণে সে চমকাচ্ছে।
পলক মৃদু হেসে বলল,
“নিজের প্রাণ থাকতে খারাপ থাকতে দিব না ওকে।”
“ভাই আপনি ওকে এখানে নিয়ে আসতে পারবেন এখন? আমার ওর সাথে জরুরি কথা আছে। অনেক গুলো দিন চলে গেছে। অভিমানের পাল্লা কেবল ভারী হচ্ছে। একদিনের ক্ষুদ্র রাগ আজ বিশালতায় আকাশ ছুঁয়ে গেছে। এখনো অভিমান গলাতে না পারলে জানিনা কখনো পারব কিনা। আপনি দেখুন না আসে কিনা।”
পলক আশ্বাস দিয়ে বলল,
“আপনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুনি কান টেনে নিয়ে আসছি পাঁজি টার।”
সিজান শত কষ্টের মাঝেও মৃদু হাসল। মোর্শেদুল হকেরও বেশ মনে ধরেছে পলক কে।

পলক বলে গেল কান টেনে নিয়ে আসবে। কিন্তু সে মিথ্যে বলেছে। কান টেনে আনার পরিবর্তে সে পাঁজা কোলা করে তুলে এনেছে। বেশ হুমকি ধামকি দিয়ে দরজা খুলিয়েছে সে। দরজা খুলতেই এক মূহুর্ত নষ্ট না করে কোলে তুলে নিয়ে গটগট করে ছাঁদে চলে এসেছে।

সিজান হা করে তাকিয়ে আছে। মোর্শেদুল হক মাথা নিচু করে নিয়েছেন। কেবল পৃথা মিটিমিটি হাসছে। সিজান পৃথার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বিরবির করে বলল,
“এই পিথাগোরাসের উপপাদ্য এদের কেমিস্ট্রি কি বরাবরই এরকম?”
পৃথা চমকে উঠল। কতদিন, ঠিক কতদিন পর সিজান এভাবে ডাকল তাকে। পৃথার কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু নিজেকে সামলে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তো কি সবাই আপনার মত? আনরোমান্টিক? ভীতুর ডিম? যার প্রেমিকার চোখের দিকে তাকাতেই হাত পা কেপে জ্বর চলে আসে। ব্যাটা নিরামিষের ডিব্বা কোথাকার।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here