কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব -১৫

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_15
#Writer_NOVA

‘ফুল একটু দাঁড়াও।’

অভির ডাকে ফুলের চলন্ত পা দুটো থেমে গেলো। তবে সে পিছু ঘুরলো না৷ অভি দৌড়ে ফুলের সামনে এসে দাঁড়ালো। একটু দৌড়ানের কারণে সে হাঁপাচ্ছে।

‘কিছু বলবেন?’

‘বলতেই ডেকেছি।’

‘জলদি বলুন। আমার কাজ আছে।’

ফুল অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। অভি চোখের সরু ফ্রেমের চশমা খুলে আঙুল দিয়ে মুছে পুনরায় পরলো। ফুলের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বললো,

‘চলো, হাঁটতে হাঁটতে বলি।’

‘আপনার কথা শোনার এতো সময় আমার নেই। তাই যা বলার দ্রুত বলেন।’

ফুল মুখ কঠিন করে বললো। অভিকে তার এতদিন ভয় করলেও এখন বিরক্ত লাগে। অভি গত কয়েকদিন যাবত ফুলের সাথে এমনভাবে চিপকে আছে যে ফুলের বিরক্তি চলে এসেছে। অভি, ফুল চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো৷ ফুলের অস্বস্তি লাগছে। কোথায় শুভর পাশাপাশি থাকলে তো এমনটা লাগে না। অভির সাথে থাকায় এতো অসহ্য লাগছে কেনো? মনে হচ্ছে এখান থেকে পালাতে পারলে অনেক ভালো লাগতো।

‘চুপচাপ কেনো? কিছু বলো?’

ফুল অভির দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,
‘আপনি কিছু বলতে আমাকে ডেকেছেন। আমি নই।’

‘ওহ, হ্যাঁ! চলো, পুকুরপাড়ের সিমেন্টের বেদিতে গিয়ে বসি।’

‘দেখুন, আপনার সাথে আজাইরা বকবক করার কোন সময় নেই আমার। তাই আপনার রাস্তা আপনি মাপুন।আমােে আমার মতো থাকতে দিন।’

‘তুমি কি আমার প্রতি বিরক্ত হচ্ছো?’

ফুল দাঁতে দাঁত চেপে ভেতর থেকে আসা দমকা রাত
রাগটাকে সংযত করে নিলো। বিরক্তি তার চোখে, মুখে ফুটে উঠেছে। অভি যেনো দেখেও দেখলো না। পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ এসে ফুলের মুখে লুকোচুরি খেলছে। সামনে থাকা ছোট চুলগুলো হালকা বাতাসে চোখের সামনে এসে বারি খাচ্ছে। বিরক্তিতে কাউকে এতো সুন্দর লাগে ফুলকে না দেখলে জানতো না অভি। মনে মনে আবারো আরেকবার আফসোস করলো। কেনো যে সে ফুলকে না দেখে বিয়েতে মানা করে দিয়েছিলো? সেদিন রাজী হলে ফুল শুধু তার হতো। শুধুই তার!

বড় বটগাছের সামনে সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে বসার উপযুক্ত জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বসে আড্ডায় মেতেছে পলক, শুভ, হাসান, হানিফ। বাকি দুজন এখনো এসে পৌঁছায়নি। হঠাৎ হাসান বলে উঠলো,

‘হুনলাম তোর চাচতো বোইনের লগে নাকি তোর বড় ভাইয়ের বিয়া ঠিক হইছিলো।’

শুভ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। সেই প্যাকেট থেকে সবেই একটা সিগারেট দুই ঠোঁটে মাঝে চেপে ধরেছিলো। হাসানের কথা শুনে চোখ তুলে ঠান্ডা, শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। হাসান তাতে দমলো না। সে দমবেও না। সেবার মেয়েটার কারণে শুভ তার গায়ে হাত তুলেছে। এতো সহজে ভুলে যাবে নাকি সব?

‘তোগো কি দুই ভাইয়ের কি সমস্যা রে? সবসময় একটা জিনিস লইয়া পরোস।’

পলক ধমকে উঠলো,
‘হাসান কি শুরু করছোত? পুরাইন্না কথা কেন তুলতাছোত?’

হানিফ মুখ পানসে করে বললো,
‘মা’ইর খাইবো তাই।’

শুভ দিয়াশলাই দিয়ে সিগারেটের মাথায় আগুন ধরিয়ে বড় করে টান দিয়ে ধোঁয়া উপরে ছাড়লো। পলকের কথার রেশ ধরে বললো,

‘ওর হেইদিনের মা’ইরে পোষায় নাই।’

হাসান কোঁৎ করে উঠলো,
‘ঐদিন একবারে বেশি করছোত। নিজেরে মাইয়াডার সামনে সাধু প্রমাণ করোনের লিগা হুদাহুদি (শুধু শুধু) আমগো মা’রলি।’

‘পুনরায় হেই কথা কইলে আবার মা’রমু। বন্ধু, শত্রু মানমু না। ওরে নিয়া যে কথা কইবো তার কইলজা টাইন্না ছিড়া ফালাইতেও দুইবার ভাবমু না।’

শুভ হিমশীতল চাহনি ও হুমকিতে এবার ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলো হাসান। পলক চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘মাইয়াডার প্রতি এতো টান কেনরে? আমগো ভাবী নাকি?’

শুভ কপাল কুঁচকে তাকালো। তা দেখে পলক আমতা আমতা করে বললো,

‘না মানে এমনে জিগাইলাম। কৌতুহল হইলো।’

‘ওরে নিয়া কারো কৌতুহল না থাকনোই নিজের লিগা ভালা। জানোসই তো আমার মুখের থিকা বেশি হাত চলে।’

হানিফ জিজ্ঞেস করলো,
‘মাইয়াডার মধ্যে কি এমন পাইলি শুভ? যার লিগা তুই এমন আজব ব্যবহার করোছ?’

শুভ উত্তর দিলো না। উদাস মনে বাটগাছের ডালের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো৷ গাছের ডালে একজোড়া শালিক বড্ড চেচামেচি করছে৷ একটা পাখি চেচাচ্ছে আরেকটা চুপ করে রয়েছে। শুভর মনে হলো চেচামেচি করা পাখিটা মপয়ে পাখি হবে৷ শাসন করার অভ্যাসটা তো তাদেরই। এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে শুভ কল্পনা করলো তাকে ফুল এভাবে শাসাচ্ছে সে চুপচাপ শুনছে৷

হানিফের কথার পিঠে শুভর বলতে ইচ্ছে করেছিলো, মেয়েটার মধ্যে আমি সব পেয়েছি। আমাকে শাসন করার, সামলে রাখার ক্ষমতা যে মেয়েটার মধ্যেই মজুত। কিন্তু কিছু বলবে না সে। শালারা, ভারী ধুরান্দাজ। একবার যদি বুঝে যায় শুভর দূর্বলতা ফুল তাহলে সুযোগ বুঝে কি যে করবে শুভ নিজেও জানে না। মানুষ যে বড় স্বার্থ সন্ধানী।

‘অভি বাজান আমার, তোর কি কিছু লাগবো?’

‘না, মা! আমি এভাবেই ঠিক আছি।’

‘চা খাবি?’

মায়ের প্রশ্নের উত্তরে অভি ফুলের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘একটু আগে ফুল বানিয়ে দিয়েছিলো।’

ফুল এক পলক অভির দিকে তাকিয়ে দেখলো না। মুখে গতকালের মতো কোন বিরক্তির ছাপ নেই। সে মন দিয়ে পেঁয়াজ কুচি করছে৷ ঝুমুর রুটি বানানোর জন্য কলসি থেকে পাতিলে পানি ঢেলে গরম বসিয়ে দিলো। সোহেলী বেগম ফুলকে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কতক্ষণ লাগবো আর? তহন থিকা দেখতাছি পিয়াইজ নিয়া বইয়া রইছোত।’

ফুলের উত্তরটা ঝুমুর দিলো,
‘আমরা কি মেশিন চাচী? কাম করতে একটু দেরী লাগেই। আপনি হুদাই খিটখিট শুরু করেন।’

ঝুমুরের উত্তরটা পছন্দ হলো ফুলের। একদম মোক্ষম জবাব। প্রকাশ্যে ঝুমুরকে বাহবা দিতে না পারলেও মনে মনে বাহবা ঠিকই দিলো। সোহেলী বেগম ঠিকই বলে। ঝুমুর তার সাথে থাকতে থাকতে প্রতিবাদী ভাষা শিখেছে। প্রথম প্রথম কারো মুখের ওপর কথা বলতো না ঝুমুর। আজকাল যেনো কাউকে ছাড়েই না। ফুল যেগুলো এড়িয়ে যায় সেগুলো সে নিজ দায়িত্বে কাঁধে তুলে নেয়।

‘মুখে খই ফুইট্টা গেছে। আগে বোমা মা’রলেও মুখ দিয়া কথা বাইর হইতো না। আর এহন কথার ফুলঝুরি ছুটে৷ কমামু নে। খাড়া, একটু দেরী কর।’

‘যুগ পাল্ডাইছে না চাচী। আগের মতো কি সব আছে কন? এর লিগা আমি পাল্ডাইলাম।’

সোহেলী বেগমের কথার পিঠে আবরো কথা বললো ঝুমুর। ফুল ঠোঁট চেপে হেসে উঠলো। সোহেলী বেগম নীরবে ক্রুর দৃষ্টি ছুঁড়লেন ঝুমুরের দিকে। কিন্তু ঝুমুর আর ভুলেও সেদিকে তাকায়নি। সে চিকন বাঁশের কঞ্চি চুলোর ভেতরে গুঁজে দিলো। আগুনের খোরাক পেয়ে দাউদাউ করে শিখা উপরে উঠতে লাগলো৷ সোহেলী বেগম রাগটাকে মনের ভেতর চাপা দিয়ে রাখলো। ছেলের সামনে নিজের আসল রূপ খানা দেখাতে চাইছেন না।

ফুল পেঁয়াজ কাটা রেখে আটার ডিব্বা সামনে নিলো। অভি বই হাতে বাশের মোড়ায় বসে আছে। ভাবখানা এই যে সে পড়ছে। কিন্তু সে বইয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারছে না৷ আড়চোখে বারবার ফুলের দিকে নজর দিচ্ছে। ফুল লক্ষ্য না করলেও দোতলা থেকে বিষয়টা চোখ এড়ালো না শুভর। সে বারান্দার সামনে মাটির চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অভির ভাবভঙ্গি খেয়াল করছিলো। পুরো বিষয়টা যখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো তখন হাতে থাকা কাপটা মেঝেতে ছুঁড়ে মা’রতে উদ্যত হলো। কিন্তু সামনে তার পায়ের কাছে পুষি বসে আছে। কাপটা ভাঙলে ভাঙা টুকরো এসে পুষির গায়ে লেগে যেতে পারে। পুষি তার বড্ড আদুরে। তবে ফুলের থেকে বেশি নয়। ফুলের সাথে কারো তুলনা হয় না। শক্ত করে কাপটাকে নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রাখলো শুভ। সে তার রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে ভেবে, নিজে নিজে অবাক হয়ে গেলো।

আনমনে হাঁটতে হাটতে কিছু ভাবছিলো ফুল। পাশের খুঁটির সাথে পা লেগে যেই মাত্র হেচোট খাবে সেই মাত্র একটা হাত এসে টেনে সরিয়ে নিলো। ফুল ভেবেছিলো অভি। তাই কিছু কড়া কথা শুনানোর জন্য ঠোঁট খুলেছিলো। কিন্তু মুখ উঠিয়ে দেখলো শুভ! মুহুর্তেই মেজাজটা ঠান্ডা হয়ে গেলো।

‘তুই কিরে? কোনদিক চাইয়া হাটোস? এতবড় একটা খুঁটিও চোখে লাগে না তোর। তোরে নিয়া আর পারি না। এতো বেখায়ালে কেউ হাঁটাচলা করে?’

ফুলের বলতে ইচ্ছে করছিলো, ‘তুমি আছো না খেয়াল রাখার জন্য। তুমি খেয়াল রাখলে আমি হাজারবার বেখেয়ালি হবো। ইচ্ছে করে হবো।’ কিন্তু মুখে টু শব্দ করলো না। শুভ বুঝতে পারলো ফুলের অভিমান এখনো কমেনি। কমবে কি করে? সে কমার জন্য কিছু করেছে নাকি? যখনই দেখা হয়েছে ধমকি-ধামকি ছাড়া ভালো করে একটা কথাও বলিনি। ফুল পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে শুভ বাহু ধরে টেনে নিজের সামনে আনলো। গালে আলতো করে এক হাত ছুঁয়ে শান্ত গলায় বললো,

‘আমার লগে এহনো অভিমান কইরা আছোত কইতরির মা? তুই কথা কবি না? তুই কথা না কইলে আমার যে ভালো লাগে না। তোর মন চাইলে আমারে যা মন চায় শাস্তি দে। তাও আমার লগে ইট্টু কথা ক। আমার মনে হইতাছে কত জনম ধইরা তোর মুখে নিজের নাম হুনি না।’

শুভর আকুতিভরা কন্ঠে ফুল চমকে তাকালো৷ এ কোন শুভর দেখা মিললো তার সাথে? এতো নরম গলায় তো শুভ কথা বলে না। বিস্ময়ে ফুলের চোখের পলক পরছে না। শুভ সেটা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললো,

‘আমার ভুল হইছে। তুই যদি এর লিগা আমারে কানে ধইরা উঠবস করতে কস তাও করমু। তুই শুধু আমার লগে একটু কথা ক।’

শুভ দুই কানে হাত দিয়ে উঠবস করতে শুরু করলো৷ ফুলের চোখ দুটো এবার বোধহয় কোটর থেকে বেরিয়ে বলের মতো মাটিতে ড্রপ খাবে৷ এতো বিস্ময় সে নিতে পারছে না। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। জ্ঞান হারাবে নাকি?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here