কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব -১৬

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_16
#Writer_NOVA

শরৎ এর আকাশটা দেখতে চমৎকার লাগে৷ সাদা তুলোর পাজার মতে শুভ্র মেঘগুলো সারা আকাশ জুড়ে ছোটাছুটি করে। মাঝে মধ্যে সকালের রোদের সাথে সেই মেঘগুলো পাল্লা দিয়ে কোথায় জানি হারিয়ে যায়। সেটা আরো বেশি আকৃষ্ট করে ফুলকে৷ চোখ ডলে খাট থেকে উঠে জানালার সামনে দাঁড়ালো। জানালা খুলে দিতেই এক ঝাটকায় সকালের বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করলো। বাতাসের ছটা গায়ে লাগতেই ফুলের মন প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। শ্বাস টেনে অক্সিজেন নিলো৷ চুল ঠিক করতে করতে এদিক সেদিক তাকাতেই চোখ পরলো টেবিলের ওপর। ওমনি তার কপাল কুঁচকে গেলো। আপনমনে বললো,

‘এগুলো এখানে কে রাখলো?’

সদ্য গাছ থেকে তুলে আনা তাজা শিউলি ফুলের ভীষণ পছন্দের। ফুলগুলোকে যে কেউ একটু আগেই কুড়িয়ে এনেছে তার প্রমাণ গায়ে লেগে থাকা শিশির বিন্দু। দূর্বা ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো ফুলের গায়ে লেপ্টে আছে। ফুল অবাক হলো। এতো সকালে শিউলি তার কামরায় কে রেখে গেলো? সাথে ছোট এক টুকরো চিরকুট। চিরকুট হাতে নিয়ে ভাজ খুললো।

❝আমার ফুলের জন্য উপহার হিসেবে ফুল ছাড়া অন্য কিছু পেলাম না।❞

ইতি~~
তোমার……..

ডট ডটের জায়গায় কিছু নেই দেখে ফুলের রাগ হলো। মন বলছে এটা অভির কাজ। অভি ছাড়া কেই বা করবে? অভি না থাকায় আগে তো কখনে এমনটা হয়নি। আজ হয়েছে তার মানে অভির কাজ। ফুল ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে চিরকুটটাকে দলা মোচড় করে টেবিলের কোণায় ছুঁড়ে মা’রলো। এই ছেলের চিরকুট সে কিছুতেই রাখবে না। ফুলগুলো ছুয়েও দেখলো না। অযত্ন, অবহেলায় টেবিলের কোণায় পরে রইলো। ফুল দাতা যদি এই অবহেলা দেখতো তাহলে মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেতো।

‘তুই ফুলের আগেপিছে এমন ঘুরাঘুরি করোস কেন?’

শুভর কন্ঠে ভ্রু যুগল কুঁচকে ঘাড় কাত করে তাকালো অভি। হাতে থাকা দূর্বা ঘাসগুলো হাতে পিষে দূরে ছুঁড়ে মারলো। হালকা হওয়ায় বাতাসে তা নিজের শরীরে এসেই পরলো। অভির এই হেয়ালিপনা শুভর ভালো লাগলো না। পূর্বের থেকে দ্বিগুণ গলায় চেচিয়ে বললো,

‘তুই ওর পিছনে ঘুরবি না।’

অভিও কম যায় না। ত্যাড়ামি করে উত্তর দিলো,
‘একশ বার ঘুরবো।’

‘না।’

‘কেন?’

‘আমি কইছি তাই।’

‘তোর কথা শুনতে আমি বাধ্য নই।’

‘আমারে রাগাইস না অভি। তাইলে ভালো হইবো না।’

অভি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তা দেখে শুভর মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। এগিয়ে এসে অভির শার্টের কলার ধরে হাত উঠিয়ে ঘুষি দেওয়ার ভঙ্গি করে ভয় দেখিয়ে বললো,

‘আমি কউছি ওর থিকা দূরে থাকবি। তার মানে দূরে থাকবি। আর কোন কথা কবি না।’

‘তোকে ভয় পাই নাকি আমি? দূরে যা৷ আমার যা মন চায় তা করবো। তুই বলার কে?’

অভির কথা বলতে দেরী। ওর নাক বরাবর ঘুষি পরতে দেরী নয়। অভির মাথাটা ঝিঝি করে উঠলো। আচমকা আক্রমণে তার মস্তিষ্ক মিনিট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। মাথা ঝাড়া দিয়ে নিজের অস্তিত্বে ফিরে এসে হাসতে হাসতে বললো,

‘আমার ফুলকে পছন্দ হয়েছে তার মানে ওকেই আমার লাগবে৷ তুই যতই মা’রিস, কা’টিস আমি দমবো না। ভুলে যাস না আব্বা ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলো।’

‘ঠিক করছিলো৷ কিন্তু তুই না কইরা দিছোত। তুই আর ওর দিকে চাবিও না। ও এখন আর তোর না। আমার জিনিসে নজর দেওয়া বন্ধ কর।’

‘তুই সবসময় আমার জিনিসে নজর দিস।’

‘তোর কাছে একটা সুযোগ আছিলো। তুই নিজে ঐটা হারাইছোত। এহন আমি তোরে কোন সুযোগ দিমু না।’

‘আমি তোর কোন কথা শুনবো না। দরকার পরলে গাছ থেকে ফুলকে ছিঁড়ে হলেও নিজের কাছে রেখে দিবো।’

শুভ রেগে পরপর দুটো ঘুষি অভির নাকে বসিয়ে দিলল। অভির নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পরলো। তবুও অভির মুখে হাসির রেশ লেগে আসছে। জিদে আরো দুটো দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই ফুল এসে টেনে অভির থেকে সরিয়ে দিলো। চিৎকার করে বললো,

‘কি করছো শুভ ভাই? পাগল হয়ে গেছো? বড় ভাইয়ের গায়ে হাত দিছো কেনো? তুমি কি ভালো হবে না? নাক দিয়ে রক্ত পরছে।’

অভির নাকে বরফ ধরে শুভকে ইচ্ছেমতো বকছেন সুফিয়া বিবি। অভি সুন্দর হওয়ায় নাকের ডগাটা লাল টুকটুকে হয়ে আছে। সোহেলী বেগম চুপ করে থাকলেও ছোট ছেলের প্রতি তারও রাগ লাগছে৷ অদূরে বাটি ভর্তি বরফ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমুর।

‘তোর ছোট পোলার কাম দেখছোত বড় বউ? পোলাডার নাক ফাডায় হালাইছে। কই গেছে, কই গিয়া পলাইছে? আইতে ক আমার সামনে৷ দেহি গায়ে কত শক্তি হইছে।’

সুফিয়া বিবির কথায় মুখ বাকালো ঝুমুর। চিবিয়ে চিবিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

‘শখ দেইখা বাঁচি না। হুহ, বুড়ি নিজে হাটে লাঠি দিয়া।অথচ ভাবখান দেহো। মনে হইতাছে একলাই শুভ ভাইরে কাইত কইরা হালাইবো।’

‘ঐ ছেমরি কি বিরবির করোস?’

ধমকে উঠলো সুফিয়া বিবি। ঝুমুর দ্রুত তটস্থ হয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘কিছু না দাদী।’

সুফিয়া বিবি এদিকে খেয়াল দিলেন না। অভির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো,

‘ব্যাথাডা কি কমছে ভাই?’

‘একটু কমেছে।’

‘বরফডা ধইরা রাখ। রক্ত পরা কমবো৷ অমানুষ হইতাছে৷ বড় ভাইয়ের গায়ে হাত তুলে৷ আহুক আজকে আনোয়ারে৷ ওর নাক যদি না ফাডাইছে আমার নাম ফিরা নাম রাখমু।’

সোহেলী বেগম ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,

‘আম্মা, বাদ দেন না। ওর বাপেরে এসব জানানোর দরকার নাই। তাইলে আবার ঝামেলা লাগবো। জানেনই তো শুভ কেমন! এহন যদি আবার ঝগড়া কইরা দুই পোলার মধ্যে কেউ যায় গা। আমার ভাল্লাগবো না।’

সুফিয়া বিবি হুংকার দিয়ে উঠলেন।

‘তোর প্রশ্রয়ে কুট্টিডায় মাথায় উডছে। ছোড বেলা থিকা টাইট দিয়া রাখলে আজকে এই দিন দেখতে হইতো না। কতবড় সাহস দেহাইছে তুই ভাবতে পারোস? বড় ভাইয়ের গায়ে হাত তুলছে৷ শুধু গায়ে হাত তোলা অব্দি থাকলেও মানোন যাইতে৷ ও তো নাক ফাডায় হালাইছে। দেখতো চাইয়া। পোলার নাকের কি অবস্থা!’

‘জিদ আমারো উঠতাছে আম্মা।কিন্তু আমার বাড়িতে অশান্তি ভাল্লাগে না। এতদিন পর পোলাডা আইলো। এহন কি আবার অশান্তি কইরা ওরে হারাইতে চামু?’

‘তোর ঘরে কি দিলো আল্লায়? দুইডায় সাপ বেজি। কারো লগে কারো মিলে না। আমার আনোয়ার, মনোয়ার কহনও এমন করে নাই। দুইজন কি মিইলা মিইশা থাকছে৷ এহন দুই ভাইয়ের কি মিল! আর এই দুইডায় পারলে মিনিটে মিনিটে দাও নিয়া কোপাকুপি লাগে।’

দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন সোহেলী বেগম। শাশুড়ী মিথ্যে বলেনি। আনোয়ার, মনোয়ার সর্দার দুজনের মধ্যে ভীষণ ভাব। একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। একজন অপরের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। আর অভি, শুভ যেনো একে অপরের জান নিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। এর পরিণাম দাঁড়াবে কি? নিশ্চয়ই ভালো কিছু নয়। মনটা তার কু’ডাকছে। আগাম বিপদের পূর্বাভাস পেয়ে কেঁপে উঠলেন সোহেলী বেগম।

মাথায় ঠান্ডা বস্তুর সংস্পর্শ পেতেই মাথা উঠালো শুভ। ফুল ওর মাথায় বরফ ধরে রেখেছে। ক্ষীণ শ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে রাখলো।

‘তোমরা মাত্র দুইটা ভাই। নিজেরা মিলেমিশে থাকবে বাবা, চাচার মতো। তা না করে ষাড়ের মতো এমন গুতাগুতি করো কেন?’

‘আমি ষাঁড়?’

‘অবশ্যই, উন্নতি প্রযুক্তির অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড় গরু।’

শুভ চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ফুল খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। শুভর চোখ দুটো নিস্তেজ হয়ে এলো। আগের জৌলুশ হারিয়ে দেখা দিলো একরাশ মুগ্ধতা। অবশেষে তার কইতরির মায়ের অভিমান ভেঙেছে। আজকাল ফুলকে যেনো চোখের আড়াল করতেই মনন চায় না। শুভর ইচ্ছে হয় ফুলকে চব্বিশ ঘণ্টা ওর সামনে বসিয়ে রেখে মন ভরে দেখতে৷ এর জন্য শুভর বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এখন আরো কমাতে হবে৷ অভির নজর থেকে রক্ষা করতে।

‘কি দেখো?’

‘তোরে!’

‘কেন?’

‘ভাল্লাগে।’

‘ভাল্লাগে কেন?’

‘জানি না।’

ফুল ভ্রু কুঁচকে শুভর দিকে তাকালো। শুভ হাত দুটো কোলে রেখে দৃষ্টি মেঝেতে আবদ্ধ করলো। ফুল শুভর মাথা থেকে হাত সরিয়ে দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। এতে শুভর মাথার ওপরে থাকা বরফ দুটো শব্দ করে মেঝেতে পরে টুকরে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো। তাতে শুভর হেলদোল নেই।

‘শুভ ভাই!’

‘হু!’

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’

‘হুম কর।’

‘তুমি আমার এতো যত্ন করো কেন?’

শুভ চট করে ফুলের চোখে চোখ রাখলো। ফুল দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। শুভ চুলে চিরুনির মতো করে আঙুল চালিয়ে শান্ত গলায় স্পষ্ট, শুদ্ধ ভাষায় বললো,

‘সব বাগানে ফুল ফুটে না। যে বাগানের মালি ফুল গাছকে অনেক যত্ন করে, আগলিয়ে রাখে, সকল ঝড়ঝাপটা থেকে বাচিয়ে রাখে। সেই বাগানেই ফুলের অস্তিত্ব দেখতে সুন্দর লাগে।’

দিন যত যাচ্ছে ফুল তত অবাক হচ্ছে। আজও হলো। শুভ যে এতো সুন্দর করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে তা ফুল ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। শুভর বলা প্রতিটা শব্দ ফুলের কানে মোহনীয় লাগছে। শুভ এক পলক ফুলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘ফুলকে অনেক যত্ন করে আগলে রাখতে হয়। যা সব মালি পারে না। যত্ন, ভালোবাসার অভাব হলে অবহেলায়, অনাদরে ফুলের পাপড়ি অকালে ঝড়ে পরে। যত্ন করলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তা সতেজ, প্রাণোচ্ছল থাকে। ফুল বাগানেই সুন্দর। সেটাকে ছিড়ে হাতে তুলে নিলে ভালো লাগে না।হাতে তুলে নেওয়া ভালোবাসা নয়। সাময়িক সময়ের মোহ। ফুলের স্থান বাগানে৷ যা যত্ন নেওয়ার অধিকার একমাত্র সেই বাগানের মালির।’

কত সুন্দর করে মনের ভাব প্রকাশ করলো! ফুলের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। ফুল বলতে কি শুভ তাকেই বুঝালো? ভেতর থেকে মন সায় দিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, তোকেই বুঝিয়েছে৷ তুই অবুঝ নস।’

#চলবে

নেক্সট, নাইস, স্টিকার কমেন্ট দেখে আর মন চায় না, এতো ব্যস্ততার মধ্যেও গল্প লিখতে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here