#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_26
#Writer_NOVA
আনোয়ার সর্দারের কাছে ভাইয়ের অসুস্থতার খবর পৌঁছালো একদিন পর। তখনকার দিনে আমাদের মতো এতো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো না। কাউকে খবর দিতে হলে পায়ে হেঁটে, চিঠিতে কিংবা সাইকেলে চড়ে পৌঁছে দিতে হতো৷ মোটরসাইকেল শুধু ধনীর দুলালদের কাছে ছিলো। যখন খবর এলো তখন আনোয়ার সর্দার ইউনিয়ন পরিষদে ছিলেন। সেই মুহুর্তে তিনি বেরিয়ে গেলেন। তবে একা যাওয়ার সাহস করলেন না। আমিন, মারুফের লোকদের সাথে ষাটের কোঠায় দাঁড়ানো চেয়ারম্যান শক্তিতে কখনোই পারবেন না। খবর পাঠালেন শুভর কাছে৷
শুভ ক্লাবের ভেতরে চেয়ারে বসে সিগারেট ফুঁকছিলো। এক চেয়ারে বসা আরেক চেয়ারে দুই পা তুলে দেওয়া। জ্বর কমতেই ছুটে এসেছে ক্লাবে৷ হানিফ পাশে দাড়িয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘শুভ ইউনিয়ন পরিষদ থিকা লোক আইছে।’
শুভর কপাল কুঁচকে গেলো। চোখ তুলে হানিফের দিকে তাকিয়ে রইলো আশ্বস্ত হওয়ার জন্য আসলে সে ঠিক শুনেছে কিনা। হানিফ মাথা নাড়ালো। সিগারেটের বাকি আংশ দূরে ছুঁড়ে মেরে পা নামিয়ে বসলো।
‘কিল্লিগা?’
‘তোর বাপে তোরে এহনই ইউনিয়ন পরিষদ যাইতে কইছে।’
‘কেন? আমি তো কোন মারামারি করি নাই। জ্বরের থোন উইঠা আইলাম দুই দিন পর। আমগো ক্লাবের কেউ কি এর মধ্যে কোন ঝামেলা করছে?’
‘কই না তো।’
‘তাইলে সর্দারের পোলায় ডাকছে কেন?’
‘কইতে পারি না। কইলো এহনই যাইতে৷ তোরে নিয়া কই জানি যাইবো।’
‘কই যাইতে পারে?’
শুভ হানিফের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো। হানিফ মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে জানে না৷ শুভ দোটানায় পরে গেলো যাবে কি যাবে না। একমাত্র তার ক্লাবের ছেলেপেলে কোন হাঙ্গামা করলে অথবা শুভ কেথাও মারামারি করে এলেই আনোয়ার সর্দার ছেলেকে ইউনিয়ন পরিষদে ডাকতেন। তেমন কিছু না করায় শুভ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে৷ একবার ভাবে যাবে, আরেকবার ভাবে না। এক সময় দ্বিধাদ্বন্দ এড়িয়ে উঠে গেলো। পকেট থেকে চাবি বের করে মোটরসাইকেল করে ইউনিয়ন পরিষদের দিকে রওনা দিলো। পেছন থেকে হানিফ চেচিয়ে উঠলো,
‘হালার পো হালা, আমারে নিয়া যা।’
শুভ শুনেও শুনলো না। তার ধ্যান জ্ঞান জুড়ে এখন একটাই কথা তার বাপ তাকে কেনো ডেকেছে।
শুভ, আনোয়ার সর্দার হাসপাতালে পৌঁছালো সন্ধ্যার একটু আগে। মনোয়ার সর্দারের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখেই শুভর মাথা গরম হয়ে গেলো। পথে আসতে আসতে পুরো কাহিনি শুনেছে সে। টগবগ করে রক্ত ফুটছে। এই মুহুর্তে আমিন কিংবা মারুফ কাউকে পেলে জ্যন্ত কবর দিতো। ভাইকে দেখে উঠে বসলো মনোয়ার সর্দার।
‘আরে করোস কি? হুইয়া থাক।’
‘কেমন আছো ভাইজান?’
‘তোর অবস্থা দেইখা কি ভালো থাকতে পারি?’
মনোয়ার সর্দার স্মিত হাসলো। কলি বেগম ভাসুর ও তার ছেলেকে দেখে ব্যস্ত হয়ে গেলো। বৃন্তকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘যা বাজান সামনের দোকান থিকা চা-বিস্কুট লইয়া আয়।’
‘তার কোন দরকার নাই চাচী। শালাবাবু তুমি আমার কাছে আহো।’
শুভর কথা শুনে দুই ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। শুভর থেকে এরকম কিছু তারা আশা করেনি। অবশ্য শুভই তো এমন। কলি বেগম স্বামীর থেকে কমবেশি সবই শুনেছেন। তাই প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না। এদিক সেদিক তাকিয়ে শুভ জিজ্ঞেস করলো,
‘পাপড়িরে যে দেহি না চাচী। ও কই?’
‘কলপাড়ে গেছে গোসল করতে।’
‘এতো দেরী?’
‘সারাদিন এইহানে ওর বাপের কাছে আছিলো। আমি বাইতের (বাড়িতের) থিকা রাইন্ধা, হাসপাতালে আইলাম তোমরা আহোনের ইট্টু আগে। তা বাজান, আমার ফুল ভালা আছে?’
‘হো ভালোই আছে। আমার কাছে থাকলে আপনেগো ফুল ভালো থাকবো না তা কি হয়? কারো কোন সাহস আছিনি ওর গায়ে টোকা মারার?’
শুভর ঠাটবাট জবাবে সন্তুষ্ট হলেন মনোয়ার সর্দার। হ্যাঁ, তার মেয়ের জন্য এমন একটা ছেলেই খুঁজছিলেন। যে সবার আগে ফুলকে গুরুত্ব দিবে। আনোয়ার সর্দারের চোখ দুটোতে মুগ্ধতা। এতোদিন কি সে রত্ন চিনতে ভুল করেছে? শুভ একটু বেপরোয়া, কারো কথা মানে না, জেদী, রাগী। নিজের কাছে যেটা ঠিক মনে হবে তাই করবে। কিন্তু অন্যায়ের সাথে কখনও আপোষ করেনি৷ আর রাগ, জিদের জন্য দায়ী তো তারাই। ছোট বেলা থেকে দুই ভাইকে ভিন্ন চোখে দেখেছেন৷ লেখাপড়ায় ভালো বলে অভিকে আদর করেছেন বেশি। শুভকে করেছেন তিরস্কার। তাতে বিগড়ে যাওয়ারই কথা।
শুভ, কলি বেগমের সাথে টুকটাক কথা বলছে। মনোয়ার সর্দার ভাইকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আমার অসুস্থতার কথা ফুল জানে?’
‘না, আমি তো বাড়িতে যাই নাই। গেলে জানতো।’
‘তুমি আর ওকে কিছু বলো না। না জানায় ভালো। জানলে আসার জন্য পাগলামো করবে। এখানে আসলেই ওর বিপদ। আমি চাই না ও এখানে আসুক। ও জায়গা থেকে যত দূরে থাকবে তত ভালো।’
‘তুই যা ভালো মনে করোস।’
‘ভাইজান আমি একটা সিদ্ধান্ত নিছি।’
‘কি সিদ্ধান্ত?’
‘এর মধ্যে ফুলের সাথে শুভর বিয়েটা দিয়ে দিবো।’
মনটা দুদিন ধরে কু’ডাকছে ফুলের। কোন কাজে মনোযোগ বসছে না। রাতের রান্না করে না খেয়ে শুয়ে পরছিলো। হঠাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেতেই হুরমুর করে উঠে গেলো। শিউরের পাশে নিজের দাদীকে দেখে ভীষণ অবাক হলো ফুল।
‘দুপুরে ভালো মতো কিছু খাস নাই। এহনো না খাইয়া ঘুমাইতাছোত কেন ছেমরি?’
‘দাদী আপনি এখানে? কিছু লাগবে?’
‘আমি এহনো ভাত খাই নাই। তোর লগে ভাত খামু আয়৷’
‘শুভ ভাই আসছে?’
‘না আইতে দেরী হইবো। তুই আমার লগে আয়। আমার মন চাইতাছে তোর লগে ভাত খাইতে।’
দাদীর নরম গলার কথা শুনে ফুল অবাকের ওপর অবাক। আজ কোন সুফিয়া বিবির দেখা পেয়েছে সে? এ যেনো ভিন্ন কোন মানুষ। স্বপ্ন ভেবে নিজের গায়ে চিমটি কাটলো ফুল। না সে জেগেই আছে। খাট থেকে নেমে দাদীর পেছন পেছন গেলো৷ একসাথে বসে খাবার খেলো। খাওয়ার সময় ফুলের চোখের নোনাপানি গাল বেয়ে পরছিলো৷ এই কান্না দুঃখের নয় সুখের। সবকিছু এখনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে তার।
‘কান্দোস কেন?’
দাদীর কথার উত্তর দিতে পারলো না ফুল। কান্নার তোর বাড়ছে৷ সুফিয়া বিবি নাতনীকে নিজের বাহুডোরে টেনে নিলেন। এতক্ষণ নিঃশব্দে থাকা কান্না এবার শব্দে রূপান্তরিত হলো। সুফিয়া বিবির চোখেও পানি। সেও কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘আমারে মাফ কইরা দিস। তোর লগে কত খারাপ ব্যবহার করছি। তাও আমারে বদদোয়া দেস নাই তুই। হেই দিন খারাপ স্বপ্ন দেখলাম। আমি বোধহয় বেশি দিন বাচমু না। মরণের আগে কোন দায় রাইখা যাইতে চাই না। খুব শীঘ্রই আমি তোর মারেও খবর দিমু। ওরে আমি বউ হিসেবে মাইনা নিছি। ও যেন এহন থিকা হেনেই থাকে।’
ফুল বিস্ময়ে হতভম্ব। আজ যেনো ফুলের অবাক হওয়ার দিন। এক দমকা হাওয়ায় সব যেনো ঠিক হয়ে গেলো। এমনটা তো সে কখনো আশা করেনি।
পরদিন শুভ, আনোয়ার সর্দার যখন ফিরলো তখন তাদের সাথে ফুলের পুরো পরিবারও ছিলো। ফুলের পরিবার দেখে ফুল, ঝুমুর সুফিয়া বিবি খুশি হলেও সোহেলী বেগমের মুখটা কালো হয়ে গেলো। সে গটগট করে দোতলায় উঠে গেছে। অভি বাড়িতে নেই। সে শহরে চলে গেছে গত পরশু। বাবার মুখে শুভর সাথে ফুলের বিয়ের খবর শুনে সে রাগ করে আবারো বাড়ি ছেড়েছে। তবপ এবার চেয়ারম্যান ছেলেকে আটকায়নি।
সুফিয়া বিবি ছেলের অবস্থা দেখে হু হু করে কেঁদে উঠলো। ফুল এগিয়ে এসে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে বললো,
‘তোমার এসব কি করে হলো বাবা?’
আনোয়ার সর্দার ফুলকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
‘সবেমাত্র আইছে৷ একটি জিরাইতে দে। তারপর বাকি কথা কইবোনে৷’
বৃন্ত, পাপড়ি বোনকে পেয়ে কি খুশি! এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে রইলো কিছুখন। সর্দার বাড়ি আজ খুশির জোয়ার। কত বছর পর সব ঠিক হলো৷ কলি বেগম ভেতরে ঢুকতে নিলেই সুফিয়া বিবি থমথমে গলায় বললো,
‘খাড়াও, তুমি ঢুকবা না।’
খুশির মুহুর্তে সুফিয়া বিবির কথা শুনে থমকে গেলো। ফুল বুঝতে পারলো না হঠাৎ করে তার দাদীর আবার কি হলো। কলি বেগম অসহায় চোখে স্বামীর দিকে তাকালো৷ সুফিয়া বিবি ঝুমুরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘খাড়ায় রইছোত কেন? যা গিয়া বরণ ডালা সাজায় আন। আমার ছোড বউরে বরণ কইরা ঘরে তুলতে হইবো না?’
সবাই একসাথে হাফ ছাড়লো। তারা কত কি ভেবে ফেলেছিলো। ঝুমুর খুশিতে মাথা নাড়িয় বললো,
‘এহনি যাইতাছি দাদী।’
ঝুমুর বরণ ডালা সাজিয়ে আনতেই বরণ করে নতুন বউয়ের মতো করে কলি বেগমকে ঘরে তোলা হলো। কলি বেগম শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না। বৃন্ত, ফুল, পাপড়িকেও বেশ উৎফুল্ল দেখালো। এত কিছুর মধ্যে ফুল শুভর কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলো। যদি না সে চেচিয়ে কইতরির মা বলে ডেকে না উঠতো।
#চলবে