#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_09
#Writer_NOVA
ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। নদীর পাশে থাকা কাশফুলগুলো হেলেদুলে তার জানান দিচ্ছে। দু-চারটা সাদা ফুল ফুটেছে। নদীতে দুটো পানকৌড়ি খেলা করছে।একটা ডুব দিচ্ছে তো আরেকটা উঠছে। লুকোচুরি খেলায় আজ কে জিতবে তার প্রতিযোগিতা। ক্ষেতের আইল বেয়ে উঠে মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে ফুল। একটা পানকৌড়ি ডানা মেলে ছোট গুল্মলতার ডালে বসলো। ফুলের কাছে মনে হলো পাখিটা কাঁপছে। তবুও সে কিন্তু তার সঙ্গী ছেড়ে গেলো না। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করলো যতক্ষণ না অপর পাখিটা ফিরে আসে।
‘কিরে কি দেহোস? ধেন্দির মতো খাঁড়ায় রইছে। কহন থিকা ডাকতাছি হুনেও না।’
শুভর ধমকে চমকে তাকালো ফুল৷ শুভর চোখে, মুখে স্পষ্ট বিরক্তি জানিয়ে দিচ্ছে সে আসলেই ফুলকে অনেকবার ডেকেছে। কিন্তু ফুল পানকৌড়ি দেখতে এতই মুগ্ধ ছিলো যে কোনদিকে ধ্যান ছিলো না।
‘আবারো খাঁড়ায় রইলো। বিকাল শেষ হইলে কি গঞ্জে যাবি? তোর লিগা বেডারা দোকান খুইলা রাখবো?’
‘এতো ধমক দিচ্ছো কেনো?’
শুভ কোমড়ে এক হাত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
‘ধমকের কাম করলে তোমারে কাঁধে তুইল্লা হাটমু।’
‘হাঁটতে মন চাইলে কাঁধে নিতে পারো।আমি কিছু মনে করবো না। এমনিতেও পা দুটো ব্যাথা করছে।’
‘ওরে আমার নবাবজাদি! এতডু হাইটা উনার পাও ব্যাথা করতাছে।’
‘তোমার বটবটি তো আনতে পারতা শুভ ভাই।’
খিলখিল করে হেসে উঠলো ফুল। শুভ চোখ রাঙানিকে সে পাত্তা দিলো না। শুভ দাঁত কটমট করে বললো,
‘আমার মোটর সাইকেলরে বটবটি কবি না কইতরির মা।’
‘একশবার বলবো। কি বলবে তুমি?’
শুভ আবারো চোখ রাঙাতেই ফুল উচ্চস্বরে হাসলো। সেই হাসির শব্দ নদীর ওপাড়ে গিয়েও বারি খেলো। ফাঁকা জায়গায় বাতাসে বারবার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। শুভর বিরক্তিগুলো সব ঠুস করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। এই কারণে সে মোটরসাইকেল আনেনি। মাটির কাঁচা রাস্তা হলে এতক্ষণে বাজারে পৌঁছে যেতো তারা। কিন্তু শুভ তা চায়নি। যত বেশি সময় ফুলের সাথে থাকা যায় সেই বন্দবস্ত করেছে। মেয়েটার সাথে থাকলে সব দুঃখ যেনো তার থেকে ছুটি নিয়ে কোথাও পালিয়ে যায়।
শুভকে গভীর চিন্তায় মগ্ন দেখে ফুলের কপাল কুঁচকে গেলো।শুভকে রাগাতে তার বেশ লাগে। অল্পতেই লুচির মতো ফুলেফেঁপে উঠে। তবে ভয়ংকর রেগে গেলে সর্বনাশ! তাই ফুল বোঝার চেষ্টা করলো শুভর মতিগতি কেমন!
‘শুভ ভাই!’
‘হু ক।’
‘দাড়িয়ে আছো কেন? যাবে না?’
‘হো লো (চল)।’
শুভ আগে আগে চলতে লাগলো। পিছনে ফুল পানকৌড়ির মতো হাত মেলে বড় করে মুক্ত বাতাস নিলো। নির্ভেজাল অক্সিজেন। বাড়িতে থাকতে থাকতে দমবন্ধ লাগে তার। কতদিন পর বাসা থেকে বের হয়েছে সে। ইচ্ছে করছে তা ধিন ধিন করে নাচতে। শুভ তাকে নিয়ে যাচ্ছে সেলোয়ার-কামিজ কিনে দিতে। সোজা রাস্তা ছেড়ে এই ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে কেনো নিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না ফুল। পিছনে পরতেই এক দৌড় লাগালো সে। তার দৌড়ে ক্ষেতে থাকা সাদা বকগুলো ভয় পেয়ে আকাশে উড়াল দিলো।
‘তুমি এদিক দিয়ে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?’
‘তোরে মা’ইরা নদীতে ফালায় দিমু।’
‘যাঃ আজাইরা কথা!’
ফুলের কথা শুনে শুভ হো হো হেসে উঠলো। ফুল মুখ ভোঁতা করে ফেললো। ছেলেটার হয়েছে কি? অকারণে এমন হাসে কেন?
মোড়ায় বসে পান সাজাতে সাজাতে কূটনামি বুদ্ধিটাও সাজিয়ে ফেললেন সুফিয়া বিবি। পান মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বড় বউকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘আমি আগেই কইছিলাম এই মাইয়া আইছে আমগো নাতিরে কব্জা করতে। এহন তোর বিশ্বাস হইলো?’
‘আপনের পোলায় কি হেইডা হুনে? আমার কলিজা ভাজা ভাজা করতাছে। কত বড় সাহস দেহেন আম্মা। আমার পোলারে নিয়া বাজারে গেছে। আপনার পেলায় ঐ মাইয়ারে লাই(সাহস) দিয়া মাথায় তুলতাছে। আমারে বনবাসে পাডানোর ব্যবস্থা করে।’
সোহেলী বেগমের কন্ঠে তীব্র রাগ। এই মুহূর্তে ফুলকে হাতের কাছে পেলে হয়তো গালে কষিয়ে চড় মেরে বলতো, ‘এত শখ কেন আমার পোলার লগে বাজারে যাওনের?’ শুধু নেই বলে বেঁচে গেলো। হাতটা নিশপিশ করছে ভীষণ। ঝুমুর একবার দরজা দিয়ে সাবধানী দৃষ্টি দিয়ে কচ্ছপের মতো মাথাটা ভেতরে নিয়ে গেলো। সোহেলী বেগমোর মেজাজ যে আকাশে উঠে আছে তা বুঝে সে এদিকে ভিড়লো না। তাড়াতাড়ি করে নিচে নেমে হাঁস-মুরগির খাবার নিয়ে খোয়ারের দিকে চলে গেলো।
‘সব দোষ তো আমার পোলার না! তুই খালি আনোয়াররে টানোস? ঐ মাইয়া কি কম ছলনা জানে? কেমনে কারো হাত কইরা রাখতে হয় তা ওর আয়ত্ত্বে ভালাই আছে।’
‘মান-সম্মান খাইতে আইছে। বুঝছেন আম্মা? চেয়ারম্যান বাড়ির যতুডু মান-ইজ্জ্বত বাকি আছে ঐডুও ধুলার লগে মিশাইবো। আহুক আজকে। আমার পোলার লগে বাজারে ঘুরোন ছুটামুনে।’
‘তোর পোলাও কি কম যায় নাকি? জীবনে দাদী, মায়েরে নিয়া কোনহানে গেলো না। অথচ ঐ ছেমরিরে নিয়া ডেং ডেং কইরা আমার সামনে দিয়া হাইটা গেলো। একবার কইলোও না যে দাদী বাজারে যাই।’
সোহেলী বেগম উত্তর দিলেন না। তার শরীর রাগে কাঁপছে। সুফিয়া বিবি চুপ হয়ে মনে মনে হাসলেন। ফুল, শুভর বিরুদ্ধে যতটা উসকে দিয়েছেন আজকের জন্য এতটুকু যথেষ্ট। দুজনের কি অবস্থা হবে তা ভেবে মনে মনে খুশির পরিমাণটা বেড়ে গেলো।
‘ফুল কই ঝুমুর আপা? ওরে দুদিন ধইরা দেহি না। ও কি বাড়িগে গেছে?’
ময়নার কথা শুনে পেছনে ঘুরে তাকালো ঝুমুর। হাতে মুরগীর খাবার বাটিটা মাটিতে রেখে ময়নার বাহু ধরে আড়ালে টেনে নিয়ে গেলো। ফিসফিস করে বললো,
‘আস্তে কথা কও। বাড়ির পরিস্থিতি ভালা না। আমার ডর করতাছে জানোস?’
ময়না চোখ কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললো,
‘কেন?’
‘আরে ছোট ভাই ফুলরে নিয়া গঞ্জে গেছে। হের লিগা চাচী তো রাইগা আগুন। এহন ফুল বাড়িতে আইলে খবর কইরা ফালাইবো।’
‘কও কি!’
চাপা আর্তনাদ করে উঠলো ময়না। ঝুমুরের চোখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেলো। ময়নার বুক চিরে বেরিয়ে গেলো দীর্ঘ শ্বাস। যা ঝুমুরের কানে বিকট শব্দ মনে হলো।
‘ওর লিগা চিন্তা হইতাছে আমার ময়না৷ তুই তো জানোস এই বাড়ির মানুষ কেমন! মাইয়াডা সারাদিন সংসারে বান্দীর মতো খাটে। তাও একটু কিছু হইলে বাপ-মা তুইল্লা কথা কয়। আজকে তো বোধহয় চুলের মুঠি ধইরা ঘুরাইবো।’
ময়না আশ্বাসের বুলি আওড়ে বললো,
‘চিন্তা কইরো না, আল্লাহ আছে। দেইখো ফুল সব ঠিক করে নিবো। তয় লগে শুভ ভাই থাকলে ভালা হইবো। কেউ কিছু কওনের সাহস পাইবো না।’
ময়নার আশ্বস্ত বাণীতে ঝুমুর খুশি হতে পারলো না। মনের ভেতর দমকা হাওয়া বইছে। মন বলছে আজ কোন ঝড় অবশ্যই আসবে।
মাগরিবের আজানের বেশি সময় নেই। ঠান্ডা বাতাস বইছে। আকাশটাও হঠাৎ করে ভার হয়ে গেলো। কালো মেঘে সারা আকাশ ছেয়ে গেছে। বৃষ্টি হবে হবে ভাব। আনোয়ার সর্দার রমিজ মিয়াকে তাড়া দিয়ে বললেন,
‘তাত্তাড়ি (তাড়াতাড়ি) পা চালা রমিজ। আকাশের অবস্থা ভালো না।’
‘তাইতো দেখতাছি চেয়রাম্যান সাব।’
‘বৃষ্টিতে নাগাল পাইবো নাকি আমগো?’
‘কইতে পারি না। আল্লাহর ইচ্ছা।’
‘একটু আগেও সব ঠিক আছিলো। আজানের আগে বাড়িত যাইতে হইবো।’
দ্রুত গতিতে পা চালাচ্ছেন আনোয়ার সর্দার। সাথে ছাতা নেই। অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজলে পাক্কা এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগতে হবে। চেয়ারম্যানের সাথে পা মিলাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হোচট খেলেন রমিজ মিয়া। সেটা খেয়াল করে আনোয়ার সর্দার বললেন,
‘আস্তে হাট, এই বয়সে পইরা মাজা(কোমড়) ভাঙবিনি?’
রমিজ মিয়া বেআক্কলের মতো হাসলো৷ আনোয়ার সর্দার কথা না বাড়িয়ে হাঁটার গতি বাড়ালেন। কথায় আছে না যখন তুমি তাড়াতাড়ি করতে যাবে তখুনি তোমার বেশি দেরী হবে। তেমনি ঘটলো আনোয়ার সর্দারের ক্ষেত্রে। দক্ষিণের গ্রামের মেম্বার কালাম ব্যাপারি এই রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। চেয়ারম্যানকে দেখে হাঁকডাক শুরু করলেন।
‘ও চেয়ারম্যান সাব, এট্টু দাড়ান। আপনের লগে অনেক জরুলি (জরুরি) কথা আছে।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আনোয়ার সর্দারকে দাঁড়াতে হলো। তার কাজই গ্রাম ও গ্রামের মানুষের উন্নয়ন করা।সেখানে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলে তো চলবে না।
ফুল বাসায় ফিরলো আজন দিবে দিবে এমন মুহুর্তে। শুভ ফুলকে বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আজ তার ক্লাবে বাজি খেলা আছে৷ সেখানে তার থাকতেই হবে। এর জন্য দেরী করলো না। ফুল হাতে থাকা ব্যাগটা বুকের সাথে জাপ্টে ধরে ধীর পায়ে নিজের কামরায় চলে গেলো। কামটায় ঢুকে আশেপাশে ঝুমুরকে দেখতে পেলো না। ভেতরে ঢুকে খাটে বসে বড় করে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। চাচীর সামনে পরলে নির্ঘাত তোপের মুখে পরতে হতো।
হাতের ব্যাগটা উপুড় করে ঢালতেই দুই সেট সেলোয়ার-কামিজ ও এক মুঠ নীল রঙের কাচের চুড়ি বের হলো। কাচের চুড়ির মুঠ সে নিজের টাকা দিয়ে কিনছে ছোট বোনের জন্য। কাচের চুড়ি দেখলে ও অনেক খুশি হবে। শুভর কাছে বললো শুভ কিনে দিতো। তাহলে নিজের জমানো টাকা দিয়ে প্রিয়জনের মুখের হাসিটা দেখা হতো না। মাঝে মাঝে ফুলের চাচা যে টাকা দেয় তা ফুল জমিয়ে রাখে। সেই টাকা দিয়ে বাড়িতে লেইস ফিতা ওয়ালা এলে লুকিয়ে একটু একটু করে অনেক কিছু কিনে রাখে। বাড়ি ফেরার সময় ছোট বোনটার জন্য নিয়ে যাবে বলে। চুড়ির মুঠটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগো। ততক্ষণাৎ সোহেলী বেগম ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে মেঝেতে আছাড় মেরে চেচিয়ে বললো,
‘আমার পোলার টেকা দিয়া এই কাম করোস? তোর মায় আমার দেওরে বশ করছে। তুই আইছোত আমার পোলারে করতে।’
ফুলের কানে চাচীর কথা ঢুকলো না। সে এক দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠায় বসে কাচের চুড়িগুলো রিনঝিন শব্দ করে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে দেখলো। চুড়িগুলো নয়, যেনো ফুলের উৎফুল্ল হৃদয়টা ভেঙে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেলো। সাথে ছোট বোনের তৃপ্তির হাসিটাও এক ঝটকায় মিলিয়ে গেলো।
#চলবে
ভাইয়ার বিয়ে, পরীক্ষার কারণে এই সপ্তাহে লম্বা গ্যাপ গেলো। এখন থেকে নিয়মিত গল্প দিবো ইন শা আল্লাহ।