#কোমল
তৃতীয় /শেষ পর্ব
লেখাঃ #আশনা_আরাফ
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন আমার মেয়ের মা হবেন? জিজ্ঞেস করছি না তবে অনুরোধ করছি। আমার স্ত্রী না হলেও চলবে।
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।
তিনি চোখের জলে সিক্ত হয়ে বললেন এইটুকুই চাই আপনার কাছে। এর চেয়ে বেশি আর কিছুই না।
আমি তাকিয়ে আছি লোকটার দিকে। মনে মনে ভাবছি এই মুহূর্তে আমি যে সম্মতি দিলাম সেটা কি আদৌ রাখতে পারবো? কিন্তু না রাখার কি আছে? আমিতো সব জেনেই এখানে এসেছি। তিনিও স্পষ্ট করেই বলে আসছেন প্রথম দিন থেকে। মনের মাঝে অনেক এলোমেলো প্রশ্ন। কি একটা ঘোরে ডুবে আছি তা নিজেও বুঝতে পারছিনা।
এমন সময় তিনি বললেন কিছু মনে না করলে ফ্রেশ হয়ে আসেন। জামাকাপড় চেঞ্জ করলে আরাম পাবেন। অনেকতো হলো এবার কান্নাকাটি বন্ধ করে একটু ঘুমান না হয়। বলেই তিনি বারান্দায় চলে গেলেন।
আমি সব অস্বস্তি পিছনে ফেলে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। সত্যিই বেশ আরাম লাগছে। বিগত কয়েকদিনের ধকল অনেকটা কম মনে হচ্ছে। কিন্তু এতো রাতে ফ্রেশ হওয়ার অভ্যাস নেই। সাথেই ঠান্ডা লেগেছে মনে হয়। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই হাঁচি দিলাম বেশ কয়েকটা। তিনি তাড়াতাড়ি সর্দি-জ্বরের ঔষধ আর পানি এগিয়ে বললেন খাবারটুকু খেয়ে এই ঔষধ খেয়ে নিন।
খাবারের কথা শুনে আমি অবাক হলাম। এতোরাতে খাবার কোথায়?
তিনি হাসলেন!
বললেন নিয়ে এসেছি। খেয়ে নিন। গরম করলাম মাত্র।
আপনি? এতো রাতে কি দরকার ছিলো?
ছিলো। নিন খেয়ে নিন।
কিছু না বলে খাবারটুকু খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিলাম। তারপর ঘুম। গভীর ঘুম। ক্লান্তির চাপে অনেকক্ষণ ঘুমালাম।
যখন চোখ খুললো তখন দেখি সকাল ১০ টা বাজে। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে নামলাম। তিনি বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছেন। ঘর গুছিয়ে উনার কাছে গেলাম।
কোমল কোথায়?
ঘুমাচ্ছে।
সরি দেরি করে উঠলাম। আসলে খুব ক্লান্ত ছিলামতো তাই।
ব্যাপার না। এই বাড়ির সবাই ১০ টার পরেই ওঠে। আপনি তাদের তুলনায় একটু আগেই উঠেছেন।
শুনে অবাক হলাম।
যাইহোক একটু শান্তি পেলাম আমি।
কিছুক্ষন পরেই একজন এসে নাস্তা দিয়ে গেলো রুমে।
খাওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই বললাম আপনি খেয়ে নিন। আমি পরে খাবো।
তিনি খেয়ে বাইরে চলে গেলেন।
ফিরলেন বেশ কিছুক্ষণ পর।
সাথে ঐ মিষ্টি মেয়েটা।
যাকে গতকাল প্রথমবার দেখেছিলাম এই বাড়িতে।
গুটিগুটি পায়ে উনার হাত ধরে আমার সামনে এসে বসলো। আমার খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে তাকে। কিন্তু মা হিসেবে হাত বাড়াতে ইচ্ছে করছেনা। মনের ভিতরে কেমন একটা অনীহা কাজ করছে।
সে’ই আমার দিকে চিপসের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো খাবে? এটা খুব মজায়ালা চিপস।
আমি বললাম, না তুমি খাও। আমার খিদে নেই।
নাওনা মা৷ একটা নাও।
তার মুখে মা ডাক শুনে খুব অবাক হলাম আমি। হ্যাঁ, অবাক হয়েছি কিন্তু খুশি হইনি। তবে মা ডাক শুনার পর কোমলকে আর না করিনি। খেয়ে নিলাম।
সে আমার সামনে বসে বসে আমাকে দেখবে। এটাই তার আজকের ইচ্ছা। প্রথমবার মা’কে দেখতে পেরেছে তাই সরতে চায় না আমার সামনে থেকে। হলোও তাই। তিনি কোমলকে আমার কাছে রেখে চলে গেলেন বাইরে৷
যাওয়ার আগে হাতে একটা মোবাইল দিয়ে বলে গেলেন যদি বিরক্ত লাগে তবে উনাকে একটা মেসেজ দিলেই হবে৷ তবুও যেন কোনোভাবে কোমলের সাথে খারাপ ব্যবহার না করি। সে মা সমন্ধে কোনোভাবেই যেন খারাপ ধারণা পোষণ না করে।
সত্যিই খুব মুগ্ধ হলাম। এতো ছোট মেয়েকে কত সুন্দর করে প্রতিটা সম্পর্কের ব্যাপারে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আমি মোবাইলটা রেখে উনাকে বিদায় দিলাম।
কিছুক্ষণ পর আমার শাশুড়ী ননদ সবাই আসলেন আমার কাছে। এসে দেখেন কোমল কোলে বসে আছে। টুকটুক করে গল্প করছে। আমিও খুব ইঞ্জয় করছি ব্যাপারটা।
উনারা খুব খুশি হয়ে বললেন কোমলকে এভাবেই আগলে রেখো ইতি। সে যেন কখনো কষ্ট না পায়।
আসলে উনাদের কথা শুনে আমার খুব রাগ হচ্ছিলো। আমি কোমলকে আদর করলেও তার মা হওয়ার ইচ্ছে রাখি না। নিজের মনকে বুঝাতে পারছি না। উনাদের কথা শুনে শুধু মাথা নেড়ে বসে থাকলাম।
প্রায় তিনঘণ্টা পর আমি উনাকে মেসেজ দিলাম আর পারছিনা।
মেসেজ দেওয়ার প্রায় পনেরো মিনিট পরেই তিনি চলে আসলেন। এসে কোমলকে নিয়ে গেলেন নিজের সাথে। কিন্তু মেয়েটা যাবে না। সে এখানেই থাকবে। আমার সাথেই থাকবে।
বাধ্য হয়ে রাখতে হলো।
প্রায় দশ বারো দিন ধরে সে আমার সাথেই থাকে। উঠা বসা খাওয়া শোওয়া সবকিছুতেই তার আমাকেই চাই। সে আমি ছাড়া কিছু বুঝছে না।
এদিকে আমি খুব টায়ার্ড অভিনয় করতে করতে। বেশিদিন অভিনয় করতে পারবোনা এটাও সত্যি।
তাই উনাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম দেখুন আমি এসব মানতে পারছি না। একেতো আমি তার মা না। তার ওপর আবার আদিখ্যেতা! আপনি আমার কাছে এতোকিছু আশা করিয়েন না প্লিজ!
তিনি কিছুই বললেন না।
চুপচাপ বাইরে চলে গেলেন।
এদিকে কোমল আবার এসেছে।
তার খুব জিদ সে আমাকে সাজিয়ে দিবে আর আমি তাকে।
খুব বিরক্ত হয়ে তাকে চড় মেরে বসলাম।
যদিওবা সেটা আস্তে ছিলো কিন্তু তার বাবার বুকে গিয়ে লাগলো।
তিনি কোমলকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন থাক৷। আপনার রাগ করতে হবে না। বাচ্চা মেয়েতো সে জানে মায়েরা খুব ভালবাসে৷ কিছুতেই না করে না। তাই জিদ করেছে।
আমি রেগে গিয়েই বললাম ঠিকু জানে। কিন্তু আমিতো আর………
তিনি কথা অসম্পূর্ণ শুনেই বের হয়ে গেলেন বাসা থেকে। আমিও বসে রইলাম রুমের ভিতরেই।
প্রায় একমাস পর ভাইয়া ভাবি এসেছেন আমাকে নিয়ে যেতে। আমিও রেডি হয়ে চলে গেলাম। যাওয়ার আগে উনাকে বলে গেলাম দুঃখিত আমি মা হতে পারলাম না। তিনি কিছুই বলেননি। কোমল জড়িয়ে ধরে বললো আমিও যাবো মা তোমার সাথে। আমি বললাম পরেরবার সোনা। আজ থাকো এখানে।
তিনি আমাকে বারান্দায় ডেকে বললেন মিথ্যে ভরসা দিয়েন না। বাচ্চা মেয়েতো নয়তো আপনাকে মিথ্যেবাদী ভাববে।
আমি কিছু না বলেই আবার ফিরে এলাম ভাইয়া আর ভাবীর সাথে। সবাই কি আদর যত্ন করছে আমার। তাদের কাছে আমি অতিথি। কিন্তু যাওয়ার যে ইচ্ছে নেই আমার। সেই কথা ভাইয়াকেও বলতে পারছি না।
ভিতরে ভিতরে কষ্ট লালন করছি আমি।
প্রায় সপ্তাহখানেক পর আমার খুব জ্বর এলো। বিছানা থেকে উঠতেই পারছি না।
খবর দেয়া হলো শশুরবাড়িতে।
আমার স্বামী আর মেয়ে দু’জনে আসলো আমাকে দেখতে। আমাকে অসুস্থ দেখে কোমলের কি কান্না!
কতবার নাক মুখ ধরে ডাকছে মা মা করে।
জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। সেও দিচ্ছে৷ মাথা ধোওয়ানোর সময় সেও পানি ঢালছে। এইটুকু মেয়ে যথেষ্ট খেয়াল রাখছে আমার। মাঝরাত্র উঠে দেখি সে আমার বুকের উপরেই ঘুমিয়ে আছে। আস্তে করে সরিয়ে আমার পাশে শুইয়ে রাখি।
ঘুম থেকে উঠেই সে দোয়া করছে আমার জন্য। আল্লাহর কাছে মিনতি যেন তার মাকে সুস্থ করে দেন তিনি তাড়াতাড়ি।
কোমলের প্রার্থনা আর কেয়ার দেখে আমার চোখে পানি। মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে।
সারাদিন অপরাধবোধে ভুগেছি আমি মা হয়ে চাইনি মেয়েটার কিন্তু সে আমার মা হয়ে দেখিয়ে দিলো। কি কোমল তার মন।
কোমলের ভালবাসায় আমি মা’কে ফিরে পেয়েছি মনে হয়। তাকে আমার কাছে টেনে নিয়ে খুব আদর করলাম আমি। তিনি এসে বললেন ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে। আজই চলে যাবেন। সাথে ডিভোর্স পেপার দিলেন। বললেন মন চাইলে স্বাক্ষর করে মুক্ত হতে পারেন। তবে না করলেও আমি অধিকার খাটাবো না।
আমি খুব অবাক হলাম৷ মুহূর্তেই কোমলের ভালবাসা আর নিষ্পাপ মুখটা ভেসে উঠলো আমার সামনে। তার ভালবাসা বাঁধা দিলো আমায়। আটকে রাখলো খুব শক্ত করে।
আমি মুহূর্তেই পেপারসটা ছিঁড়ে দিলাম।
তিনি বললেন আপনিতো পারবেন না।
হুম্ম! আমি মা হতে পারবোনা বলেছিলাম কিন্তু কোমল আমার মা হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। আমার মা থেকে আমাকে আলাদা করবেন না প্লিজ!
তিনি হাসলেন।
প্রশান্তির হাসি। আমার হাত ধরে বললেন ওকে। মেয়েরাতো মায়ের মা হয়। কোমলের জন্য আপনার চেয়ে ভালো মা আর পাওয়াই যাবে না। আল্লাহর লাখো কোটি শুকরিয়া তিনি আমার দোয়া কবুল করেছেন।
আমিও হাসলাম।
উনার সাথেই বাড়ি ফিরলাম সেদিন বিকেলেই।
কোমল আমার সাথেই ছিলো সারাক্ষণ। রাতের বেলা তাকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দায় বসে আছি।
এমন সময় তিনি এসে বললেন, কি ভাবছেন?
একটা কথা বলি?
বলুন!
কোমলকে নিতে তার মা আসবেনাতো কখনো?
তিনি খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে ব%LS