কোমল পর্ব -০২

#কোমল

পর্বঃ ২

লেখাঃ #আশনা_আরাফ

বিয়েতে বউ লাল রঙের ছোঁয়া নিয়ে সাজে। আমিতো বিয়ে করে মা হচ্ছি।

আমার কথা শুনে ভাইয়া কেমন যেন থমকে গেলেন। মুহূর্তেই হাত গুটিয়ে নিয়ে সরে গেলেন অশ্রুভরা চোখ নিয়ে৷

এদিকে বরযাত্রী চলে এসেছে। আমি আর কিছুক্ষণের অথিতি এই বাড়িতে একটু পর বিদায় হয়ে যাবে আমার। ভাবী জঞ্জালমুক্ত হবে কিন্তু ভাইয়ার কষ্ট হবে খুব৷ ইতির অভ্যাস ভাইয়ার খুব পুরোনো। খাওয়ার সময় কিংবা কোনো হিসাব নিকাশ করার সময় ইতি ছাড়া ভাইয়ার চলেই না। হুম্ম! আমি চলে গেলে আমার দুই বছরের ভাইঝি আর ছয় বছরের ভাইপো খুব একা হয়ে যাবে৷ তাদের কাছেতো ইতি ফুপি মানে সকাল,বিকাল, দিন রাত সব।

খুব কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে চলে যেতে হবে। তবে মনের ভিতর কেমন যেন সুনসান নিরবতা খুব বেগে ঝড় হচ্ছে কিন্তু অনুভূতির কোনো কিছুই নেই। শুধু সব সম্মতি দিয়ে মেনে নিচ্ছি।

অনেককিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে মনের ভিতর।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিলো, পারবোতো এই বিয়ে মেনে নিয়ে সংসার করে যেতে? মেয়েটার মা হতে পারবোতো?

উত্তরতো একটাই আমি পারবো না।
কিন্তু কেন পারবো না?

এই উত্তর আমি খুঁজে পাচ্ছি না।
সম্ভবত কাউকে নিজের সন্তান ভাবা আর তার মা হওয়ার মধ্যে অনেক তফাত।

এলোমেলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন সময় কাজী সাহেব এসেছেন কলমা পড়াতে। সবাই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে এই সময়। বড়রা মাথার ঘুমটা টেনে আমার মুখ ঢেকে দিলেন। কাজী সাহেব যা যা বলছেন আমিও ঠিক সেগুলো উচ্চারণ করে গেলাম। কিন্তু কবুল বলার সময় থমকে গেলাম। বের হচ্ছে না মুখ থেকে। সামনে থেকে ভাইয়া বললেন, বুনু বলে দে। বলে দে। ভাঙা মনে সেটাও বলে দিলাম। কাবিননামায় আমার স্বাক্ষর নিয়ে চলে গেলেন উনারা।

পরিশেষে আমি স্ত্রী হলাম কারো। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পরছে। কিন্তু মুছে দেওয়ার কেউ নেই। চুপচাপ বসে আছি। বউ দেখতে অনেকেই আসছে আর যাচ্ছে। খুব অসহনীয় অবস্থা আমার।

ভালো লাগছেনা কিছুই। এমন সময় ভাইয়া এসে বসলেন আমার পাশে। পকেট থেকে বের করে দুটো বালা দিলেন আমার হাতে। বালা দুটো চিনতে ভুল হয়নি আমার। এগুলো মায়ের বালা। তিনি খুব যত্ন করে আমার হাতে পডিয়ে দিতে চাইলেন কিন্তু আমি হাত বাড়িয়ে দেইনি। বললাম এগুলো ভাবীকে দিয়েন। আমার অধিকার নেই এগুলোর উপর। তাছাড়া মায়ের গহনাগাঁটির ভাগ বউরা পায়। আর ভাবীতো এটার যোগ্য। অনেক কিছু করেছেন তিনি মায়ের জন্য। উনার মেয়েকে নিজ দায়িত্বে বিয়ে দিচ্ছেন এটাও বা কম কিসের?

ভাইয়া আমাকে বুকে জড়িয়ে কান্না শুরু করলেন। আমিও পারিন খুব বেশি একটা শক্ত হয়ে থাকতে৷ ভাইয়ার সাথে আমিও কাঁদছি। সাথে আমার কলিজার টুকরাগুলো। ভাবীর মতো নির্দয় মানুষের চোখেও পানি। যাইহোক ভাইয়া খুব জোড়াজুড়ি করলেও আমি বালা দুটো ভাবীর হাতে পরিয়ে দিলাম৷

এদিকে বিদায়ের সময় হয়ে এসেছে৷ ভাইয়ার হাত ধরেই গিয়ে গাড়িতে বসলাম। আমার পাশে এসে বসলেন তিনি মানে আমার স্বামী। সবাইকে বিদায় জানিয়ে শুরু হলো যাত্রা। আমি খুব বিস্মিত হয়ে বসে আছি। উনার মেয়ে নেই কেনো সাথে? যার জন্য বিয়ে তাকেই নিয়ে আসেননি?

তিনি খুব শান্ত গলায় বললেন দেখুন কিছু ভাবার নেই। মেয়েটাকে আনিনি। আপনি ঠিক আছেনতো?

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।

তাহলে চোখমুখেত বারোটা বাজিয়েছেন যে!
বলেই টিস্যু পেপার এগিয়ে দিয়ে মুখ মুছে নিতে বললেন।

আমিও উনার হাত থেকে টিস্যু নিয়ে মুখ মুছে নিলাম।

বউরাতো লাল রঙে সাজে।
আপনি নীল রঙে…………..

আমার এটাই ভালো লাগে। প্রিয় রঙ তাই সেজেছি।

সেজেছেন?
কোথাও সাজেরতো ছিটেফোঁটাও নেই।

এটাই সাজ। মায়ের আবার কিসের সাজ?
আপনিতো স্পষ্টই বলেছিলেন আপনার মেয়ের জন্য বিয়ে করছেন। তাহলে আবার?

তিনি আর কথা বাড়ালেন না। হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে আমি খুশি হইনি।

পুরো রাস্তা মৌনতা অবলম্বন করেই বাড়ি পৌঁছালাম।
স্বাগত জানিয়ে আমাকে ভিতরে নেয়া হলো। বিশাল বাড়ি। দেখেই চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে সাজসজ্জা। আমি চতুর্দিকে দেখছি অবুঝের মতো। এমন সময় একটা ছোট মেয়েকে দেখলাম বয়স প্রায় দু’বছর হবে। মনে হলো এই সেই মেয়ে যার জন্য আমি এখানে। কিন্তু ভালো করে দেখতে পারলাম না মেয়েটাকে।

ততক্ষণে আমাকে আমার রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। খুব সুন্দর করে সাজানো সব। বিছানায় ফুলের তোঁড়া। খুব রোমান্টিক পরিবেশ। কিন্তু আমার জন্য বিরক্তিকর। গোলাপে এলার্জি আছে আমার৷ আমি সরিয়ে রাখলেও এলার্জি উঠবে। তবু গিয়ে বসলাম। এদিকে মাথা ভারী হয়ে আসছে।

অনেক অপেক্ষা করিয়ে তিনি রুমে আসলেন।
এক পা দু পা করে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। আর আমি ভয়ে জড়োসড়ো। তবুও উনাকে থামিয়ে বললাম আমার কাছে আসবেন না। ওখানেই থাকেন। প্লিজ!

তিনি মুচকি হেসে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ঠিক আমার পাশে বসলেন।

আমি কিছু বলবো তার আগেই তিনি বলে উঠলেন,
দেখুন আমি কিচ্ছু করবোনা। জাস্ট গোলাপের তোড়া সরাতে এসেছি। আপনি ঘাবড়াবেন প্লিজ!

আমি চুপ করে রইলাম।

তিনি সব সরিয়ে বললেন এলার্জি আছে সরাতে পারলেইতো হতো। এই যে চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে। এতে স্পষ্ট বুঝাই যাচ্ছে আপনার এলার্জি।

আমি আবারো কিছু বললাম না। তবে বুঝতে পেরেছি তিনি কিছু সমস্যা না বললেও বুঝতে পারেন। রুমের লাইট অফ করে শুয়ে পড়লেন। আমি জেগেই আছি।

রাত প্রায় তিনটা। তিনি ঘুম থেকে উঠে আমাকে দেখে খুব অবাক হলেন। আপনি এখনো জেগে চেঞ্জ করেননি? ঘুমাননি এখনো?

না, মানে!

না, মানে কি?
ভয় পেয়েছেন? দেখুন আমি আপনাকে কিছুই করবো না। আপনাকে বলেছিলাম মেয়ের জন্য বিয়ে করছি আমি আমার কথায় অনড়। আপনি আমার মেয়ের মা হলেই আমি খুশি। আর যদি না হতে পারেন আক্ষেপ নেই। জন্মদাত্রী যখন মা হতে পারেনি তখন আপনার কাছে আশা করাটা বোকামিই হবে নাহয়। ভেবে নিবো আমি ব্যর্থ তাকে মা এনে দিতে।

বলেই তিনি ওযু করে এসে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করলেন। বুঝার আর বাকি নেই যে তিনি খুব ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। আমি দাঁড়িয়ে আছি জানালায়। তিনি নামাজ শেষে আমার পাশে দাঁড়ালেন।

এই বিয়েতে আপনার মত ছিলো না। তাইনা?

আমি খুব অবাক হলাম উনার এই কথা শুনে।
আসলে তা না!

হুম্ম! তা না।
কিন্তু আমার মেয়ের কথা শুনে আপনি মত পালটে ফেলেছিলেন।

দেখুন! আপনি……

মিস. ইতি আপনি খুব অবাক হয়েছিলেন আমি জানি। আপনার ভাবীর অস্বাভাবিক কথাবার্তা শুনে আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

আসলে আমি বুঝতে পেরেও আপনাকে বিয়ে করে সেলফিসের মতো কাজ করলাম।

আমি কিছু না বলেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।

দেখুন আমি বিয়ে না করলে আপনার বিয়ে আপনার ভাবি ঠিকই দিতেন। কিন্তু আপনি হয়তো সুখী হতেন না।

মানে?

হুম্ম! তিনি গ্রামের ঐ রহিম ঘটকের বেকার ছেলের সাথে আপনার বিয়ে দিতেন। সেওতো বিবাহিত। ডিভোর্সি।।

মানে?

আমি আসার পর রহিম ঘটক আমাকে সব বলেছে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না।
জিজ্ঞেস করলাম আপনার মেয়ে কোথায়?

দাদীর সাথে ঘুমিয়েছে। সকালে দেখা হবে তার সাথে।
নাম কি?

কোমল।

সুন্দর নামতো।

তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন আমার মেয়ের মা হবেনতো? জোর করছি না। তবে অনুরোধ করছি।
আমার স্ত্রী না হলেও চলবে।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম।

তিনি চোখের জলে সিক্ত হয়ে বললেন আপনার কাছে শুধু এইটুকুই চাই।

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here