কোমল পর্ব -০১

#কোমল

পর্বঃ ১

লেখাঃ #আশনা_আরাফ।

নতুন করে কোনো কথা না বাড়িয়েই লোকটা আমাকে তার সন্তানের মা হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলো।
অথচ আমি জানতাম তিনি আমাকে দেখতে এসেছেন। খুব ভালো সমন্ধ। ভাইয়া খুব করে চাচ্ছেন এই বিয়েটা হয়ে যাক। অনেক বড়লোক তারা। নিজের গাড়ি বাড়ি সবই আছে। দুতলা দালান। নিজস্ব জমিজমা। শহরে ব্যবসা। এক কথায় অন্যরকম।

এতো ভালো সমন্ধ আমাদের মতো গ্রামে আসা মানেই বিশাল ব্যাপার। তাছাড়া আমাদের মতো পরিবারে আসা ভাগ্যের ব্যাপার। লবণ আনতে যেখানে পান্তা ফুড়ায় সেখানে এই সমন্ধ অনেকটা অকল্পনীয়। প্রতিবেশী রহিম চাচার ঘটকালিতে হয়েছে এটা।
ভাইয়ার চোখেমুখে খুব সুখ দেখতে পাচ্ছি আমি। খুব খুশি তিনি।

কিন্তু আমার মাথায় বাজ পড়েছে। পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে কয়েক হাত। ভাইয়া হয়তো লুকোতে চেয়েছিলেন বিষয়টা কিন্তু পারেননি। যখন সরাসরি লোকটি বলছিলেন, তিনি তার দু’বছর বয়সী মেয়ের মা হওয়ার জন্য সরাসরি বলেছিলেন সবার সামনে আমি শুনে কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। ভাইয়ার হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলো। ভাবী দৌঁড়ে এসে আমাকে সব পরিষ্কার করতে করতে বললেন আমাদের ইতিতো খুব পছন্দ করে ছোট বাচ্চা। এখানে বলার কিছু নেই যে সে একজন আদর্শ মা হবে না। তাছাড়া ইতিকে আমরা আগেই বলে দিয়েছি এসবকিছু। চিন্তার কোনো কারণ নেই আপনাদের৷

ভাইয়ার চোখমুখ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে। ভাবি অনর্গল মিথ্যা বলার পর আমাকে ঘরে নিয়ে এলেন।
ওদিকে অথিতি বিদায় হওয়ার পর ভাইয়া আমার কাছে এসে বসলেন৷

আমি চুপচাপ বসে আছি।
ভাইয়া কিছু একটা বলতে গিয়েও বারবার থেমে যাচ্ছেন। কেমন যেন কাচুমাচু করছেন তিনি। আমিও চুপচাপ বসে আছি।

কিছুক্ষণ পর তিনি নিজেই বললেন, ইতি একটা অনুরোধ রাখবি বুনু?

বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো অনুরোধ থাকলে ভেবে দেখতাম ভাইয়া।

এই বিয়েতে তুই না করিস না বুনু। না করিসনা।

আমি কোনো বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করতে পারবো না ভাইয়া। আবার তার সন্তানের মা! এটা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার পড়ালেখা করতে হবে ভাইয়া। অনেক বড় হতে হবে৷

এতো পড়ালেখা কিভাবে করাবো আমি? খরচ কে দিবে তোকে?

এতোদিনতো খরচ লাগেনি ভাইয়া।
তাহলে এখন?
সামনেও লাগবে না দেখবেন।

ইতি!
এই বিয়েতে না করিস না।

আমি বিয়ে করবোনা ভাইয়া। প্লিজ!

ততোক্ষণে ভাবি এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে।

উনার দিকে তাকানো যায় না। কারণ আমি কখনো উনার জন্য সহনীয় ছিলাম না। মা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি আমাকে আরও সহ্য করতে পারেন না।
এদিকে ভাইয়ার সংসার সন্তান এগুলো বড় হয়েছে। সেখানে আমি নিতান্তই একটা বোঝা। বুঝতে পারতাম। কিন্তু বলতাম না। আশায় বুখ বেঁধেছিলাম কিছুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। শহরে যাবো পড়াশোনা করবো। জব করবো। ভাইয়ার সব কষ্ট এক এক করে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মনের কথা মনের ভিতর রয়ে গেলো যখন ভাবি এসে বললেন, বিয়ে না করলে এই বাড়ি এখনই ছাড়তে হবে। অন্যথায় তিনি ছেড়ে চলে যাবেন।

ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরিই বলে দিলেন যেন তাড়াতাড়ি আপদ(আমাকে) বিদেয় দেন। আমি একটা বোঝা যা তিনি আর বয়ে বেড়াতে পারবেন না।

ভাবির মুখে এমন কথা আমি নতুন শুনিনি। কিন্তু আজ খুব খারাপ লাগছে। আমি চুপচাপ বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি। ভাবি হনহন করে চলে গেলেন। কেমন যেন সব ভারী ভারী লাগছে। ভাইয়া ধীর পায়ে আমার পাশে এসে বসলেন। কাঁপা কাঁপা হাত মাথায় রেখে বললেন, না করিসনা বনু।।খুব সুখী হবি তুই দেখিস।
না, করিসনা।

ভাইয়ার অসহায় চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুই বললাম না। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালে খবর এলো তারা এই মাসেই বিয়ে করতে চাচ্ছেন। ভাবি এক মাসের জায়গায় এক সপ্তাহে সব ঠিক করে ফেললেন।

আমি ভাবির এমন কর্মকান্ড দেখে খুব অবাক হচ্ছিলাম কিন্তু বলার ছিলো না কিছুই। ভাইয়ার করুন দৃষ্টি আমাকে থামিয়ে দিচ্ছিলো। আমার প্রতি ভাবির অনীহা ভাইয়াকে আরও কষ্ট দিচ্ছিলো। ভাইয়ার কষ্ট লাঘবের জন্য আমি নীরবতাই পালন করে গেলাম। জানিনা কি হবে সামনে?

সপ্তাহজুড়ে চললো বিয়ের আয়োজন। গায়ে হলুদের আগের দিন আমার হাতে দেয়া হলো কিছু টাকা নিজের পছন্দের কেনাকাটা করার জন্য। আমি চুপচাপ টাকা রেখে দিলাম। কেনাকাটার ইচ্ছে নেই। ভাবিই নিয়ে এলেন সসবকিছু। পছন্দ অপছন্দের কোনো কথা নেই।
আমার ইচ্ছার মূল্যায়ন তিনি কখনোই করেননি।

হলুদের দিন আমাকে খুব করে সাজানো হলো। কিন্তু লাল রঙের ছোঁয়া বাদ দিয়ে। আমিই নিষেধ করেছিলাম তাই।

এই একটা কথা অন্তত রাখা হলো আমার।
বিয়ের দিনেও আমাকে লাল রঙের কিছু দেওয়া হয়নি।
পাশ থেকে কে যেন বলছিলো বউ আবার লাল রঙ ছাড়া ভালো লাগে নাকি?

শুনে ভাইয়া একটা লাল টিপ নিয়ে এলেন দৌঁড়ে গিয়ে। আমার কপালে দেওয়ার আগে আমি হাত ধরে ফেললাম।

তিনি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেনো? কেনো লাল টিপ দিবি না ইতি? লালতো তোর পছন্দের রঙ।

বিয়েতে বউ লাল রঙের ছোঁয়া নিয়ে বউ সাজে। বিয়ে করেতো আমি মা হচ্ছি। তাই!

আমার কথা ভাইয়া কেমন যেন থমকে গেলেন।
হাতটা মুহূর্তে গুটিয়ে নিয়ে সরে গেলেন অশুভর্তি চোখ নিয়ে।

চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here