#ক্যাসিনো ©লেখিকা_(মায়া)
#পর্ব_৩০
আফজাল শরীফ ভিসির অফিস রুমের দিকে রওনা হলো এবং শাহানা কে ক্লাসে চলে যেতে বলল। নিশান মূহুর্তেই খুব অস্থির হয়ে পড়ে। কেমন ভীতু নজরে চারদিকে তাকাতে শুরু করে। শাহানা কপালে ভাঁজ টেনে নিশান কে বলে?? নিশান ঠিক আছো তুমি?? এমন করছো কেন?? কি হয়েছে??
নিশান নিজের কপালের সাইটের বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে বলে,, শরীর টা ভিষন খারাপ লাগছে আমার। আমি মেসে যাবো তোমরা ক্লাসে যাও!!
নিশান কি বলছো কি হয়েছে?? মেহমেত সন্দিহান দৃষ্টিভঙ্গি করে বলে আরে মাত্রই তো সব ঠিক ছিলি!! টিপ্পনি কেটে আবার বলে, শশুর কে দেখে কি এতই ভয় লাগছিল যে সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে পড়লি??? শাহানা নিজেও ভাবলো হয়তো তার বাবা কে দেখে ভয় পেয়েছে!! অবশ্য ভয় পাওয়া টাও স্বাভাবিক, নিশান বিয়ের দিন থেকে তো এই একটা ভয় বেশি পায় যদি ফ্যামিলি মেনে না নেয় তাকে শাহানার জন্য!! যদি না মেনে নেয় তো কি হবে ?? শাহানার থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে??? এমন হাজারো চিন্তা নিশানের মাথায় গিজগিজ করে। কিন্তু আসলেই কি নিশান এখন তাকে হারানোর ভয় পাচ্ছে?? নাকি অন্য কিছু?? শাহানা মলিন করে হেসে নিশান কে চলে যেতে বলে। আর তখনই নিশান কোন কথা না বলে গটগট করে হেঁটে চলে যায়। শাহানা আর মেহমেত নিশানের চলে যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। শাহানার ভিতরে কেমন করছে।
নিশানের এমন বদলানো রূপ বড্ড অচেনা লাগছে তার, খুব ভাবাচ্ছে তাকে কি হয়েছে নিশানের??? মেহমেত শাহানার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। এখন কি ভাবে তাকে শান্তনা দিবে তা নিয়ে ভাবছে সে। মেহমেত তখন শাহানার কাঁধে হাত দিয়ে বলে, চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে!! শাহানা নিশানের যাওয়ার দিকেই এক ধ্যানে চেয়ে থেকে বলে!
রাঙামাটি থেকে ফিরে আসার পর থেকেই নিশান কেমন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। যে ছেলেটা সারা দিন পড়া শুনা পড়া শুনা করে সে দিনের পর দিন ভার্সিটি আসে না। বিষয় টা কেমন অদ্ভুত না মেহমেত??? হুমম আমি ও ভাবছি সেটা,,সারা দিন শুয়ে কাটাই,আর রাত হলেই নিশাচর দের মত পায়চারি করে বেড়াবে।
শাহানা আর মেহমেতের কথার মাঝেই ক্লাসের টাইম হয়ে যায়। তাই আর কথা বাড়িয়ে তারা ক্লাসের উদ্দেশ্য চলে যায়। নতুন নতুন ক্লাস তার জন্য খুব একটা চাপ নেই। সবাই নিজের মত গল্প আড্ডা দিচ্ছে । শাহানার কিছুই ভালো লাগছে না। সে কাঁধে হাত ব্যাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়। শিরীনের অবস্থা টা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। বাবা নিজেও মায়ের বিষয়ে তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না এখন। মনে হয় এই বাড়ির শিরীন বলে কোন সদস্যই নেই। আজ আবার বাবা চলে যাবে। কবে আবার আসবে কে জানে?? ছোট বেলায় আব্বূ আসবে বললে হায়রে খুশি লাগতো। খুশির ঠেলায় সারা রাত ঘুম হতো না। আব্বু আসলে নিজেকে আর একলা মনে হবে না। বেরাতে নিয়ে যাবে, আইসক্রিম খাওয়াবে। কত মজা হবে!! কিন্তু আব্বু আসলে কিছুই হতো না। ৫টা মিনিট ও শাহানার সাথে বের হওয়ার সময় বের করে না। পরবর্তী তে দিন দিন আব্বু আসার খুশি বিলীন হয়ে যেতে লাগলো। পরিশেষে কে আসছে কে যাচ্ছে তাতে কোন মাথা ব্যাথা কাজ করে না। তার জীবন সে একলা নির্বাসনে পাঠিয়েছে সামনে যে টুকু খুশি সে পায় তাই উপঢৌকন হিসেবে গ্রহন করে।
শাহানা বাসায় গিয়ে লম্বা সময় ধরে গোসল দেয়। তার পর মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে খাটে এসে গা এলিয়ে দিয়ে মাথার উপর সেলিং ফ্যানের দিকে চেয়ে আছে। তখনি ঘরের দরজার টোকা পড়ার শব্দ শুনে উঠে বসে শাহানা । শিরীন ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। শিরীন কে দেখে বেশ অবাক হয় শাহানা। কারন ছোট বেলা থেকেই কখনো সে দেখেনি তার মা তার ঘরে এসেছে। এমনিতেই সে শাহানার সাথে কম মিশতো। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। আর যখনই প্রয়োজন পড়তো তার ঘরে ডাকতো। আর বর্তমান শিরীন ঘর থেকে খুব কমই বের হয়। আর এই অসময়ে তার ঘরে আসাটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।
শাহানা উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলে , তুমি এখানে?? ভিতরে কি আসতে পারি। শাহানা ঠোঁট প্রশস্ত করে বলে কেন নয় ভিতরে আসো!! সব ঠিক আছে তো?? কোন কিছু লাগবে তোমার?? শিরীন কে দেখে ফুরফুরে মেজাজের মনে হচ্ছে। দাঁত বের করে হেসে বলে, কেন কোন কিছু ছাড়া কি তোমার ঘরে আসা যাবে না?? শাহানা হচকচিয়ে যায় শিরীনের কথায় নাহ তেমন নয় আসতে পারবে না কেন অবশ্যই পারো। কখন আমার ঘরে আসতে দেখিনি তাই ভাবলাম। শিরীন অপরাধীর মত কিছু ক্ষন শাহানার মুখের দিকে চেয়ে বলল। বিকেলে আমার সাথে বের হতে পারবে কি তুমি?? হ্যাঁ নিশ্চয়ই কেন নয়। কিন্তু তোমার শরীর ঠিক আছে তো?? হ্যাঁ আমার শরীর ঠিক আছে। তাহলে এখন সুন্দর করে নিচে চল দুপুরের খাওয়া দাওয়া করতে হবে!! আমি আজ রান্না করেছি। শাহানা চোখ বড় বড় করে বলে কিহ তুমি রান্না করেছো?? আমি খাবো তাহলে!
শাহানা খাবারের টেবিলে বসে আছে। শিরীন খাবার বাড়ছে। শাহানা কে খাবার দেওয়ার পর সে দেরি না করেই খেতে শুরু করে। শিরীন মুচকি হেসে নিজের প্লেটে খাবার নেয় এবং এক লোকমা মুখে দিতেই বুঝতে পারে তরকারি ভিষন পরিমাণে ঝাল হয়েছে। ২০_২২ বছর পর রান্না করছে সে। রান্নার এমন অবনতি হবে তা বুঝতেই পারেনি। শিরীন খাবার টা কোন মতে গিলে ঢকঢক করে পানি খেতে আরম্ভ করে। শিরীন শাহানার দিকে তাকিয়ে দেখে। বিনা বাক্যে শাহানা খেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব স্বাদ হয়েছে। কিন্তু আদোতে কি এমন হয়েছে?? শাহানা বেশি ঝাল খেতে পারে না তা সবাই জানে। শিরীন শাহানার কে প্রশ্ন করে। এতো ঝাল হয়েছে তার পর ও খাবার টা খাচ্ছো কেন রেখে দাও। আমি বুয়া কে বলে ভালো কিছু রান্না করে দিবে তোমায় দাঁড়াও একটু। তার প্রয়োজন নেই আম্মু। সব সময় শুনে এসেছি মায়ের হাতের রান্নার মত রান্না হয় না। কিন্তু কখনো তো তোমার হাতের রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। আজ যখন পেয়েছি। ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। শিরীনের চোখের কোণে পানি জমে উঠেছে। ইশ্ ঝালের চোটে মুখ লাল বর্ন ধারন করেছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তবুও খাচ্ছে কারণ এটা তার মায়ের হাতের রান্না।
বিকেলের দিকে শিরীন আর শাহানা বের হয় সামনের একটা পার্কের উদ্দেশ্যে। শিরীন আর শাহানা শাড়ি পড়েছে আজ। সুতি শাড়ি,, শিরীন নিজে জোর করে শাহানা কে শাড়ি পড়িয়েছে। হালকা গোলাপি শাড়ি, দুই জন কে দেখে মনে হচ্ছে মা মেয়ে নয়। যেন দুই জন বোনে বোনে। শাহানা তার মাকে এমন হালকা সাজে কখনো দেখিনি। সব সময় দেখেছে পাতলা জর্জেটের শাড়ি পড়তে যখনই বাইরে বের হয়েছে। আর এই সাজে শিরীন কে যে অপরুপা লাগছে । তা দেখে মনে হচ্ছে তার মাকে আর এক বার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে। সারা বিকেল মা মেয়ে ঘুরেছে। শিরীন এক পলকের জন্য ও শাহানার হাত ছেড়ে দেয়নি। সব সময় হাত ধরে রেখেছে। যেন তার ৫ বছরের মেয়ে,,হাত ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুইজনে হালিম খাওয়ার প্রতিযোগিতা করেছে। শাহানার কাছে মনে হচ্ছিল সে কোন স্বপ্ন দেখছে। একটা সুন্দর স্বপ্ন যা ঘুম ভেংগে যাওয়ার সাথে সাথে দেখা যাবে তার মা তার সাথে নেই। আবার আগের মত গম্ভির হয়ে থাকবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না কারণ সে স্বপ্ন দেখছে না এটা বাস্তব ছিল। ছোট বেলায় এমন একটা দিনের জন্যে মরিয়া হয়ে মা বাবার কাছে সময় চেয়েছিল ।
সন্ধ্যা বেলা সময় তারা ঘরে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আবার ড্রয়িং রুমে আড্ডা দিতে থাকে। শাহানা মনে মনে ভাবছে তার জীবন টা তাজ কের দিনের মতো স্বাভাবিক কেন হতে পারেনি। নিশান কে নিয়ে এতো এতো চিন্তা গত এক মাস ধরে। কাউকে বলতে পারছে না কিছুই কত রাত কান্না করতে করতে ঘুমিয়েছে সে। মায়ের সাথে এতো ফ্রি মাইন্ড থাকলে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে একটু কান্না করা যেতো। তার পর শাহানা কিছু ক্ষন ভেবে বলে আম্মু একটা কথা বলবো?? হুমম অনুমতি লাগবে না বলে ফেলো । তোমার কোলে একটু মাথা দিতে দিবে??? শিরীন মুচকি হাসি দিয়ে শাহানা কে নিজের কোলে শুয়ে নেয়। গল্পতে গল্পতে শাহানা বলেই ফেলে, আম্মু আব্বু কে কেন তুমি এতো অপছন্দ করো?? আব্বুর সাথে কেন তোমাদের সম্পর্ক টা স্বাভাবিক নয়???
শিরীন কিছু ক্ষন থম মেরে ভাবতে থাকে তার পর বলতে আরম্ভ করে।
একটা কথা বলি শুনো তোমায়!!
যখন জীবন সঙ্গি নির্বাচন করবে যে,, প্রথমেই সৎ মানুষ,যে সৎ পথে উপার্জন করে। যার কাছে তুমি বন্ধু সুলভ আচারন করতে পারবে! যার সাথে কখনো মেপে কথা বলতে হবে না। যার গুরুত্ব এবং তোমাকে সব কিছুর উর্ধ্বে মূল্য দেয়। মা বাবারা মনে করে ধনী পরিবারে মেয়ে বিয়ে দিলেই সে সুখের সাগরে ভাসবে। সুখি হতে গেলে ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার,বড় বড় ব্যাবসায়ী,বিসিএস ক্যাডার এমন ধরনের স্বামি প্রয়োজন!! সুখ কুড়েঘরেও পাওয়া যায় যদি মানুষ টি সৎ হয়!! বুঝলে?? মানুষ জনের একটা কথা খুব প্রচলিত যে মেয়েরা টাকার পাগল হয়! কথা টা একে বারেই অযথা। টাকার পিছনে তো পুরো পৃথিবী পাগল নারী তো এমনিতেই বদনাম হয়েছে। যদি টাকার পিছনে নারী পাগল হতো তাহলে দরিদ্র্য পরিবার গুলো তে তালাকের সংখ্যা বেশি হতো। শাহানা কথা গুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো। শেষের কথা টা সত্যি কারণ সে দেখেছে নিজের চোখে নিশানের পরিবার কে। তার মা কত পরিশ্রম করে। দিন আনে দিন খায়। ছেলে মেয়ের পড়া শুনার খরচে অভুক্ত দিন কেটেছে। কই নিশানের মা তো কখনো ছেড়ে যায়নি তার বাবাকে।
শাহানা শিরীনের কোল থেকে উঠে গম্ভির মুখ করে বলে আব্বু কে অসৎ বলে ইঙ্গিত কেন করো তুমি আম্মু??
শিরীন আরো কিছু বলতে যাবে তখনই আফজাল শরীফ সদর দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। মা মেয়েকে এমন ভাবে বসে থাকতে দেখে বেশ চমকালেন তিনি। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। আফজাল শরীফ কে আসতে দেখেই শিরীনের মুখ খানি আষাঢ়ে কালো মেঘের ন্যায় কালো হয়ে গেল।
আধা ঘন্টা পর হাতে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসেন আফজাল শরীফ। তার মানে সে এখন চলে যাবে। শাহানা তাকে বার বার খেয়ে যেতে বলল কিন্তু সে সাফ বলে দিয়েছে খাবে না। শিরীন আর ঘর থেকে বের হয়নি। আফজাল শরীফ গাড়িতে উঠে বসে। শাহানা বাবাকে এগিয়ে দিতে আসে। তখন শাহানার হাতে হাজার খানেক টাকা দিয়ে বলে শিরীনের সাথে কম মিশার চেষ্টা করবে আসছি ভালো থেকো।
শাহানা অবাক হলো খুব। তার পর বাসার ভিতরে প্রবেশ করে দেখে শিরীন দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ শিরীন শাহানার কাছে এসে জরিয়ে ধরে,,আর বলে sorry সব কিছুর জন্য। শিরীনের চোখে পানি, চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। আর শাহানা ঠায় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। কেন তার জীবন টা স্বাভাবিক নয়???
নিশান আর মেহমেত পাশাপাশি বসে আছে। মেহমেত নিশান কে শাহানার বিষয়ে কথা শুনাচ্ছে যে তার এমন অস্বাভাবিক আচারনে মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। কেন এমন করছে সে?? কিন্তু নিশান অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে সব শুনছে কোন উত্তর করছে না। তার পর মেহমেত ধমক দেয় তাকে। এতে নিশান বলে আচ্ছা মেহমেত শাহানার বাবা কে তোর অদ্ভুত মনে হয় না?? কিহ অদ্ভুত মনে হতে যাবে কেন?? নাহ মানে শুনেছি মাসের ২০_২৫দিন বাইরে থাকে। মানে উনি এমন সফল ব্যবসায়ী ও নন যে এতো কাজ তার??
বলতে কি চাচ্ছিস তুই???
আমি বলতে চাচ্ছি যে তোর বাবার থেকে তো অনেক ছোট ব্যাবসায়ী তিনি। কই তোর বাবা কি মাসের পর মাস বাইরে কাটায়??
মেহমেত বিষয় টা নিয়ে বেশ কিছু ক্ষন ভাবলো তার পর বলল কি জানি!! exporter of import বিজনেস তার। বিভিন্ন দেশে হয়তো আমদানি করা জিনিস পত্র নিয়ে মাসের অর্ধেক সময় বাইরে কাটায়!!
নিশান আরো কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি তার ফোন বেজে উঠে। ফোন টা হাতে নিয়ে নাম্বার দেখে মলিন হয়ে যায় নিশানের মুখ!!
চলবে _______?????
কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না।