ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৪
প্রায় দু’মাস হতে চলল মেয়েটার আগমনের। তবে এটাকে ঠিক আগমন বলা যায় কি না জানিনা। মাঝরাতে কোত্থেকে এসে যেন উদয় হয়। সকাল হতেই চলে যায়। ওর এ রহস্যের উদঘাটন কবে করতে পারব তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
ক্লিওপেট্রার কিছু কিছু বিষয় অত্যন্ত রহস্যময়। যেগুলোর কোনো লজিক আমি আপাতত খুঁজে পাচ্ছি না। যেমনঃ বাড়ির সকলের মনের কথা ও শুনতে পারে। বুঝতে পারে কে কী ভাবছে। আবার এমন একটা স্থান যেখানে ও উপস্থিত নেই কিংবা ছিলনা। কিন্তু সে স্থানে কী ঘটেছে সেটা সে স্পষ্ট বলে দিতে পারে! যেন সবকিছু সে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছে।
অফিসে আমার সহকর্মী একটা মেয়ে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ওর নাম ফারিয়া। ক্লিওপেট্রার থেকে রেহাই পেতে আমি ফারিয়ার প্রস্তাবে রাজি হবার স্বীদ্ধান্ত নেই। কিন্তু ক্লিওপেট্রা আশ্চর্যজনকভাবে সেটা টের পেয়ে যায়। আমাকে হুমকি দেয় ফারিয়ার থেকে দূরে থাকতে।
আমি ক্লিওপেট্রার নিষেধ শুনিনি। ফারিয়ার সঙ্গে আরো বেশি করে মিশতে শুরু করি। রোজ দু’জনে একই সঙ্গে একই বাসে অফিসে যাই। ফিরিও একই সঙ্গে। অফিসের ক্যান্টিনে একসঙ্গে লাঞ্চ করি। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো কোনো সমস্যার সৃষ্টি হতো না। কিন্তু ফারিয়া একদিন বিরাট ভুল করে বসে। একদিন অফিস ছুটির দিনে ও আমাকে ফোন করে বলে আমার সঙ্গে ওর খুব জরুরী দরকার। দেখা করতে। কথা ছিল মার্কেটের সামনে দেখা করবার। ফারিয়া এসে বলে আজ লাঞ্চে ও আমাকে ট্রিট দিতে চায়। আমি আগ্রহ দেখাই না। ফারিয়া জোরাজুরি শুরু করে। বাধ্য হয়ে রাজি হই। লাঞ্চ থেকে ফেরার সময় রিকশায় ফারিয়া হঠাৎ আমার গালে টুপ করে চুমু খেয়ে বসে। ব্যাস! এটাই ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
পরদিন ফারিয়া অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল। সিড়ি বেয়ে নামার সময় ওকে না কি কেউ একজন পেছন থেকে ধাক্কা দেয়! তৎক্ষনাৎ ও সিড়ির গায়ে গড়াতে গড়াতে নিচে পড়ে যায়। মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে ওর। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ওকে। জ্ঞান ফেরার আগে একবার এবং পরে দু’বার ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। ওই আমাকে তৃতীয়বারের সময় সব খুলে বলে। আমি বুঝে যাই এ কাজ কার হতে পারে।
সেদিন রাতে ক্লিওপেট্রা এলে ওকে জেরা করি ও কেন এমনটা করল। ও বলে, ‘আমি তো এমনটা করতে চাইনি আহান! তুমিই আমাকে বাধ্য করেছ। তুমি যদি আমার কথা শুনতে…।’
আমি ক্লিওপেট্রাকে থামিয়ে দেই। ‘চুপ! একদম চুপ! তোমার সঙ্গে আমি আর একটা কথাও বলতে চাইনা। তোমার মতো বর্বর, নিকৃষ্ট প্রাণীর সঙ্গে কথা বলা তো দূর তোমার মুখও আমি দর্শন করতে চাইনা। তুমি আমার জীবন থেকে চলে যাও! মুক্তি দাও আমাকে!’
এরপর এক সপ্তাহ রাগ করে ক্লিওপেট্রা আর আসেনি। সাতদিন পর আবারও কোত্থেকে এসে যেন উদয় হয়। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ নির্লজ্জের মতোন আবার ফিরে এলে কেন? তোমাকে না চিরতরে চলে যেতে বলেছি?’
ক্লিওপেট্রা উত্তর দেয়, ‘কীভাবে যাবো বলো! তোমাকে যে আমার খুব দরকার!’
আমি রাগত স্বরে বলি, ‘আমাকে কেন দরকার তোমার? কীসের জন্য? ‘
ও বলল, ‘কাল রাতে আমি তোমাকে সব বলবো। সব বলতেই তো ফিরলাম। কিচ্ছু লুকাবো না। এরপরও যদি তোমার মনে হয় আমি ঘৃণ্য, পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট তাহলে আমার আর কিছুই করার নেই। গলায় দড়ি দেবা ছাড়া।’
কিছুসময় থেমে ক্লিওপেট্রা আবার বলল, ‘একটা জরুরী কথা তোমাকে আজকেই জানানো দরকার। নয়তো আরো দেরিতে বললে হয়তো তুমি খুব রাগ করবে।’
আমি জানতে চাইলাম, ‘কী কথা?’
ও জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে নরম স্বরে বলল, ‘আমি মিথি! তোমার মিউ!’
আমি জ্ঞান হারালাম। সকালে আর অফিসে যেতে পারলাম না। একটা ঘোরের মধ্যে রইলাম সারাদিন। মা এসে একটু পরপর জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘আহান! বাবা আমার! তোর শরীর খারাপ লাগছে?’
আমি প্রতি উত্তরে ‘না’ বললেও মা থামলো না। প্রতি ঘন্টায় অন্তত পাঁঁচবার এসে এই এক কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগল।
ওই ঘটনার পর আমি মিথিকে কোলে নেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলাম। যতটা পারলাম ওর থেকে দূরে রইলাম। কিন্তু মিথি যেন হাল ছাড়বার পাত্রী নয়! ও সারাদিনই আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগল। যেখানেই পা রাখতে নেই সেখানেই গিয়ে দাঁড়ায়। বিরক্ত হয়ে মা’কে বললাম ওকে মায়ের ঘরে বন্দী করে রাখতে। আমার এহেন আচরণে মা প্রচন্ড অবাক হল। আমার এত আদরের পোষা প্রাণীকে হঠাৎ দূরে ঠেলে দিচ্ছি বলে।
সেদিন রাতেই আবার ক্লিওপেট্রা কিংবা মিথি যেটাই হোক মেয়েটা আমার ঘরে আসল। ঘুম ভাঙ্গতেই পাশে দেখতে পাই ওকে। আমাকে জাগতে দেখে ও শোয়া থেকে উঠে বসে। বলে, ‘ আহান তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে।’
আমি জবাব দেই না। ও আবার বলে, ‘আমি জানি তুমি রাগ করে আছো। আচ্ছা ঠিকাছে আজ তোমাকে কোনো কথা বলতে হবে না। আজ শুধু আমি বলবো, তুমি শুনবে।’
কিছুক্ষণ থেমে দম নিয়ে ক্লিওপেট্রা আবার বলতে শুরু করে,
‘আমার বাবা ছিলেন মিশরীয়। আর মা আমেরিকান। বাবা ব্যাবসার কাজে আমেরিকা গেলে মায়ের সঙ্গে তার সেখানে পরিচয় হয়। তাদের পরিচয় ধীরে ধীরে প্রণয়ে রূপ নিতে থাকে। একসময় তারা বিয়ে করার স্বীদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাবা মুসলিম হলেও মা ছিলেন খ্রিষ্টান। তাই বাবার পরিবার মা’কে মেনে নেন না। মা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার বাবা মারা যায়। আমার নানুর একমাত্র মেয়ে ছিল আমার মা। মেয়ের পছন্দে তিনি আর দ্বিমত করেননি। তাই মায়ের তরফ থেকে তেমন কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি।
বাবার পরিবারের সৃষ্ট অনেক ঝড় ঝঞ্জাটের পর বাবা-মা পরিবারের অমতেই বিয়ে করেন। বিয়ের পর মা আর বাবা মিশরেই থাকতেন। পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বাবার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তাই ব্যাংক থেকে মোটা টাকার লোন নিয়ে পার্টনারশিপে ব্যাবসা শুরু করেন। মোটামুটি চলছিল বাবার ব্যাবসা।
কিন্তু আমার বড় বোন জন্ম নেবার কিছুদিন পর হঠাৎই বাবার ব্যাবসায় ধ্বস নামে। আগে থেকেই বাবার ব্যাবসার অবস্থা খুবই জটিল ছিল। কিছুতেই উন্নতি করতে পারছিলেন না। তার মধ্যে আবার প্রতারণার শিকার হন। বাবার ব্যাবসার সহযোগীই বাবাকে ধোঁকা দেয়। ফলে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থার সৃষ্টি হয়। তার ওপর আবার ব্যাংকের মোটার টাকার ঋণ তখনও শোধ হয়নি। এমনও দিন গিয়েছে মা-বাবা শুধু মাত্র এক টুকরো রুটি খেয়ে দিন-রাত পার করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় মা বাবাকে পরামর্শ দেয় আমেরিকায় চলে যাবার। আমেরিকায় মায়ের কিছু জায়গা- জমি আছে। সেগুলো বিক্রি করলে নিশ্চয়ই ঋণ পরিশোধ করতে পারবে।
আমেরিকায় চলে যাবার পর মায়ের জমি বিক্রি করে বাবা কিছু টাকা আয় করেন। সে টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করে পুনরায় ব্যাংক থেকে লোন তোলেন। ব্যাবসা শুরু করার কিছুদিন পর আমি জন্ম নেই। আমি জন্ম নেবার পর থেকেই না কি অদ্ভুতভাবে বাবার ব্যাবসা রমরমাভাবে চলতে আরম্ভ করে। আমাদের আর্থিক অবস্থায় স্বচ্ছলতা ফিরতে শুরু করে। সংসারেরও উন্নতি হয়। সেজন্য বাবা আমাকে তার ভাগ্যলক্ষ্মী ভাবতে শুরু করেন।
প্রাচীন মিশরের রানী ছিলেন ক্লিওপেট্রা। তিনি ছিলেন মিশরের সর্বশেষ ফারাও এবং নারী শাসক। গ্রিক মিথ অনুযায়ী তিনি ছিলেন অসম্ভব রকমের রূপবতী এবং একই সঙ্গে অশেষ গুনের অধিকারী। তার সৌন্দর্যে পাগল হত না এমন কোনো মানুষ ছিল না। তার গুন সবাইকে মুগ্ধ করে দিত। তার গভীর নীল চোখের দিকে তাকালে না কি চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়তো।
তার রূপের সঙ্গে আমার বাবা-মা আমার মিল খুঁজে পান। এমনকি কাকতালীয়ভাবে আমার চোখও গভীর নীল রঙের। আমার বাবার বিশ্বাস ছিল আমি বড় হয়ে তার মতোই গুনবতী এবং বিচক্ষণ হব। এছাড়া বাবা ভাবতেন আমিই একদিন তার গৌরবের কারণ হব। তাই তিনি রানী ক্লিওপেট্রার নামের সঙ্গে মিল রেখে আমার নাম রাখেন ক্লিওপেট্রা! বাবার গৌরব!
আফসোস! বাবার জীবদ্দশায় আমি বাবার গৌরবের কারণ হতে পারিনি। আমার যখন বারো বছর বয়স তখন বাবাকে খুন করা হয়। শুধুমাত্র বাবার সম্পত্তির লোভে। কারণ তখন আমরা পুরোপুরি স্বচ্ছল হয়ে পড়েছিলাম। ইতোমধ্যেই বাবার অঢেল সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে কে বা কারা খুন করে আমরা জানতে পারিনি।
বাবা মারা যাওয়ার পর মা-ই তার ফেলে যাওয়া ব্যাবসা সামলাতে শুরু করেন। বিধবা, একাকী পেয়ে মা’র দিকে যারা চোখ তুলে তাকানোরও সাহস পেত না তারাই মা’কে খারাপ প্রস্তাব দিতে শুরু করে। মা বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রতিটি পরিস্থিতিই নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু একবার এক ক্ষমতাশালী প্রচুর বিত্তবান লোকের নজর পড়ে মায়ের ওপর। মা তাকে নাকচ করে দিলে মা’কে সে হুমকি দেয়। আমাদের ক্ষতি করবে। তাই মা শহর ছেড়ে গ্রামে পালানোর পরিকল্পনা করে। মায়ের পরিকল্পনার কথা একমাত্র মায়ের বেস্টফ্রেন্ড এলেক্সাই জানত। এলেক্সা মা’কে জানায় সে সবরকমের সাহায্য করবে মা’কে পালানোর জন্য।
টাকার কাছে আজীবনের বন্ধুত্বও বোধহয় অর্থহীন! অঢেল টাকার লোভে এলেক্সা ওই লোককে মায়ের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেয়। ওই লোক এবং এলেক্সা মিলে নতুন ষড়যন্ত্র করে।
চলবে…
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা
(আপনাদের ভালো লাগা মন্দ লাগা জানিয়ে যাবেন। আমার পড়াশোনা, বাড়ির কাজ, শরীর খারাপ সবকিছু পেরিয়ে আপনাদের ভালোবাসায় রোজ লিখতে বসি।🙃)