ক্লিওপেট্রা পর্ব- ০৫

ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৫

দিনের আলোয় বেরোলে প্রতিবেশীরা নানান প্রশ্ন করবে। জানতে চাইবে আমরা কোথায় যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি। হয়তো আমরা শহর ছেড়ে পালাচ্ছি এ কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়বে। ধীরে ধীরে খবরটা পৌঁছে যাবে ওই লোকটার কাছে। এসব ভেবে মা স্বীদ্ধান্ত নেয় রাতের আঁধারে রওয়ানা দেবার।

সন্ধ্যা পেরোতেই আমরা বেরিয়ে পড়ি। এলেক্সা বলেছিল ওর পরিচিত লোক আছে। তার ট্যাক্সিতে গেলে পুরো রাস্তা নিরাপদে থাকতে পারব।
আমরা এলেক্সার ঠিক করা ট্যাক্সিতে করেই গ্রামে রওনা দেই।
একসময় গাড়ি চলতে শুরু করে। কিছুসময় যেতেই ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি থামায়। আমাদেরকে বলে, সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট বসতে। পাঁচ মিনিটের স্থানে আঁধ ঘন্টা পেরিয়ে যায়। ড্রাইভার আসেনা। আমরা ভয় পেতে শুরু করি। এমনিতেই রাস্তাটা ছিল নিরব। দু’ধারে ঘন গাছপালা। ছোটোখাটো জঙ্গলের মতো।
মা’র হঠাৎ সন্দেহ হতে শুরু করে। ড্রাইভারের কি কোনো বিপদ হল! মা আমাদের গাড়িতে বসিয়ে রেখে আশপাশ খুঁজতে যায়। কিন্তু কোত্থাও ড্রাইভারকে খুঁজে পায় না।
এবার মায়ের মনের সন্দেহের দানাটা বেশ বড়সড় আঁকার ধারণ করে। মা আমাদের নিয়ে অতিদ্রুত সেখান থেকে বেরোতে চায়। আমরা রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি লিফটের আশায়। কিন্তু একটা গাড়িও আসছিল না। অনেকক্ষণ পর একটা গাড়ি আসে। কিন্তু গাড়ির মালিক আমাদের লিফট দিতে রাজি হয় না। তার কিছুক্ষণ পরে আরেকটা গাড়ি দেখতে পাই আমরা। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ভেতরের মানুষদের দেখা যাচ্ছিল না। তবে একটু কাছে আসতেই মা গাড়ির ভেতরে বসা লোকগুলোকে চিনে ফেলে। মা আমাকে আর আপুকে পালাতে বলে। আমরা মা’কে একা ফেলে যেতে চাইনা। মা আমাদের ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। আমাদের কসম দেয়। দৌড়ে পালাতে বলে। চিৎকার করে বলে যে পর্যন্ত লোকারণ্য স্থানে না পৌঁছাই সে পর্যন্ত যেন আমরা না থামি।
আমি, আপু অনিচ্ছায় মায়ের কথা মেনে পালাতে থাকি। আমি দৌড়ের গতি কমিয়ে পেছনে তাকাই। দেখি জানোয়ারটা আমার মা’কে হিচড়ে তার গাড়িতে উঠিয়ে নিচ্ছে। দূর থেকেই মায়ের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। আমি বুঝতে পারি মা কাঁদছে। মা সে অবস্থাতেই হাতের ইশারায় আমাকে পালাতে বলে। আমি হাত মুঠো করে দাঁতে দাঁত চেপে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দেই। মা’কে, আপুকে পেছনে ফেলে পালাতে থাকি অজানা গন্তব্যে।
জঙ্গল পেরোতেই একটা অজপাড়াগাঁ। অজপাড়াগাঁতে পৌঁছে আমি দৌড় থামিয়ে দেই। অকস্মাৎ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরি।’

কথা থামিয়ে ক্লিওপেট্রা কাঁদতে শুরু করে। আমার মায়া লাগে ওর জন্যে। মেয়েটা এত দুঃখী!
আমি ওর কাঁধে স্বান্তনার হাত রাখি।
ও কান্না থামিয়ে আবার বলতে শুরু করে,

‘জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি একটা ঘরে বিছানায় শুয়ে আছি। উঠে বসতেই দেখি আমার সামনে চেয়ারে বসে একজন মহিলা ঝিমুচ্ছে। আমাকে জাগতে দেখে উনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমি ঠিক আছি কি না, এসব কীভাবে হল নানান প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। মহিলাটিকে আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। আমি ওনাকে সব খুলে বলি। সব শুনে উনি খুব কষ্ট পান। আমাকে স্বান্তনা দিয়ে ভাগ্য মেনে নিতে বলেন। এরপর থেকে আমি ওনার কাছেই রয়ে যাই। জেনিফার আন্টি ছিলেন ডিভোর্সি। তিনি কোনোদিন মা হতে পারবেন না বলে তার স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।
জেনিফার আন্টি নিজের সন্তানের মতোন লালনপালন করে আমাকে বড় করে তোলে। মায়ের অভাব উনি অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন তখনো দাউদাউ করে জ্বলছিল।

আমার মা’কে ওই লোক রেপ করে খুন করে। আপুর কোনো খোঁজ পাইনি। আমার ধারণা ওই লোক আপুকেও মেরে ফেলেছে। আমাকে খুঁজে পেলে হয়তো আমাকেও মেরে ফেলত!
আমি জেনিফার আন্টিকে আমার প্রতিশোধ নেবার স্বীদ্ধান্ত জানাই। জেনিফার আন্টি আমাকে বলে উনি আমাকে সাহায্য করবে প্রতিশোধ নিতে। তবে এখন নয়। আমি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হব তখন। আমি বাধ্য হয়ে আন্টির কথা মেনে নেই। কারণ তখন তিনিই ছিলেন আমার মা,বাবা, আত্নীয়স্বজন সবকিছু।

বিশে পা রাখার পরপরই আমি আমার রিভেঞ্জ নেবার মিশনে নেমে পরি। জানতে পারি ওই লোকের সঙ্গে সেদিন আরো দু’জন ছিল। দুজনের মধ্যে একজন ছিল এলেক্সা। আরেকজন আমাদের অফিসেরই একজন কর্মচারী। আর এই তিনজন মিলেই আমার বাবাকে খুন করে। জানার পর ঘৃণায়, রাগে আমার গা রি রি করে উঠে। আমি আরো মত্ত হয়ে উঠি প্রতিশোধের নেশায়।

কিন্তু ভাগ্য বোধহয় আমার সহায় ছিল না। সে বছরই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে আমাকে সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে জেনিফার আন্টি মারা যান।

জেনিফার আন্টির মৃত্যুর পর আমার অবস্থা পাগলপ্রায়। আমি নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে দিনরাত কাঁদি। আমার অবস্থা দেখে জেনিফার আন্টির এক প্রতিবেশী মহিলা আমাকে রোজ সঙ্গ দিতে আসত। যাতে আমি উল্টো পালটা কিছু একটা করে না বসি। কথায় কথায় আমি ওনাকে সব বলে দেই আমার প্রতিশোধের ব্যাপারে। আমার কথা শোনার পর উনি আমাকে আশ্বাস দেন সাহায্য করবার।

তারপরের দিন তিনি আমাকে একজন তান্ত্রিক ধরনের মহিলার কাছে নিয়ে যান। তিনি জানান ওই মহিলাটি আমার শত্রুদের ওপর কালো-জাদু করে তাদের ধ্বংস করে দিতে সাহায্য করবে। এরপর থেকে আমি রোজ একাই ওই তান্ত্রিক মহিলার কাছে যেতাম। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল কালো জাদু করা নয়। নিজের হাতে আমার শত্রুদের হত্যা করা।’

এ পর্যন্ত বলে ক্লিওপেট্রা কথা থামায়। আমাকে বলে, ‘ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এবার আমাকে যেতে হবে।’

আমি ওকে বাঁধা দেই, ‘কিন্তু কথা তো শেষ হয়নি।’

ও বলে, ‘বাকিটা রাতে বলবো আহান। এবার আমাকে যেতে দাও প্লিজ।’

আমি আর ওকে আটকাই না। বলি, ‘আচ্ছা, ঠিকাছে।’

পরে কী ঘটেছিল জানার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠি। অস্থিরতায় বাকিসময়টকু আমার আর ঘুম হয়না। দিনেও সারাদিন সবকিছুই অমনোযোগীভাবে কাটালাম। অফিসের কাজেও মন বসল না। মা বোধহয় কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল। বাসায় ফেরার পর জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তিত, বাবা?’

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে ‘না’ বলি।

রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। মিথি কিংবা ক্লিওপেট্রার অপেক্ষা করতে থাকি। রাত দুটো বেজে যায় আমার ঘুম আসেনা। দুটোর পরেই মেয়েটা আসল। আমাকে জেগে থাকতে দেখে বলল, ‘ঘুমোওনি?’

আমি না সূচক মাথা নাড়াই। ও আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করে না।
আমি ওকে বললাম, ‘তারপর তুমি কী করেছিলে?’

ক্লিওপেট্রা বলতে শুরু করল,

‘তান্ত্রিক মহিলাকে আমি জানাই আমি নিজ হাতে বাবা-মায়ের হত্যাকারীদের খুন করতে চাই। উনি আমাকে বলে, একটা উপায় আছে। কিন্তু সেটা করাটা ঠিক হবে না।
আমি জিজ্ঞেস করি, কী উপায়।
তিনি বলেন, ডাকিনীবিদ্যা!
প্রতিশোধের নেশা এমন ভাবে আমায় পেয়ে গেছিল যে আমি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সেটাই আমার ওপর প্রয়োগ করতে বলি। আর আমার জীবনের সবচাইতে বড় কাল সেটা!

তান্ত্রিক মহিলাটি শুধু ডাকিনীবিদ্যা নয়। “ডাকিনী”, “শাকিনী”, “হাকিনী” এই তিন বিদ্যাই আমার ওপর প্রয়োগ করে। কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়া। শুধুমাত্র তার নিজের এক্সপেরিমেন্টের জন্য। অবশ্য আমি তখন সেটা জানতাম না। পরে হিতে-বিপরীত ঘটতে শুরু করলে তাকে চেপে ধরি। হুমকি দেই জীবন নিয়ে নেবার। তখন তান্ত্রিক মহিলাটি বাধ্য হয়ে সব আমাকে বলে দেয়। কিন্তু তখনো ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দেইনি। যখন সাইড-এফেক্ট দেখা দিতে শুরু করল তখনই আমি ব্যাপারটাকে আমলে নেই।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘কী সাইড ইফেক্ট দেখা দিচ্ছিলো? ‘

ও বলল, ‘হঠাৎ হঠাৎ আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে শুরু করলাম। আমি সবাইকে দেখতে পেতাম, কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে পেত না।’

আমি বললাম, ‘কিন্তু এটা তো তোমার রিভেঞ্জ নেবার জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল।’

‘মোটেও না। কারণ অদৃশ্য হওয়াটা কখনোই আমার হাতে ছিল না। আমি নিজেই জানতাম না কখন অদৃশ্য হব আর কখন দৃশ্য হব! যেমনঃ এখন অদৃশ্য হয়ে গেলাম আবার এখনই দৃশ্যমান হয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে সপ্তাহও পার হয়ে যেত আমার ঠিক হতে।’

‘ওহ স্যরি।’

‘ইটস ওকে। তোমার মনে প্রশ্ন জেগেছে তুমি জিজ্ঞেস করেছ। এতে তো দোষের কিছু নেই।’

আমি বললাম, ‘তারপর কী হল? তুমি কীভাবে প্রতিশোধ নিলে?’

ক্লিওপেট্রা বলল,

‘ওই ত্রিবিদ্যা আমার ওপর প্রয়োগ করার পর আমার মাঝে পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করল। আমি অদ্ভুতরকমভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠলাম। যে কেউ আমার চোখে একবার তাকালেই তাকে হেপ্নোটাইজ করে ফেলতে পারতাম। কাউকে বশে আনতে আমার দু’সেকেন্ডও সময় লাগতো না।’

অকস্মাৎ আমার কৌতুহল জাগল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকেও কি হেপ্নোটাইজ করে বশে আনতে পারবে?’

ও উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ। ‘

‘তাহলে যে আমার ক্ষতি করলে না! কেন হেপ্নোটাইজ করোনি আমায়?’

‘কারন আমি যে তোমায়…! ‘

‘কী?’

ক্লিওপেট্রা আমার কানের কাছে ওর মুখ নিয়ে এল। এরপর ফিসফিস করে বলল, ‘ভালোবাসি!’

আমার সারা শরীর ও মন জুড়ে একটা অদ্ভুত শিহরণ ছেয়ে গেল।

চলবে…

লেখা: ত্রয়ী আনআমতা

(অনেকেই পর্ব ছোট বলে মন খারাপ করেন। আমি প্রতি পর্বে ১২০০+ শব্দ করে লিখি। আমার নিজের পড়াশোনা আছে। বাড়ির কাজ আছে। শরীর খারাপ, মন খারাপ বিষয়গুলোও তো থাকে। কিন্তু তবুও আপনাদের ভালোবাসার জন্য আমি নিয়ম করে রোজ লিখতে বসি। এই বারোশো শব্দ লিখতেই আমার সাড়ে তিন ঘন্টা থেকে চার ঘন্টা সময় লাগে। আপনারাই বলুন এর চাইতে বেশি আমি কি করে লিখি!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here