গাংচিল পর্ব ৬+৭

#গাংচিল
#৬ষ্ঠ_পর্ব

গেস্ট রুম থেকে বের হয়েই রান্নাঘর। সীমান্তের ইচ্ছে হলো এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত খেতে। যদি এতে মাথা ব্যাথা কমে। নীলুকে বললে হয়তো করে দিবে। কিন্তু রান্নাঘরে যেতেই সীমান্তের পা আটকে গেলো। তার চোখের সামনে যেনো কোনো মায়াপুরীর রাজকন্যা দাঁড়িয়ে আছে। স্রষ্টা বেশ সময় করে যেনো এই শিল্পকর্মের রচনা করেছেন। কোনো নারী কি এতোটা মায়া পরিপূর্ণ হতে পারে! সূর্যের স্নিগ্ধ আলো শ্যামমুখুখানার উপর আছড়ে পড়ছে। মুখশ্রীর মায়া যেনো আরোও দ্বিগুন লাগছে এই প্রভাতে। পাতলা ঠোঁটজোড়ার কোনেতে যে এক চিলতে স্নিগ্ধতা লেপ্টে আছে তা বুকে আঘাত হানতে সীমান্তের। চুলগুলো উঁচু করে মাথায় খোপা করে রাখা। ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়ছে চুলের গোড়া থেকে। নেমে আসছে মোলায়েম ঘাড়ে। কাধের কালো তিলটা যেনো তার নজর টিকা। নীলশাড়িতে মায়াবতীকে মনে হচ্ছে কোনো নীলকন্ঠী ফুল। মৌপ্রিয়া কাজে ব্যাস্ত, ক্ষণে ক্ষণে কপালের চুল গুলো কানের পাশে ঘুজছে সে। ফাঁকে কোমড়ের কাপড়টি খানিকটা স্বরে গেলো, সেদিকে খেয়াল নেই মৌপ্রিয়ার। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো সীমান্ত। তার মনে হলো শিরদাঁড়া বেয়ে গরম রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। অজান্তেই বুকে হাত চলে গেলো সীমান্তের। এই প্রথম কোনো নারীর প্রতি অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। এই অনুভূতিকে প্রকাশ করার সাধ্য তার নেই। এই অনুভূতির নাম কি সেটাই যে তার অজানা। এক পা আগানোর সাধ্য নেই তার। সেখানেই দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো সীমান্ত।

পরোটা ভাজা শেষে হটপট হাতে পেছনে ঘুরতেই চমকে উঠলো মৌপ্রিয়া। সীমান্ত বুকে হাত দিয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাটাকে দেখেই গতরাতের দুঃস্বপ্নটা চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। শ্যামগাল জোড়া রক্তিম হয়ে উঠলো। কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না। তাকে এই ব্যাক্তির মুখোমুখি হতে হবে প্রতিদিন। মৌপ্রিয়া নিজেকে সামলালো। ঝাঁঝিয়ে বললো,
“এখানে কি করছেন আপনি?”

মৌপ্রিয়ার কন্ঠ কানে আসতেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে সীমান্ত। আমতা আমতা করে বলে,
“মাথা ব্যাথা করছে, লেবু পানি খেতে পারলে ভালো হতো। তাই”
“উহহহ, আগে গোসল করে আসুন। গা থেকে শুকোরের মতো গন্ধ বের হচ্ছে। সকাল সকাল আমার পেট মুড়িয়ে উঠেছে। ছি ছি এই নাকি আপনি টিচার।“

নাকে আঁচল চেপে সুতীক্ষ্ণ স্বরে কথাটা বলে মৌপ্রিয়া। মৌপ্রিয়ার কথায় খানিকটা বিব্রতবোধ হয় সীমান্তের। গতকালের কাজটা মোটেই ভালো হয় নি তার। মৌপ্রিয়ার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো তাকে ঘাড় ঘরে বের করে দিতো। খানিকটা লজ্জিত কন্ঠে সীমান্ত বলে,
“ সরি, আমার কাছে তো এক্সট্রা পাঞ্জাবী নেই। গতরাতের জন্য ও সরি।“
“আমি নীলাঞ্জনাকে দিয়ে সাবান, শ্যাম্পু, কাপড় পাঠিয়ে দিচ্ছে। আপাত্ত বাবার পাঞ্জাবী ই পড়তে হবে। আর পরণের পাঞ্জাবীগুলো আমার হাতে দিবেন। ধুয়ে শুকানোর পর ফেরত দেবো। গোসল করে ডাইনিং টেবিলে আসুন।“
“জ্বী”

সীমান্ত শুধু ঘাড় কাত করে ছোট করে জ্বী বলে। ক্ষনিকের জন্য মনে হলো মৌপ্রিয়াই তার শিক্ষক। আর সে তার বাধ্য ছাত্র। সীমান্ত যেতে ধরলে মৌপ্রিয়া হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“শুনুন”
“জ্বী”
“কাল হয়েছে, কিছু বলছি না। কিন্তু আর যেনো এমনটা না হয়। তাহলে আমার রুদ্ররুপ দেখতে হবে, বলে দিলাম।“
“কথা দিচ্ছি, আর হবে না।“

সীমান্ত এক মূহুর্ত দেরি না করে নিজের রুমে প্রস্থান করলো। মৌপ্রিয়ার সাথে কথা বলাটা যেনো বিশ্বের সব থেলে দুর্বিসহ কাজে পরিণত হয়েছে। তার দিকে তাকালেই হৃদয়ের কোনায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। এই ব্যাথার উৎসটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। তাড়াতাড়ি প্রস্থান করাটাই যথার্থ। সীমান্তের কাচুমাচু মুখখানা দেখে হেসে উঠলো মৌপ্রিয়া। লোকটাকে এবার বাগে পেয়েছে সে। গতকাল রাতে লোকটির জন্য কম ধকল যায় নি তার। সারারাত লোকের নেশাগ্রস্থ কন্ঠের কবিতাটি তার মাথায় ঘুরেছে। নির্ঘুম রাত পার করেছে সে। অবশ্য ঘুমের ব্যাপারে সে বেশ দূর্ভাগা, ঘুমের ঔষধ ও তাকে দু থেকে তিনঘন্টার বেশি ঘুম দিতে পারে না। এই সমস্যা টা আজ থেকে না। যেদিন সে মাকে হারিয়েছিলো সেই দিন থেকেই এই সমস্যা। ছোটবেলায় মায়ের মিহি কন্ঠের গল্প না শুনলে তার ঘুম আসতো না। এই অভ্যাসটা তার কাল হয়ে উঠেছে। তাইতো এখনো নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় তাকে। তার সাথে যোগ হয়েছে এখন সীমান্তফোবিয়া। এই রোগটা কতদিন তাকে জ্বালাবে সেটাই দেখার পালা।

ডাইনিং টেবিলে পিনপতন নীরবতা। কাচুমাচু মুখে মাথা নিচু করে বসে আছে ইফতেকার সাহেব। গতকালে একটু বেশি ই হয়ে গিয়েছিল। তার ঠিক অপোজিটে বসে আছে সীমান্ত। ইফতেকার সাহেবের পাঞ্জাবী বেশ আটসাট হয়েছে তার। ফুল হাতা হয়ে গিয়েছে থ্রি কোয়ার্টার। হাটু অবধি উঠে এসেছে হাটু থেকে পাচ ইঞ্চি উপরে। বুকের বোতাম আটকালে শ্বাস আটকে আসবে তার। তবুও উপায় নেই। মৌপ্রিয়ার আদেশ না মানার সাধ্য নেই তার। ইফতেকার সাহেবের কাচুমাচু মুখ দেখে মৌপ্রিয়া হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠলো,
“খাবার তো দেখার জন্য দেই নি, খাওয়ার জন্য দিয়েছি। তা সেটাকে কি দেখেই যাবে নাকি?”
“তুই আমাকে বকশিস কেনো? আমি না তোর বাবা?”
“ওহ তাই নাকি? জানাই ছিলো না। তা গতরাতে কটা বোতল ফাঁকা করা হয়েছে সেটা কি কবি মহাশয়ের মনে আছে?

এবার চুপ করে গেলেন ইফতেকার সাহেব। মৌপ্রিয়া এবার শক্ত কন্ঠে বললো,
“আজ থেকে তোমার ড্রিংক করা বন্ধ। আমার ঘরে কোনো মদের বোতল খুলবে না। যদি সেটা না হয়, তবে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।“
“সীমান্তের সামনে এই কথাগুলো না বললেই তো নয়?”
“না, কাল যখন উনার সামনে সরি উনাকে নিয়ে মদ গিলেছো তখন মনে ছিলো না উনি বাহিরের কেউ। এখন বকা খাবার সময় মানে লাগছে? আমার কথা স্পষ্ট আমার ঘরে হয় মদ থাকবে নয় আমি। অনেক হয়েছে আর না।“

ইফতেকার সাহেব মাথানিচু করে বসে রইলেন। তখন সীমান্ত ধীর স্বরে বলে উঠলো,
“মৌপ্রিয়া ঠিক বলছে, মদটা খুব বাজে জিনিস। কাল টের পাই নি, আজ মনে হচ্ছে নাড়িতে যেনো পেঁচ লেগে আছে। আপনি তো বয়স্ক, আপনার জন্য তো আরো খাওয়া উচিত না। মাসে এক আধবার ঠিক আছে কিন্তু প্রতিদিন না।“
“মাসে এক আধবার ও না।“
“এতোটাও কঠোর হও না মৌপ্রিয়া, আসলে এতোদিনের অভ্যাস তো।“
“ঠিক আছে, মাসে দুবার। ঠিক আছে বাবা?”

ইফতেকার সাহেব শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানান। মেয়ের রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণাই রয়েছে তার। তাই সে যে মাত্র দুবার খেতে পারছে এইতো অনেক। তাই রাজী হয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সীমান্ত খাওয়া শুরু করলে মৌপ্রিয়া বলে,
“আজ কোনো লেখা পড়তে হবে না আপনার। আবার গতবার লেখা বইটা নিয়ে যাবেন। কাল এসে আমাকে পয়েন্ট করে বলবেন কোথায় কোথায় ভুল ছিলো।“
“জ্বী”
“আমি ড্রাইভার কাকুকে বলে বলে দিবো আপনাকে পৌছে দিবেন। পাঞ্জাবী আর পায়জামাটাও কালকেই পাবেন।“
“জ্বী”
“জ্বী, জ্বী ছাড়া দেখি আজ কোনো কথা মুখ থেকে বের হচ্ছে না। কাল তো খুব কবিতা বের হচ্ছিলো”

মৌপ্রিয়ার কথা শুনেই বিষম খেলো সীমান্ত। গতরাতের মূহুর্তটা চখের সামনে ভাসছে। ইফতেকার সাহেব পানি এগিয়ে দিলেন। তারপর মৌপ্রিয়াকে নরম গলায় বললেন,
“থাক না কাল রাতের কথা, রাত শেষ রাতের কাহিনীও শেষ।“

মৌপ্রিয়া কোনো কথা বলে না, শুধু আড়চোখে সীমান্তকে দেখে যায়। তার ঠোঁটের কোনায় একটা দুষ্টু হাসি লেগেই রয়েছে। সীমান্তকে এভাবে দেখতে বেশ উপভোগ করছে সে। যাক আবালচন্দ্র মাস্টরমশাই কিছু পারুক না পারুক, মৌপ্রিয়ার হাসির কারণ তো হতে পেরেছে______________

দুপুর ১টা
হাসপাতালের বেশ জট লেগেছে। একজন রোগীর অভিভাবক রীতিমতো চেঁচামেচি করছে। গতকাল সন্ধ্যায় রোগীকে ভর্তি করিয়েছিলো সে। কিন্তু মিনিট বিশেক পূর্বে সে ইন্তেকাল করেছেন। লাশ নিয়ে যাবে নিজ বাসায়। লোকটি পুরুষ, তার মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে কান্না করছে। তার স্বামীকে বলা হয়েছে সব অফিসিয়াল কাগজের কাজগুলো মিটানোর জন্য। ঝামেলাটা বাধলো যখন বিল দেবার সময় এলো। সব মিলিয়ে ত্রিশ হাজার টাকা বিল এসেছে তাদের। কিন্তু সেই লোক এই টাকাটা দিতে নারাজ। তার কথা চব্বিশ ঘন্টা তো হয় নি, তাহলে সে কেনো কেবিনের টাকা সম্পূর্ণ দিবে। তিয়াশা তাকে বারংবার বুঝাতে চাইছে,
“স্যার এটা আমাদের হসপিটালের নিয়ম। আমাকে নিয়ম মানতে হয় স্যার। সকাল বারোটার পর একদিন কাউন্ট করা হয়। এখন একটআ বাজে। সুতরাং আপনাকে আই.সি.উ রুমের ভাড়াটা সম্পূর্ণ দিতে হবে। এটাই রুল।“
“আপনারা কি রাহাজানি শুরু করেছেন হ্যা? কি ভেবেছেন মানুষের গলা চেপে টাকা নিবেন কিছু বুঝবো না। আমার শ্বশুর এক দিন পুরোও হাঁসপাতালে থাকে নি। আমি কেনো চব্বিশ ঘন্টার টাকা দেবো?”
“স্যার, ভর্তির সময় বলা হয়েছিলো। বারোটার পর ডিসচার্জ করলে একদিনের টাকা যুক্ত হবে। প্লিজ স্যার ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।“
“চুপ, একদম চুপ। তোর উপরে কে আছে তাকে ডাক। আমি তোর সাথে কথা বলবো না।“
“স্যার বিলিং সেকশনে আমি ই আছি।“

এবার লোকটি যেনো নিজের সংযম হারিয়ে ফেললো। উগ্রতার মাত্রা ছাড়িয়ে তুই তুকারি করা শুরু করলো। লোকটির সাথে জড়ো হয় আরোও কিছু মানুষ। অপমান জনক কথার মাত্রা বাড়তে তিয়াশা বাধ্য হয় সিক্যুরিটি ডাকতে। তিয়াশার কলিগেরা এসে লোকটিকে বোঝানোর চেষ্টা করে। সিক্যুরিটি ডাকতে দেখে লোকটি যেনো আরোও চেতে যায়। তার শ্বশুর মারা গিয়েছে তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই, সে পড়ে রয়েছে বিলের পেছনে। হায় রে মানুষ! তিয়াশা তাকে শেষবারের মতো নবলে,
“স্যার, অথোরিটির বাহিরে কাজ আমি করতে পারবো না। আপনাকে টাকাটা দিতে হবে। নয়তো আমরা লাশ ছাড়তে পারবো না। নয়তো আমার চাকরি চলে যাবে।“
“ তবে রে”

বলেই লোকটা ডেস্কে থাকা পেপার ওয়েটটি হাতে নেয়। ছুড়ে মারে তিয়াশার দিকে। পেপারওয়েটটা ঠিক কপালে যেয়ে লাগে তিয়াশার। টপটপ করে রক্ত পড়তে থাকে। লোকটি আরো কিছু করতে গেলে সিক্যুরিটি তাকে আটকায়। হাসপাতালের এমন পরিস্থিতি দেখে মেইন এডমিনিস্ট্রেশন নেমে যায়। লোকের ভিড় জমে যায়। তিয়াশা মাটিতে বসে পড়ে। চিনচিনে ব্যাথা তাকে গ্রাস করছে, এ যেনো অসহনীয়। মাথাটা ঘুরছে। এই বুঝি জ্ঞান হারাবে সে। তখনই এক জোড়া হাত তাকে আগলে ধরে। রুমালটা মাথায় চেপে ধরে তার কপালে। তিয়াশা মাথা তুললেই দেখে……………
#গাংচিল
#৭ম_পর্ব

তিয়াশা মাটিতে বসে পড়ে। চিনচিনে ব্যাথা তাকে গ্রাস করছে, এ যেনো অসহনীয়। মাথাটা ঘুরছে। এই বুঝি জ্ঞান হারাবে সে। তখনই এক জোড়া হাত তাকে আগলে ধরে। রুমালটা মাথায় চেপে ধরে তার কপালে। তিয়াশা মাথা তুললেই দেখে তাকে অন্ত তাকে আগলে রেখেছে। অন্তুর উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি তাকে দেখে যাচ্ছে। তার হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পারছে তিয়াশা। বহুবছর পর এই চাহনী দেখেছে সে, বহুবছর পর এই স্পন্দন অনুভূত হচ্ছে। তিয়াশার মনে হলো তার আশেপাশে কেউ নেই। শুধু অন্তু এবং সেই রয়েছে এখানে। কোনো কোলাহল তার কানে আসছে না। সকল শব্দ যেনো থেমে গেছে। শ্রবণেন্দ্রীয় শূণ্য হয়ে গিয়েছে। তার চোখের সামনে শুধু একজন ব্যাক্তি, অন্তু। যাকে কোনোকালে ভালোবেসেছিলো সে। যার সাথে জীবনের হিসেবগুলো ভাগ করে নিতে চেয়েছিলো। তিয়াশা অনুভব করলো সে যেনো শূন্যে ভাসছে। অন্তুর ব্যাকুল কন্ঠ কানে এলো,
“আমি উনাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা এই লোককে বের করুন এখান থেকে”

বহুবছর পর এই ব্যাকুলতা অনুভব করতে পারছে তিয়াশা। তার মনে হলো এই ব্যকুলতা কেবল ই তার জন্য। কেবলই তার জন্য। আচ্ছা, অন্য কেউ হলেও কি অন্তু এমনটাই করতো? হয়তো, হয়তো না। প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া বা না পাওয়ার উপর কিছুই যায় আসে না। কারণ সময়টা বদলে গেছে। বদলে গেছে সম্পর্কটা। এখন তারা কেবলই দুজন অপরিচিত মানুষ, যাদের পৃথিবী ভিন্ন, চাহিদা ভিন্ন।

ইমার্জেন্সি রুমের বেডে বসে রয়েছে তিয়াশা। অন্তু নিজ হাতে তার ট্রিটমেন্ট করছে। পেপারওয়েটটার ভার বেশি হওয়ায় বেশ খানিকটা থেতলে এবং কেটে গিয়েছে। চারটা স্টিচ লেগেছে। বোন ফ্রাকচার হয় নি ভাগ্য ভালো ছিলো। অন্তু বেশ ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। কাঁটা স্থানে মেডিসিন দেবার সময় অসম্ভব জ্বলন অনুভুত হচ্ছিলো। এখন অনেকটাই কমে এসেছে। তিয়াশার সাহস অনেক তাই স্টিচের সময় সে একবারের জন্য উহ, আহ করে নি। এতোটা সময় অন্তু একটা কথাও বলে নি। তিয়াশা আড়চোখে শুধু অন্তুকেই দেখে গেছে। তার চোয়াল শক্ত, দৃষ্টি স্থির। সকল উচাটনের যেনো সমাধান হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একজন নার্স এসে বললেন,
“স্যার আমি করে দিচ্ছি, আপনি লান্স এ যেতে পারেন”

অন্তু তার স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বললো,
“আপনি চিন্তা করবেন না, আমি খেয়ে নিবো। রোগী ছেড়ে খেতে যাওয়াটা আমার স্বভাবে নেই। আপনি বরং লান্স করে আসুন।“

নার্স কথা বাড়ালো না। তিয়াশা নীরবতা ভাঙ্গলো, ধীর স্বরে বললো,
“আমি ঠিক আছি, সামান্য চোঁট লেগেছে। আপনি খেতে যেতে পারেন।“
“আমি কি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি? ডাক্তারিটা মুখ দেখে পাস করি নি। নিশ্চয়ই আমার জ্ঞান আপনার থেকে বেশি। অহেতুক কথা বলবেন না।“

শক্ত কন্ঠে কথাটা বললো অন্তু, তারপর আবার প্রেসক্রিপশন লেখা শুরু করলো সে। তিয়াশার খানিকটা মানে লাগলো কথাটা, হ্যা সে ভালো কোনো ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করে নি; হ্যা, সে ডাক্তার নয়। তাই বলে তাকে নিচু করে কথা বলার অধিকারটা অন্তু রাখে না। আর তার শরীর, ভালো লাগছে না খারাপ সেটা নিশ্চয়ই অন্তু তার থেকে ভালো জানবে না। তিয়াশার একটি ভালো গুন রয়েছে, তার রাগ হলে সে চুপ হয়ে যায়। তার ফর্সা নাকটা রাগে লাল হয়ে যায়, কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দ ও বের হয় না তার। অন্তু প্রেসক্রিপশন লিখে ধীর স্বরে বললো,
“স্টিচ সারতে সময় লাগবে, সাতদিন পর আমি স্টিচ কেঁটে দিবো। এই সময়ে পানি লাগানো যাবে না। আমি একটা নোট লিখে দিয়েছি, অফিসে গিয়ে দেখালে ছুটি হয়ে যাবে। সাত দিন রেস্ট নিলে তাড়াতাড়ি সেরে যাবেন। এখন আপনি বাসায় যাবেন। আমি খালিদের কাছে ঔষধগুলো দিয়ে দিচ্ছি। খালিদকে বললে ও একটা সিএনজি ভাড়া করে দিবে। “
“আমার তো ছুটি লাগবে না। দিন প্রেসক্রিপশনটা। আমি যাবার সময় ঔষধগুলো কিনে নিবো।“

বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা বললো তিয়াশা। অন্তু থেকে যে সে কোনো সাহায্য নিতে চায় না, এটুকু বুঝতে বাকি রইলো না অন্তুর। অন্তুর স্থির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো, তার ভ্রু যুগলো কুঁচকে আসলো। কড়া কন্ঠে বললো,
“আপনার এখন রেস্টের প্রয়োজন। এখন আপনি বাসায় যাবেন।“
“আপনার ডাক্তারি জ্ঞান থাকতে পারে, কিন্তু আমার শরীর সম্পর্কে আমার ও জ্ঞান আছে। পঁচিশটা বছর এটাকে আমি সামলে রেখেছি কি না!”
“অহেতুক কথা আমার পছন্দ নয় তিয়াশা। এখন বাড়ি যাচ্ছো তুমি”

দাঁতে দাঁত পিষে কথা বললো অন্তু। রাগে তার চোখ থেকে যেনো আগুন বের হচ্ছে। চোয়ালগুলো আরোও শক্ত হয়ে রয়েছে। কিন্তু তিয়াশাও পিছিয়ে যাবার মানুষ নয়। যার সাথে সকল সম্পর্কের পাঠ চুকিয়ে এসেছে সে। তার কিসের এতো অধিকার! তার উপর এখন অন্তুর কোনো অধিকার নেই। নিজ হাতে এই অধিকারের স্থানটা নষ্ট করে দিয়েছে তিয়াশা। অন্তুর রাগকে পাত্তা না দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো,
“সেটা না হয় আমাকেই বুঝতে দিন। অফিস কামাই করে বেতন কাটার বিলাসিতাটা আমি করতে পারবো না। দিন প্রেসক্রিপশনটা।“

প্রেসক্রিপশোন নেবার জন্য হাত বাড়ালে অন্তু বাধ্য হয় তাকে সেটা তিয়াশার হাতে দিতে। ইমার্জেন্সি রুমের মানুষের অভাব নেই। এখন একটা সিন ক্রিয়েট করার মানে হয় না। সত্যি ই তো তিয়াশার বিষয় সেই বুঝবে, তার মতো অযাচিত মানুষের টিপ্পনী সে কেনো শুনবে। অন্তুর রাগ আকাশ ছুলো। সে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো ইমার্জেন্সি রুম থেকে। নিজের কেবিনে এসেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। সব কিছু ভেঙ্গে ফেললে হয়তো শান্তি পেতো। তিয়াশা একবার আবার তাকে বুঝিয়ে দিলো তার স্থান। সে এখন তিয়াশার জীবনের কোনো স্থানে নেই ব্যাপারটা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিলো তাকে। ভালোবাসা নামক জ্বলন্ত আগুনে অজান্তেই ঝাঁপ দিয়েছিলো সে। আজ সেই আগুনে নিজেই জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। এতই কি সোজা সব অনুভূতিকে অস্বীকার করা। এতোই কি সোজা সেই সুন্দর স্বর্ণালী মূহুর্তগুলো ভুলে যাওয়া। যেখানে ছিলো শুধু অন্তু এবং তিয়াশা। যেখানে ছিলো শুধু ভালোবাসা। না না, শারিরীক কাছে আসাটা তাদের হয় নি। সম্পর্কটা খুব পবিত্র হলেও বয়সটা ছিলো কম। তিয়াশার দাবি ছিলো যখন পরিবারের সম্মতিতে বিয়েটা হবে সেদিন ই দৈহিক মিলনটা ঘটুক। অন্তু ও কোনো আপত্তি করে নি। ভালোবাসা তো মনের মিলন, তাতে দেহের মিলনে কি যায় আসে। এই কথাগুলো মনে পড়লে মনটা বিষিয়ে উঠে অন্তুর। সবই ফাঁকা আওয়াজ ছিলো। অহেতুক স্বপ্ন, অহেতুক বেদনা। যদি থাকার ই না হয় তবে কেনো এসেছিলো। কেনো নিজের আধিপত্য করেছিলো মনের রাজ্যে। মাথাটা ব্যাথা করছে। রাগ হচ্ছে। নিজের টেবিলে সজোরে আঘাত করলো সে। হাতের ব্যাথায় মনের ব্যাথাটা কিছুটা হলেও ভুলে থাকা, যদিও তা নিতান্ত ব্যার্থ চেষ্টা____________

৪.
মৌপ্রিয়া তার লেখাগুলোকে সিন সিন বাই সিন সাজাচ্ছে। বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালা দিয়ে ছিটকে আসছে বৃষ্টির পানি। টেবিলের সামনের টুকু খানিকটা ভিজে গিয়েছে। এই আবহাওয়াতে লিখতে ভালো লাগে মৌপ্রিয়ার। মনটা শান্ত থাকে তখন, শব্দ গুছোনা খানিকটা সহজ হয়ে যায়। তার উল্টোপাশে গভীর চিন্তায় চোখ বুঝে রয়েছে সীমান্ত। আসার পর থেকে লোকটা কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তা করছে। যেখানে তার মুখ আটকানো দায় হয়ে যায়, সেখানে সে আসার পর থেকে চুপ। মৌপ্রিয়া আড়চোখে তাকে দেখে নিলো খানিকটা। আজ নীল পাঞ্জাবী পড়ে এসেছে। পাঞ্জাবীটা খানিকটা কুচকে আছে। হয়তো কলেজের জন্য বের হবার সময় স্ত্রী করা হয় নি। সামনে দলামচা যা পেয়েছে তাই পড়ে ছুটেছে। লোকটাকে দুদিন আগে আগের বই টা পড়তে দিয়েছে মৌপ্রিয়া। তার কোনো রেসপন্স এখনো পায় নি। হয়তো পড়া শেষ হয় নি তার। মোউপ্রিয়াও কোনো প্রশ্ন করে নি। হঠাৎ সীমান্ত গভীর চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“নায়ক-নায়িকাকে সবসময় সুন্দর কেনো হতে হয় মৌপ্রিয়া। আমি, তুমির মতো সাধারণ মানুষ হলে ক্ষতি কি? ধরো গল্পের নায়ক আমি, নায়িকা তুমি। গল্পটা কি খুব বেমানান হবে?”

সীমান্তের প্রশ্নে …………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here