#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ১৯
#রাউফুন (ছদ্মনাম)
সারাফ ঘন্টা খানেক বাদে শৈবালের দরজায় কড়াঘাত করলো। একবার, দুবার, তিনবার বার বার শৈবাল কে ডাকার পরেও দরজা খুলছে না সে। সারাফ চিন্তিত হলো। এতোক্ষণে সাহিরা দরজার সামনে এলেন। উনার চিন্তা হচ্ছিলো ভীষণ। কিন্তু কোনো এক কারণে তিনি আসতে পারেন নি। এমনিতেই তিনি শৈবালের অতি অপ্রিয় একজন মানুষ। আজকের পর হইতো আরও বেশি অপ্রিয় হয়ে গেলেন তিনি। সারাফ, সাহিরা একে অপরের দিকে দেখে চিন্তিত হয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। সারাফ জানে এক মাত্র সে যদি ডাকে তাহলে শৈবাল অবশ্যই দরজা খুলবে। কিন্তু আজকে কেন খুলছে না। কোনো অঘটন ঘটে যায় নি তো এর মধ্যেই। সারাফ ভীষণ আতংকিত হয়ে আরও জোরে দরজা ধাক্কালো। কিন্তু না কোনো রেসপন্স নেই। সাহিরা, সারাফ দুজনেই চিৎকার শুরু করলেন। দুজন পরিচারিকা আসলো ছুটে। ড্রাইভার কাকাও চলে এসেছেন। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো দরজা ভাঙার। দরজা ভাঙতেই সারাফ আর সাহিরা দেখে সোফায় শৈবাল চিত হয়ে শুয়ে আছে। ওর মুখ থেকে ফেনা বেরোচ্ছে। চোখ দুটো বন্ধ আর ওর হাতের কাছেই পরে আছে ফাঁকা ঘুমের ওষুধের একটা পাতা।
সাহিরা আর্তনাদ করে উঠলেন। সারাফ অস্থিরচিত্তে ভাই কে পাজা কোলে তুলে নিলো দেরি না করে। কারোর বুঝতে আর বাকি নেই কি করেছে শৈবাল। সারাফ কে সাহায্য করলেন ড্রাইভার কাকা। শৈবালের শ্বাস চলছে খুব ধীরে ধীরে। সাহিরা হাহুতাশ করছেন কান্নায় বিজড়িত হয়ে। হাহাকার করছে তার হৃদয়। কেন এই বেদনা! কেন এই অসহায় অবস্থা। কি করবেন এখন তিনি?নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।
শৈবাল কে গাড়িতে তুলতেই ড্রাইভার কাকা গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। এখন সারাফের অত্যন্ত আফসোস হচ্ছে কেন সে শৈবাল কে একা ছাড়লো। ওর সঙ্গে যদি থাকতো তবে তো আর এসব কিছুই হতো না। সারাফ হতে দিতো না। নিকটবর্তী এখন যে হসপিটাল আছে প্রিতি যে হসপিটালে চাকরি করেন সেটাই। শৈবাল কে সেখানেই আনা হলো। ইতি মধ্যে শাহরিয়ার সাইফের কাছে ফোন করে সব কিছু বলেন সাহিরা। তিনি ছুটে আসছেন। বিগত কয়েকটি মাস থেকে তিনি কাজের জন্য দিক বেদিক হয়ে ছুটছেন। আজ এই মিটিং তো কাল এই মিটিং। বিজনেস আর বিজনেস। বাড়ির খবর নেওয়ার সময় তার নেই। তিনি যতটা সম্ভব তারাতাড়ি চলে আসবেন বলে জানালেন সাহিরা কে। যেখানে যা ছিলো সব কিছু ফেলে তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসছেন। শৈবাল কে ইমার্জেন্সি তে নেওয়া হলো। সারাফ মাথার চুল দু হাতে পেছনে ঠেলে দিয়ে দু হাত মুখে ঢেকে বসে পরলো। বড্ড বেশি চিন্তা হচ্ছে তার শৈবালের।জন্য। ভাই বাঁচবে তো? নানান রকমের বাজে চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সাহিরা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
সাহিরাকে হসপিটালের করিডরে দেখে প্রিতি এগিয়ে এলেন। যেহেতু উনি এই হসপিটালে এই চাকরি করেন সেহেতু উনার থাকতেই হয়। তিনি একটা রোগী কে দেখেই এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই সাহিরাকে দেখলেন। হঠাৎ কি হলো যে এখন হসপিটালে এসেছে ও। ঘন্টা দুয়েক আগেই তো সব কিছু ঠিক ছিলো। তিনি চিন্তিত হয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
‘সাহিরা কি হয়েছে? তুই হসপিটাল কি করিস?’
সাহিরা কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলো প্রিতি কে। ফুফাতে ফুফাতে বলে,
‘শৈবাল তোমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার পর সু’ই’সা’ই’ড করেছে আপা।’
কথাটি শুনেই তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। সাহিরা বাকি সব কিছু খুলে বললো।
‘চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।’
প্রিতি ভেবে পেলেন না আসলে কি বলে শান্ত করবেন সাহিরা এই সময়। প্রিতি ফোন করে কুহুকে শৈবালের সু’ই’সাই’ডের কথাটা জানালেন। কুহু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাইনি এতে। কিন্তু সে বললো আসবে এখানে। মুহুও আসবে সঙ্গে।
সারাফ নিশ্চুপ। কি থেকে কি হয়ে গেলো। একাবার ও ভাবলো না যার জন্য এরকম টা করছে সে আসলে তারই নয়।
‘যে তোর নয় তার জন্য কেমন করলি তুই? তুই মরে গেলেই কি তাকে তুই পেতিস? যাকে তুই কোনো দিনই পাবি না তার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করলি। আমার কথা একবারও ভাবলি না তুই? এতো বড় বোকামি কি করে করতে পারলি শৈবাল। মৃত্যু এতোটাই সহজ যে তাকে আপন করে নিতে চাইলি।’
আধ ঘন্টার মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন শাহরিয়ার সাইফ। সাহিরার দিকে ছুটে এসেই জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি করে হলো এসব। আমার ছেলের এই অবস্থা কি কারণে হয়েছে বলো? কি এমন হলো যে আমার ছেলে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো এরকম একটা ভুল কাজ করে বসলো?’
প্রিতি সরে এলেন কিছু টা সাইডে। কোনো না কোনো ভাবে নিজেদের দায়ী করছেন তিনি। শৈবাল এতো ম্যাচিয়রড একটা ছেলে হয়ে এরকম একটা স্টেপ নিলো কিভাবে? টিনএজার দের মতো এরকম পাগলামির মানে কি? মুহু আর কুহু ও চলে এসেছে এর মধ্যেই। সাহিরা সাইফকে দেখেই আরও কান্নায় ভেঙে পরেছেন তাকে জড়িয়ে ধরে। এখন সব টা বলার সময় না।তিনি নিরব রইলেন। সারাফ এগিয়ে এসে তিরিক্ষি গলায় বলে,
‘নিজের ছেলের খোঁজ নেওয়ার সময় কি আদোও কোনো দিন ছিলো আপনার মিষ্টার শাহরিয়ার সাইফ?’
সাইফ ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
‘মানে কি বলতে চাইছো তুমি?’
‘বাবা হয়ে কোন দায়িত্ব টা আপনি পালন করেছেন ? টাকা, বিজনেস, আপনার কাজ, এসবই তো আগে আপনার কাছে প্রায়োরিটি পেয়েছে তাই না? ‘
‘কোন জিনিসের অভাব রেখেছি আমি ওর। টাকা পয়সা, ওর যাবতীয় দায়িত্ব কোনো টাই কি আমি এড়িয়ে গেছি?’
‘শুধু টাকা পয়সা দিলেই নিজের দায়িত্ব শেষ হয় না। আপনি শেষ কবে আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেমন আছিস বাবা?’ কাছে ডেকে কবে বলেছেন, ‘আয় বাবা বোস এক সাথে খাবার খাই!’ খোঁজ রাখেন আপনি ওর। নাহ রাখেন না। আর আজ যখন ও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে তখন এসেছেন হম্বিতম্বি করতে!’
নিস্তব্ধতা উনাকে ঘিরে ধরলো ছাউনির মতো। চুপচাপ সহ্য করলেন তিনি সারাফের কটাক্ষের বানী। কারণ প্রতিটি বাক্য হরফে হরফে সত্যি। এটা সাইফের কাছে চূড়ান্ত গ্লানির। একমাত্র ছেলে শৈবাল তার। মা মারা যাওয়ার পর ছেলের জন্য আরেকটা বিয়ে করে মা নিয়ে এলেন। কিন্তু বড় বড় হওয়ার সাথে সাথে উচ্ছন্নে গেছে ছেলেটা। তাকে ভুল বুঝে গেছে শৈবাল তাকে। সব খবর তার কাছে আছে শৈবাল কি কি করে বেরাই। কিন্তু এই মুহূর্তে সারাফের কথায় থরথর করে কাঁপছেন সাইফ। তিনি হিরহিরে গলায় বলেন,
‘সাহিরা ওঁকে চুপ করতে বলো।’
সারাফ দমে গিয়ে হিসহিস করে গিয়ে সেখান কার বেঞ্চে বসলো। মুহু গিয়ে সারাফের পাশে বসলো। এটুকু সময়েই মানুষ টাকে কতটা বিদ্ধস্ত লাগছে। মানুষ টা ভাইয়ের জন্য খুব চিন্তা করছে। চিন্তা করার ই কথা। যতই হোক ভাই তো। সে শান্তনার স্বরে বলল,
‘চিন্তা করো না ফুলবাবু শৈবাল ঠিক হয়ে যাবে।’
সারাফ মাথা তুলে তাকালো। ওর চোখ গুলো আগুনের ফুলকির ন্যায় লাল হয়ে গেছে। মুহু চমকে উঠে এতে। একবার ভাবে এতো কিছুর পরেও কি তার আর তার ফুলবাবুর বিয়েটা হবে। সারাফ কিছু বলে না চুপ করে থাকে। এতেই যেনো মুহুর ভেতর টা ধক করে উঠলো। তার ফুলবাবু তার সঙ্গে কথা কেন বললো না? কিছুক্ষন বাদে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন।
‘পেশেন্টের বাড়ির লোক কে আছেন?’
সাহিরা সহ সবার টনক নড়লো। সবাই এগিয়ে এলেন। ডাক্তার বুঝতে পেরে বললেন,
‘বিপদ কেটে গেছে। উনি এখন সুস্থ। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই উনার জ্ঞান ফিরবে। আপনারা কোনো একজন গিয়ে দেখা করতে পারবেন!’
সবাই একটু আস্বস্ত হলো ডাক্তারের কথায়। ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন। প্রিতিও ডাক্তার কে অনুসরণ করে গেলেন। কিছু কথা বলা প্রয়োজন বলে উনি মনে করলেন। সাহিরা তখনও কান্না করছেন। যায় হোক উনার নিজের সন্তান না হলেও কম স্নেহ করেন না তিনি শৈবাল কে। ছোট থেকে বড় হয়েছে ছেলেটা তার চোখের সামনে। শৈবাল তাকে যতই ঘৃণা করুক না কেন তিনি তো শৈবাল কে সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। শৈবালের বাবার মনে সন্দেহ জন্মালো। তিনি কুহুকে এক ধ্যানে তাকিয়ে দেখছেন। একমাত্র এই মেয়েটির চোখে মুখে চিন্তার কোনো রেশ নেই। সবাই কিছু না কিছু বলছে কিন্তু এই মেয়েটা এক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এরকম নয় তো যে এই মেয়ের জন্যই তার ছেলের আজ এই অবস্থা।
কুহুর মধ্যে হেলদোল নেই বিন্দুমাত্র। একটা মানুষ সু’ইসা’ইড করার চেষ্টা করেছে জেনেও যদি না আসতো তাহলে নিজের কাছে নিজেকে বিবেকহীন বলে মনে হতো। এতোটা বিবেকহীন সে নয়। মনুষ্যত্ব আছে তার মধ্যে। একজন মানুষ হিসেবে একজনের এরকম অবস্থার কথা শুনে স্থির থাকতে পারেনি। তাই সে এখানে আজ উপস্থিত। যাক এখন ছেলেটা ভালো আছে শুনে ভালো লাগছে। কুহু আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ওটি রুমের দিকে। কাচের দরজার বাইরে থেকে দেখলো শৈবাল বেডে শুয়ে আছে। নিথর দেহ খানা শিথিলতায় মুড়িয়ে গেছে। অজ্ঞান অবস্থায় ওঁকে বেশ বিষন্ন লাগছে। সে ভাবলো ওঁকে বুঝাবে সব টা ভালো ভাবে। ঠান্ডা মাথায় বুঝাতে হবে। এরকম অবুঝের মতো করলেই তো আর হয় না। যত যায় করুক শৈবাল চাইলেও কুহু ওঁকে মন দিতে পারবে না। কুহু মনে মনে আওড়ালো,
‘মোটেও তোমার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী নয়। তোমার এই অবস্থার জন্য নিশ্চয়ই তুমিই দায়ী। কি বোকা ছেলে কেউ যদি ভালো না বাসে সেটা কি তার কাছ থেকে জোর করে আদায় করা যায়। আমি তো তোমায় ভালোবাসি না। তবে আমার কি উচিত তোমাকে বিয়ে করা? আমি তো তাকেই বিয়ে করবো যাকে আমি ভালোবাসি। তুমি যতই কষ্ট পাও না কেন তার জন্য তো আমি আমার ভালোবাসাকে ছাড়তে পারবো না। আমার ভেতর থেকে শুধুই অনুশোচনা আসছে তোমার জন্য। আর কিছুই না। আমার পক্ষে থেকে এর চেয়ে আর বেশি কিছুই তুমি পাবে না শৈবাল।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে এলো কুহু দরজার সামনে থেকে। হঠাৎই সেখানে শাম্মীকে দেখলো কুহু। এদিকেই এগিয়ে আসছেন তিনি। উনিও কি তবে এসব জেনেই এখানে এসেছেন? নিশ্চয়ই মা বলেছে। মা কোথায় গেলো? প্রশ্ন জাগলো কুহুর মনে।
শাম্মী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন সাহিরার দিকে।
এতো দিন পর তিনি সাহিরাকে দেখতে পাবেন ভাবতেও পারেন নি। তার চোখ অশ্রুতে টইটুম্বুর করছে। তিনি এসেই সোজা সাহিরার হাত ধরলেন। অনুনয় করে বলেন,
‘সাহিরা তুমি কোথায় ছিলে এতো গুলো বছর? আমার সন্তান কে তোমার কাছে দিয়েছিলাম। কোথায় সে? কি করেছো তুমি তার সাথে? আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার সন্তান কে আগলে রাখতে তবে কেন তুমি তাকে নিয়ে পালিয়ে গেছিলে?’
#চলবে