#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ২০
#রাউফুন (ছদ্মনাম)
‘সাহিরা তুমি কোথায় ছিলে এতো গুলো বছর? আমার সন্তান কে তোমার কাছে দিয়েছিলাম। কোথায় সে? কি করেছো তুমি তার সাথে? আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার সন্তান কে আগলে রাখতে তবে কেন তুমি তাকে নিয়ে পালিয়ে গেছিলে?’
এরকম অপ্রত্যাশিত সময়ে এমন বিস্ফোরণের মুখোমুখি হতে হবে কেউই ভাবেনি। সবার মাথায় যেনো আকাশ তুম্বি বজ্রপাত হয়েছে। সবাই স্থীর। নড়াচড়া করতে ভুলে গেছে সকলে। যেনো সবাই চক্ষুপেয় দৃশ্য দেখেছে বহুদিন পর। সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাম্মীর দিকে। কারোরই মস্তিষ্কে ধরা দিচ্ছে না এক্সাক্টলি কি হতে যাচ্ছে। মুহু এসে কুহুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিস্টার শাহরিয়ার সাইফ নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইলেন। সুযোগ বুঝে তিনি অন্য সাইড দিয়ে বেরিয়ে এলেন হসপিটাল থেকে। কারণ তিনিও যে অনেক কিছুই জানেন। অনেক কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী তো তিনিও। অন্যায় তারও কম কিছু না। এই ঘটনার ফাঁকে তার নাম টা না উঠে আসে।
সারাফ ভালো করে দেখতেই বুঝলো সেদিনের সেই এক্সিডেন্টকৃত মহিলাটি সাহিরা মাকে এসে এসব বলছেন। সেদিন কি তবে এই কারণেই সাহিরা মা নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পরছিলেন। এই মহিলার কাছে নিজেকে লুকায়িত রাখতে চাইছিলেন। তবে কি এই টাই তার কারণ ছিলো? কোনো বাচ্চাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন তিনি। কিন্তু কেন? এতো ভালো একজন মানুষের উপর এমন অপবাদ সরাসরি কেউ কেন দিবে! কি রহস্য রয়েছে এর মধ্যে? তার জানতে হবে সবটা। সাহিরা মায়ের নামে এমনি এমনি তো আর এতো বড় অপবাদ কেউ দিয়ে দিলেই হবে না। সে মেনে নেবে না। যত যায় হোক সে তার সাহিরা মাকে বিশ্বাস করে। তিনি কোনো ভুল করতেই পারেন না।
সাহিরা ভাবতেও পারেনি এমন একটা দিনে এভাবে শাম্মীর মুখোমুখি হতে হবে। এখন সে কি বলবে? কিভাবে বলবে কি জন্য সে শাম্মীর ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গেছিলো। আর সেদিন কি হয়েছিলো তার সঙ্গে এবং শাম্মীর সন্তানের সঙ্গে। সত্যি টা বললে কি শাম্মী বিশ্বাস করবে? নাকি ভুল বুঝবে তাকে? কিন্তু এখনি সব টা বলার সময় আসে নি। আজ পরিস্থিতি হইতো তাকে অন্য দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু এর সামাল তাকেই দিতে হবে। সাহিরা শক্ত হাতে শাম্মীর হাত টেনে ধরে গটগট করে অন্য সাইডে নিয়ে এলেন। তারপর চাপা স্বরে বলেন,
‘প্লিজ শাম্মী আপা এখন কিছুই জানতে চেও না। আমি তোমাকে সবটা বলবো। তোমার ছেলেকেও দেখাবো। আজকে এখানে আমার এক সন্তান মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। দয়া করো আজকে।’
শাম্মীর ছলছল করছে। চোখ থেকে বাঁধাহীন ভাবে জল পরছে তার। এতো দিন খুঁজেও তিনি সাহিরার হদিস পান নি। আজ যখন পেয়েছেন সত্যি টা জেনেই ছাড়বেন। তিনি ক্রন্দনরত কন্ঠে বলেন,
‘তার মানে আমার সন্তান বেঁচে আছে? কোথায় সে? তুমি এতো বড় একটা অন্যায় কি করে করলে সাহিরা? কি করে পারলে একজন মায়ের বুক এভাবে খালি করে দিতে। সন্তান হারানোর ব্যথা তুমি জানো? কতটা কষ্ট হয়? আঠাশ টা বছর এই যন্ত্রণা আমি বয়ে বেড়াচ্ছি! কেন করলে এমনটা বলো?’
শাম্মী শেষ কথা গুলো সাহিরার দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে কিছু টা চিৎকার করেই বললেন। নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলেন সাহিরা। তার মুখের ভাষা নেই। একজন অসহায় মাকে কি করে শান্ত্বনা দিতে হয় সেই ভাষা যে তার কাছে মজুদ হয়নি। কি বলা উচিত, বা কি বললে শাম্মীর মনের এই হৃদয় বিদারক কষ্ট তিনি দূর করতে পারবেন! সাহিরা কোনো রকমে শাম্মীকে আশ্বাস দিয়ে বলেন,
‘আপা আমাকে শুধু একটা দিন সময় দাও। আমি তোমার সামনে তোমার ছেলেকে দাঁড় করাবো। কথা দিচ্ছি। শুধু আজকে এখানে কোনো প্রশ্ন করো না দয়া করে। অনুরোধ করছি আমি!’
‘আমি তোমাকে তীল পরিমাণ বিশ্বাস করি না সাহিরা। কোনো ভাবেই আজ তুমি ছাড়া পাবে না। আজকেই আমাকে আমার ছেলেকে দেখাতে হবে! এতো দিন তুমি তবে ইচ্ছে করেই আমার থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছো তাই না? পাছে আমি তোমাকে পুলিশের হাতে না দিয়ে দিই! এই ভয়ে তাই না বলো? তুমি শুধু আমার ছেলেটা কে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও অনুরোধ করছি। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে পুলিশের হাতে দেবো না!’
‘জ্বেল তো আমি খেটেইছি আপা। সেটাও বিনা দোষে! এখন আর ভয় পাই না পুলিশকে!’
‘কি কথা হচ্ছে এখানে?’
একটা শক্ত গম্ভীর কন্ঠ কানে আসতেই দুজনেই তাকালো সেদিকে। সারাফ দাঁড়িয়ে আছে দেখে সাহিরা আঁতকে উঠলেন। তবে কি সবটাই তার হাত থেকে বেরিয়ে গেলো? যখন সব টা এলোমেলো হয়েই গেছে তখন আর লুকিয়ে লাভ নেই তিনি বুঝতে পারছেন। সবটা বলেই দিতে হবে আজ। উপায় নেই কোনো। কিন্তু সারাফের যদি কিছু হয়? ওঁর জন্যই এতোটা দিন সব টা আড়াল করা।
এর মধ্যেই প্রিতিও ডাক্তার এর সঙ্গে কথা বলে ফিরে এসেছেন। কি হয়েছে কুহুর থেকে শুনেই ছুটে এলেন তিনি। সবাই সারাফের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। কুহু, মুহুও অধীর আগ্রহ নিয়ে তাদের দুজনকে দেখছে। হঠাৎ ওই কথার পর সাহিরার শাম্মীকে টেনে আনার বিষয় টা সবার কাছে আরও ঘোলাটে লাগলো। প্রথমত সাহিরাকে সরাসরি যখন বলা হলো তার সন্তান কে আগলে রাখার নাম করে পালিয়েছেন তিনি। দ্বিতীয়ত সাহিরা ঘাবড়ে গিয়ে ওই মহিলাকে অন্য সাইডে টেনে আনা। এতেই সারাফের সন্দেহ বাড়ে। সে এগিয়ে আসতেই শাম্মী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে। এই তো সেই ছেলে যার গাড়ির সাথে তার এক্সিডেন্ট হতে গিয়েও বেঁচে গেছেন। ও এখানে কেন? সাহিরা চোখের পানি মুছে সারাফ কে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এরপর ভাঙা গলায় বলেন,
‘এই যে তোমার ছেলে আপা! তাকে আমি আগলে রেখেছি! এই নাও তোমার ছেলেকে তোমায় দিলাম।’
আরও বড়সড় ঝটকা লাগলো সবার। মুহু কুহু দুজন দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। কি হচ্ছে বুঝার চেষ্টা চালাচ্ছে দুজনেই। এ কোন গোলক ধাঁধাঁর মধ্যে পরলো তারা। প্রিতি এগিয়ে এসে বলেন,
‘এসব তুই কি বলছিস সাহিরা? তুই তো বলেছিলি সারাফকে কোনো এক অনাথ আশ্রম থেকে তোরা এডপ্ট করেছিলি? তাহলে এসব কি প্রলাপ বকছিস? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? সারাফ শাম্মীর আপার ছেলে ?’
সাহিরা অকপটে বলে উঠলেন,
‘ঠিকই বলছি প্রিতি আপা! সারাফ ই শাম্মি আপার ছেলে!’
সারাফের চোখে অশ্রুরা এসে ভীর জমালো। এতোদিন পর সাহিরা মা এসব কি বলছেন? এই মহিলা টি তার মা? কিন্তু এতোগুলা বছর তিনি এসব কেন বলেন নি? কেন লুকিয়েছেন সবটা? শাম্মী কথা টা শুনতেই সারাফকে জাপটে ধরলেন দুই হাতে। একাধারে গালে, কপালে, মায়ের আদর লেপ্টে দিতে লাগলেন৷ সন্তান কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলেন তিনি। সারাফের চিবুক ছুয়ে দিলেন তিনি,
‘আমার বাচ্চাটা! আমার বাবা! আমার কলিজা! আমি তো সেদিনই তোকে চিনতে পেরেছিলাম বাবা। কিন্তু কোথাও গিয়ে সব টা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো। তোর বাম ভ্রু তে এই জন্ম দাগ টা দেখেই আমি তোকে চিনতে পেরেছিলাম। সেদিনের পর থেকে আমি তোকে এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি। একবার আম্মু বলে ডাক বাবা একবার ডাক!’
সারাফের দুই গাল বেয়ে চোখের পানি পরছে। তার কিছু তেই বিশ্বাস হচ্ছে না সাহিরা মা তার থেকে এতো বড় একটা সত্য আড়াল করতে পারে। কোনো রকমে শাম্মীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো সে। সে যেনো এতে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিলো। সাহিরার দিকে এগিয়ে এসে শাম্মীকে উদ্দেশ্য করে শুধালো,
‘এসব কি মা? উনিই কি আমার মা? আমার জন্মদাত্রী জননী তিনি? আমি আবারও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইছি! বলুন না মা?’
সাহিরা চোখ বন্ধ করে নিলেন। তিনি চান নি এসব কিছুই লুকাতে। তিনি নিঃসন্তান। তার উপর সারাফের বড় একটা সত্য আছে যেটা উনি ছাড়া কেউই জানেন না। ডাক্তার বলেছেন ওঁকে যেনো বড় কোনো শকট না দেওয়া হয়। তাছাড়া যখন সারাফ তাকে মা বলে ডাকতো তখন তিনি সন্তানের অভাব ভুলে যেতেন। সারাফ বড় হওয়ার পর ওঁকে সবটা জানাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি স্বার্থপর হয়ে গেছিলেন। সারাফের মুখ থেকে মা ডাক টা তিনি হারাতে চান নি। এতোটাই গভীর ভাবে এই ডাক টা তিনি শুনতেন যে ভুলেই গেছিলেন সারাফ অন্য একজনের সন্তান। অন্য একজন মায়ের কষ্ট তার কাছে অনুভব হয়নি। ভুলেই গেছিলেন তিনি সব টা। কিন্তু আজ আর লুকিয়ে লাভ নেই। সাহিরা নিঃসংকোচে স্বীকারোক্তি দিলেন,
‘হ্যাঁ শাম্মী আপায় তোমার জন্মদাত্রী মা!’
সারাফ দু কদম পিছিয়ে এলো সাহিরার থেকে,
‘আমি তো আপনাকে কখনোই কষ্ট দিইনি! তবে কেন এতো বড় একটা সত্য আড়াল করলেন আপনি? কেন এই মিথ্যা? শুধুমাত্র একজন সন্তান কে নয় একজন মায়ের থেকে তার সন্তান কে কেড়ে নিলেন আপনি? কিভাবে পারলেন আপনি এটা? আমার আইকন ভাবতাম আমি আপনাকে। বেস্ট একজন মা ভাবতাম আমি আপনাকে। তার এই মর্যাদা দিলেন আপনি?
সাহিরা সারাফের দিকে এগিয়ে আসতে নিলে সারাফ হাত উঠিয়ে বাঁধা দেই। ওর কাছে আসতে বারন করে সাহিরাকে। মুখে আঁচল চেপে কান্না আটকালেন তিনি। মুহুর সহ্য হচ্ছে না সারাফের এই কষ্ট। সারাফ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সে পরে যেতে নিলে মুহু এসে আগলালো। একটা ব্রেঞ্চে বসিয়ে দিলো সে সারাফকে। কুহু গিয়ে শাম্মীকে ধরলো। শাম্মী আসলেন সারাফের কাছে। মুহু সারাফ কে দুই হাতে আগলে বলে ,
‘নিজেকে সামলাও তুমি ফুলবাবু! এভাবে ভেঙে পরলে চলবে না। আমাদের জীবনে এরকম অনেক ঘটনা ঘটে যা সম্পুর্ন আমাদের হাতে থাকে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিলো। নইলে আমার খালা মনি এতো বড় একটা অন্যায় করতেই পারেন না।’
সারাফ নিঃশব্দে কাঁদছে। কোনো কথায় ওর কান অব্দি যাচ্ছে না। হঠাৎই করেই মাথা চেপে ধরলো সে। মাথায় হাত রেখে হাসফাস করতে লাগলো। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই সারাফ জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরলো মুহুর কোলে। মুহু চিৎকার করে ডেকে উঠলো,
‘ফুলবাবু! তোমার কি হলো। হয়েছে তোমার?কথা বলো প্লিজ! আমার সাথে কথা বলো না? কেন চুপ করে আছো?’
মুহু সমান তালে সারাফ কে ঝাকাচ্ছে আর অশ্রুবর্ষণ হচ্ছে তার চোখ থেকে। শাম্মী দৌড়ে এলেন সারাফের কাছে। সাহিরা, প্রিতি, কুহুও ছুটে এলো। সাহিরা ঠিক এই ভয় টাই পাচ্ছিলেন। এই কারণেই তিনি কিছুই বলতে চান নি। সব টা তার জন্যই হলো। তিনি আরও ভেঙে পরলেন এই মুহুর্তে। ধপ করে বসলেন হসপিটালের করিডরের টাইলসের মেঝেতে।
মুহু কাঁদতে কাঁদতে গালে চাপড় দিচ্ছিলো সারাফের। মুহুর হাত সারাফের নাকে যেতেই তার হাতে তরল পদার্থ লাগলো। হাতে লাল কিছু চোখে পরতেই আরেকদফা চমকে গেলো সে। সারাফের নাক থেকে রক্ত পরছে! আঁতকে উঠলো মুহুর্তের মধ্যে। চোখ ঘোলাটে হয়ে এলো ওর। বক্ষস্থলে যেনো খেজুর গাছের কাটা দিয়ে কেউ খচখচ করে আঘাত হানছে। হৃদয়ের স্পন্দন যেনো থেমে গেছে। ক্রমাগত ভারী হয়ে আসছে তার হৃদয়। কি হলো তার ফুলবাবুর?
#চলবে